বিশেষ প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম মহানগরীতে ভেজাল ও নিম্মমানের ঘি তৈরী হচ্ছে অনুমোদনহীন কারখানাগুলোতে। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এসব পদার্থ মিশিয়ে নিম্নমানের ভেজাল ঘি তৈরি করা হয়। এসব ক্ষতিকারক পদার্থ দিয়ে প্রতি কেজি ঘি তৈরিতে উৎপাদন খরচ সর্বোচ্চ ৩শ টাকা। এসব মানহীন ভেজাল ঘিও খুচরা পর্যায়ে কেজিতে বিক্রি হয় ৮শ থেকে এক হাজার টাকা দরে। অথচ ভালোমানের ঘি উৎপাদনে বর্তমানে কেজিপ্রতি ৮শ থেকে সাড়ে ৮শ টাকা। কয়েক হাত ঘুরে ভোক্তা পর্যায়ে তা এক হাজার থেকে ১২শ টাকায় বিক্রি করতে হয়। ভেজাল ঘি উৎপাদনকারীদের নিকট থেকে সংশ্লিষ্ট পুলিশ প্রশাসনের স্ব-ঘোষিত ক্যাশিয়াররা মাসোয়ারা আদায় করে এহেন অপরাধে সহযোগীতা করছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ভেজাল ঘি নিয়মিত খেলে ধীরে ধীরে কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি। এছাড়াও শরীরের নানা রোগ সৃষ্টি হয়। এদিকে বিএসটিআই এর অনুমোদিত ঘি কারখানার সন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে নামে-বেনামে অবৈধ কারখানা।
বিএসটিআইয়ের তালিকায় দেখা যায়, চট্টগ্রামে ঘি তৈরির ১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেই তালিকা ধরে গত তিনদিন একাধিক কারখানার সরেজমিন খোঁজ নেওয়া হয়। বেশির ভাগ কোম্পানির ঠিকানা কৌটায় লিখা অনুযায়ী খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিএসটিআইয়ের তালিকায় না থাকলেও হাটে-বাজারে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে ভুঁইফোড় কোম্পানির নামে অবৈধ ও ভেজাল ঘি। নগরী ও জেলায় শতাধিক অবৈধ ঘি তৈরির কারখানা রয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানায়। একাধিক ঘি’র কৌটা সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, সবকটি কৌটার গায়ে বিএসটিআইয়ের লোগো ও বিএসটিআই অনুমোদিত বলে লিখা রয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে বিএসটিআইয়ের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
এ বিষয়ে বিএসটিআইয়ের উপ-পরিচালক নূরুল ইসলাম দি ক্রাইমকে বলেন, কৌটার গায়ে যে ঠিকানা রয়েছে, সেই ঠিকানায় কারখানা থাকতে আইনিভাবে বাধ্য। সরেজমিনে না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আপনার কাছে তথ্য থাকলে আমাদের দিয়েন। ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নিয়ে কী ধরনের ঘি তৈরি করছে তা দেখভালো করার দায়িত্ব আপনাদের। তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পর তিনি বলেন, আমাদের সীমিত জনবল দিয়ে কাজ করতে হয়। তারপরও আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে আসছি বলে তিনি জানান।
তবে বিএসটিআই আইন বলছে, পণ্যের কৌটার গায়ে যে ঠিকানা রয়েছে সেখানে উৎপাদন কার্যক্রম বাধ্যতামূলক। অন্য কোথাও উৎপাদন পরিচালনা করা দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আইন মানে কে? এ বিষয়ে দেখভালে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই যেন এ বিষয়ে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’। ঘি তৈরির অনুমোদন দিয়েই দায় সেরেছে বিএসটিআই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর বাকলিয়া, ষোলশহর বিসিক শিল্প এলাকা, চাক্তাই-রাজাখালী, নাসিরাবাদ, বায়েজিদ, পাহাড়তলী এবং জেলার পটিয়া, কর্ণফুলী, বোয়ালখালী, আনোয়ারা, সাতকানিয়া, হাটহাজারী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠেছে ভেজাল ঘি’র কারখানা। টিন ও প্লাস্টিকের কৌটার গায়ে বিএসটিআইয়ের লোগো ব্যবহার করেই নিম্নমান-ভেজাল ঘি তৈরি এবং বাজারজাত করা হচ্ছে। বিএসটিআই অনুমোদিত অনেক কারখানায়ও তৈরি হচ্ছে ভেজাল ও নিন্মমানের ঘি।