নগর প্রতিবেদক: অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপে রয়ে যাওয়া দেশী-বিদেশী মাফিয়া চক্রের নানান ফাঁদ ডিঙিয়ে এগুতে হচ্ছে। চট্টগ্রাম আদালত কর্তৃক ডা. শাহাদাতকে মেয়র ঘোষণা এবং তার শপথ গ্রহনের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দেশপ্রেমিক সকলের মাঝে চাঞ্চল্যের জন্ম দিয়েছে। আওয়ামীলীগের বির্তকিত সাবেক মেয়র আ জ ম নাছিরকে ফুলেল শুভেচ্ছা জ্ঞাপন মূলত: গোটা পরিস্থিতিকে জটিল করে নিকট ভবিষ্যতে ড. ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপাকে ফেলার নামান্তর মাত্র- এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষক মহল।
সুত্রমতে, চট্টগ্রামের সিটি কর্পোেরশনের নির্বাচন বাতিলের মামলায় বিজয়ী প্রাার্থী রেজাউল করিমের পরিবর্তে নির্বাচনে ২য় হওয়া প্রার্থী বিএনপির ডা. শাহাদাতকে জেলা জজ আদালত বিজয়ী ঘোষণা করেন। এর প্রেক্ষিতে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং নিয়ে এলজিইডি মন্ত্রণালয় কে কাল রোববার (০৩ নভেম্বর) সকাল ১১টায় মেয়র হিসেবে শপথ দিতে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে একজন রীট করেছে, রীটের শুনানী একই দিন রোববার(০৩ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায়। এজন্য শপথ স্থগিত করা দরকার মর্মে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এদিকে জেলা জজের রায়ের বিরুদ্ধে জনৈক প্রার্থী আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ইতোমধ্যে তিনি সরকারকে উকিল নোটিশও দিয়েছেন। আইনগত প্রক্রিয়া শেষ না করে সরকার ডা. শাহদাতকে শপথ দিতে পারে না। তদুপরি বর্তমান সরকার ও বিএনপি-জামাত গত ১৫ বছরের কোন নির্বাচনকে বৈধ বলে মানে না। এমন অবস্থায় আদালতের নির্দেশে মেয়রকে শপথ দিলে একদিকে গত ১৫ বছরের অবৈধ নির্বাচনগুলির বিরুদ্ধে কথা বলার নৈতিক ভিত্তি নষ্ট হয়ে যাবে।
অন্যদিকে সরকার যেসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করেছে সেগুলিতে মামলা করে দায়িত্ব পাওয়ার হিড়িক পড়ে যাবে। এতে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। তাই এ শপথ বন্ধ করে সরকার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা দরকার।
উল্লেখ্য, নির্বাচনে পরাজিত ঘোষণার প্রায় সাড়ে তিন বছর পর বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেনকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসাবে ঘোষণা করেছে আদালত। একই সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গেজেট প্রকাশ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে।
ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর শাহাদাত হোসেন দ্রুত এই রায়ের ভিত্তিতে গেজেট প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন।এর আগে, ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ডা. শাহাদাত ৯ জনকে বিবাদী করে নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। এজাহারে তিনি নির্বাচন পরবর্তী ফলাফল সংক্রান্ত প্রকাশিত গেজেট (রেজাউল করিমকে মেয়র ঘোষণা করে) বেআইনি, অবৈধ ও ন্যায় নীতির পরিপন্থী বলে দাবি করেন।
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চসিকের ষষ্ঠ পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। নির্বাচনে ভোট পড়ে মাত্র ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ।
ডা. শাহাদাতের ভাষায়, “মামলার পর সাড়ে তিন বছর ধরে লড়েছি। এতদিন পর আদালত যে রায় দিয়েছে সেটি একটি ঐতিহাসিক রায়। আমি আশা করবো দ্রুত যেন এই রায়টি বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন।”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে নিম্ন আদালতের রায়ের পরই কি দায়িত্বে বসতে পারবেন এই বিএনপি নেতা? জবাবে নির্বাচন কমিশন বলছে, রায়ের পূর্ণাঙ্গ আদেশ না দেখে এখনই তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
ইসি সচিব শফিউল আজিম বলেন, ‘“ইসির লিগ্যাল উইংয়ের সাথে কথা বলেই আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। এখন নির্বাচন কমিশন নেই। যে কারণে হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত দেয়া যাবে না।” মি. হোসেনকে যখন মেয়র ঘোষণা করে রায় দেয়া হয়েছে তখন এই সিটি করপোরেশনসহ দেশের সব সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করলেও এখনই তিনি চেয়ারে বসতে পারবেন কী না তার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম শহীদ খান গণমাধ্যমকে বলেন, “ট্রাইব্যুনাল ভোটের প্রায় সাড়ে তিন বছর পর রায় দিয়েছে। এখন এই রায়ের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন যদি উচ্চ আদালতে আপিল করে তখন এই সিদ্ধান্ত তো আটকে যাবে। কবে নাগাদ পূর্ণাঙ্গ রায় আসবে সেটা কেউ জানে না।”
