ড. মাহরুফ চৌধুরী: প্রবাস-জীবন নিয়ে মানুষের নানামাত্রিক কৌতুহল আর চিন্তাভাবনার শেষ নেই। অন্তহীন এই জিজ্ঞাসায় ব্যক্তিক-মানুষের জাতিগত উত্তরাধিকার ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তাই একটি নতুন দেশের সাংস্কৃতিক আবহে নবাগত মানুষের স্বপ্নের প্রজাপতিরা ডানা মেলতে শুরু করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য যে, আমরা বাংলাদেশীরা স্বপ্নের সেই প্রজাপতিগুলোকে ব্যক্তিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র গন্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলি। বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের যে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রয়েছে তার বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা কি আমাদের নেই? এ- প্রশ্ন তাই আমাকে প্রতিনিয়তই আন্দোলিত করেছে এবং করছে এই প্রবাস-জীবনে। আমাদের অধীত জ্ঞান, জীবনাভিজ্ঞতা আর এপ্রবাসের ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল কি আমাদের জ্ঞান-জগতে আলোড়ন তুলতে সক্ষম নয়? নতুন পরিবেশে নবজীবনের স্বপ্নের ক্যানভাসে মানবিকতার তুলির পরশে আমরা কি কিছুটা বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে পারি না? পারি না সমৃদ্ধ করতে আমাদের মন ও মননকে?
একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের আশায় স্বদেশের রুঢ় বাস্তবতায় উন্মুখ হয়ে বসে থাকে বাংলাদেশীরা; আর সুযোগ খুঁজতে থাকে কোনমতে দেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমাতে। আমাদের বিশ্বাস- যে কোনভাবেই হোক অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার উন্নত বিশ্বে প্রবেশ করলেই আমাদের আর পায় কে! উন্নতির রুদ্ধদ্বার খুলে যাবে আর সমৃদ্ধির সোনার হরিণ আমাদের হাতের মুঠোয় এসে যাবে। অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য এবং যশ-খ্যাতি আমাদের জীবনে সুখের ফোয়ারা বইয়ে দেবে। ঘর হতে আঙ্গিনা বিদেশ- যাদের জন্য, সেই সব মানুষদের এসহজসরল বিশ্বাসকে তো দায়ী করা যায় না। দারিদ্রপ্রপীড়িত সংগ্রামমুখর জীবনে অর্থনৈতিক মুক্তির অন্বেষাই তো টিকে থাকার একমাত্র ভরসা। তাছাড়া যে পরিমন্ডলে তাদের বসবাস, সে প্রতিবেশের সমাজ-বাস্তবতা তো তাদেরকে সেই ধারণাই দেয়। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় আপাত দৃষ্টিতে তারাতো তা-ই দেখছে। তাদের আশেপাশের বিদেশ ফেরত লোকজনদের জীবনে তারই প্রতিফলন তারা দেখতে পায় প্রতিনিয়ত। যখনই আমাদের দেশের প্রবাসীরা দেশে ফিরে যায়, অর্থের বৈভব তারা প্রদর্শন করে নানা কায়দায়, নানা মাত্রায়। প্রবাস-জীবনের বাস্তবতা আমাদের যে রকমই হোক না কেন, তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রসালো আর আকর্ষণীয় করে তুলতে না পারলেতো আর নিজের ব্যক্তিত্বকে অন্যের কাছে শাণিত করা যায় না।
