মন্তব্য প্রতিবেদন————

বুলবুল ভট্টর্চায্য: স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসেও বাংলাদেশ পুলিশ তাদের প্রতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা ও পেশাগত মর্যাদা পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি–এ প্রশ্ন বারবারই ফিরে আসে। সংবিধান অনুযায়ী পুলিশ রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত একটি পেশাদার সংস্থা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বারবার তারা রাজনৈতিক শক্তির লেজুড়বৃত্তিতে পরিণত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দলকে সন্তুষ্ট করা, বিরোধী দলের কর্মসূচি দমন করা কিংবা নির্বাচনে প্রশাসনিক সহায়তার নামে একপক্ষীয় আচরণ করা–এ অভিযোগ বহু বছর ধরেই চলছে।

সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো, রাজনৈতিক পালাবদলের পর সেই একই পুলিশ সদস্যরাই প্রতিহিংসার শিকার হন। কখনো বদলি, কখনো মামলা, কখনো শারীরিক আঘাত–অর্থাৎ রাজনৈতিক আনুগত্যের দায়ভার শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদেরই বহন করতে হয়।

২৪ এর জুলাই আন্দোলনে অনেক পুলিশ সদস্য নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন; গর্ভবতী এক মহিলা পুলিশ সদস্যের থানার ভেতর আগুন থেকে বাঁচার আর্তনাদের–এ দৃশ্য মানবসভ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্র কেউ বলছে, প্রায় ১৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে, কেউ বলছে ৩০০০-এর বেশি। আবার একটি বিশ্লেষণ বলছে, ১৫ জুলাই থেকে ২১ জুলাইয়ের মধ্যে ১৫০ জন নিহত হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশ কতজন নিহত বা আহত হয়েছেন এর কোনও ভেরিফায়েড তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি–সব জায়গায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। কর্মকর্তাদের বড় অংশ নিরাপদ থাকার জন্য নীতিগত স্বাধীনতার বদলে ‘ক্ষমতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা’-ই বেছে নেন। অথচ পুলিশের দায়িত্ব দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা করা–যুদ্ধ ঘোষণা করা নয়। একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার অন্য দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ডাক দেওয়া নিছক ক্ষমতার তোষামোদি ছাড়া কিছুই নয়।

এছাড়া বাহিনীর অভ্যন্তরেও জবাবদিহির সংস্কৃতি দুর্বল। অন্যায্য নির্দেশ অমান্য করলে চাকরি হারানোর ভয়, আর পালন করলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেলে প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার আশঙ্কা–এই চক্রের মধ্যেই পুলিশ আটকে যায়। ফলে তারা কখনো রাজনৈতিক শক্তির হাতিয়ার, আবার কখনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলিতে পরিণত হয়। এই
পরিস্থিতির কারণে জনগণের চোখে পুলিশের প্রতি আস্থাও কমে যাচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, মিথ্যা মামলা–এসবে পুরো বাহিনীকে দায় বহন করতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রতিষ্ঠান জনগণের ভরসার জায়গা থেকে সরে গিয়ে ভয়ের প্রতীকে পরিণত হয়। এর ফলে আইনের শাসন দুর্বল হয়, গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সমাধান কী?–হ্যাঁ, এ থেকে বেরিয়ে আসতে কাঠামোগত ও রাজনৈতিক সংস্কার জরুরি।যেমন–(১) নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে, যা সংসদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে।(২) স্পষ্ট জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অভ্যন্তরীণ তদন্তের পাশাপাশি জন অভিযোগ বিবেচনার স্বাধীন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।(৩) পুলিশের প্রশিক্ষণে মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার ও ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে তারা বুঝতে পারে–রাষ্ট্র নয়, জনগণই তাদের মালিক।(৪) রাজনৈতিক দলগুলো পুলিশকে নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।(৫) গণমাধ্যম ও নাগরিক সংগঠনগুলোকেও তথ্য প্রকাশ ও জনমত গঠনে সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে।

কথা হচ্ছে, পুলিশ বাহিনীর রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি একদিনে তৈরি হয়নি,তাই এর সমাধানও একদিনে সম্ভব নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও কাঠামোগত সংস্কার থাকলে পরিবর্তন অবশ্যই সম্ভব। পুলিশ যদি জনগণের “বন্ধু” হিসেবে ফিরে আসতে চায়, তবে প্রথম শর্ত হলো রাজনৈতিক প্রভাবের ছায়া থেকে নিজেদের মুক্ত করা।এটাই হবে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

