নিজস্ব প্রতিবেদক: সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে হতাহতের সংখ্যা এখনও বাড়ছে। অনেক খোঁজার পর দগ্ধ স্বজনকে ফিরে পাচ্ছেন কেউ, আবার কেউবা ফিরছেন স্বজনের নিথর দেহ নিয়ে। কিন্তু ঝলসে যাওয়া অনেকের পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দগ্ধ আরও ৩ জনকে নেওয়া ঢাকায় নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ডিপোতে আগুনে ৬৩ জনের চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। আজ মঙ্গলবার (০৭ জুন) ঘটনাস্থল থেকে আরও দু’জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া চমেক হাসপাতাল মর্গ থেকে ২৬ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখনও স্বজনদের বুক ফাটা কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। কেউ কেউ স্বজনদের দ্বগ্ধ লাশ চিনতে না পারায় বিলাপ করে কাঁদছে। আবার কেউ কেউ স্বজনের খোঁজে অনারবত কান্না করেই চলেছে। এরই মাঝে আজ মঙ্গলবার দুপুরে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুনের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। তিনি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে সাংবাদিকদের জানান।

জানা গেছে, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও আগুনে মৃত ২৬ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গত রোববার (৫ জুন) রাত থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত এসব লাশ হস্তান্তর করেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আজ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। কন্ট্রোল রুম সূত্রে আরও জানা যায়, এ ঘটনায় ২৩০ জন আহত হয়েছেন। তাদের ১৫ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী এবং ১০ জন পুলিশ সদস্য।

হস্তান্তর করা ২৬ জন হলেন- কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট থানাধীন সাতবাড়িয়া সামারা এলাকার শামসুল হকের ছেলে মনিরুজ্জামান (৫০), ভোলা জেলার সদর থানাধীন দক্ষিণ কালিয়া এলাকার হাবিবুর রহমান (২৩), বাঁশখালী উপজেলার চনুয়া মধুখালী এলাকার আবদুল মজিদের ছেলে রবিউল আলম (২৪), একই এলাকার ফরিদুল আলমের ছেলে মমিনুল হক (২৪), বাঁশখালী উপজেলার চারিয়াপাড়া এলাকার মাহমুদুর রহমানের ছেলে মহি উদ্দিন (২২), বাঁশখালী উপজেলার নাপুরা এলাকার হাসান আলীর ছেলে তোফায়েল ইসলাম (২২), নোয়াখালী জেলার টাটখীল থানাধীন শোল্লা বানসা এলাকার আবদুর রশিদের ছেলে আলাউদ্দিন (৩৫), সীতাকুণ্ড উপজেলার মধ্যম মহাদেবপুর এলাকার আফজাল হোসেনের ছেলে মো. সোলাইমান, নোয়াখালী জেলার সুধারাম থানাধীন নিজাম উদ্দিনের ছেলে মো. সুমন (২৮), যশোর বাঘারপাড়া থানাধীন নরসিংপুর এলাকার আবুল কাসেমের ছেলে ইব্রাহিম (২৭), পিরোজপুর জেলার মঠবাড়ী থানাধীন তুসখালী এলাকার মৃত সাত্তার জমাদ্দারের ছেলে ফারুক জমাদ্দার (৫০), চট্টগ্রামের হালিশহর থানাধীন নারিকেলতলা দক্ষিণ হালিশহর এলাকার আব্দুস সবুরের ছেলে হারুন অর রশিদ (৫৫), মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানাধীন পুটিকলিন এলাকার মো. আছির ছেলে মো. নয়ন (২২), চট্টগ্রামের মিরসরাই থানাধীন সোনাপাহাড় এলাকার ননামিয়া বাড়ির শাহজাহানের ছেলে শাহাদাত হোসেন (২৯), ফেনী জেলার ফুলগাজী থানাধীন আনন্দপুর এলাকার আমিন উল্লাহ জমাদ্দারের ছেলে শাহাদাত উল্লাহ জমাদ্দার, চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানাধীন পূর্ব চালিয়াপাড়া এলাকার জাফর মাহমুদের ছেলে মো. রিদুয়ান (২৫), চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থানাধীন কালাপানিয়া এলাকার মোবাসের ইসলামের ছেলে তৌহিদুল ইসলাম (৪১), ফেনী সদর থানাধীন নাসিমপুর এলাকার আবু ইউসুফের ছেলে সালা উদ্দিন কাদের চৌধুরী (৪২), খুলনার শুকধারা এলাকার আব্দুস সাত্তারের তরফদারের ছেলে শাকিল তরফদার (৪৫), রাঙ্গামাটি সদরের কাজাচুরা এলাকার চিত্তরঞ্জন চাকমার ছেলে নিপন চাকমা (৪৫), মানিকগঞ্জ শিবালয় এলাকার মো. পান্না মিয়ার ছেলে রানা মিয়া (২২), হালিশহর থানাধীন আব্দুস সবুরের ছেলে মো. হারুন (৫৫), শেরপুর সদরের মো. আকরাম হোসেনের ছেলে রমজানুল ইসলাম রনি, নাজিম উদ্দিন রুবেল, মিঠু দেওয়ান, মো. সোহেল। শেষের তিন জনের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত সোমবার ২১ জনের খোঁজে ৩৭ জন স্বজন নমুনা দিয়েছেন। আজ মঙ্গলবার আরও দুই জন স্বজন নমুনা দিয়েছেন। আজ মাত্র দুজন নমুনা দিয়েছেন। সারাদিনের অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেবো আমরা কাল বুধবার পর্যন্ত থাকবো কিনা। আমাদের সিআইডির টিম চলে যাওয়ার পর কোনও স্বজন নমুনা দিতে চাইলে ঢাকায় গিয়ে দিতে হবে।