স্বদেশে ফিরে প্রবাসীদের অনেকেই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় প্রবাস-জীবন নিয়ে নষ্টালজিক আমেজে নানা বিচিত্র কাহিনী তুলে ধরে আশেপাশের লোকজনদের কাছে। বাস্তব আর অবাস্তবের অদ্ভুত সংমিশ্রণে সেসব জীবনগাঁথা সাফল্য আর গৌরবের বহুবর্ণীল আলোকচ্ছ্বটায় দীপ্ত হয়ে ওঠে। আর সেসব মানুষেরাই আবার প্রবাসে বসে প্রবাসী স্বদেশীদের কাছে কল্পলোকের গল্প বলে স্বদেশে নিজের অবস্থা এবং অবস্থান নিয়ে। নিজেদেরকে জাহির করার কসরত করতে গিয়ে বিদেশের মাটিতে পা রেখেই এশ্রেণীর বাংলাদেশীদের বেশীর ভাগই নবাবজাদা কিংবা শাহজাদা হয়ে পড়ে। হয়ে পড়ে এক একজন দিকপাল কিংবা নিধেনপক্ষে ঔপনিবেশিক সামন্ত জমিদারের উত্তরপুরুষ। আপন মহিমা বিস্তারে ও আত্মপ্রতিষ্ঠায় পরিতৃপ্তি লাভ করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু এসব মানুষদের অকর্ষিত চিত্তের প্রক্ষেপণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে মহিমা কীর্তন এমন নগ্ন আর অন্ত:সারশুন্যতায় পর্যবসিত হয় যে তা তাদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক সৌন্দর্য আর সৌকর্ষকে ম্লান করে দেয়। পরিশীলিত আত্ম-প্রচারে দোষের কিছু না থাকলেও এই সুপেরিয়টি-ইনপেরিয়রিটি কম্প্লেক্স সঞ্জাত অন্ধ আত্মমুখী প্রবণতা যে আমাদের সৌহার্দ্য, সম্প্রতি আর ঐক্যের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রবাসের ব্যক্তিক-দ্বন্দ্ব আর গোষ্ঠিবদ্ধ জটলা তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
একটি গণতান্ত্রিক সহনশীল উদার পরিবেশে বসবাস করেও নিজেদের ব্যক্তিচরিত্র আর সামষ্টিক কল্যাণ নিয়ে ভাববার সময় কি আমাদের কখনওই হবে না? প্রবাসে যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ছেন কিংবা নিজ নিজ ফিল্ডে কাজ করছেন, তাঁরা যে যার ক্ষেত্রে যোগ্যতমদেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন তাতে কারো কারো সন্দেহ থাকলেও আমার মতো ক্ষুদ্রজ্ঞানের সাধারণ মানুষদের থাকার কথা নয়। ধানের সাথে চিটার অস্তিত্বকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনি আমার মতো দুএকটা চিটা হয়তো তাঁদের দলে ঢুকে পড়তে পারেন কোন এক কানাগলি দিয়ে। তাই বলে তাঁদের প্রতিভা, যোগ্যতা আর সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ কথায় বলে, সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। এঁদের কারো যোগ্যতায় যদি কোন রকম ঘাটতি থেকেও থাকে, দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি- পারিপার্শ্বিক পরিমন্ডল, অভিজ্ঞতা ও প্রচেষ্টা তাঁদেরকে এক সময় পরিপূর্ণতা এনে দেবে। আমি তাঁদের জন্য বাংলাদেশী হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে করি। তাঁদের এঅর্জন আমাদের জাতির জন্য কল্যাণের বার্তাবহ ও নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিতবহ। তাই অহঙ্কারবোধ করি তাঁদের অর্জন এবং সাফল্যের সংবাদে। আর লজ্জিত হই তাঁদের হীনমন্যতায়, ব্যথিত হই তাঁদের ব্যক্তিক ক্ষুদ্রতায়, আত্মতুষ্টি আর অহঙ্কারে।
মানুষ হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে যদি আমরা স্বীকার করি, তবে আমরা কেউই দুধে ধোয়া তুলসী পাতা নই। ব্যক্তিক দোষ-ত্রুটি আর সীমাবদ্ধতা নিয়েই আমরা এক একজন মানুষ। প্রবাসের এস্বল্পকালীন জীবনযাত্রায় অনেক গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল-এর সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই কমবেশী হয়েছে। তাদের সাথে মেলামেশার সেই অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে তাদের মানসিক ক্লেদাক্ততার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেও জীবনবাস্তবতা সম্পর্কে তারা আমার জ্ঞানজগতকে অনেক বেশী সমৃদ্ধ করেছে; করেছে আলোকিত নতুন মাত্রায়। