সুকান্ত বিকাশ ধর, সাতকানিয়া: জায়গা সংক্রান্ত জটিলতার অজুহাতে স্কুল ভবন নির্মাণের টেন্ডার বাতিলের তিন বছর অতিক্রম হতে চললেও এখনও পর্যন্ত কোনো নতুন ভবন তৈরি না হওয়ায় চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ১৩৩ বছরের পুরনো উত্তর এওচিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা বহুমুখী সমস্যার মুখোমুখি হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও শ্রেণিকক্ষ সংকটসহ নানা সমস্যার আবর্তে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান থাকলেও উপজেলা শিক্ষা অফিস নতুন ভবন নির্মাণে গাফিলতি করায় এ স্কুলের সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্কুলের নানামুখী সমস্যা নিয়ে এলাকাবাসী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) সোচ্চার হলে টনক নড়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার। তড়িঘড়ি করে এ স্কুলের প্রধান শিক্ষককে দিয়ে একটি আবেদন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠান শিক্ষা কর্মকর্তা।
এ আবেদনে জরুরী ভিত্তিতে অস্থায়ী গৃহ নির্মাণের জন্য পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দের কথা উল্লেখ করলেও এখনও পর্যন্ত মূল ভবনের জন্য অফিসিয়ালি করা হয়নি কোনো আবেদন। ফলে মৃত্যু ভয়ে শিক্ষার্থীরা এ স্কুল ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় শিক্ষার্থী সংখ্যা আগের চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগে গিয়ে ঠেকেছে। অপরদিকে, স্কুলের অবস্থা দেখে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে সেমিপাকা টিনশেডের দু’টি কক্ষ নির্মাণ ও ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল ভবনটি সংস্কারের আশ্বাস দিয়েছেন।
জানা যায়, চাহিদা ভিত্তিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প (১ম পর্যায়) এর আওতায় ২০২২ সালের আগস্ট মাসে বিদ্যালয়টিতে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য সাতকানিয়া উপজেলা স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) দরপত্র আহ্বান করেন। এর প্রেক্ষিতে, সাতকানিয়া পৌরসভার গোয়াজর পাড়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স কেয়া কর্পোরেশন কাজটি পায়। এরপর ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও এলজিইডি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হয়। ২০২৩ সালের মে মাসের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করে এলজিইডি কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল।
স্কুল সূত্রে জানা যায়, টেন্ডার হওয়ার পর ঠিকাদার ভবনটি ভাঙার জন্য প্রধান শিক্ষককে বললে তিনি (প্রধান শিক্ষক) শিক্ষা অফিসের পরামর্শক্রমে নিলামে তুলে ভবনটি ভেঙে ফেলেন। ভাঙা অংশগুলোও ক্রয় করেন ঠিকাদার নিজেই। পরে ঠিকাদারকে ভবনের কাজ শুরু করার জন্য প্রধান শিক্ষক বললেও ঠিকাদার বলেন- নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় কাজ করলে তার লস হবে। এই বলে তিনি আর কাজ করেননি। পরে জায়গা সংক্রান্ত জটিলতার অজুহাত দেখিয়ে তৎকালীন উপজেলা প্রকৌশলী পারভেজ সারওয়ার হোসেনের নিকট আবেদন করেন।
প্রকৌশলী পারভেজ ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে ভবন নির্মাণ কাজের চুক্তিটি বাতিলের জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন পেতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রকৌশলী (মানব সম্পদ উন্নয়ন, মাননিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ) মো. আব্দুর রশীদ মিয়া বরাবর আবেদন করেন। তাঁর আবেদনের প্রেক্ষিতে, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে চুক্তিটি বাতিলের অনুমতি প্রদান করা হয়। এরপর একই বছরের জুন মাসে চুক্তিটি বাতিল করে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয় বর্তমান উপজেলা প্রকৌশলী সবুজ কুমার দে।