এদিকে কিন্তু ঝলসে যাওয়া অনেকের পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তেমনি একজন আব্দুল মনির হোসেন। অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর থেকেই তার সন্ধানে মরিয়া হয়ে ছুটছেন পরিবার। এবার মনিরের সন্ধান চেয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছেন বড় ভাই মোহাম্মদ আলমগীর। আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় চমেক হাসপাতালের সামনে ব্যানার নিয়ে দাঁড়ান তিনি।

আলমগীর জানান, বিএম কনটেইনার ডিপোতে এফএলটি অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন আমার ভাই। অগ্নিকান্ডের খবর রাতেই বাড়িতে জানিয়েছিল সে। তার শেষ কথা ছিল- বেঁচে থাকলে পরে দেখা হবে। পরে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। আমি চট্টগ্রামে এসে চমেক হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ করেও ভাইয়ের সন্ধান পাইনি। তার কী পরিণতি হয়েছে জানি না। অন্তত আমার ভাইয়ের লাশটা এনে দেন। কিছুটা শান্তি লাগবে। ভাইয়ের পরিচয় জানতে গত সোমবার আমার ডিএনএ নমুনা দিয়েছি।

এর আগে গত শনিবার রাতে অগ্নিকান্ডের সময় বাড়িতে ফোন দিয়েছিলেন মনির। তখন একটু পরপর বিস্ফোরণ হচ্ছিল। এক পর্যায়ে বেঁচে থাকলে পরে কথা হবে বলে ফোনের লাইন কেটে দেন। এরপর বিএম কন্টেইনার ডিপো ছাড়াও সীতাকুন্ড হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছেন। কিন্তু কোথাও আব্দুল মনিরের সন্ধান পায়নি পরিবার। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে মনির সবার ছোট। গতবছর বিয়ে করেছিলেন তিনি। বর্তমানে তার স্ত্রী চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

অন্যদিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ আরও তিনজনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়েছে।গত সোমবার রাতে তাদের শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। তারা হলেন- এনামুল (২৫), বদরুজ্জামান রুবেল (১৮) ও মো. সুমন (৩৪)। এর আগে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুন থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে এখন পর্যন্ত দগ্ধ মোট ১৭ জনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নগরীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আগুনে পুড়ে এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ৯ সদস্যসহ নিহত হয়েছেন ৪৩ জন। আহত হয়েছেন অন্তত আরও দুই শতাধিক। গতকাল দুপুরে ডিপোর আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

এদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যারা দোষী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আজ মঙ্গলবার দুপুরে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন আইজিপি।

তিনি বলেন, ডিপোতে কাজ করতে গিয়ে কর্মীরা আহত হয়েছেন এবং ফায়ারম্যান ও পুলিশ উদ্ধার করতে গিয়ে আহত হয়েছে। এরমধ্যেই তদের চিকিৎসায় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ উদ্যোগ গ্রণ করেছেন। এখনো এখান থেকে ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। অতএব স্থানটি এখনো নিরাপদ না। আশা করছি সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে সম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে পারবো।

আইজিপি বলেন, সরকারিভাবে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আরেকটি ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বিএম ডিপোতে দুর্ঘটনার তিনদিন পর পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও ব্রিফিং সেন্টার খুলেছে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার সেন্টারের সামনে গতকাল মঙ্গলবার সকালে তারা এ বুথ চালু করে। এর আগে কনটেইনার ডিপোর আগুন ৬১ ঘণ্টা পর তা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তারা বলছে, এই ডিপো থেকে আর কোনো বড় ধরনের বিপদ হওয়ার আশঙ্কা নেই।

গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেডের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম হিমেল এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গত রোববার সকাল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের প্রায় দুই শতাধিক সদস্য বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে কাজ করছে। ডিপোতে এসে আমরা ফায়ার সার্ভিসকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। এখন যে আগুনটা আছে তা প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের কিছুটা সময় বেশি লেগেছে।

তবে আজ মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল পরিচালকের দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ নুরুল হক বলেন, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও আগুনে ৬৩ জনের চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এদের মধ্যে ৬ জনের চোখের সমস্যা গুরুতর।

তিনি বলেন, চোখে আঘাত পাওয়া ৬ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানোর প্রয়োজন। তাদের একজনকে দেশের বাইরে পাঠানো হতে পারে।

জানা গেছে, বিএম কন্টেইনার ডিপো থেকে আরও দুটি মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া বেশ কয়েকজনের হাড়েও উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার লাশ দুটি মর্গে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।

আজ মঙ্গলবার বিষয়টি নিশ্চিত করে ফায়ার কর্মকর্তা আনিসুর রহমান জানান, বিএম ডিপোর ঠিক যেখানে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত, আর যেখানে সবচেয়ে বেশি ধংসযজ্ঞ হয়েছে, ঠিক সেখানে আজ উদ্ধার কাজ চালানো হচ্ছে। এসময় সেখানে দুটি লাশের সন্ধান মেলে। পাশাপাশি আরো বেশ কিছু হাড়, পোড়া মাংস ছড়িয়ে আছে, ধীরে ধীরে সেগুলো বের করা হবে।

তিনি আরও জানান, লাশ দুটি অ্যাম্বুলেন্সযোগে চমেকের মর্গে পাঠিয়ে দেয়া হয়। লাশ দুটির মধ্যে একটি ওই ডিপোর নিরাপত্তাকর্মী হতে পারে বলে পোশাক দেখে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যটির পাশে ফায়ার সার্ভিসের নিরাপত্তা পোশাক, হেলমেট ইত্যাদি ছিলো। যা দেখে ফায়ার সার্ভিস কর্মী বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ডিএনএ টেষ্ট করে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করা হবে।

নিজস্ব প্রতিবেদক: সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে হতাহতের সংখ্যা এখনও বাড়ছে। অনেক খোঁজার পর দগ্ধ স্বজনকে ফিরে পাচ্ছেন কেউ, আবার কেউবা ফিরছেন স্বজনের নিথর দেহ নিয়ে। কিন্তু ঝলসে যাওয়া অনেকের পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দগ্ধ আরও ৩ জনকে নেওয়া ঢাকায় নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ডিপোতে আগুনে ৬৩ জনের চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। আজ মঙ্গলবার (০৭ জুন) ঘটনাস্থল থেকে আরও দু’জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া চমেক হাসপাতাল মর্গ থেকে ২৬ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখনও স্বজনদের বুক ফাটা কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। কেউ কেউ স্বজনদের দ্বগ্ধ লাশ চিনতে না পারায় বিলাপ করে কাঁদছে। আবার কেউ কেউ স্বজনের খোঁজে অনারবত কান্না করেই চলেছে। এরই মাঝে আজ মঙ্গলবার দুপুরে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুনের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। তিনি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে সাংবাদিকদের জানান।

জানা গেছে, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও আগুনে মৃত ২৬ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গত রোববার (৫ জুন) রাত থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত এসব লাশ হস্তান্তর করেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আজ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। কন্ট্রোল রুম সূত্রে আরও জানা যায়, এ ঘটনায় ২৩০ জন আহত হয়েছেন। তাদের ১৫ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী এবং ১০ জন পুলিশ সদস্য।