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ যে তারা আমাকে মানুষের মনোজাগতিক অভিজ্ঞানের অস্পষ্ট ও স্পর্শকাতর দিকগুলো সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ভিন্নসাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বিচ্ছিন্নভাবে স্বদেশীদের ব্যক্তিচরিত্রের স্বরূপ অনুধাবণ করা যত সহজ, তত সহজ নয় নিজ দেশে নিজ প্রতিবেশে অবস্থান করে। কারণ সমসাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়েও ভিন্নসাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে আবেগহীন অভ্যাস আর অভ্যাসহীন আবেগ- এদুয়ের আপেক্ষিক মানদন্ড একজন মানুষের ব্যক্তিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে সুস্পষ্ট করে তোলে আমাদের বোধের জগতে। এখানে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের কারো সাথেই আমার পূর্ব-পরিচয় ছিল না এদেশে আসার আগে। তাই সম্পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিতহীনভাবে ব্যক্তিক আদর্শের পরিমাপে তাদেরকে জানার সুযোগ হয়েছে। না, এখানে কোন ব্যক্তি-মানুষ ও তার ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে বিষাদাগার করার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। জাতি হিসেবে আমাদের নিজেদের দুর্বলতার দিকগুলো আলোচনার প্রসঙ্গে দুএকটা প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে অনিবার্যভাবেই আমাদের উপলব্ধির জগতকে শাণিত করার জন্য। তাতে যদি কেউ কোনভাবেই অস্বস্তিবোধ করেন আমার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশে তবে সেটা একান্তই আমার ভাষাগত প্রকাশভঙ্গির ব্যর্থতা।
মানুষের উৎকর্ষতা আর সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়ে তাকে যথার্থ স্থান দিতে পারলেই আমরা মানবিকতার পরাকাষ্ঠ প্রদর্শন করতে সক্ষম হবো। স্বাভাবিকভাবেই বিদেশের মাটিতে পা রাখা একজন নবাগত প্রবাসীর জীবনে বিদেশ-বিভুঁইয়ে একজন স্বদেশীর উপস্থিতি তার মনে একটু ভবিষ্যতের আশা, প্রয়োজনে নির্ভরতার ভরসা আর ভিন্ন পরিবেশে খাঁপখাইয়ে নেয়ার স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এদেশে অবস্থানকারী ভারতীয়, পাকিস্তানী ও চীনা প্রবাসীরা এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করলেও বাংলাদেশীরা খুব কমক্ষেত্রেই একজন স্বদেশীর জন্য সাহায্যের হাত বাড়ায়। প্রত্যাশায় ভর করে স্বদেশী-প্রবাসীদের আচরণে যখন নবাগত বাংলাদেশীরা হতাশ হন, তখন তাদের মনে একটা প্রশ্ন বারবার উঁকি মারে- কেন এমনটি হয় বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে? বিভিন্ন সময় তাদেরকে প্রশ্ন তুলতে দেখেছি। সেসব আশাহত নবাগতদের প্রারম্ভিক এপ্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাই অনেক সময়। অপেক্ষা করতে থাকি তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনচর্যার স্বরূপ জানতে। অচিরেই তারাও তাদের