ফলে ওই বিদ্যালয়ে নতুন ভবন আর নির্মিত হয়নি। তবে, টেন্ডারটি বাতিল হওয়ার ৩ বছর অতিক্রম হতে চললেও এখনও পর্যন্ত নতুন করে ভবন নির্মাণের জন্য কোন ব্যবস্থা বা কোন আবেদনও করেননি শিক্ষা অফিস। এমনকি, ঠিকাদারের অভিযোগটি সত্য কি মিথ্যা তাও যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি শিক্ষা অফিস। যার ফলে বর্তমানে পুরনো ভবনে চরম ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ঠিকাদার আবুল কাশেম ও সাবেক সাতকানিয়া উপজেলা প্রকৌশলী পারভেজ সারওয়ার হোসেনকে মোবাইল ফোনে কল দিলে তাদের  সাড়া মেলেনি।
তবে, সাতকানিয়া উপজেলার বর্তমান প্রকৌশলী সবুজ কুমার দে এর ভাষ্য, ঠিকাদার কার্যাদেশ পাওয়ার পরও সময় মতো শিক্ষা অফিস পুরাতন ভবনটি ভেঙে কাজের সাইড বুঝিয়ে দেয়নি। ফলে কাজের সময় ওভার হয়ে যায়। ঠিকাদার টেন্ডার বাতিলের আবেদন করলে পূর্ববর্তী ডকুমেন্টস পর্যালোচনা করে টেন্ডারটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তবে, নতুনভাবে ভবন  নির্মাণের জন্য টেন্ডার করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
তবে, স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুক্তি রানী ধর বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁর ভাষ্য, টেন্ডার এর পরপরই তারা পুরনো ভবনটি নিলামে তুলে এবং ঠিকাদার আবুল কাশেম নিজেই সেটি নিলামে কেনেন। তাকে জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া হলেও তিনি কাজ শুরু করেননি। তিনি আমাদের জানিয়েছেন-এ কাজ করলে তার লোকসান হবে। তার গাফিলতির কারণেই আজ আমাদের এই সীমাহীন দুর্ভোগ। আমাদের দাবি- উর্ধতন  কর্তৃপক্ষ যাতে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন ভবন নির্মাণ ও পুরনো ভবনটি ঝুঁকিমুক্ত করে দেয়। অস্থায়ী শ্রেণিকক্ষ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেছি।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বিদ্যালয়টি ১৩৩ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৯২ সালে স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে একতলা বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মিত হয়। ভবনটির মধ্যে তিনটি শ্রেণিকক্ষ ও একটি ছোট কক্ষ রয়েছে। বর্তমানে ওই বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ১২৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ছয়জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে পাঁচজন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালে এ স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৭৮ থাকলেও মৃত্যু ঝুঁকির ভয় ও শ্রেণি কক্ষ সংকটসহ নানা কারণে বর্তমানে এ স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২৬ জনে গিয়ে ঠেকেছে । যা অতীতের চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ।
সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, স্কুল মাঠের পূর্ব প্রান্তে একতলা বিশিষ্ট একটি ভবনের তিনটি শ্রেণিকক্ষ ও একটি অফিস কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে এক সময় ছোট কক্ষে প্রাক-প্রাথমিকের ক্লাস নেওয়া হতো। এ কক্ষে ছাদ ও বিমের পলেস্তারা প্রায় সময় খসে পড়ায় এখন তাদের ক্লাস নেওয়া হচ্ছে শিক্ষক অফিসের মেঝেতে। ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক ফারজানা ববি। ভবনের দক্ষিণ পাশে বিমের পলেস্তারা খসে পড়েছে। এ ছাড়া বারান্দার কয়েকটি পিলারের অংশ ভেঙে রড বেরিয়ে এসেছে। ছোট কক্ষটির খসে পড়া পলেস্তারাগুলো সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় সেই পুরনো ভবনের বেঞ্চগুলো শ্রেণিকক্ষগুলোতে থরেথরে সাজিয়ে রাখাই সংকুচিত হয়ে গেছে বসার স্থান।
