এম. জসিম উদ্দিন: অস্বাভাবিকভাবে বিত্ত-বৈভবের মালিক হলেও এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে এক সময়ের ভিখারী কানা মান্নান। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার জুঁইদন্ডির কানা মান্নানকে ঘিরে আনোয়ারা জুড়ে চলছে নানান আলোচনা-সমালোচনা।
সকলের প্রশ্ন, এত অল্পসময়ে কানা মান্নান অটেল সম্পদের মালিক হলো কখন ! জুঁইদন্ডির কানা আলম খানের সহযোগী হয়ে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে একসময় পুলিশসহ বিত্তশালীদের দুয়ারে দুয়ারে প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়াতেন খুরুসকুলের কানা মান্নান। কানা আলম খান জন্ম থেকেই দুইচোখ অন্ধ। কানা মান্নানের একচোখ অন্ধ ।
এ ব্যাপারে কানা আলম খানের সাথে সরাসরি কথা হলে তিনি বলেন, সেই ১৯৮৮ সাল থেকে দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে কানা মান্নান আমাকে সঙ্গ দিতেন। আমিও মনেপ্রাণে তাঁকে বিশ্বাস করতাম। কে কত টাকা ভিক্ষা দিতেন আমি জানতাম না। যেহেতু আমার দু’চোখ অন্ধ। আমার সরলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মান্নান প্রতিদিন আমার প্রচুর অর্থ আত্মসাৎ করতেন।
কানা আলম বলেন, এখন লোকমুখে শুনতে পাচ্ছি কানা মান্নান বর্তমানে বিশাল ধন সম্পত্তির মালিক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কানা মান্নানের মালিকানাধীন মাছ ধরার ট্রলারে চাকুরী করতেন সরেঙ্গা গ্রামের মৃত আব্দুল বারির কনিষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ লোকমান ওরফে লোকমান মাঝি। লোকমানের বড়ভাই আবু আলম ও লেদু মিয়ার অভিযোগ, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে কানা মান্নানের নির্দেশে আমাদের ছোটো ভাই লোকমানকে গভীর সমুদ্রে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে ট্রলারে কর্মরত অন্যান্য মাঝিমাল্লারা। লাশ পর্যন্ত ফেরত দেয়নি ট্রলারে কর্মরত মাঝিমাল্লারা।
আবু ও লেদু বলেন, লাশ ফেরত না এনে কানা মান্নানের নির্দেশে আমাদের ভাই লোকমানকে পরিকল্পিতভাবে গভীর সমুদ্রে ফেলা দেয়া হয়। বিলম্ব হলেও ভাই হত্যার বিচার চান লেদু ও আবু।
এ প্রসঙ্গে লোকমান মাঝির স্ত্রী কাউছার বেগমের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ঘটনাটি ঘটেছে ৮ বছর আগে। আমার স্বামী লোকমান হত্যার বিচার চেয়ে অনেকের সহযোগিতা চেয়েছিলাম, অনেকের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। কারো সহযোগিতা পায়নি। প্রতিপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় আমাদের ডাকে কেউ সারা দেয়নি। ফলে বিচারের আশা ছেড়ে দিয়ে স্বামীর ঘরসংসার চিরতরে ত্যাগ করে আমি বাপের বাড়িতে চলে আসি। প্রবাদ আছে ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, কানা মান্নান একসময় পুলিশের সোর্স ছিলেন। চট্টগ্রামসহ সারাদেশের অনেক ধনাট্য ব্যক্তিদের সাথে রয়েছে তার দহরমমহরম সম্পর্ক। অত্যন্ত সুচতুর মান্নান স্থানীয়দের কাছে দানবীর হিসেবে পরিচিতি হলেও আবার অনেকের কাছে তিনি ইয়াবা সম্রাট হিসেবেও পরিচিত।
ওরা যেভাবে শূন্য থেকে কোটিপতি : বঙ্গোপসাগরের উপকুল সংলগ্ন আনোয়ারার রায়পুর, গহিরা জুঁইদন্ডি কেন্দ্রীক ইয়াবা ব্যবসায়ী ও পাচারকারীদের মধ্যে বর্তমানে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। সমুদ্র উপকুলীয় এলাকায় ইয়াবা খালাসের খবর পেয়ে মাঝেমধ্যে প্রশাসন শুরু করে বিশেষ অভিযান। এছাড়া মরণঘাতী এসব ইয়াবা কারবারে জড়িত রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, জেলে ও একাধিক ফিশিং ট্রলারের মালিক।
গোয়েন্দা সূত্রে ও স্থানীয় প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের তথ্যমতে, নানা সময়ে সাগর উপকূল সংলগ্ন এলাকায় নৌ-পথে আসা মরণঘাতী টেবলেট ইয়াবা খালাস হচ্ছে রায়পুরের গলাকাটা ঘাট, পড়ুয়া পাড়া, বাঁচা মিয়া মাঝির ঘাট, চিপাতলী ঘাট, জুঁইদন্ডির শঙ্খের ভড়ার চর, সাপমারা খালের মুখ, পারকি সমুদ্র সৈকত, ঘাসফুল, গহিরাসহ আনোয়ারার বিভিন্ন পয়েন্টে । দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনকে জড়ো করে যেমন মানব পাচার হয় তেমনি মাছ ধরার ট্রলারে করেই পাশ্ববর্তী দেশ মায়ানমার থেকে দেশে বিশাল বিশাল ইয়াবা চালান আনা হচ্ছে।
