দি ক্রাইম ডেস্ক: বঙ্গোপসাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহী আন্তর্জাতিক কোম্পানি না পেয়ে উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি)-২০২৫ ফের পর্যালোচনার কমিটি গঠন করা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে ডাকা দরপত্রে সাড়া না পাওয়ার পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ কমিটি গঠন করল। পেট্রোবাংলাকে এ কমিটিকে দাপ্তরিক ও লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করতে বলেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। কমিটির পর্যালোচনা ও সুপারিশের ভিত্তিতে পিএসসি সংশোধন করা হবে বলে জানিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
দেশে বিদ্যমান গ্যাস সংকট দূর করতে দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রে গ্যাস ও খনিজ অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরুর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রতিবারই এ চেষ্টায় হোঁচট খেয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন তিনটি সরকার। এ জন্য উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) বিদেশি বিনিয়োগকারী বা আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর জন্য আকর্ষণীয় নয় বলে দাবি করছিল সরকারগুলোর বিভিন্ন অংশ। সেই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ পিএসসি পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করতে নির্দেশনা দেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। গত ১৭ ডিসেম্বরে গঠিত জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ (ইএমআরডি) এ সংক্রান্ত একটি দাপ্তরিক আদেশ জারি করেছে। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহসীনকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। পর্যালোচনাশেষে আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে তাদেরকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
গত বছরের ১১ মার্চ বিদ্যমান পিএসসির আওতায় সমুদ্রের ২৪টি ব্লকের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হলেও কোনো কোম্পানিই আগ্রহ দেখায়নি। পরে কোনো আগ্রহ না দেখানোর কারণ জানতে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মতামত চায় পেট্রোবাংলা। পাশাপাশি পিএসসি-২০২৫ পুনরায় সংশোধন করতে আন্তর্জাতিক আইনি প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেঞ্জিকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দেশীয় গ্যাসের জন্য অনুসন্ধান বাড়াতে এক যুগ পর গভীর সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম হাতে নিলেও কার্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাই পুনরায় মডেল পিএসসি-২০২৫ সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, অফশোর মডেল পিএসসি ২০২৫-এর খসড়া এবং এতে অন্তর্ভুক্ত নতুন বিধানসমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনার পাশাপাশি প্রস্তাবিত মডেল উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তির (পিএসসি) ওপর সুপারিশ প্রদানের জন্যই এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন—ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ভিসি অধ্যাপক ড. এম তামিম, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের (এসজিএফএল) পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আবুল মনির মো. ফয়েজ উল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এস এম মাইকেল কবির, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ব্যারিস্টার অ্যাট-ল ড. সিনথিয়া ফরিদ, পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) প্রকৌশলী মো. শোয়েব, মহাব্যবস্থাপক (কন্ট্রাক্টস) হাসান মাহমুদুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক (রিজার্ভার অ্যান্ড ডাটা ম্যানেজমেন্ট) মেহেরুল হাসান এবং মহাব্যবস্থাপক (এক্সপ্লোরেশন) ফারহানা শাওন (সদস্যসচিব)।
জানা গেছে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে পেট্রোবাংলা মডেল পিএসসিতে গ্যাস বিক্রয় মূল্য, পাইপলাইন খরচ পুনরুদ্ধার এবং কাজের বাধ্যবাধকতায় বড় ধরনের সংস্কার এনেছে। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে নতুন মডেল অনুযায়ী গ্যাসের দাম ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, যা আগে এইচএসএফও (ফার্নেস অয়েল) ভিত্তিক ছিল। পেমেন্টের ক্ষেত্রে লাইবরের পরিবর্তে সোফার ব্যবহার করা হবে। এছাড়া ডাটার দাম, ওয়ার্কার্স প্রফিট বোনাস ও কস্ট রিকভারিতে সংশোধন আনা হচ্ছে।
জানা যায়, বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল ও শেভরন, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস, নরওয়ে ও ফ্রান্সের যৌথ কোম্পানি টিজিএস অ্যান্ড স্লামবার্জার, জাপানের ইনপেক্স করপোরেশন ও জোগম্যাক, চীনের সিনুক, সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি এবং ভারতের ওএনজিসি আগ্রহ প্রকাশ করে। দরপত্র আহ্বানের আগে থেকেই এসব কোম্পানি পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপের তথ্য কিনেছিল শেভরন, এক্সনমবিল, ইনপেক্স, সিনুক ও জোগোম্যাক। সাতটি কোম্পানি দরপত্র সংগ্রহ করলেও নির্ধারিত সময়ে কেউ-ই জমা দেয়নি। দরপত্রে অংশ না নেওয়ার কারণ হিসেবে এক্সনমবিল ঐ সময় পেট্রোবাংলাকে জানায়, গভীর সমুদ্র থেকে স্থলভাগে আনা পাইপলাইনের খরচ হিসেবে সঞ্চালন চার্জ না রাখা এবং ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিপিপিএফ) নিয়ে আপত্তি আছে।
বিদ্যমান আইনে কোম্পানির মুনাফার পাঁচ শতাংশ ডব্লিউপিপিএফে হস্তান্তরের বিধান রয়েছে, যা নিয়ে বর্তমানে অপর মার্কিন কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশের সঙ্গে এখনো টানাপড়েন চলছে। এই পাঁচ শতাংশ কমানোর জন্য এরই মধ্যে জ্বালানি বিভাগ থেকে শ্রম মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। অন্যদিকে, চায়না ন্যাশনাল অফশোর অয়েল করপোরেশন (সিএনওওসি) তার জবাবে লিখেছে, পেট্রোবাংলা তাদের ডাটা বিক্রির জন্য যে প্যাকেজ মূল্য নির্ধারণ করেছিল, তার দর অনেক বেশি ছিল। গ্যাসের দাম কমিয়ে রাখার বিষয়টিও সামনে এনেছে একটি কোম্পানি। তাদের দাবি, পিএসসি চূড়ান্তকরণে কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান দামের যে সুপারিশ দিয়েছিল তা রাখা হয়নি।
ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সাগর সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের। ২০১০ সালে গভীর সমুদ্রে ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ ব্লকে কাজ নেয় কনোকো ফিলিপস। তারা দ্বিমাত্রিক জরিপ শেষে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি করে। সেই দাবি পূরণ না হওয়ায় কাজ ছেড়ে চলে যায়। এ ছাড়া চুক্তির পর কাজ ছেড়ে চলে যায় অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস ও দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ু।