সামান্য বৃষ্টিতে ছাদে জমে থাকা পানি চুইয়ে পড়ে শ্রেণি কক্ষে। এতে ভিজে যায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বই-খাতা, চেয়ার-টেবিলসহ সব কিছু। শ্রেণিকক্ষ সংকটের অভাবে গাদাগাদি করে ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। তবে ভবনের বয়স বেশি হওয়ায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। শ্রেণি কক্ষে বসে শিক্ষার্থীরা সবসময় আতঙ্কে থাকে কখন যেন ছাদ খসে পড়ে। বর্তমান স্কুল ভবনটির দক্ষিণ পাশে রয়েছে দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি বাথরুম। বাথরুম দু’টিও পরিপাটি নয়। কোন রকমে দায় সারেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। উত্তর পাশে নতুনভাবে নির্মিত হচ্ছে একটি ওয়াস ব্লক। যেটি এখনও চালু করা হয়নি।
অপরদিকে, স্কুল ভবনটি নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ শাহজাহান চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এলাকার লোকজন বিভিন্নভাবে চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য।
এ স্কুলের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদিত্য দাশ, সাফা মারওয়া, আবদুল্লাহ সাইফু ও সায়ন্তিকা চক্রবর্তীর ভাষ্য, ভবনটির অবস্থা মোটেও ভালো নয়। বৃষ্টি হলেই ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। ফলে তারা ঠিক মতো ক্লাস করতে পারে না। আবার ভয়ে থাকতে হয়, কখন ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।
শিক্ষক আবদুল মজিদ ও  ফারজানা ববির ভাষ্য, জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে বৃষ্টি হলে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে বসে থাকতে পারে না। ক্লাস করানো সম্ভব হয় না। কখনও কখনও তিন-চার বিষয়ের ক্লাসের পর তাদের ছুটি দিতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অভিভাবক জানান, স্কুল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তাদের সন্তানদের মৃত্যু ভয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে।
এ স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র মো.পারভেজ ও ইকবাল হোসেন জাহেদ জানান, টেন্ডার বাতিল হওয়ার পর শিক্ষা কর্মকর্তার গাফিলতি ও কোন পদক্ষেপ না থাকায় নতুন ভবন এখনও নির্মাণ হয়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও এলজিইডির প্রকৌশলীর যোগসাজশে চুক্তিটি বাতিল করা হয়। এর দায় সাবেক স্কুল কমিটি এড়াতে পারবে না। তাদের প্রত্যেককে জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন। কারণ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়াতে এই বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা অন্য বিদ্যালয়ে চলে যাচ্ছে। ২০২২ সালের দিকে এই বিদ্যালয়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল যা বর্তমানে তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।
এ স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ও জি বাংলা খ্যাত শুভ দাশের ভাষ্য, এ স্কুলে আমার শৈশব কেটেছে। এখন শুনছি স্কুলটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও অবহেলিত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. কামরুল বাশার ওমর ফারুক বলেন, শিক্ষা অফিসের গাফিলতির বিষয়টি আমার জানা নেই। কারণ আমি সম্প্রতি যোগদান করেছি। নতুন ভবন নির্মাণের বিষয়ে আমি উপজেলা প্রকৌশলীর সাথে কথা বলেছি। এ ছাড়াও বর্তমান ভবনটি সংস্কারের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। আশা করছি শীঘ্রই এ সমস্যার সমাধান হবে।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোন্দকার মাহমুদুল হাসান বলেন, উত্তর এওচিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টি আমি পরিদর্শন করেছি।  সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে বিষয়টি আমি তাদের নজরে এনেছি । উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে অনতিবিলম্বে দু’টি সেমিপাকা শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি সংস্কার করে দেওয়া হবে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে সহায়তার আশ্বাস প্রদান দিয়েছেন।
