বুলবুল ভট্টাচার্য্য: ইন্দোনেশিয়া এটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যেখানে দেশের ৯৫ শতাংশই মুসলিম। সেখানে ২০,০০০ রুপাইয়া নোটে হিন্দু দেবতা গণেশের ছবি ছিল। বর্তমানে প্রচলিত নোটে বিখ্যাত মন্দির “পুরা উলুন দানু ব্রাতান”-এর ছবি রয়েছে।আবার,প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০ কোটির উপরে মুসলিম জনসংখ্যার বসবাস,যা পুরো বাংলাদেশের চেয়েও অনেক বেশী।সেখানেও টাকার নোটে বিভিন্ন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং স্থাপত্যের ছবি রয়েছে,যার মধ্যে সনাতনী মন্দিরও অন্তর্ভুক্ত।১০ টাকার নোটে রয়েছে কোণার্কের সূর্য মন্দির।২০ টাকার নোটে ইলোরা গুহা (যেখানে কৈলাসনাথ মন্দির রয়েছে)।৫০ টাকার নোটে হাম্পির পাথরের রথ (যেটি বিজয়নগর সাম্রাজ্যের স্থাপত্যের)।এছাড়াও নোটে আরও রয়েছে মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট অশোকের সিংহচতুর্মুখ স্তম্ভশীর্ষ ভাস্কর্যের স্থাপত্যের ছবি(Lion Capital of Ashoka)। এইসব নোট সেই দেশের মুসলমানদের পকেটে রাখতে তাদের কোন অসুবিধে হয় না। কিন্তু,আমাদের বাংলাদেশে শুধু পকেটে কোন মানুষের ছবিযুক্ত নোট,পাখির ছবিযুক্ত নোট বা বিধর্মীদের কোন মঠ-মন্দিরের ছবিযুক্ত নোট পকেটে রাখলে অনেক অনেক গুনাহ এবং নানান অসুবিধে!
বাংলাদেশ যে একটি ধর্মভীরু দেশ, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মপ্রাণ এবং দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মের একটি বড় প্রভাব দেখা যায়।ধর্ম সাধারণত ঐশ্বরিকতা, নৈতিকতা এবং আচার-অনুষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে গঠিত।কথা হচ্ছে,যারা সব কিছুতেই ধর্মকে টেনে আনেন বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেন,তারা হয়তো সব বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেন না বা যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসকে বেশি প্রাধান্য দেন। তাদের কাছে হয়তো ধর্মই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের মূল চালিকাশক্তি। এই ধরনের চিন্তাভাবনাকে অনেকেই একপেশে বা সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন।ছোটবেলা থেকে পরিবার বা সমাজের কাছ থেকে পাওয়া ধারণাগুলো মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। যদি পরিবারে বা পরিবেশে ধর্মীয় বিদ্বেষের সংস্কৃতি থাকে, তবে শিশুরা তা আত্মস্থ করে বড় হতে পারে। একইভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থান শিশুদের ভবিষ্যৎ জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। শিশুরা তাদের চারপাশের পরিবেশ থেকেই শেখে, এবং বড়দের আচরণ তাদের উপর গভীর ছাপ ফেলে। যখন শিশুরা তাদের পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সমাজে বড়দের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও শ্রদ্ধাবোধ দেখে, তখন তারা নিজেরাই এই মূল্যবোধগুলি আত্মস্থ করে।
টাকার নোটে কী ছবি থাকবে বা থাকবে না,তা নির্ধারণ করা সম্পূর্ণরূপে সরকারের এখতিয়ার বলে মনে করি। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো সরকারি সংস্থাগুলির নীতিগত সিদ্ধান্ত।দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, স্থাপত্য, বা ঘটনার ছবি নোটে ব্যবহার করা হয়।অনেক সময় জাতীয় প্রতীক বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ছবি ব্যবহার করা হয়।নোট জাল করা প্রতিরোধের জন্য নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছবি নির্বাচন করা হয়।
সম্প্রতি ২০ টাকার নোটে দিনাজপুরের কান্তাজিউ মন্দির,রাজশাহীর নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের ছবি এবং ২০০ টাকার নোটে মসজিদ,মন্দির,গীর্জা ও প্যাগোডার সম্মিলত ছবির ব্যাপারে দেশব্যাপী এখন ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বইছে।হেফাজতে ইসলাম ইতিমধ্যেই এসব নতুন নোট বাতিলের দাবী জানিয়েছে।তারা গভীর উদ্বেগ ও এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে মুসলমানদের আবেগ -অনুভুতির পরিপন্থীও জাতিগত ধর্মীয় চেতনাকে ইন্টেরিম সরকার উপেক্ষা করেছে।
নেতৃদ্বয় এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন,”একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও প্রতীকসমুহে ইসলামি সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনার প্রতিফলন থাকা অপরিহার্য।এ ধরণের সিদ্ধান্ত দেশবাসীর বিশ্বাসে আঘাত হানে এবং জাতীয় ঐক্য বিনষ্টের পথ সুগম করে”। কিছু মানুষ এখনো বিশ্বাস করেন যে, ধর্ম মানুষের তৈরি একটি সামাজিক কাঠামো, যা তাদের জীবনকে নির্দিষ্ট নীতিমালার অধীনে পরিচালনা করতে সাহায্য করে। তবে, একজন প্রকৃত মানুষের জন্য এই নির্দিষ্ট কাঠামোর বাইরেও বিশ্বজনীন মূল্যবোধগুলি বেশি জরুরি। তাদের কাছে ধর্ম কেবল একটি পথ, গন্তব্য নয় এবং তারা আরো মনে করেন ধর্ম মুখ্য নয়, তারা প্রায়শই ধর্মীয় বিভাজন, সংঘাত এবং গোঁড়ামিকে এড়িয়ে যেতে চান। তাদের কাছে ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে সকল মানুষের একাত্মতা বেশি জরুরি। একজন ব্যক্তি নিজের আধ্যাত্মিক শান্তি ও মূল্যবোধ খুঁজে পেতে পারেন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বাইরেও। তাদের কাছে আনুষ্ঠানিকতা বা আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং অন্তর্নিহিত সততাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আসলে ধর্ম হল একটি ব্যাপক বিশ্বাস,অনুশীলন এবং মূল্যবোধের সমষ্টি যা মানুষকে জীবনের গভীর অর্থ খুঁজে পেতে, সামাজিক বন্ধন গড়ে তুলতে এবং মানসিক শান্তি পেতে সাহায্য করে। এটি মানব সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা যুগ যুগ ধরে মানুষের জীবন ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে আসছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামি মেনে যাওয়া যায় না। ধর্মীয় গোঁড়ামি সমাজের জন্যে খুবই ক্ষতিকর। এটি ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা তৈরি করে, যা সংঘাত ও বিভেদ বাড়ায়। গোঁড়ামি মানুষকে সংকীর্ণমনা করে তোলে এবং অন্যের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াতে উৎসাহিত করে। এর ফলে সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি ব্যাহত হয়। অনেক সময় মানুষ অন্য ধর্ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখে না। ভুল তথ্য, গুজব বা সীমিত ধারণার ওপর ভিত্তি করে তারা অন্য ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে, যা বিদ্বেষের জন্ম দেয়।ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রায়শই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য, নিপীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিকে পরিচালিত করে।
উপাসনার স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের অধিকার এবং সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।সংঘাত ও অস্থিরতা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে সৃষ্ট অস্থিরতা দেশে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে, ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত করে এবং দারিদ্র্য বাড়িয়ে তোলে।বিদ্বেষ কেবল যাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা হয় তাদেরই নয়, যারা বিদ্বেষ পোষণ করে তাদেরও মানসিক ও আত্মিকভাবে ক্ষতি করে। এটি ঘৃণা, ক্রোধ এবং নেতিবাচকতার জন্ম দেয়, যা ব্যক্তিগত শান্তি ও সুখ নষ্ট করে।যখন সমাজ ধর্মীয় বিভেদ ও বিদ্বেষে ডুবে থাকে, তখন তা গঠনমূলক আলোচনা,সহযোগিতা এবং সামগ্রিক অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির বিকাশ ব্যাহত হয়।আর এই ধর্মীয় বিদ্বেষ কখনোই শান্তি বয়ে আনতে পারে না। বরং এটি অস্থিরতা, অশান্তি এবং সংঘাতের জন্ম দেয়, যা ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর।এর বিপরীতে, ধর্মীয় সহনশীলতা, বোঝাপড়া এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং মানবিক সমাজ গঠনে সহায়ক।
বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা যদি একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, তবে তা পারস্পরিক সম্মান, সহযোগিতা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে পারে।ইতিহাসে ধর্মীয় সংঘাত, যুদ্ধ বা নিপীড়নের ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। এই ঐতিহাসিক বিদ্বেষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে এবং বর্তমান সময়েও এর প্রভাব দেখা যায়।অনেক সময় রাজনৈতিক দল বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতা বা অর্থনৈতিক লাভের জন্য “ধর্মকে” ব্যবহার করে। তারা ধর্মীয় বিভেদ উস্কে দিয়ে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে, যা বিদ্বেষ বাড়ায়। কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের হেয় প্রতিপন্ন করে। তাদের গোঁড়ামি ও উগ্রবাদী মনোভাব ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াতে সাহায্য করে।সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল তথ্য, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বা একপেশে সংবাদ পরিবেশন ধর্মীয় বিদ্বেষকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
অন্যদিকে, কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন যে ধর্ম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্দেশনা দিতে পারে এবং আধ্যাত্মিকতা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের কাছে, ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং বিশ্বকে বোঝার ভিত্তি তৈরি করে।মূলত: এই বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে।কিন্তু,একজন “সত্যিকারের মানুষ” হওয়ার জন্য ধর্মীয় অনুষঙ্গের চেয়ে মানবতা, নৈতিকতা, সহানুভূতি, এবং ভালো কাজ করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কাছে অন্যের প্রতি ভালোবাসা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, এবং সমাজের কল্যাণে অবদান রাখাই মুখ্য। ধর্ম তাদের জন্য ব্যক্তিগত বিশ্বাস হতে পারে, কিন্তু তা তাদের মানবিক মূল্যবোধকে ছাপিয়ে যায় না।
একটি দেশের উন্নতি কেবল ধর্মীয় বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে না, বরং এর সাথে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রাকৃতিক সম্পদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আরও অনেক কারণ জড়িত।শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্ব উন্নয়ন সম্ভব নয়।বিশ্ব উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন বহুবিধ উপাদানের সমন্বয়, যার মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস একটি অংশ হতে পারে, কিন্তু কখনোই একমাত্র ভিত্তি নয়। বিশ্বে উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। নতুন আবিষ্কার, উন্নত চিকিৎসা, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি-এ সবই বিজ্ঞানের অবদান। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস দিয়ে এসব অর্জন সম্ভব নয়। গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমেই মানবজাতি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
লেখক: বুলবুল ভট্টাচার্য্য,প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক দি ক্রাইম(www.thecrimebd.net).