দি ক্রাইম ডেস্ক: চমেক হাসপাতালে মেঝেতেই চিকিৎসা নিচ্ছে প্রায় ১৩০০ রোগী। ওয়ার্ডে সিটের ফাঁকে ফাঁকে মেঝেতে ও বারান্দায় শুয়ে আছে রোগী। সিট-সংকট, পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকা ও রোগীর বাড়তি চাপে চিকিৎসাসেবায় ভোগান্তিতে রোগীরা। একটি সিট পাওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। সরকারি ওষুধ চুরি, রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিকাল ৩টার পর থেকে পরের দিন সকাল ৮টা পর্যন্ত কোনো সিনিয়র, জুনিয়র চিকিৎসক থাকে না। এই সময়ে ইন্টার্ন চিকিৎসকই একমাত্র ভরসা। অথচ হাসপাতালে অনুমোদিত চিকিৎসকের পদ কম থাকলেও সংযুক্তিতে অনেক চিকিৎসক নিয়োজিত রয়েছেন। রোগ নির্ণয়ের ৯৫১টি চিকিৎসা সরঞ্জামের মধ্যে অনেক অচল।
প্রাইভেট হাসপাতালের দালালদের উৎপাত, রোগী ও হাসপাতালের বিভিন্ন জিনিস চুরি, বিশেষ আয়া নামে লোকদের কাছে রোগী হয়রানি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল পরিচালনায় কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় চিকিৎসা নিয়ে কর্মরত চিকিৎসকদের ফাঁকি ও অনিয়ম বন্ধ হচ্ছে না।
এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঁচটি জেলার জনসংখ্যার একমাত্র উন্নত চিকিৎসালয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ২২০০ শয্যার অনুমোদিত এই হাসপাতালে দৈনিক ৩৫০০ রোগী চিকিৎসাধীন থাকে। চমেক হাসপাতাল অত্র অঞ্চলের গরিব রোগীদের উন্নত চিকিৎসার শেষ ভরসা। অন্যান্য হাসপাতালে ব্যর্থ হয়ে গরিব ও জটিল রোগীরা ছুটে আসছে চমেক হাসপাতালে। এছাড়া দুর্ঘটনায় শিকার রোগীদেরও প্রথমে নিয়ে আসা হচ্ছে চমেক হাসপাতালে। কিন্তু রোগীর অতিরিক্ত চাপ, জনবল সংকট, স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মচারীদের খবরদারি ও হয়রানিতে চিকিৎসা নিয়ে রোগীদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।
সূত্র মতে ৫০০ শয্যা থেকে এক দফায় ১৩১৩ শয্যায় উন্নীত করা হয়। পরবর্তীকালে বছর দুয়েক আগে ২২০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু জনবল এখনো ৫০০ শয্যার রয়ে গেছে। অন্য হাসপাতাল থেকে সংযুক্তিতে রয়েছে কয়েকশ চিকিৎসক। এতে শয্যা বাড়লেও খাদ্য ও ওষুধের বরাদ্দই বেড়েছে। কিন্তু চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য জনবল বাড়েনি।
বিগত সময়ে একটি কার্ডিয়াক বিল্ডিং, অ্যানেক্স ভবন ছাড়া আর কোনো নতুন স্থাপনা নির্মিত হয়নি। ফলে সরকারিভাবে শয্যা বাড়ানো হলেও নতুন অবকাঠামো নির্মাণ না হওয়ায় রোগীর চাপ সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। শয্যা বাড়ানোর সঙ্গে চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারী, বেড, ওষুধ ও রোগ নির্ণয়ের চিকিৎসা উপকরণ, খাদ্যসহ অনেক কিছু জড়িত রয়েছে। এখন সরকার শয্যার অনুমোদন দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে।
হাসপাতালে ৪ হাজার ৬৬৮টি সিলিং ফ্যান রয়েছে। অধিকাংশ ফ্যান অনেক পুরোনো। এসব ফ্যানের গতি এত স্লো রোগীর শরীরে লাগে না। ১৬টি লিফটের মধ্যে বেশির ভাগই অনেক পুরোনো। প্রায় সময় কোনো না কোনো লিফট যান্ত্রিক ত্রুটিতে অচল হয়ে পড়ে। ৮ হাজার লাইটের মধ্যে অনেক স্থানে লাইট নষ্ট। গণপূর্ত বিভাগ জানায়, নতুন করে তিনটি লিফট, ৩৫০টি সিলিং ফ্যানের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রায় ৯৫১টি চিকিৎসা সরঞ্জাম রয়েছে। এসব হালকা ও ভারী চিকিৎসা উপকরণ রোগী নির্ণয়, সার্জারিসহ অন্য চিকিৎসার জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। কিন্তু এসব চিকিৎসা উপকরণের সুবিধা রোগীদের জন্য নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অনেক যন্ত্রপাতি অচল অবস্থায় রয়েছে।