সুকান্ত বিকাশ ধর, সাতকানিয়া: জায়গা সংক্রান্ত জটিলতার অজুহাতে স্কুল ভবন নির্মাণের টেন্ডার বাতিলের তিন বছর অতিক্রম হতে চললেও এখনও পর্যন্ত কোনো নতুন ভবন তৈরি না হওয়ায় চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ১৩৩ বছরের পুরনো উত্তর এওচিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা বহুমুখী সমস্যার মুখোমুখি হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও শ্রেণিকক্ষ সংকটসহ নানা সমস্যার আবর্তে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান থাকলেও উপজেলা শিক্ষা অফিস নতুন ভবন নির্মাণে গাফিলতি করায় এ স্কুলের সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্কুলের নানামুখী সমস্যা নিয়ে এলাকাবাসী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) সোচ্চার হলে টনক নড়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার। তড়িঘড়ি করে এ স্কুলের প্রধান শিক্ষককে দিয়ে একটি আবেদন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠান শিক্ষা কর্মকর্তা।
এ আবেদনে জরুরী ভিত্তিতে অস্থায়ী গৃহ নির্মাণের জন্য পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দের কথা উল্লেখ করলেও এখনও পর্যন্ত মূল ভবনের জন্য অফিসিয়ালি করা হয়নি কোনো আবেদন। ফলে মৃত্যু ভয়ে শিক্ষার্থীরা এ স্কুল ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় শিক্ষার্থী সংখ্যা আগের চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগে গিয়ে ঠেকেছে। অপরদিকে, স্কুলের অবস্থা দেখে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে সেমিপাকা টিনশেডের দু’টি কক্ষ নির্মাণ ও ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল ভবনটি সংস্কারের আশ্বাস দিয়েছেন।
জানা যায়, চাহিদা ভিত্তিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প (১ম পর্যায়) এর আওতায় ২০২২ সালের আগস্ট মাসে বিদ্যালয়টিতে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য সাতকানিয়া উপজেলা স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) দরপত্র আহ্বান করেন। এর প্রেক্ষিতে, সাতকানিয়া পৌরসভার গোয়াজর পাড়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স কেয়া কর্পোরেশন কাজটি পায়। এরপর ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও এলজিইডি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হয়। ২০২৩ সালের মে মাসের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করে এলজিইডি কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল।
স্কুল সূত্রে জানা যায়, টেন্ডার হওয়ার পর ঠিকাদার ভবনটি ভাঙার জন্য প্রধান শিক্ষককে বললে তিনি (প্রধান শিক্ষক) শিক্ষা অফিসের পরামর্শক্রমে নিলামে তুলে ভবনটি ভেঙে ফেলেন। ভাঙা অংশগুলোও ক্রয় করেন ঠিকাদার নিজেই। পরে ঠিকাদারকে ভবনের কাজ শুরু করার জন্য প্রধান শিক্ষক বললেও ঠিকাদার বলেন- নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় কাজ করলে তার লস হবে। এই বলে তিনি আর কাজ করেননি। পরে জায়গা সংক্রান্ত জটিলতার অজুহাত দেখিয়ে তৎকালীন উপজেলা প্রকৌশলী পারভেজ সারওয়ার হোসেনের নিকট আবেদন করেন।
প্রকৌশলী পারভেজ ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে ভবন নির্মাণ কাজের চুক্তিটি বাতিলের জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন পেতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রকৌশলী (মানব সম্পদ উন্নয়ন, মাননিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ) মো. আব্দুর রশীদ মিয়া বরাবর আবেদন করেন। তাঁর আবেদনের প্রেক্ষিতে, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে চুক্তিটি বাতিলের অনুমতি প্রদান করা হয়। এরপর একই বছরের জুন মাসে চুক্তিটি বাতিল করে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয় বর্তমান উপজেলা প্রকৌশলী সবুজ কুমার দে।