জুঁইদন্ডি, রায়পুর ও গহিরায় মানবপাচার কমলেও প্রতিনিয়ত বাড়ছে ইয়াবা কারবারির সংখ্যা। আর এসব অনৈতিক কর্মকান্ডের নেতৃত্বে রয়েছে জুঁইদন্ডি ইউনিয়নের কানা মান্নান ওরফে ভিক্ষুক মান্নান এবং রায়পুরের জনৈক জনপ্রতিনিধি। কানা মান্নানের আপন সহোদর জালাল আহমদ বিগত কয়েকবছর আগে ইয়াবা মামলায় দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। জেল থেকে মুক্ত হলেও এই পেশার হাল ছাড়েননি মান্নানের ভাই জালাল।
পুলিশ র্যাব ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় ধৃত চার ইয়াবা কারবারির বাড়ি আনোয়ারায়। তারমধ্যে আটক দলনেতা আবুল হোসেনের বাড়ি জুঁইদন্ডি গ্রামে। ধৃত আবুল হোসেন হলেন, ইয়াবা কারবারি কানা মান্নানের তালই সম্পর্ক। অর্থাৎ মান্নানের ছোটো ভাই হামিদের শশুর হলেন, টেকনাফ থানায় ধৃত ইয়াবা কারবারি আবুল হোসেন।
গত সপ্তাহে জুঁইদন্ডি ও গহিরায় সরেজমিনে গিয়ে কথা বলে জানা গেছে, কানা মান্নানের দলে রয়েছে ইয়াবা কারবারির বিশাল গ্রুপ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গহিরার জলিল আহমদ, দক্ষিণ পড়ুয়া পাড়া গ্রামের হাসান মাঝি, চুন্নাপাড়ার শফি, গহিরার ছালে আহমেদের ছেলে আব্দুল মান্নান, আলাউদ্দিন, ছাবের আহমদ , জুঁইদন্ডির জসিম, ইছহাক, জালাল আহমদ, হামিদুল্লাহ, দোভাষী বাজারের জসিম, আনু মিয়া, রায়পুরের আবদুল জলিল, খোর্দ্দ গহিরা গ্রামের কানা মনুসহ ৩০/৩৫ সদস্যের একটি বিশাল সিন্ডিকেট।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, ইয়াবা কারবার করে রাতারাতি অর্থসম্পদ, বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে গেছে জুঁইদন্ডি, রায়পুর ও গহিরার অনেকেই। এরপর টাকার জোরে ক্ষমতা, প্রভাব, প্রশাসনিক দাপট, রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে এলাকায় সম্রাজ্যও গড়ে তুলেছেন তারা। তারমধ্যে জুঁইদন্ডির কানা মান্নান ও রায়পুর ইউনিয়নের এক জনপ্রতিনিধির রয়েছে বিশাল সম্রাজ্য। স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে সবসময় তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় কানা মান্নানরা। বিশাল ধনকুবের মালিক সমুদ্র উপকূলীয় এক ইয়াবা কারবারি জনপ্রতিনিধির চেয়ারে বসে বীরদর্পে রাজত্ব করছে। তার দাপটে স্থানীয়রা অনেকটা অসহায়। ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে স্বল্প সময়ে কোটিপতি হয়ে উঠার অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্ম্যে চলে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
পুলিশ- র্যাব এর হাতে গ্রেফতার হওয়া ইয়াবা কারবারিদের নাম-ঠিকানা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে গাড়ি চালক-হেলপার, দিনমজুর বেকার-বখাটেসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ইয়াবা কারবারের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত।
গোয়েন্দা পুলিশের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তারা বলছেন, রাতারাতি বিত্তশালী হওয়ার নেশায় ইয়াবা কারবারের ব্যপ্তি বাড়ছে। গোয়েন্দা পুলিশের তালিকা অনুসরণ করে কয়েকদিন আগে এই প্রতিবেদক রায়পুর, গহিরা ও জুঁইদন্ডি এলাকায় গিয়ে সরেজমিনে অনুসন্ধাানে জানতে পারে সমুদ্রতটে গড়ে উঠা চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা। ওইসব এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে যারা মৎস্য শিকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসা-বানিজ্য করে সাদামাটা জীবন কাটায় তাদের অনেকেই এখন ইয়াবা সম্রাট। জুঁইদন্ডির কানা মান্নানসহ রায়পুর, জুঁইদন্ডি, গহিরার অর্ধশত ট্রলারের মালিক মাছ ব্যবসার আড়ালে জড়িয়ে পড়েছেন ইয়াবা কারবারে। অল্পসময়ে বিত্তশালী হতে গিয়ে তাদের নাম এখন জায়গা পেয়েছে পুলিশের মাদক কারবারির তালিকায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ইদানিং সাগর উপকূল হয়ে ইয়াবা চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। ইয়াবার ক্ষেত্রে লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে পুলিশের পক্ষে নৌ-পথে অভিযান চালানো কষ্টকর। আর এর সুযোগে বাড়ছে ইয়াবা আমদানি। ইয়াবা ব্যবসা করে দিনেদিনে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া ঐসব মানুষগুলো আনোয়ারার প্রত্যন্ত অঞ্চল মেঠোপথ ঘেঁষেই করছেন সুরম্য অট্টালিকা। এ প্রসঙ্গে মান্নানের মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট বলে উত্তেজিত হয়ে ফোন কেটে দেন।