হস্তান্তর করা ২৬ জন হলেন- কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট থানাধীন সাতবাড়িয়া সামারা এলাকার শামসুল হকের ছেলে মনিরুজ্জামান (৫০), ভোলা জেলার সদর থানাধীন দক্ষিণ কালিয়া এলাকার হাবিবুর রহমান (২৩), বাঁশখালী উপজেলার চনুয়া মধুখালী এলাকার আবদুল মজিদের ছেলে রবিউল আলম (২৪), একই এলাকার ফরিদুল আলমের ছেলে মমিনুল হক (২৪), বাঁশখালী উপজেলার চারিয়াপাড়া এলাকার মাহমুদুর রহমানের ছেলে মহি উদ্দিন (২২), বাঁশখালী উপজেলার নাপুরা এলাকার হাসান আলীর ছেলে তোফায়েল ইসলাম (২২), নোয়াখালী জেলার টাটখীল থানাধীন শোল্লা বানসা এলাকার আবদুর রশিদের ছেলে আলাউদ্দিন (৩৫), সীতাকুণ্ড উপজেলার মধ্যম মহাদেবপুর এলাকার আফজাল হোসেনের ছেলে মো. সোলাইমান, নোয়াখালী জেলার সুধারাম থানাধীন নিজাম উদ্দিনের ছেলে মো. সুমন (২৮), যশোর বাঘারপাড়া থানাধীন নরসিংপুর এলাকার আবুল কাসেমের ছেলে ইব্রাহিম (২৭), পিরোজপুর জেলার মঠবাড়ী থানাধীন তুসখালী এলাকার মৃত সাত্তার জমাদ্দারের ছেলে ফারুক জমাদ্দার (৫০), চট্টগ্রামের হালিশহর থানাধীন নারিকেলতলা দক্ষিণ হালিশহর এলাকার আব্দুস সবুরের ছেলে হারুন অর রশিদ (৫৫), মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানাধীন পুটিকলিন এলাকার মো. আছির ছেলে মো. নয়ন (২২), চট্টগ্রামের মিরসরাই থানাধীন সোনাপাহাড় এলাকার ননামিয়া বাড়ির শাহজাহানের ছেলে শাহাদাত হোসেন (২৯), ফেনী জেলার ফুলগাজী থানাধীন আনন্দপুর এলাকার আমিন উল্লাহ জমাদ্দারের ছেলে শাহাদাত উল্লাহ জমাদ্দার, চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানাধীন পূর্ব চালিয়াপাড়া এলাকার জাফর মাহমুদের ছেলে মো. রিদুয়ান (২৫), চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থানাধীন কালাপানিয়া এলাকার মোবাসের ইসলামের ছেলে তৌহিদুল ইসলাম (৪১), ফেনী সদর থানাধীন নাসিমপুর এলাকার আবু ইউসুফের ছেলে সালা উদ্দিন কাদের চৌধুরী (৪২), খুলনার শুকধারা এলাকার আব্দুস সাত্তারের তরফদারের ছেলে শাকিল তরফদার (৪৫), রাঙ্গামাটি সদরের কাজাচুরা এলাকার চিত্তরঞ্জন চাকমার ছেলে নিপন চাকমা (৪৫), মানিকগঞ্জ শিবালয় এলাকার মো. পান্না মিয়ার ছেলে রানা মিয়া (২২), হালিশহর থানাধীন আব্দুস সবুরের ছেলে মো. হারুন (৫৫), শেরপুর সদরের মো. আকরাম হোসেনের ছেলে রমজানুল ইসলাম রনি, নাজিম উদ্দিন রুবেল, মিঠু দেওয়ান, মো. সোহেল। শেষের তিন জনের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত সোমবার ২১ জনের খোঁজে ৩৭ জন স্বজন নমুনা দিয়েছেন। আজ মঙ্গলবার আরও দুই জন স্বজন নমুনা দিয়েছেন। আজ মাত্র দুজন নমুনা দিয়েছেন। সারাদিনের অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেবো আমরা কাল বুধবার পর্যন্ত থাকবো কিনা। আমাদের সিআইডির টিম চলে যাওয়ার পর কোনও স্বজন নমুনা দিতে চাইলে ঢাকায় গিয়ে দিতে হবে।

এদিকে কিন্তু ঝলসে যাওয়া অনেকের পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তেমনি একজন আব্দুল মনির হোসেন। অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর থেকেই তার সন্ধানে মরিয়া হয়ে ছুটছেন পরিবার। এবার মনিরের সন্ধান চেয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছেন বড় ভাই মোহাম্মদ আলমগীর। আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় চমেক হাসপাতালের সামনে ব্যানার নিয়ে দাঁড়ান তিনি।

আলমগীর জানান, বিএম কনটেইনার ডিপোতে এফএলটি অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন আমার ভাই। অগ্নিকান্ডের খবর রাতেই বাড়িতে জানিয়েছিল সে। তার শেষ কথা ছিল- বেঁচে থাকলে পরে দেখা হবে। পরে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। আমি চট্টগ্রামে এসে চমেক হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ করেও ভাইয়ের সন্ধান পাইনি। তার কী পরিণতি হয়েছে জানি না। অন্তত আমার ভাইয়ের লাশটা এনে দেন। কিছুটা শান্তি লাগবে। ভাইয়ের পরিচয় জানতে গত সোমবার আমার ডিএনএ নমুনা দিয়েছি।