সার্জারি বিভাগে রোগীর চাপ : সার্জারির তিনটি ওয়ার্ড রয়েছে। এসব ওয়ার্ডে প্রায় চার শতাধিক রোগী ভর্তি রয়েছে। সার্জারি টেবিলের সংকট রয়েছে। রোগীর চাপ অনুপাতে ওটি টেবিলের স্বল্পতা রয়েছে। ওটিগুলোতে সার্জারি ওয়ার্ডের রোগী ছাড়াও গাইনি, অর্থোপেডিকস, মেডিসিন, নিউরো সার্জারিসহ অন্য ওয়ার্ডের রোগীদের অপারেশন করতে হয়। এতে সার্জারির প্রতিটি ওয়ার্ড প্রতিদিন শিডিউল পায় না। এতে সিরিয়ালের জন্য সার্জারি রোগীদের এক মাসের অধিক সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
জনবল সংকট : হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল ২ হাজার ২০০ শয্যায় উন্নীতকরণে প্রশাসনিক অনুমোদনের পর অবকাঠামো ও জনবলের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এই জন্য দুটি ২০ তলাবিশিষ্ট ভবন ও ২ হাজার ৬৪০ জন জনবলের প্রস্তাব করা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, জনবল সংকটে রোগীদের ন্যূনতম সেবাও দেওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যমান অবস্থায় আউটসোর্সিংয়ে ৫৭৪ জন জনবলের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। তার মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে ২৫০ জন জনবল নিয়োগ দেওয়া না হলে চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়বে। বর্তমানে অবকাঠামো অনুপাতে সর্বোচ্চ ৮০০ জন রোগী রেখে সেবা দেওয়া যাবে। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শূন্য পদে জনবল নিয়োগ দীর্ঘ দিন ধরে হচ্ছে না। যারা অবসরে যাচ্ছে সেই পদ পূরণ হচ্ছে না। বর্তমানে অনুমোদিত স্থায়ী ২৫৫ জন কর্মচারীর স্থলে কর্মরত আছেন ১১১ জন। ১৯৩ জন আউটসোর্সিংয়ে জনবল দিয়ে সেবা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। হাসপাতালের বিশাল এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য স্থায়ী পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছে ৮৮ জন। আউটসোর্সিংয়ে আরও ৬৩ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োজিত করা হয়েছে। পরিচ্ছন্নতা কর্মী পর্যাপ্ত না থাকায় হাসপাতালের টয়লেটগুলো পরিচ্ছন্ন রাখা যাচ্ছে না। অনেক টয়লেট ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
‘বিশেষ আয়া’দের রোগী হয়রানি : সরেজমিনে দেখা গেছে, জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে রোগী আনা-নেওয়ার হুইল চেয়ার ও টলি সংকট। জনবল সংকটে প্রায় দুই শতাধিক বিনা বেতনে ‘বিশেষ আয়া’ রয়েছে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ রোগী আনা-নেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন বিনা বেতনের এসব লোক। হুইলচেয়ার ও টলি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এতে রোগী পরিবহন নিয়ে এসব আয়া রোগীর কাছ থেকে চাহিদা অনুপাতে টাকা আদায় করে থাকে। টাকা কম দিতে চাইলে খারাপ ব্যবহার, চেয়ার কেড়ে নেওয়া ইত্যাদি ঘটনা নিত্যদিনের। প্রতিদিন বহিরাগত এসব আয়ার বিরুদ্ধে রোগীদের অভিযোগ কর্তৃপক্ষের নজরে এলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে হাসপাতালের যারা স্থায়ী কর্মচারী আছেন তারা দায়িত্ব নেয় আর্থিক সুবিধা থাকা স্থানে। জরুরি বিভাগ, ওয়ার্ডে তদারকি, সিট বরাদ্দ এসব জায়গায়।
‘ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার’ : হাসপাতালের ওয়ার্ডে কম গুরুত্বপূর্ণ রোগীর চাপ কমাতে প্রায় চার বছর আগে জরুরি বিভাগকে আধুনিকায়ন করে ‘ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার’ ইউনিটে রূপান্তর করা হয়েছে। জরুরি বিভাগকে সম্প্রসারণ করে ১০০ শয্যা সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু চার বছরেও চিকিত্সকসহ জনবলের অনুমোদন মেলেনি। একই ছাদের নিচে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রদানের জন্য প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে জরুরি বিভাগকে আধুনিকায়ন করা হয়। বসানো হয়েছে রোগ নির্ণয়ের চিকিৎসা সরঞ্জাম। অনেক আগেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কনসালট্যান্ট, নার্সসহ ১০৮ জন জনবলের তালিকা তৈরি করে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত জনবলের অনুমোদন মিলেনি। এতে এক ছাদের নিচে সব চিকিৎসাসেবা মিলছে না।