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ও নকল ঘি। বৈধ কোম্পানির আড়ালেও তৈরি হচ্ছে নিম্নমানের ঘি। বাজারে বেশ দাপটের সঙ্গে বেচা-বিক্রি হচ্ছে এসব ঘি। বিশেষ করে কারখানাগুলোতে নোংরা-অপরিচ্ছন্ন ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ঘি তৈরি করা হয়। অথচ কৌটায় লিখা রয়েছে, আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গাভির খাঁটি দুধের ক্রিম দিয়ে তৈরি হয়। চটকদার বিজ্ঞাপন ও বিএসটিআইয়ের লোগো সাঁটিয়ে বাজারজাত করা হয়।
সরেজমিনে আরো দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীতে ভালো চাহিদা রয়েছে রাজরাণী ব্র্যান্ডের ঘি। বিশেষ করে বাবুর্চিদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে এ ব্র্যান্ডের ঘি। কিন্তু বিএসটিআইয়ের হালনাগাদ তালিকায় এ ব্র্যান্ডের নাম নেই। রাজরাণী ঘি’র কৌটায় থাকা মোবাইল নম্বারে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও কেউ রিসিভ করেননি। এছাড়াও তাহের ফুড প্রোডাক্টসের ডানোফা ব্র্যান্ডের ঘি’র চাহিদাও ভলো রয়েছে।
সরেজমিনে ঘি তৈরির একাধিক কারখানা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সাথে কথা বলে জানা গেছে, অপরিশোধিত ভোজ্যতেল (সয়াবিন ও পাম) পরিশোধনের পর এক ধরনের কালো স্বাদ-গন্ধহীন বর্জ্য বের হয়। যাকে বলা হয় ‘টেলো’। সাবানের কাঁচামাল হিসেবে তা ব্যবহৃত হয়। কেজিপ্রতি মূল্য ৪০ টাকা। এ বর্জ্যে কস্টিকসোডা মিশিয়ে আগুনের তীব্র তাপের ফলে সাদা রং ধারণ করে। টেলো থেকে রূপান্তরিত হয়ে তা প্যারামিন নাম রূপ নেয়। এর সঙ্গে পাম ও সয়াবিন তেল এবং বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল এবং রঙের সুগন্ধি মিশিয়ে ঘি তৈরি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে জুতায় ব্যবহৃত গামও ব্যবহার করা হয়। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এসব পদার্থ মিশিয়ে নিম্নমানের ভেজাল ঘি তৈরি করা হয়।
জানতে চাইলে বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক শশী কান্ত দাশ দি ক্রাইমকে বলেন, ১৭ টি লাইসেন্স অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। লাইসেন্স নবায়ন না হওয়া কোম্পানির ঘি কিভাবে বাজারে বিক্রি হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি আমাদের ডিডি স্যার বলতে পারবেন।
এদিকে ঘি তৈরির একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোজ্যতেলের বর্জ্য, সাবানের ফেনা, জুতার গাম, পামওয়েল, সয়াবিনের সঙ্গে রঙের ফ্লেভার ও কেমিক্যাল মিশিয়ে নিম্নমানের ঘি তৈরি করা হয়। যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। কম খরচে তৈরি নিম্নমানের ভেজাল ঘি নামিদামি ব্র্যান্ডের নামে বিক্রি হয় বেশি দামে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রতিষ্ঠানের স্বত্ত্বাধিকারী বলেন, নকল ও ভেজাল ঘি কেজিপ্রতি ৮শ টাকায় বিক্রি করা হয়। কিন্তু উন্নতমানের ঘি তৈরিতে আট থেকে সাড়ে আট শ টাকা খরচ পড়ে। এতে বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো মার খাচ্ছে। বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে ভোক্তারা।
বনফুল এন্ড কোম্পানির জিএম আমানুল আলম দি ক্রাইমকে বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে ভেজাল ও নিম্নমানের ঘি তৈরি করা হচ্ছে। কিছুদিন আগেও আমরা বিএসটিআই ও জেলা প্রশাসনকে মৌখিকভাবে অবহিত করেছি। কিন্তু কেউ তো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বৈধ কারখানারও অস্তিত্ব মিলে না। কোথায় তৈরি হয় তার খোঁজ নেয় না বিএসটিআই। তদারকির অভাবে ভেজাল ও মানহীন ঘি’য়ে সয়লাভ হয়ে গেছে।