পূর্বসূরীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ব্যক্তিগত জীবনাচরণে তারাও পূর্বসূরীদের প্রতিরূপ হয়ে যায়। তাহলে যে বিষয়টি এখানে সত্য হয়ে ওঠে, সেটা হলো আমরা যে আচরণ অন্যের কাছে প্রত্যাশা করি, আমরা আমাদের নিজেদের আচরণে ঠিক তার বিপরীত। কি অদ্ভুত আমাদের প্রত্যাশা আর ব্যক্তিচরিত্রের সংগঠন? সে যা-ই হোক, প্রবাসে স্বদেশীদের সাহার্য্য-সহযোগিতা করার জন্য এই এগিয়ে না-আসার অনেক কারণ থাকতে পারে। সেসব যৌক্তিক ও অযৌক্তিক বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে; নানা ব্যাখ্যাও থাকতে পারে আমাদের অনেকের কাছে। সেসব না হয় এখানে আলোচনা না-ইবা করলাম। কিন্তু স্বদেশপ্রেমের প্রেক্ষাপটে এবিষয়ে দুএকটি কথা না বললেই নয়। উৎকেন্দ্রিক আর অকৃতজ্ঞ মানুষগুলো ছাড়া সবাই স্বদেশপ্রেমিক।
স্বজ্ঞানে আমাদের কেউই নিজেকে উৎকেন্দ্রিক কিংবা অকৃতজ্ঞ ভাববেন বলে আমার মনে হয় না। তাই বিবেকচালিত ব্যক্তিমাত্রই প্রশ্ন করতে পারেন- যেদেশের আলো-বাতাস-পানিতে আমাদের দৈহিক পরিবৃদ্ধি হয়েছে, যে জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবদানে আমাদের মেধা ও সৃজনশীলতার পরিপুষ্টি হয়েছে, সেদেশের একজন মানুষের ন্যুনতম কল্যাণে কি আমাদের কোন নৈতিক দায় নেই? অবশ্যই আছে। সে দায় আদর্শিক ও চেতনাগত। পরিতাপের বিষয়, আমরা সেটা বোঝার চেষ্টা করি না, চেষ্টা করি শুধু নিজের ব্যক্তিস্বার্থের দিকটাকে প্রধান করে দেখতে। আসলে যে দরিদ্র-সংস্কৃতির ঘোলা জলে আমরা বেড়ে উঠেছি সেখানে নিজেদেরকে নিয়েই আমরা সদাসর্বদা ব্যতিব্যস্ত থেকেছি। তাই আমাদের চারপাশে আত্মস্বার্থ চরিতার্থতার একটা পরিবৃত্ত তৈরী হয়েছে। সেই পরিবৃত্তে অস্বাভাবিক আত্মনিমগ্নতায় আমাদের জীবনে আশেপাশের মানুষগুলোর নানামাত্রিক অবদানের বিষয়গুলো আমাদের নজরেই আসে না। এতে করে আমাদের বিবেকের চোখ ফোটেনি বলে দীর্ঘ অভ্যাসজাত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতায় কুয়োর ব্যাঙ হয়ে নিজের আখের গোছানোতে আত্মনিয়োগ করে আছি আমরা সবাই। আমরা পারিনা স্বপ্ন দেখতে সবাইকে নিয়ে নতুন দিনের। নিজেরা নিজেদের স্বপ্নে আমরা এতোই বিভোর যে সেখানে অন্যের স্থান কোথায়; সবার জন্য স্বপ্নের বাসর সাজাতে আমাদের অবকাশ কোথায়! সুন্দর আগামী সেতো শুধু আমার নিতান্ত একার। সেখানে কারো ঠাঁই নেই। প্রকৃতপক্ষে এ আত্মকন্দ্রিক স্বার্থপরতা আমাদের জাতীয় জীবনে দুর্বৃত্তায়নের মূল কারণ।
আমাদের মানসিক দৈন্য এখন এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, আমরা জাতি হিসেবে আমাদের কোন ভাল দিকই আর দেখতে পাচ্ছি না। হতাশা, ব্যর্থতা আর গ্লানি আমাদের জীবনচর্যার নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ আমরা যেমন নিজেদেরকে শ্রদ্ধা করতে শিখিনি, তেমনি অন্যকেও শ্রদ্ধা করতে জানি না। আমরা শিখেছি প্রভুভক্তি আর চাটুকারিতা। এদুই চাতুরীর মাধ্যমে লক্ষ্য হাসিলের প্রচেষ্টায় গলদঘর্ম আমরা। সামষ্টিক চেতনা বা সবাইকে নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই বলেই চেতন কিংবা অবচেতন মনে আমাদের চোখে ছানী পড়েছে। সে ছানী তথাকথিত উন্নত বিশ্বের ক্ষমতাধর প্রভুদের দেশী সেবাদাসদের উদ্গীরিত বিষাদাগারে সৃষ্ট আর গণমাধ্যমগুলোর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণায় অতিরঞ্জিত। ফলে আমাদের সম্ভাবনা, শক্তি ও সামর্থ সম্পর্কে আমাদের ধারণা সুস্পষ্ট নয়। আর তাই এক ধরনের অজ্ঞতাজাত ভয় আমাদেরকে প্রেরণা যোগায় না কর্মপ্রচেষ্টায় কিংবা আত্মবিশ্বাসে আত্মবিকাশে; স্বপ্ন দেখায় না নতুন আগামীর।
