বাঁশখালী প্রতিনিধি :বাঁশখালী উপজেলার বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী কয়েক লক্ষ মানুষের জানমাল রক্ষা ও বেড়িবাঁধ ভাঙন রোধে ২০২৪ সালের ২৮ মে একনেকে অনুমোদন পায় ৪৫৩ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প। ৭ হাজার ৫১০ মিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও পুনরাকৃতিকরণে ছয়টি প্যাকেজে বিভক্ত এই প্রকল্পের কাজ চলমান থাকলেও শুরু থেকেই অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উঠেছে গুরুতর অভিযোগ। উপকূলের তিনটি ইউনিয়ন- ছনুয়া, খানখানাবাদ ও সাধনপুরে প্রকল্প বাস্তবায়নে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগে ক্ষোভে ফুঁসছেন স্থানীয়রা।
ছনুয়া ইউনিয়ন:
ছনুয়া উপকূলে ১০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ হাজার ৮ শত মিটার বেড়িবাঁধ পুনরাকৃতিকরণ ও ঢাল সংরক্ষণ কাজ বাস্তবায়ন করছে আরএফএল প্লাস্টিক লিমিটেড (RFL) ও প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (PDL)। ছয়টি প্যাকেজে বিভক্ত এই প্রকল্পে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা নয়টি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাজ ভাগ-বাটোয়ারার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, কুতুবদিয়া চ্যানেল ও বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত পানি দিয়ে বলগেট থেকে ড্রেজারের মাধ্যমে স্থানীয় বেতাগী বালু আনলোড করে সিসি ব্লক তৈরি করা হচ্ছে। সিলেটি ২.৫ বালুর পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের স্থানীয় বালু ও ময়লাযুক্ত পাথর। এতে বাঁধের স্থায়িত্ব নিয়ে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের ঝুঁকি।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাউবো কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে শ্রমিকরা সিসি ব্লক তৈরি করছে। ভাইব্রেটর মেশিন ব্যবহার না করায় এবং ব্লক তৈরির পর পর্যাপ্ত পানি না দেওয়ায় অনেক ব্লক বসানোর সময়ই ভেঙে যাচ্ছে। এলাকায় শ্রমিক, লেবার কাস্টিং ও বালু সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে মো. হোসাইন (আল ইমরান এয়ার ইন্টারন্যাশনাল), আব্দুল খালেক, আব্দুল হাকিম-জাকের, হাজী ট্রেডার্স, জসিম, জোনাইদ-ইসলাম, মামুন, কাইছার ও ফজলুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন গ্রুপগুলো। মালামাল লোড-আনলোডের কাজ নিয়ন্ত্রণ করছেন জাকের ও কাইছার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাবি, তারা সিন্ডিকেটের বাইরে থেকে বালু আনতে গেলে বাধা দেওয়া হয় এবং চাপ সৃষ্টি করা হয়।
খানখানাবাদ ইউনিয়ন:
খানখানাবাদ ইউনিয়নের কদমরসুল এলাকায় ১৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ হাজার ৩০০ মিটার বেড়িবাঁধ পুনরাকৃতিকরণ ও ঢাল সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মেসার্স থ্রি পয়েন্ট ও তালুকদার ট্রেডিং কাজের নিয়ন্ত্রণ দখলে নিয়েছে। মেসার্স থ্রি পয়েন্টের পক্ষে স্থানীয় মো. আরিফ, রেজাউল করিম ও খানখানাবাদ ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম শ্রমিক, বালি ও লেবার কাস্টিংয়ের কাজ পরিচালনা করছেন। তালুকদার ট্রেডিংয়ের পক্ষে কাইদুল ওয়াদুদ, আশরাফ ও শাহেদ বালু সরবরাহ করছেন। এছাড়া সিনবাদ জেনারেল ট্রেডিংয়ের হান্নানও যুক্ত রয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, নিম্নমানের পাথর ও লবণাক্ত পানিতে আনলোড করা বালু ব্যবহার করা হচ্ছে। নিজেদের রাজনৈতিক গ্রুপিংয়ের কারণে কাজের গতি অত্যন্ত ধীর হয়ে পড়েছে। তারা নিজেরাও কাজ করছে না, আবার ঠিকাদারকেও কাজ করতে দিচ্ছে না।
সাধনপুর ইউনিয়ন:
সাধনপুর ইউনিয়নে ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর তীর সংরক্ষণ কাজের আওতায় ১ হাজার ১০০ মিটারের মধ্যে ৭৫০ মিটার সিসি ব্লক কাস্টিং ও জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের কাজ করছে আরএফএল। এখানেও রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে বালি, শ্রমিক ও লেবার কাস্টিং নিয়ন্ত্রণ করছে একাধিক গ্রুপ। এই কাজে যুক্ত রয়েছে ওয়াহিদ উদ্দিন চৌধুরী, আখি এন্টারপ্রাইজের ইউসুফ, পল্লীমাতা সোসাইটির সরওয়ার, সিনবাদ জেনারেল ট্রেডিংয়ের ফারুক, রয়েল ট্রেডিংয়ের হান্নান, আক্তার, ফারুকী অ্যান্ড ব্রাদার্স, আব্দুল হান্নান ও নুর উদ্দীন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ব্লক তৈরিতে নিম্নমানের পাথর ও লবণাক্ত বালু ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাইব্রেটর ছাড়া ব্লক তৈরি ও পর্যাপ্ত কিউরিং না করায় অল্প সময়েই ব্লক খসে পড়ছে।
ছনুয়া প্রকল্পের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রজেক্ট ম্যানেজার মিরাজ জানান, পাথর ও প্রিমিয়ার সিমেন্ট কোম্পানির পক্ষ থেকেই সরবরাহ করা হচ্ছে। স্থানীয় সিন্ডিকেট জোরপূর্বক বালু আনলোড করলেও তা গ্রহণ করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
পিডিএলের অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাদিকুল ইসলাম বলেন, লবণাক্ত পানি ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে। প্রতিটি সাইটে গভীর নলকূপ স্থাপন করে মিঠা পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। জোরপূর্বক দেওয়া বেতাগী বালু ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে।
পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অনুপম পাল বলেন, লবণাক্ত পানিতে আনলোড করা বালু আগেই বাতিল করা হয়েছে। ব্লকগুলো বুয়েট থেকে টেস্ট করা হচ্ছে। মান খারাপ হলে ঠিকাদারকে পুনরায় কাজ করতে হবে। তবে সিন্ডিকেটের কারণে বিভিন্ন স্থানে কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে স্বীকার করেন তিনি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রাতের আঁধারে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে কাজ চালানো হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে চাঁদাবাজি ও মামলার ভয় দেখানো হয়। তারা শত কোটি টাকার এই প্রকল্পে চলমান অনিয়ম বন্ধে সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।