এদিকে, শপথ গ্রহণ সংক্রান্ত পত্রে বলা হয়, আগামীকাল ০৩ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১১টায় স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলন কক্ষে চসিকের নির্বাচিত মেয়রের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ. এফ. হাসান আরিফ নির্বাচিত মেয়রকে শপথবাক্য পাঠ করাতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। একইপত্রে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এক্ষেত্রে আদালতের কোনো স্থগিতাদেশ বা আইনগত কোনো জটিলতা আছে কিনা, তা জরুরি ভিত্তিতে জানানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।
প্রশ্ন উঠেছে ড. ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপাকে ফেলার এ উদ্ভট ষড়যন্ত্রের উৎস কোথায়? বিএনপি ও আওয়ামীলীগের মাঝে দা-কুমড়া সম্পর্ক থাকা স্বত্বেও নিন্ম আদালতের রায় পাওয়া ডা. শাহাদাত হোসেন সাংগঠনিক পদ পাওয়ায় বির্তকিত আজম নাছিরকে ফুলেল সম্বর্ধনা দেয়ার রহস্য কি? রীতিমতো মেয়র হয়েই গেছেন ধরে নিয়ে নানান জায়গা পরিদর্শনে যাচ্ছেন ডা. শাহাদাত। এ ক্ষমতা তিনি পেলেন কোথায়? তার ফেসবুক পেজ জুড়ে এ বিজয় উল্লাসের কারণ কি?
এদিকে আরেক বির্তক ও প্রশ্ন উঠেছে গত ১৯ নভেম্বর, ২০১৩ সালে শাহাদাত চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার অফিসে গিয়ে নাছিরের হাতে ফুল তুলে দেয়ার ঘটনা নিয়ে। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতা নাছিরও তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মিষ্টিমুখ করান। নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যালয়ে দুই নেতার অনুসারীরাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। দুই নেতা এ সময় একে অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
এ প্রসঙ্গে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, “উনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানাতে ওখানে গিয়েছি। আমরা বিপরীত মেরুর রাজনীতি করলেও আমাদের সামাজিকতা রয়েছে।’’
হঠাৎ করেই একেবারে ধোয়া তুলসী পাতার মতো ডা. শাহাদাত গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, এ সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে শুধু নেতাদের মধ্যে নয়, ভবিষ্যতে দলীয় রাজনীতিতেও সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে ।
জনৈক তৃণমূল কর্মী তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, “মনে আছে? চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের নিবেদিত কর্মী সেই আবিদের কথা? যাকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল। বিচার হয়নি আজও সেই হত্যাকান্ডের খুনীদের। মুরগীর বাচ্চার মত এসব খুনীদের আগলে রয়েছে চট্টগ্রামের টপটেরর খুনী আজম নাছির। আফসোস! খুনীদের ইন্ধনদাতা সেই আজম নাছির আজ চট্টগ্রাম মহানগরীর আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী মনোনীত। দুঃখের বিষয় আ.লীগের সেক্রেটারী হওয়ায় বিএনপি’র নগর সেক্রেটারী ডা. শাহাদাত হোসেন তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে মিষ্টি খেয়ে আসলেন। রাজনৈতিক শিষ্টাচার ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে একজন খুনীকে যে কিনা নিজের ডেডিকেটেট কর্মী আবিদকে হত্যা করালো তাকে ফুলের শুভেচ্ছা জানাবেন?
ডাক্তার শাহাদাতের মত একজন ক্লীন ইমেজধারি নেতা খুনী, সন্ত্রাসী আজম নাছিরকে ফুল দিয়ে মূলত আবিদের খুনিদেরকেই উৎসাহিত করেছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষক ও ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সুদীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে সৃষ্ট অনিয়ম দূর্ণীতির মাফিয়ারা প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে শক্ত আসন গেড়ে অবস্থান করছে। নানান প্রতিকূলতা আর ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এগুতে হচ্ছে। এখানে নতুন করে দেশ জুড়ে একটি অযাচিত নতুন ইস্যু তৈরী করে কোন ফাঁদে পা দেয়া বর্তমান সরকারের উচিত হবেনা।
ডা. শাহাদাত মেয়র পদে আসীন হোক বা না হোক তার শপথ গ্রহণটাই গোটা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলবে। দেশজুড়ে বরখাস্তকৃত জনপ্রতিনিধিদের মামলার মাধ্যমে পদ ফিরে পাওয়ার ঝড়ে অন্তর্বতীকালীন সরকারের ইমেজ আরো দারুণভাবে ক্ষুন্ন হবে।




