দি ক্রাইম ডেস্ক: প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০২৩ সালে শুরু করা হয় ৪৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প। এই প্রকল্পটি চলমান অবস্থায় নদীতে একের পর মা মাছ ও ডলফিন মরে যাচ্ছে। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পে যেসব কর্মপরিকল্পনা ছিল সেসব কর্মসূচিতে বারবার পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ২৩ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু করে আড়াই বছর শেষ করা হলেও মূল কাজের কিছুই করা হয়নি। অথচ প্রকল্পটির মেয়াদ ২৭ সাল পর্যন্ত।
জানা যায়, ‘প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প দ্বিতীয় পর্যায়’ নামের এই প্রকল্পের মাধ্যমে হালদা নদী সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগীদের বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণ ও সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি, হালদার দুই পাড় রাউজান ও হাটহাজারীর ৬টি পুরাতন হ্যাচারি সংস্কার করে সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি, হ্যাচারির পুকুর সংস্কার, ডিম সংগ্রহকারী ও মৎস্য কর্মকর্তা–কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান, হালদা রক্ষায় অভিযান পরিচালনা ও আইন বাস্তবায়ন, দরিদ্র জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান এবং ওয়ার্কশপ, সেমিনার ও গবেষণা করার কথা। ২৫ সালে এসেও এর কোনোটির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দেখছেন না নদীপাড়ের মানুষ।
হালদাপাড়ের মানুষ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক নজরদারির অভাবে মানব সৃষ্ট দুর্যোগে গত আট বছরে এই নদীতে মরেছে অন্তত ৪৬টি ডলফিন ও শতাধিক মা মাছ। নদীতে রাত–দিন সক্রিয় থাকা মাছ চোর চক্র শিকার করছে ছোট–বড় মাছ। চোর চক্র নানা শ্রেণির জাল ও বড়শি ফেলে নদীর মাছ মারা অব্যাহত রেখেছে।
পরিবেশ ও জলজ প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষায়িত এই নদীটি ভয়াবহ দূষণের শিকার। এখানকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। তার ওপর মাছ শিকারিদের বেপরোয়া তৎপরতায় প্রাকৃতিক এই মৎস্য ভান্ডারটি এখন মাছশূন্য হতে চলেছে। গবেষকরা বলছেন, অনেক বছর ধরে হালদা রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশমালা দিয়ে আসছেন। কিন্তু ওইসব সুপারিশ পাশ কাটিয়ে হালদার উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার নামে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে বারবার প্রকল্প তৈরি করে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় করা হচ্ছে। কোনো কোনো প্রকল্প হ–য–ব–র–ল অবস্থায় রেখে অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় বন্ধ করে দেয়ার নজিরও রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদার জলজ প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষের কাছে আটটি সুপারিশ করা হয়েছিল। আমাদের সুপারিশ ছিল হালদা নদীকে ডলফিনের অভয়ারণ্য ঘোষণা করা, হালদা নদীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ড্রেজার এবং মোটরচালিত নৌকা নিষিদ্ধ করা, জাল ও বড়শি ফেলে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা, নদীর উজানে থাকা রাবার ড্যাম অপসারণ করা, বন্যপ্রাণী এবং মৎস্য শিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। হালদাপাড়ে পর্যাপ্ত সিসিটিভি স্থাপন, জাল পাতা বন্ধে নদীতে নজরদারির জন্য নৌযানের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
তিনি জানান, ২৮ অক্টোবর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সাথে এক বৈঠকে এসব প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তিনি আশ্বস্ত করেছেন, বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ মূল্যায়নে প্রকল্পের কিছু সংশোধনী আনা হবে। পাশাপাশি মাছ ও ডলফিনের মৃত্যু রোধে কর্মপন্থা সংযুক্ত করবেন।
তিনি বলেন, হালদা এমন একটি নদী, যেটি দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক কার্প প্রজননের উর্বর ক্ষেত্র। আদিকাল থেকে এই নদীটি গাঙ্গেয় ডলফিনের নিরাপদ আবাসস্থল হিসাবে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এই প্রজাতির ডলফিন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিপন্ন হিসাবে তালিকাভুক্ত। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে এখন এই শ্রেণির ডলফিনের সংখ্যা আনুমানিক ১২শ। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমরা হালদার ডলফিন রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারছি না। ডলফিন রক্ষায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও তারা যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের জরিপে হালদায় প্রায় ১৬৭টি ডলফিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ২০২০ সালে এই সংখ্যা নেমে আসে ১২৭টিতে। তবে ২০২২ সালের অন্য এক জরিপে ১৪৭টি ডলফিন থাকার কথা বলা হচ্ছে। সূত্রমতে, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত হালদা নদীতে ১৮টি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়। মার্চ ২০১৮ থেকে ডিসেম্বর ২০২০–এর মধ্যে আরো ১০টি উদ্ধার করা হয়েছে। ২০২১ সালে পাঁচটি এবং ২০২২ সালে ছয়টি ডলফিন মারা গেছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, যেসব মৃত ডলফিন নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তাদের মধ্যে নব্বই শতাংশের দেহে আঘাতের চিহ্ন ছিল। গবেষকদের মতে, যান্ত্রিক নৌকার ডুবন্ত পাখা আর জালে আটকে এসব ডলফিনের মৃত্যু হেেয়ছে।
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও হালদা গবেষক ড. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, অংশীজনদের নিয়ে আয়োজিত বৈঠকে তাকে ডাকা হয় না। তার অভিযোগ, আইআইইউসির উপাচার্য ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী হালদা নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তাকেও ডাকা হয় না। নেয়া হয় না কোনো পরামর্শ।
হালদার ওপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী সুনামগঞ্জ কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আরশাদ–উল–আলমও কোনো সময় দাওয়াত পাননি হালদা বিষয়ক কোনো সভা–সেমিনারে। তরুণ এই গবেষক দাবি করেন, প্রাকৃতিক এই মৎস্য ভান্ডার রক্ষায় মৎস্য বিভাগ এ পর্যন্ত যত প্রকল্প নিয়ে কাজ করেছে অতীতের সব কটি প্রকল্প হ–য–ব–র–ল অবস্থায় শেষ করেছে। তারা যা বলে আসছেন তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
চলমান হালদা প্রকল্প নিয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সালমা বেগম বলেন, ২৭ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ আছে। আড়াই বছরে প্রকল্পের কত শতাংশ কাজ হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, এ বিষয়ে প্রকল্প কর্মকর্তাই ভালো বলতে পারবেন।
প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।