মূলধারার জনজীবনবিচ্ছিন্ন এপ্রবাসে বসেও নিলজ্র্জভাবে আমরা যেভাবে নিজেদের মহিমা প্রচার করি স্বদেশী-প্রবাসীদের কাছে, সেভাবে কেন স্বদেশ ও স্বজাতির মহিমা কীর্তন করি না বিদেশীদের কাছে? আমাদের মধ্যে এক ধরনের প্রবণতা লক্ষণীয় যে আমরা আমাদের জাতীয় দীনতাকে বিদেশীদের কাছে তুলে ধরে এক প্রকার আত্মতৃপ্তি লাভ করার চেষ্টা করি। নিজের জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করা আর নিজেদেরকেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা যে একই কথা সেটা না বোঝার মতো নির্বোধ তো আমরা কেউ নই। তবে কেন এ আত্মহনন? সত্যিই আমরা এক আত্মঘাতী জাতি। নিজেদেরকে গোবরে পদ্মফূল ভাবার আত্মতুষ্টি কি শতদলে বিকশিত বনফুলের মহিমান্বিত আত্মবিকাশের আনন্দের চেয়ে বড় হতে পারে? এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার সময় কি আমাদের হবে না কোন দিন? যে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারজাত মানসিক-দৈন্য আমাদেরকে প্রপীড়িত করে চলেছে, দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়কে- সেটা আরো প্রকোট করে তুলেছে আমাদের ব্যক্তিক ক্ষুদ্রতাকে।
স্বদেশের নোংরা রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি আর ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রবণতা যে সাংস্কৃতিক দারিদ্রের জন্ম দিয়েছে আমাদের মাঝে তারই প্রতিনিধিত্ব করে চলেছি আমরা। এপ্রবাসেও তাই আমরা বিভাজিত নানা পরিচয়ে আমাদের আপন পরিচিতির বলয়ে। সে পরিচয় কখনো আর্দশিক অবস্থানজাত, রাজনৈতিক চেতনাগত, কখনোবা আরোপিত- ব্যক্তিক-দ্বন্দ্বের ভিত্তিভূমে যার শিকড় প্রোথিত। অন্যকে ছোট করতে পরলেই যেন নিজকে বড় করা গেলো- এধরনের একটা বিশ্বাস ও প্রবণতা আমাদের অনেকের মাঝে লক্ষণীয়। অন্যকে আহত করার পৈশাচিক আনন্দে অনেককেই মেতে ওঠতে দেখি। ফলে ব্যক্তিক আদর্শে অবিচল থেকে অন্যের সাথে সহমর্মিতায় সহাবস্থান আমাদের আচরণে নেই। আদর্শিক জীবনচর্যায় আত্মশক্তির বিকাশের মধ্যে দিয়ে নিজেকে বড় করে তোলার প্রবণতা আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। তাই বিশাল বিশ্বের একটা ক্ষুদ্র গন্ডিতে আবদ্ধ হয়ে আমরা ছোট হতে হতে এতোই ছোট হয়ে পড়েছি যে আমাদের দীনতা এখন আর নিজেদের চোখে ধরা পড়ছে না। নানা পরিচয়ে আমরা আমাদেরকে শতধা বিভক্ত করলেও এদেশবাসী কিংবা অন্য বিদেশীদের কাছে আমাদের একটাই পরিচয় আমরা বাংলাদেশী। আমাদের প্রবাসীদের কাছেও আমাদের বাংলাদেশী পরিচয়টাই যেন প্রধান হয়ে ওঠে আর সব বিভেদ ভুলে সবাই মিলে স্বদেশ ও স্বজাতিকে মহিমান্বিত করে তুলতে পারি এপ্রবাসে- এটাই হোক আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ সংকল্প আর সকল প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু্।
লিখেছেন: ড. মাহরুফ চৌধুরী, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য।Email: mahruf@ymail.com




