সেলিম উদ্দিন, ঈদগাঁও: কক্সবাজারের ঈদগাঁও থানায় একটি অস্ত্র মামলা নিয়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যেটি এলাকার মানুষের মধ্যে হতবাক হওয়ার মতো কান্ড ঘটিয়েছে । এমনকি বাংলা সিনেমার দৃশ্যমান কাহিনিকেও হার মানিয়েছে।
ঘঠনা বিবরণে জানা গেছে, গত ১৩ অক্টোবর সকাল সাতটার পরপরই ঈদগড়-বাইশারী যাওয়ার রাস্তার মাথা থেকে সিএনজি ভাড়া নিয়েছিল পাবলিক ছদ্মবেশে এক পুলিশ সদস্য। এক মিনিট গাড়ী চালানোর পর পানির বোতলের বাহানা দিয়ে সিএনজি থামিয়ে দেয় গাড়ীতে থাকা ঐ পুলিশ সদস্য। পরে ছদ্মবেশে থাকা পুলিশ নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে ড্রাইভারকে পানির জন্য পাঠানো হয় একটি দোকানে। এরই ফাঁকে সিএনজির পিছনে অস্ত্র রেখে নামিয়ে পড়েন ঐ পুলিশ সদস্য। সিএনজির ড্রাইভার পানি নিয়ে আসা মাত্রই পরিকল্পিতভাবে আগে থেকে ঔৎপেতে থাকা পুলিশরা দৌঁড়ে এসে ড্রাইভার জাফর আলমকে ধরে ফেলে। পরে তাকে সিএনজিতে নিয়ে গিয়ে সিএনজির পিছনে ঢুকিয়ে দেয়া অস্ত্রটি বের করে জোরপূর্বক অস্ত্রটি তার দাবি করে ফাঁসানোর জন্য জোর জবরদস্তি করতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের। বাধ্য হয়ে সিএনজি চালককে গালি দিয়ে অস্ত্রটি হাতে তুলে দিয়ে ছবি তুলতে দেখা যায়। সিএনজি চালক জাফর আলম এতটাই নিরুপায় যে, ঘটনাস্থলে সে একেবারেই হতবিহ্বল ও দুর্বল হয়ে পড়ে। এ জঘন্য ঘঠনাটি ঘটে ঈদগাঁও বাস স্ট্যান্ডের আনু মিয়া ফিলিং স্টেশনের একেবারেই সামনে।
সিসিটিভি ফুটেজে যা স্পষ্ট দেখা যায় যে, সিএনজি থামানোর পর কী কী ঘটনা ঘটে।
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় , ঘটনাস্থলে যাদের নেতৃত্বে ফাঁসানো হয়েছিল এদের মধ্যে পুলিশ উপ-পরিদর্শক (এসআই) বদিউল আলম, ওসির গান ম্যান কনস্টেবল তানভীর ও কনস্টেবল মনির। এই ঘটনায় স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এরা তিনজনই অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো কান্ডে জড়িত ছিল। এমন ঘটনার অনুসন্ধান করতে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় সংগ্রহ করা সিসিটিভি ফুটেজে নিশ্চিত করা হয় ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রমাণ। এদিকে সিসিটিভি ফুটেজের সাথে মিল রেখে নিশ্চিত হতে জাফর আলমের পরিবারের সাথেও কথা বলা হয়।
ঈদগাঁও ইসলামপুর ইউনিয়নের ভিলিজারপাড়া ফু’দনির ছোঁয়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায় যে, জরাজীর্ণ একটি ঘরে বসবাস করেন জাফর আলম, তার স্ত্রী রাবেয়া ও মেয়ে লীজা মনি। পাশাপাশি বসবাস করেন রাবেয়ার বোন মিনাহার ও মেয়ে রদিয়া নুর। তাদের বক্তব্যের সাথে ঘটনার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, ঘটনাটি পরিকল্পিত এবং ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো।
জাফর আলমের স্ত্রী রাবেয়া কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, আমার মেয়ে লীজা মনি এবং আমার বোনের মেয়ে রদিয়া নুর দু’জনেই ঈদগাঁও আদর্শ শিক্ষা নিকেতনে পড়ালেখা করেন। দীর্ঘদিন ধরে যাতায়াত পথে স্থানীয় বকাটে ছেলে শাহীন প্রকাশ বাপ্পি, ও রাসেল মিলে ইভটিজিং করত প্রতিনিয়ত। এমন ঘটনাটি বারবার হওয়ায় এবং মেয়েদের স্কুলে যেতে বাঁধা হওয়া দুই বকাটে যুবকের বিরুদ্ধে একটি ইভটিজিং মামলা দায়ের করি। এ ঘটনায় একজন গ্রেপ্তারও হয়। পরে স্থানীয়ভাবে অনেকেই আপোষ মিমাংসার কথা বলে বলে হুমকিও প্রদর্শন করে আসছিল ঐ যুবকদের পরিবার। কিন্তু বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ানোর কারণেই শেষ করা সম্ভব হয়নি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে আমার স্বামীকে পুলিশের সাথে দুই লাখ টাকা দিয়ে কন্টাক্টে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে জেলখানায় পাঠানো হয়। আমার স্বামী কখনোও এমন জঘন্য কাজ করতে পারেনা। এলাকার সবাই জানে আমার স্বামী কেমন মানুষ। আমার স্বামী একদিন সিএনজি না চালালে আমরা উপবাস থাকার মতো অবস্থা। এমন সময় আমার স্বামীকে উপপরিদর্শক (এসআই) বদিউল আলম, কনস্টেবল তানভীর ও কনস্টেবল মনির মিলে টাকা নিয়ে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। তবে বিষয়টি প্রথমে কোন ডকুমেন্টস না পাওয়ায় এই পুলিশদের বিরুদ্ধে কিছু করা সম্ভব ছিলনা। এখন আমাদের এবং আপনাদের হাতে দীর্ঘ প্রচেষ্টার মাধ্যমে ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন আইনীভাবে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়েছি। আগে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ সুপার বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করব। পরে এসআই বদিউল আলম’সহ দুই পুলিশ কনস্টেবলের বিরুদ্ধে মামলা করব।