এর আগে গত শনিবার রাতে অগ্নিকান্ডের সময় বাড়িতে ফোন দিয়েছিলেন মনির। তখন একটু পরপর বিস্ফোরণ হচ্ছিল। এক পর্যায়ে বেঁচে থাকলে পরে কথা হবে বলে ফোনের লাইন কেটে দেন। এরপর বিএম কন্টেইনার ডিপো ছাড়াও সীতাকুন্ড হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছেন। কিন্তু কোথাও আব্দুল মনিরের সন্ধান পায়নি পরিবার। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে মনির সবার ছোট। গতবছর বিয়ে করেছিলেন তিনি। বর্তমানে তার স্ত্রী চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

অন্যদিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ আরও তিনজনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়েছে।গত সোমবার রাতে তাদের শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। তারা হলেন- এনামুল (২৫), বদরুজ্জামান রুবেল (১৮) ও মো. সুমন (৩৪)। এর আগে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুন থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে এখন পর্যন্ত দগ্ধ মোট ১৭ জনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নগরীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আগুনে পুড়ে এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ৯ সদস্যসহ নিহত হয়েছেন ৪৩ জন। আহত হয়েছেন অন্তত আরও দুই শতাধিক। গতকাল দুপুরে ডিপোর আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

এদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যারা দোষী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আজ মঙ্গলবার দুপুরে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন আইজিপি।

তিনি বলেন, ডিপোতে কাজ করতে গিয়ে কর্মীরা আহত হয়েছেন এবং ফায়ারম্যান ও পুলিশ উদ্ধার করতে গিয়ে আহত হয়েছে। এরমধ্যেই তদের চিকিৎসায় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ উদ্যোগ গ্রণ করেছেন। এখনো এখান থেকে ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। অতএব স্থানটি এখনো নিরাপদ না। আশা করছি সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে সম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে পারবো।

আইজিপি বলেন, সরকারিভাবে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আরেকটি ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বিএম ডিপোতে দুর্ঘটনার তিনদিন পর পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও ব্রিফিং সেন্টার খুলেছে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার সেন্টারের সামনে গতকাল মঙ্গলবার সকালে তারা এ বুথ চালু করে। এর আগে কনটেইনার ডিপোর আগুন ৬১ ঘণ্টা পর তা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তারা বলছে, এই ডিপো থেকে আর কোনো বড় ধরনের বিপদ হওয়ার আশঙ্কা নেই।

গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেডের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম হিমেল এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গত রোববার সকাল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের প্রায় দুই শতাধিক সদস্য বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে কাজ করছে। ডিপোতে এসে আমরা ফায়ার সার্ভিসকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। এখন যে আগুনটা আছে তা প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের কিছুটা সময় বেশি লেগেছে।

তবে আজ মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল পরিচালকের দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে চক্ষু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ নুরুল হক বলেন, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও আগুনে ৬৩ জনের চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এদের মধ্যে ৬ জনের চোখের সমস্যা গুরুতর।

তিনি বলেন, চোখে আঘাত পাওয়া ৬ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানোর প্রয়োজন। তাদের একজনকে দেশের বাইরে পাঠানো হতে পারে।

জানা গেছে, বিএম কন্টেইনার ডিপো থেকে আরও দুটি মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া বেশ কয়েকজনের হাড়েও উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার লাশ দুটি মর্গে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।

আজ মঙ্গলবার বিষয়টি নিশ্চিত করে ফায়ার কর্মকর্তা আনিসুর রহমান জানান, বিএম ডিপোর ঠিক যেখানে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত, আর যেখানে সবচেয়ে বেশি ধংসযজ্ঞ হয়েছে, ঠিক সেখানে আজ উদ্ধার কাজ চালানো হচ্ছে। এসময় সেখানে দুটি লাশের সন্ধান মেলে। পাশাপাশি আরো বেশ কিছু হাড়, পোড়া মাংস ছড়িয়ে আছে, ধীরে ধীরে সেগুলো বের করা হবে।

তিনি আরও জানান, লাশ দুটি অ্যাম্বুলেন্সযোগে চমেকের মর্গে পাঠিয়ে দেয়া হয়। লাশ দুটির মধ্যে একটি ওই ডিপোর নিরাপত্তাকর্মী হতে পারে বলে পোশাক দেখে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যটির পাশে ফায়ার সার্ভিসের নিরাপত্তা পোশাক, হেলমেট ইত্যাদি ছিলো। যা দেখে ফায়ার সার্ভিস কর্মী বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ডিএনএ টেষ্ট করে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করা হবে।