খন রঞ্জন রায়: সারা পৃথিবীতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে ৩০ আগস্ট পালন করা হয় আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গুম দিবস নিয়ে আন্তর্জাতিক সনদ গৃহীত হয়। ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অলপারসন্স অ্যাগেইনেস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়্যারেন্স নামক সনদটি ২০১০ সাল থেকে কার্যকর হতে থাকে।
গুম হওয়া জলজ্যান্ত মানুষগুলিকে স্মরণ এবং তাঁদের পরিবার আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জানাতে আজকের দিনটি অর্থাৎ ৩০ আগস্টকে বেছে নেওয়া হয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত মানুষ গুম হওয়া কেবল বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নয় বরং সাধারণ, নিরাপরাধ মানুষকে গুম হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশ ভয়ঙ্করভাবে মোকাবিলা করছেন। রাজনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী, বেসামরিক স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠিত মানুষজন অহর্নিশ আতংকে দিনাতিপাত করছে।
গুমের শিকার হওয়া সবচেয়ে বেশি মানুষের তালিকা প্রকাশ করেছে সিরিয়া। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য মতে, ২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত ৯৩ হাজার মানুষ ভয়ঙ্কর এই গুমের শিকার হয়েছে। এর পরেই রয়েছে শ্রীলঙ্কা, গাম্বিয়া, বসনিয়া। লাতিন আমেরিকার দেশসমূহও এই ক্ষেত্রে মানবতাবার্জিত এই কাজে পিছিয়ে নেই। সত্তর ও আশির দশকে অবৈধ অস্ত্রকারবারি আর ভিন্ন মতাবলম্বীরাই প্রতিপক্ষের অমানবিক এই দুষ্কর্মের শিকারে পরিণত হতো, অথচ বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি উৎকর্ষতা আর সুযোগের যুগেও গুমের আতঙ্ক এখন সর্বত্র পরিব্যাপ্ত।
সমাজবিরোধী, মানবতাবিরোধী, রাষ্ট্রনীতিবিরোধী এই আতঙ্ক-সংস্কৃতি বাংলাদেশের মাঝেমধ্যে মাথাচারা দেয়। সাধারণ মানুষকে হতাশ করে। গুমের ঘটনায় উদ্বিগ্ন করে। গুম যেন রাজনীতির প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রধান অস্ত্র না হয় সেজন্য বুদ্ধিজীবী মতামত ব্যক্ত ব্যাক্তিরা সোচ্চার। গুমের সঙ্গে ব্যক্তি ও তাঁদের মদতদানকারী নেপথ্যের সকলকে সংশোধন হওয়ার পরামর্শ দেয়। আন্তরিক আহবান জানান।
আমাদের দেশে গুম ঘটনার অধিকাংশ ক্ষেত্রে র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দাবাহিনী, সাদা পোশাকের বিশেষ বাহিনীর বিরুদ্ধে জোরালো অভিযোগ সাধারণ মানুষের চিন্তায় গভীরভাবে প্রোথিত। অবশ্য এইসব বাহিনীর মুখপাত্রগণ বরাবরই এইসব অভিযোগ ভিত্তিহীন, কল্পনাপ্রসূত, আবেগীমনের বহিঃপ্রকাশ বলে নাকচ করে দেন। বলা হয় কারো গুমের ঘটনার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিখোঁজ হয়ে যাওয়া লোকদের খুঁেজ বের করার সর্বাত্তক চেষ্টা করেন। চালিয়ে যায়। অনবরতভাবে প্রচেষ্টা অব্যহত রাখেন। গুম বা নিঁেখাজ হওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলি আন্তরিক প্রচেষ্টা চালান বলেও দাবী করা হয়।
আইন ও সালিশ নিয়ে স্বেচ্ছাভিত্তিক কাজ করা অনেক সংগঠন, সংস্থা নানাভাবে বিবিধ প্রক্রিয়ায় বলপূর্বক অন্তর্ধান হওয়া নিয়ে তাদের অভিমত, জরিপ ও সুপারিশ গণমাধ্যমে প্রকাশ করে। ব্যাপক আতঙ্ক, উদ্বেগ আর জননিরাপত্তা বিষয়টি তখন জনগণের সামনে আসে। তাদের নিজস্ব মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় বাংলাদেশেও ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত ৬২৯ জন নিরীহ নিরাপরাধ ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছে, বা গুমের শিকার হয়েছেন। ভুক্তিভোগী পরিবার ও তাঁদের স্বজনদের সাথে আলাপ-আলোচনা, অভিযোগ, অনুযোগ তথ্য পর্যালোচনা করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে নিখোঁজের ঘটনায় পরবর্তী সময়ে ৭৩ জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ৬২ জন তাঁদের স্ব- স্ব পরিবারের নিকট ফেরত এসেছে, আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার করতে হয়েছে।
