দি ক্রাইম ডেস্ক: ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে বিমানের হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্স। যে কোনো সময় সেখানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। আড়াই দশকের পুরোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ছয়টি ফায়ার পাম্প, ফোম লাইন ও ধোঁয়া শনাক্তকরণ যন্ত্র অচল হয়ে পড়ায় আশঙ্কা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ফায়ার সিস্টেম সচল থাকা বাধ্যতামূলক হলেও প্রায় পাঁচ বছর ধরে তা উপেক্ষিত রয়েছে। ফলে কোটি কোটি টাকার বিমান, যন্ত্রাংশ ও শতাধিক কর্মীর জীবন পড়েছে চরম ঝুঁকিতে।
ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি বিমানবন্দরকে নির্দিষ্ট মান বজায় রাখতে হলে কার্যকর অগ্নিনির্বাপক যানবাহন সার্ভিসেবল রাখা অত্যাবশ্যক। বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্ষণাবেক্ষণ, সার্ভিসিং ও মেরামতের কেন্দ্র হিসেবে হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্সে প্রায় প্রতিদিনই কয়েকটি করে বিমান রাখা হয়। অন্যদিকে কারিগরি কাজের জন্য হ্যাঙ্গারে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ ও রাসায়নিক পদার্থ মজুত থাকে। পাশাপাশি প্রতিদিন শতাধিক কর্মী সেখানে কাজ করেন। ফলে প্রতি মুহূর্তে হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্সে অগ্নিদুর্ঘটনার প্রস্তুতি রাখার কথা থাকলেও তা উপেক্ষিত হচ্ছে। এর ওপর হঠাত্ আগুন লাগলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোকাবিলার কোনো ব্যবস্থাও নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্স ভবন তৈরির সময় অগ্নিদুর্ঘটনা তাত্ক্ষণিকভাবে মোকাবিলার জন্য স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র স্থাপন করা হলেও গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে তা অচল হয়ে আছে। দুটি ওয়াটার রিজার্ভারের মধ্যে একটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। অন্যটিতে পানি সংরক্ষণ করা গেলেও পানি চলাচলের ছয়টি পাম্প অচল থাকায় তা কাজে আসছে না। হ্যাঙ্গারের কর্মীরা বলেছেন, ফোম পাম্পগুলো সচল থাকলেও পানির সরবরাহ ছাড়া আগুন নেভানো সম্ভব নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বলছেন, হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্সের স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র মেরামতের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েক দফায় লিখিত নথি পাঠানো হলেও আমলে নেওয়া হয়নি। যে কোনো সময় অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। সেই সঙ্গে হ্যাঙ্গারে থাকা কোটি কোটি টাকার বিমান ও যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সিভিল এভিয়েশনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, অগ্নিনির্বাপণের জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে পানির যে লাইন করা হয়েছে তা-ও অপ্রতুল। বিশেষ করে যেখানে যেখানে প্রয়োজন সেখানে নেই। আরও বাড়ানো দরকার। নেই পর্যাপ্ত সংখ্যক ফায়ার গাড়ি। বিমানের মতো একটা সেনসিটিভ এলাকায় এটা নেই সেটা নেই, এটা বলার সুযোগই নেই। যথেষ্ট পরিমাণে প্রস্তুতি থাকতে হবে।
তিনি বলেন, থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের সময় রানওয়ের ভেতরে পুকুর এবং যে ক্যানেলগুলো ছিল, সেসব ভরাট করে ফেলেছে। ভেতর থেকে পানি সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ দুর্ঘটনা ঘটলে প্রথম প্রতিরক্ষা হলো ঐ অগ্নিনির্বাপক যানবাহনসহ সংরক্ষিত পানি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক কর্মকর্তা জানান, হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্সের স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র মেরামতের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েক দফায় লিখিত নথি পাঠানো হলেও বিগত সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগী সিভিল এভিয়েশনের মেম্বার অপারেশনস অ্যান্ড প্ল্যানিং আবু সাইদ মেহবুব খান আমলে নেননি। তার কাছে কোনো ফাইল গেলে দাপট দেখিয়ে তিন থেকে চার মাসেও ফাইলে ইচ্ছাকৃতভাবে স্বাক্ষর করতে চান না।
এ ব্যাপারে আবু সাইদ মেহবুব খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ব্যবসায়ীরা রংচং দিয়ে সুযোগ নিতে চাচ্ছে। আমি কোনো নথি আটকে রাখি না। আমার কোনো দোষ নেই। সত্যের পথে দাঁড়ানো যদি দাপট হয় তাহলে আমার কিছু বলার নেই।’
এ বিষয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি বিমান কর্তৃপক্ষের নজরে আনার অনুরোধ করেন।
জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম বলেন, হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্সে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। সেখানে রয়েছে আগুন নেভানোর সব ধরনের উপকরণ।
এ প্রসঙ্গে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, পুরো এয়ারপোর্টের মালিকানা অনেকটা সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের। এয়ারপোর্টের ভেতরে অন্য কোনো সংস্থার কর্তৃত্ব নেই। এত বড় একটা দুর্ঘটনা যে ঘটে গেল এ নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আগুন নির্বাপণের কোনো ব্যবস্থাই দৃশ্যমান ছিল না। এটা পাবলিকের কথা নয়, আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানেরই কথা। কোনো গুজব নয়।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এয়ারপোর্টের মধ্যে সবসময় সার্বক্ষণিক জোরালো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, ফায়ার পাম্প, ফোম লাইন, ধোঁয়া শনাক্তকরণ যন্ত্র থাকতে হবে। পানির ব্যবস্থা রাখতে হয়। কিন্তু আমাদের এয়ার পোর্টে পানির ব্যবস্থা বন্ধ করে নানা রকম স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে আরও ঝুঁকি বাড়ছে।
সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা যায়, দেশের আট বিমানবন্দরে উদ্ধার ও অগ্নিনির্বাপক যানবাহন দীর্ঘদিন ধরে প্রায় অচল হয়ে পড়ে আছে—এমন অবস্থার কথা জানিয়ে বেবিচকের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্টোর ইউনিট গত বছরের ১ এপ্রিল প্রথম বেবিচক সদর দপ্তরে চিঠি দেয়। চিঠিতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সব বিমানবন্দরের অগ্নিনির্বাপক যান মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ৯ মে দ্বিতীয় বার চিঠি দেওয়া হয়। এভাবে একে একে ১৯ বার চিঠি পাঠানো হয়। প্রতিটি চিঠির বার্তা ছিল অভিন্ন। সর্বশেষ চিঠিটি দেওয়া হয় গত ৩১ জুলাই।