ফলে ওই বিদ্যালয়ে নতুন ভবন আর নির্মিত হয়নি। তবে, টেন্ডারটি বাতিল হওয়ার ৩ বছর অতিক্রম হতে চললেও এখনও পর্যন্ত নতুন করে ভবন নির্মাণের জন্য কোন ব্যবস্থা বা কোন আবেদনও করেননি শিক্ষা অফিস। এমনকি, ঠিকাদারের অভিযোগটি সত্য কি মিথ্যা তাও যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি শিক্ষা অফিস। যার ফলে বর্তমানে পুরনো ভবনে চরম ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ঠিকাদার আবুল কাশেম ও সাবেক সাতকানিয়া উপজেলা প্রকৌশলী পারভেজ সারওয়ার হোসেনকে মোবাইল ফোনে কল দিলে তাদের  সাড়া মেলেনি।
তবে, সাতকানিয়া উপজেলার বর্তমান প্রকৌশলী সবুজ কুমার দে এর ভাষ্য, ঠিকাদার কার্যাদেশ পাওয়ার পরও সময় মতো শিক্ষা অফিস পুরাতন ভবনটি ভেঙে কাজের সাইড বুঝিয়ে দেয়নি। ফলে কাজের সময় ওভার হয়ে যায়। ঠিকাদার টেন্ডার বাতিলের আবেদন করলে পূর্ববর্তী ডকুমেন্টস পর্যালোচনা করে টেন্ডারটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তবে, নতুনভাবে ভবন  নির্মাণের জন্য টেন্ডার করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
তবে, স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুক্তি রানী ধর বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁর ভাষ্য, টেন্ডার এর পরপরই তারা পুরনো ভবনটি নিলামে তুলে এবং ঠিকাদার আবুল কাশেম নিজেই সেটি নিলামে কেনেন। তাকে জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া হলেও তিনি কাজ শুরু করেননি। তিনি আমাদের জানিয়েছেন-এ কাজ করলে তার লোকসান হবে। তার গাফিলতির কারণেই আজ আমাদের এই সীমাহীন দুর্ভোগ। আমাদের দাবি- উর্ধতন  কর্তৃপক্ষ যাতে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন ভবন নির্মাণ ও পুরনো ভবনটি ঝুঁকিমুক্ত করে দেয়। অস্থায়ী শ্রেণিকক্ষ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেছি।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বিদ্যালয়টি ১৩৩ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৯২ সালে স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে একতলা বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মিত হয়। ভবনটির মধ্যে তিনটি শ্রেণিকক্ষ ও একটি ছোট কক্ষ রয়েছে। বর্তমানে ওই বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ১২৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ছয়জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে পাঁচজন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালে এ স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৭৮ থাকলেও মৃত্যু ঝুঁকির ভয় ও শ্রেণি কক্ষ সংকটসহ নানা কারণে বর্তমানে এ স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২৬ জনে গিয়ে ঠেকেছে । যা অতীতের চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ।
সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, স্কুল মাঠের পূর্ব প্রান্তে একতলা বিশিষ্ট একটি ভবনের তিনটি শ্রেণিকক্ষ ও একটি অফিস কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে এক সময় ছোট কক্ষে প্রাক-প্রাথমিকের ক্লাস নেওয়া হতো। এ কক্ষে ছাদ ও বিমের পলেস্তারা প্রায় সময় খসে পড়ায় এখন তাদের ক্লাস নেওয়া হচ্ছে শিক্ষক অফিসের মেঝেতে। ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক ফারজানা ববি। ভবনের দক্ষিণ পাশে বিমের পলেস্তারা খসে পড়েছে। এ ছাড়া বারান্দার কয়েকটি পিলারের অংশ ভেঙে রড বেরিয়ে এসেছে। ছোট কক্ষটির খসে পড়া পলেস্তারাগুলো সিমেন্ট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় সেই পুরনো ভবনের বেঞ্চগুলো শ্রেণিকক্ষগুলোতে থরেথরে সাজিয়ে রাখাই সংকুচিত হয়ে গেছে বসার স্থান।