অপহরণ, নিখোঁজ, গুম, খুন হওয়া ব্যক্তির স্বজনেরা যে দূরবস্তার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন, এই তথ্যে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর প্রতি সংহতি ও সমবেদনা জানানোই আজকের এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য। “গুম হতে সকলের সুরক্ষা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ” তৈরী করেছে জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি সংস্থা। এই সনদে অণুস্বাক্ষরের পর নিজ নিজ দেশের সকল নাগরিকদের সার্বিক সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারিভাবে বর্তায়।
গুরুত্বপূর্ণ এই সনদকে নিষ্ঠার সাথে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে ৪৩ টি দেশ। আর এই সনদ সমর্থন করে ধারা উপধারা প্রতিপালনের অঙ্গীকার পূর্বক অণুস্বাক্ষর করেছে আরো ৯৩টি দেশ। বাংলাদেশ গতকাল ২৯ আগস্ট ২০২৪ গুম প্রতিরোধ ব্যবস্থার এই আন্তর্জাতিক সনদ দলিলে অণুস্বাক্ষর করে। গুম হওয়ার সমার্থক যত শব্দই থাকুক অভিধানে, সবই কিন্তু মর্মান্তিক, পীড়াদায়ক, বেদনার, কষ্টের। যত রকমের গুমই হোক সবই সংশ্লিষ্ট পরিবারের জন্য নির্মমতার, অপূর্ণতার, অভিশপ্ত জীবন কাহিনীর। স্বেচ্ছায় উধাও বা গুম, দুর্ঘটনাবশত লুক্কায়িত বা গুম, জোরপূর্বক অপহরণ বা গুম সবগুলির পরিণতি একই। মানসিক অস্থিরতা আর নিরন্তর আক্ষেপ-অপেক্ষার।
সমসামিক কালে এই অন্তর্ধান নিয়ে বিশ্ব পরিস্থিতি তোলপার হলেও গুম শব্দটির সাথে মানবজাতির পরিচয় সু-প্রাচীনকাল থেকে। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নিরুদ্দেশ বা হারিয়ে যান রোমান সম্রাট ভ্যালেন, যেটি ঘটেছিল ৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে। ৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ ইবনে কাশেম খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পরাজিত ও বন্দী অবস্থায় হারিয়ে যায়।
যুক্তরাজ্যের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ‘আর্থার’ কেও ১২০৩ সালের পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৪৮৩ সালে ইংল্যান্ডের রাজার পুত্র পঞ্চম এডওয়ার্ড গুম হয়েছিলেন। অপরাধ বিষয়ক লেখক আগাথা ক্রিস্টিও ১৯২৬ সালে গুম হয়েছিলেন। বিশ্ব ইতিহাসে ধুরন্দর এইসব গুমের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে না পারলেও ঐ সব পশ্চিমা দেশে গর্হিত এমন ঘটনা এখন প্রায় অকল্পনীয়।
তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাম্প্রতিককালের গুমের ঘটনায় পুরা বিশ্বকে উদ্বেগে ফেলেছে। রহস্যের কূলকিনারা করতে ব্যাপক বিস্তৃত চেষ্টা তদ্বির করে যাচ্ছে। তবে যাঁরা এর যাঁদের দ্বারা এহেন গর্হিত কাজ সংঘটিত হয়েছে, হচ্ছে তারা কিন্তু নির্দ্বিধায় ইতিহাসের আস্তাঁকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। মানবতাবর্জিত যে কোনভাবে গুমের ঘটনা দেশের জনগণ সহজভাবে গ্রহণ করে না, সুযোগ পেলেই ফুঁসে ওঠে, প্রতিবাদ করে।
কখনো কখনো সরকারের ভীত পর্যন্ত নাড়িয়ে দেয়। সরকার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায় গুম। বর্তমান সভ্য পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ও জনগণ অশোভ এই গুপ্ত রহস্যের নির্মমতার বিরুদ্ধে সোচ্চার। ভয়, আতঙ্ক আর ধামা-চাপা দেওয়া বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে উদ্ধার হতে একহাট্টা। মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে, মানবতাকে সর্বাত্তক প্রকাশের বিরুদ্ধে হিংস্রতা পরিহার করতে, প্রতিবাদ জানাতে লুক্কায়িত যে কোন ঘটনার সহমর্মী, সহযোগী হতে আজকের এই দিবস।
নিষ্ঠুর অমানবিক মর্যাদা হানিকর আচরণের ক্ষেত্রে শাস্তি নিশ্চিত হোক, অবধারিত হোক সকল মানুষের সুরক্ষা, গুম শব্দটি সমাজ-সংস্কৃতি থেকে তিরোহিত হোক আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসের এই প্রত্যাশা।
লেখকঃ খন রঞ্জন রায়,সমাজচিন্তক, গবেষক ও সংগঠক।