মন্তব্য প্রতিবেদন————

বুলবুল ভট্টর্চায্য: স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসেও বাংলাদেশ পুলিশ তাদের প্রতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা ও পেশাগত মর্যাদা পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি–এ প্রশ্ন বারবারই ফিরে আসে। সংবিধান অনুযায়ী পুলিশ রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত একটি পেশাদার সংস্থা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বারবার তারা রাজনৈতিক শক্তির লেজুড়বৃত্তিতে পরিণত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দলকে সন্তুষ্ট করা, বিরোধী দলের কর্মসূচি দমন করা কিংবা নির্বাচনে প্রশাসনিক সহায়তার নামে একপক্ষীয় আচরণ করা–এ অভিযোগ বহু বছর ধরেই চলছে।

সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো, রাজনৈতিক পালাবদলের পর সেই একই পুলিশ সদস্যরাই প্রতিহিংসার শিকার হন। কখনো বদলি, কখনো মামলা, কখনো শারীরিক আঘাত–অর্থাৎ রাজনৈতিক আনুগত্যের দায়ভার শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদেরই বহন করতে হয়।

২৪ এর জুলাই আন্দোলনে অনেক পুলিশ সদস্য নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন; গর্ভবতী এক মহিলা পুলিশ সদস্যের থানার ভেতর আগুন থেকে বাঁচার আর্তনাদের–এ দৃশ্য মানবসভ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্র কেউ বলছে, প্রায় ১৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে, কেউ বলছে ৩০০০-এর বেশি। আবার একটি বিশ্লেষণ বলছে, ১৫ জুলাই থেকে ২১ জুলাইয়ের মধ্যে ১৫০ জন নিহত হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশ কতজন নিহত বা আহত হয়েছেন এর কোনও ভেরিফায়েড তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি–সব জায়গায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। কর্মকর্তাদের বড় অংশ নিরাপদ থাকার জন্য নীতিগত স্বাধীনতার বদলে ‘ক্ষমতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা’-ই বেছে নেন। অথচ পুলিশের দায়িত্ব দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা করা–যুদ্ধ ঘোষণা করা নয়। একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার অন্য দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ডাক দেওয়া নিছক ক্ষমতার তোষামোদি ছাড়া কিছুই নয়।

এছাড়া বাহিনীর অভ্যন্তরেও জবাবদিহির সংস্কৃতি দুর্বল। অন্যায্য নির্দেশ অমান্য করলে চাকরি হারানোর ভয়, আর পালন করলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেলে প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার আশঙ্কা–এই চক্রের মধ্যেই পুলিশ আটকে যায়। ফলে তারা কখনো রাজনৈতিক শক্তির হাতিয়ার, আবার কখনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলিতে পরিণত হয়। এই
পরিস্থিতির কারণে জনগণের চোখে পুলিশের প্রতি আস্থাও কমে যাচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, মিথ্যা মামলা–এসবে পুরো বাহিনীকে দায় বহন করতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রতিষ্ঠান জনগণের ভরসার জায়গা থেকে সরে গিয়ে ভয়ের প্রতীকে পরিণত হয়। এর ফলে আইনের শাসন দুর্বল হয়, গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সমাধান কী?–হ্যাঁ, এ থেকে বেরিয়ে আসতে কাঠামোগত ও রাজনৈতিক সংস্কার জরুরি।যেমন–(১) নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে, যা সংসদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে।(২) স্পষ্ট জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অভ্যন্তরীণ তদন্তের পাশাপাশি জন অভিযোগ বিবেচনার স্বাধীন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।(৩) পুলিশের প্রশিক্ষণে মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার ও ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে তারা বুঝতে পারে–রাষ্ট্র নয়, জনগণই তাদের মালিক।(৪) রাজনৈতিক দলগুলো পুলিশকে নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।(৫) গণমাধ্যম ও নাগরিক সংগঠনগুলোকেও তথ্য প্রকাশ ও জনমত গঠনে সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে।

কথা হচ্ছে, পুলিশ বাহিনীর রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি একদিনে তৈরি হয়নি,তাই এর সমাধানও একদিনে সম্ভব নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও কাঠামোগত সংস্কার থাকলে পরিবর্তন অবশ্যই সম্ভব। পুলিশ যদি জনগণের “বন্ধু” হিসেবে ফিরে আসতে চায়, তবে প্রথম শর্ত হলো রাজনৈতিক প্রভাবের ছায়া থেকে নিজেদের মুক্ত করা।এটাই হবে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।