একইভাবে ঈদগাঁও আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের ৬ষ্ট শ্রেণীর শিক্ষার্থী লীজা মনি কান্না করে বলেন যে, আমরা ইভটিজারদের কবলে পড়ে আছি দীর্ঘদিন ধরে। আমাদের স্কুলে যাওয়া আসা বন্ধ হয়ে গেছে। শাহীন প্রকাশ বাপ্পি ও রাসেলের কারণে স্কুলে যেতে পারছিনা। তারা আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ইভটিজিং করার দায়ে মামলাও হয়। মামলা হওয়ার পর থেকেই আমরা রাতে ঘরে পর্যন্ত বসবাস করতে পারছিনা। রাতে আমাদের টিনের বাড়িঘর সব কেটে রান্নার চুলা, মরিচ মসলা পর্যন্ত চুরি করে নিয়ে যায় তাদের নেতৃত্বে । রাতের বেলায় টিনের উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করার কারণে অন্য বাসায় থাকতে হয়। আমাদের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন চালিয়ে আসছে। তারা আমাদের প্রতি ক্ষোভে পুলিশের সাথে কন্টাক্ট করে আমার বাবা মতো একজন, নিরীহ মানুষকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। যা এখন সব প্রমাণ হয়ে গেছে। এখন থানা পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ কোথাও না দিতে কান্নাকাটি শুরু করে দিচ্ছে। যদিওবা এই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ দিলে আমাদের পুরো পরিবারকে আরও বিভিন্ন মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়েছে। আমরা আমার বাবার বিরুদ্ধে ফাঁসানো মামলা থেকে মুক্তি চাই। আমরা না খেয়ে না ঘুমিয়ে দিনযাপন করছি। আমরা এসআই বদিউল আলম, তানভীর ও মনিরের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেয়েছি। সিসিটিভি ফুটেজ সব দেখা যাচ্ছে। কীভাবে ফাঁসানো হয়েছে।
এবিষয়ে স্থানীয় অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, জাফর আলম একজন ভাড়াটিয়া সিএনজি ড্রাইভার। সে যেমন সৎ তেমন অমায়িক একজন মানুষ। স্থানীয় বকাটে যুবকদের পরিবারের দীর্ঘদিনের ক্লেশ থেকেই পুলিশের সাথে চুক্তি করে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে। এটি স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে এখন। এসব পুলিশদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। না হয় যে কাউকে তারা এইভাবে কন্টাক্টে ফাঁসিয়ে দিবে। তারা জড়িতদের প্রত্যাহারের পাশাপাশি শাস্তির দাবিও জানান। পাশাপাশি জাফর আলমের মুক্তির দাবি করে ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়।
এদিকে ঈদগাঁও থানার পুলিশ উপপরিদর্শক (এসআই) বদিউল আলমের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি ক্যামরার সামনে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং উপরের নিষেধ আছে বলেও দাবি করেন। তবে গোপন ক্যামরার সংবাদ প্রকাশ না করার যে আকুতি মিনতিসহ যাবতীয় সম্পুর্ন কথা উঠে আসে।
তিনি বলেন, এটি সম্পুর্ন মিথ্যা এবং বানোয়াট। তবে এই মামলায় আরেকজন জড়িত থাকার কথা বললেও এজাহারের সাথে কোন মিল নাই। পাশাপাশি অজ্ঞাত কোন আসামির তালিকাও নাই। পুরো হযবরল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে নিউজ করে হয়রানি না করতেও জোর তদবির করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন মাধ্যমে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) বদিউল আলম’সহ অন্যান্যরা। একইভাবে ওসির গানম্যান দাবি করেন যে,এটি ওসি ফরিদা ইয়াসমিন স্যারের মাধ্যমেই হয়েছে। এই কথা বলার সাথে সাথে মোবাইল কেটে দেন।
এবিষয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপারের (মুখপাত্র) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অলক বিশ্বাস বলেন, এমন ঘটনা ন্যাক্কারজনক। কিছু কিছু পুলিশ সদস্য আমাদের মান ক্ষুন্ন করতে এমন কান্ড ঘটায়। যার কারণে আমাদের বদনাম হয়। আমরা এবিষয়ে অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিব।
Post Views: 49




