পংকজ কুমার দস্তিদার: চট্টগ্রাম নগরের প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতায় এখানে প্রতিবছর বিপুল সম্পদহানি হয়। নগরবাসী যুগের পর যুগ ধরে কষ্ট ভোগ করছে এ নগরেই জুড়ে বসা এক শ্রেণীর অবৈধ দখলদারের সৃষ্ট সমস্যার কারণে। এজন্য এটাকে ‘ম্যান মেড মিজারি’ বা মানবসৃষ্ট দুর্ভোগ বলা হয়। জনজীবনে প্রতিবছর বিপর্যয় নেমে আসে বর্ষা-বাদলের তিন মাস। বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায় নগরের প্রায় অর্ধেক এলাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতি হয় শুলকবহর, চান্দগাঁও, নাসিরাবাদ, মোহরা, ষোলশহর, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, বাকলিয়া, হালিশহর, আগ্রাবাদ, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ। শেষোক্ত তিনটি এলাকায় দেশের ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার। বাজারের গুদামে পানি ঢুকে হাজার কোটি টাকার ভোগ্যপণ্য নষ্ট হয় প্রতি বর্ষা মৌসুমে। বৃষ্টির পানি আর জোয়ারের পানিতে সয়লাব হয় চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ-কোরবানীগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার, গুদাম, দোকান, অফিস, বাড়িঘর। কোমর পানিতে ডুবে যায় বিভিন্ন প্রকার আমদানি পণ্য, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন প্রকার মসলা, শুঁটকি, চাল, ডাল, গম, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, কাঁচা মরিচ, লাল মরিচ ইত্যাদি।
মানব সৃষ্ট কেন বলা হচ্ছে জলাবদ্ধতাকে। এটা এ কারণে বলা হয় যে, নগরীর প্রধান নদী কর্ণফুলী এবং রাজাখালী ও চাক্তাই খালসহ এ নদীর অনেক উপনদী বেদখলে ভরাট হয়ে গেছে। নদী খালের পানি-প্রবাহ প্রচণ্ডরূপে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নগরে অসংখ্য ছোটবড় পাহাড় ছিল। এগুলো অবৈধ দখলে নিয়ে প্রভাবশালীরা লেভেল করে ফেলেছে, আবাসন ও শিল্পকারখানা গড়ে তুলেছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এক জরিপে বলা হয়েছে শুধু কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়েই দখলদারদের অবৈধ স্থাপনা ২৫০০ এর বেশি। কর্ণফুলী নদীকে দেশের অর্থনীতির জীবন প্রবাহ বলা হয়। ২০১৫ সালের ঐ জরিপে বলা হয়েছে, নদীটাকে গিলে খাচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি ২৫০০ এর বেশি অবৈধ স্থাপনা। উচ্চ আদালতের নির্দেশে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এ নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে গিয়ে এসব অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে। নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা এসব অবৈধ স্থাপনা নদী দখলের পাশাপাশি নদী দুষণও ঘটাচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর মোহনাতেই দেশের প্রধান বন্দর চট্টগ্রাম বন্দর। বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী নদীর মোহনায় প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয় অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। এ কারণে চট্টগ্রাম পুরো দেশের প্রাণ। চট্টগ্রামকে ছাড়া দেশের সমৃদ্ধি যেমন সম্ভব নয়। তেমনি মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশের কাতারে যাওয়াও সম্ভব নয়। একারণে কর্ণফুলী নদী রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদসহ দুষণ বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরাও। তৎকালীন (২০১৫) জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিনের পক্ষ থেকে নদীর মোহনা থেকে মোহরা পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার জুড়ে নদীর দুই তীরে সীমানা নির্ধারণের কাজ করতে গিয়ে ২৫০০ অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়। ২০১০ সালে একটি বেসরকারি সংগঠন কর্তৃক জনস্বার্থে দায়ের করা একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে নদীর পাড়ের এসব অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছিল। এছাড়া ২০১০ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপে নদীতীরে গড়ে ওঠা ১৪১টি ছোটবড় কারখানাকে কর্ণফুলী দুষণের জন্য দায়ী করা হয়। কর্ণফুলীর পাড়ে শত শত একর জমি দখল করে রেখেছে যারা সেই প্রভাবশালীদের দলে রয়েছে ব্যবসায়ী, পুলিশ, আইনজীবী এবং বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত কিছু নেতাকর্মী।