সামান্য বৃষ্টিতে ছাদে জমে থাকা পানি চুইয়ে পড়ে শ্রেণি কক্ষে। এতে ভিজে যায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বই-খাতা, চেয়ার-টেবিলসহ সব কিছু। শ্রেণিকক্ষ সংকটের অভাবে গাদাগাদি করে ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। তবে ভবনের বয়স বেশি হওয়ায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। শ্রেণি কক্ষে বসে শিক্ষার্থীরা সবসময় আতঙ্কে থাকে কখন যেন ছাদ খসে পড়ে। বর্তমান স্কুল ভবনটির দক্ষিণ পাশে রয়েছে দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি বাথরুম। বাথরুম দু’টিও পরিপাটি নয়। কোন রকমে দায় সারেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। উত্তর পাশে নতুনভাবে নির্মিত হচ্ছে একটি ওয়াস ব্লক। যেটি এখনও চালু করা হয়নি।
অপরদিকে, স্কুল ভবনটি নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ শাহজাহান চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এলাকার লোকজন বিভিন্নভাবে চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য।
এ স্কুলের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদিত্য দাশ, সাফা মারওয়া, আবদুল্লাহ সাইফু ও সায়ন্তিকা চক্রবর্তীর ভাষ্য, ভবনটির অবস্থা মোটেও ভালো নয়। বৃষ্টি হলেই ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। ফলে তারা ঠিক মতো ক্লাস করতে পারে না। আবার ভয়ে থাকতে হয়, কখন ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।
শিক্ষক আবদুল মজিদ ও  ফারজানা ববির ভাষ্য, জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে বৃষ্টি হলে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে বসে থাকতে পারে না। ক্লাস করানো সম্ভব হয় না। কখনও কখনও তিন-চার বিষয়ের ক্লাসের পর তাদের ছুটি দিতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অভিভাবক জানান, স্কুল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তাদের সন্তানদের মৃত্যু ভয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে।
এ স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র মো.পারভেজ ও ইকবাল হোসেন জাহেদ জানান, টেন্ডার বাতিল হওয়ার পর শিক্ষা কর্মকর্তার গাফিলতি ও কোন পদক্ষেপ না থাকায় নতুন ভবন এখনও নির্মাণ হয়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও এলজিইডির প্রকৌশলীর যোগসাজশে চুক্তিটি বাতিল করা হয়। এর দায় সাবেক স্কুল কমিটি এড়াতে পারবে না। তাদের প্রত্যেককে জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন। কারণ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়াতে এই বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা অন্য বিদ্যালয়ে চলে যাচ্ছে। ২০২২ সালের দিকে এই বিদ্যালয়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল যা বর্তমানে তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।
এ স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ও জি বাংলা খ্যাত শুভ দাশের ভাষ্য, এ স্কুলে আমার শৈশব কেটেছে। এখন শুনছি স্কুলটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও অবহেলিত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. কামরুল বাশার ওমর ফারুক বলেন, শিক্ষা অফিসের গাফিলতির বিষয়টি আমার জানা নেই। কারণ আমি সম্প্রতি যোগদান করেছি। নতুন ভবন নির্মাণের বিষয়ে আমি উপজেলা প্রকৌশলীর সাথে কথা বলেছি। এ ছাড়াও বর্তমান ভবনটি সংস্কারের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। আশা করছি শীঘ্রই এ সমস্যার সমাধান হবে।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোন্দকার মাহমুদুল হাসান বলেন, উত্তর এওচিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টি আমি পরিদর্শন করেছি।  সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে বিষয়টি আমি তাদের নজরে এনেছি । উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে অনতিবিলম্বে দু’টি সেমিপাকা শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি সংস্কার করে দেওয়া হবে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে সহায়তার আশ্বাস প্রদান দিয়েছেন।