গত তিন দশক ধরে জলাবদ্ধতা নগরবাসীর ললাটের লিখন হয়ে রয়েছে। এ অবস্থা থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার স্থানীয় তিনটি সংস্থাকে ১০,০০০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন ও আর্থিক বরাদ্দ দিয়েছে। প্রকল্প তিনটি হলো- (ক) চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) ৫৬১৬ কোটি টাকার নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প, (খ) পানি উন্নয়ন বোর্ড এর ২৫৯৫ কোটি টাকার প্রকল্প ও (গ) চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১২৫৬ কোটি টাকার বহদ্দারহাট বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্প। ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তৈরি করা ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত ২.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খননের সুপারিশ করা হয়েছিল। এর প্রায় দুই দশক পর ২০১৪ সালের জুনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩২৬ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকার বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্প অনুমোদন দেয়। অর্থাভাবে চসিক এর এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৭ সালে এ প্রকল্প সংশোধন করে ১২৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে খাল খনন কাজ ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু দ্বিতীয় দফায়ও কোন অগ্রগতি হয়নি। ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল এই প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী এনে ১৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প অনুমোদন দেয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক সভা। ১২৫৬ কোটি টাকার প্রকল্পে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে প্রকল্প ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ সরকারি তহবিল থেকে এবং ২৫ শতাংশ চসিক তহবিল থেকে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু সর্বশেষ সংশোধিত প্রকল্পের সম্পূর্ণ টাকা অর্থাৎ ১৩৬২ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খনন করে খালের উভয় পাড়ে ২০ ফুট প্রস্তের সড়ক ও ৬ ফুট করে ফুটপাত তৈরি করা হবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম গত বছর ২৭ নভেম্বর নগরীর মাইজপাড়ায় খালখনন প্রকল্প কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ৪ বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুনে খাল খনন সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়।
জলাবদ্ধতার মূল যে প্রকল্প সেটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে ৫৬১৬ কোটি টাকার এই প্রকল্পেও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকল্পটির কাজে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল ইউনিট। চউক প্রকল্প কাজ সেনা প্রকৌশল ইউনিটকে হস্তান্তরকালে জানিয়েছিল কাজ সম্পন্ন হবে ২০২০ সালের জুন মাসে। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রায় দুই বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে কাজ তেমন হয়নি। তাছাড়া কাজের আওতা কিছুটা বেড়ে গেছে। তার মানে আসন্ন বর্ষা মৌসুমেও নগরবাসী জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে না। ৬০ বর্গ কিলোমিটারের চট্টগ্রাম নগরের একটি বড় অংশ হাঁটু থেকে কোমর পানিতে ডুববে আবার, এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রায় ৬০০০ কেটি টাকার চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকল্পটিতে বলা হয়েছে, নগরের ৩৬টি খালের কোনো অস্তিত্বই নেই। এসব খাল পুনরুদ্ধার করতে হবে ব্রিটিশ আমলের আর এস (রয়েল সার্ভে) খতিয়ানের ভিত্তিতে। সে মোতাবেক খালগুলো পুনঃখনন করে প্রায় ৮৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৫ ফুট প্রস্ত রাস্তা নির্মাণ করা হবে। যেহেতু এই খাল এবং সংযুক্ত নালাগুলো পাহাড় কাটা পলিতে ভরাট হয়ে গেছে সে কারণে খালগুলো পানি প্রবাহ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। যার কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। চউক বলেছে নগরের ৩৩টি খাল ৫০ বছরে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মাত্র ৩৭টি খালের অস্তিত্ব এখনো আছে। সংস্কারের জরুরি পদক্ষেপ না নিলে সে খালগুলোও হারিয়ে যাবে নিকট ভবিষ্যতে। সিডিএর প্রকল্পে খাল খনন ছাড়াও তিনটি ভূগর্ভস্থ বিশাল আকৃতির জলাধার নির্মাণ করা হবে, চাক্তাই খাল-কালুরঘাট সেতু বরাবর আউটার রিং রোড নির্মাণ করা হবে।
এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের জলাবদ্ধতা নিরাময় প্রকল্পের আওতায় ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ নির্মাণ করা হবে। পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি থেকে ১৫নং ঘাট বিমান বন্দর খাল পর্যন্ত, সাড়ে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ নির্মাণ করা হবে কালুরঘাট সেতু থেকে কাটাখালি পর্যন্ত, ৮.৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ নির্মাণ করা হবে বিমানবন্দর খাল থেকে নেভি প্রান্ত পর্যন্ত এবং সাড়ে ৪ কিলোমিটার বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ করা হবে বাংলাবাজার থেকে কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর বাকলিয়া পয়েন্ট পর্যন্ত।




