বিশেষ প্রতিবেদক: মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চাঙ্গা রাখে যুবলীগ। মিছিল-মিটিং সবখানেই সরব থাকে যুবলীগের নেতাকর্মিরা। এই ধারা দেশের প্রায় সব এলাকায় বিদ্যমান থাকলেও ভিন্নতা রয়েছে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। সাবেক মেয়র মরহুম এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রুপ ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন গ্রুপের কোন্দলে দীর্ঘদিন ধরেই স্থবির রয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের রাজনীতি। এই কোন্দলের কারণেই নয় বছর পরও পূর্ণতা পায়নি চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের ১০১ সদস্যের আহবায়ক কমিটি।
ওই আহবায়ক কমিটিকে ৯০ দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় যুবলীগের সম্মেলন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পদ-পদবী নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মিদের মধ্যে কোন্দল এতটাই চরম পর্যায়ে, বিবদমান দু’গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশংকায় এখনও পর্যন্ত সম্মেলনের আয়োজন করা যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে যুবলীগের সম্মেলন না হওয়ায় হতাশা বিরাজ করছে তৃণমূল নেতাকর্মিদের মধ্যে।
বন্দর নগরী চট্টগ্রামে সর্বশেষ যুবলীগের সম্মেলন হয়েছে ১৮ বছর আগে ২০০৪ সালের অক্টোবরে। ওই সম্মেলনের পর যুবলীগ নেতা চন্দন ধরকে সভাপতি ও মশিউর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তখন চট্টগ্রাম মহানগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। অধিকাংশ ওয়ার্ডে এখনও সেই ১৮ বছরের মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটিই বহাল রয়েছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ এসব ওয়ার্ড কমিটির অনেক নেতাই আর যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে নেই। তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মারাও গেছেন।
জানা গেছে, ২০০৪ সালের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১৩ জুলাই চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের ১০১ সদস্যের আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয় কেন্দ্র থেকে। এই কমিটির আহবায়ক করা হয় সাবেক মেয়র মরহুম এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী মহিউদ্দিন বাচ্চুকে। এছাড়াও চারজনকে যুগ্ম আহবায়ক করা হয়। তারা হলেন- দেলোয়ার হোসেন খোকা, ফরিদ মাহমুদ, মাহাবুবুল হক সুমন ও দিদারুল আলম। এদের মধ্যে প্রথম তিনজন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী ও শেষের জন সাবেক মন্ত্রী এমএ মান্নানের ছেলে। সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীর অনুসারীর নেতারাই মূলত স্থান পান ১০১ সদস্যের ওই কমিটিতে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীদের মধ্যে মাত্র সাতজন স্থান পান ওই কমিটিতে।
এ কারণে ওই আহবায়ক কমিটি ঘোষণা হওয়ার পর চট্টগ্রাম মহানগরীতে যুবলীগের কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। ওই আহবায়ক কমিটি গঠনের পর থেকে স্থানীয় যুবলীগের বিবদমান গ্রুপগুলো বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি আলাদাভাবে পালন করে আসছে। এরমধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মহানগর যুবলীগের নতুন কমিটি গঠিত না হওয়ায় অধিকাংশ নেতাকর্মি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে এখানে যুবলীগের রাজনীতি। নেতাকর্মিদের নিষ্ক্রিয়তা এতটাই চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসেও কোনো কর্মসূচি পালন করেনি আহবায়ক কমিটি!
এই দলীয় কোন্দলের কারণে ১০১ সদস্যের আহবায়ক কমিটি চট্টগ্রাম মহানগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র পাঁচটি ওয়ার্ডের সম্মেলন করতে সক্ষম হয়েছে। এরমধ্যে কেটে গেছে নয়টি বছর। অথচ, গঠনতন্ত্রে যুবলীগের এই আহবায়ক কমিটির মেয়াদ মাত্র তিন মাস ছিল। এখনও এখানকার দলীয় কোন্দল নিরসন হয়নি। বরং চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের নতুন কমিটি গঠনের নানামুখী উদ্যোগ নেয়ার খবরে আরো চাঙ্গা হয়েছে দলীয় কোন্দল। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি কিংবা নতুন কমিটি গঠন না হওয়ায় বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের নেতৃত্বে জট তৈরী হয়েছে। দলের হাল ধরতে প্রস্তুত অনেকেই। সভাপতি হওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা-তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
এরা হলেন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক কার্য নির্বাহী পরিষদের সদস্য দেবাশীষ পাল দেবু, চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এমআর আজিম, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) কাউন্সিলর যুবলীগ নেতা হাসান মুরাদ বিপ্লব, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কার্য নির্বাহী পরিষদের সাবেক সদস্য সুরঞ্জিৎ বড়ুয়া লাভু ও দিদারুল আলম দিদার, চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক দিদারুল আলম ও মাহাবুবুল হক সুমন।
চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে আলোচনায় রয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য সনত বড়ুয়া ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসের সাজ-সজ্জা উপ-কমিটির সদস্য ফসিউল আলম রিয়াদ, চট্টগ্রাম আইন কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস সুমন দেবনাথ ও চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবু মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। এছাড়াও চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের নতুন কমিটির বিভিন্ন পদে যাদের নাম আলোচনায় রয়েছে তারা হলেন, সাবেক ছাত্রনেতা আবু নাসের আজাদ, খোরশেদ আহমেদ জুয়েল, শিবু প্রসাদ চৌধুরী, মো. হেলাল উদ্দিন, শেখ মহিউদ্দিন বাবু, গোলাম ছামদানি জনি, আরিফুল ইসলাম মাসুম, সাজ্জাদ আলী, নুরুল আজিম রনি, মো. ইকবাল হোসেন, দিদাউর রহমান তুষার ও অ্যাড. রবি।
অবিলম্বে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের নতুন কমিটি গঠন করা উচিত বলে মন্তব্য করে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের স্টিয়ারিং কমিটির সাবেক সদস্য দেবাশীষ পাল দেবু বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের কমিটি গঠন করা হচ্ছে না। শেখ ফজলে শামস পরশ ভাই কেন্দ্রীয় যুবলীগের দায়িত্ব নেয়ার পর সারাদেশে যুবলীগের রাজনীতি চাঙ্গা হয়েছে। চট্টগ্রামেও ইতোমধ্যে বর্ধিত সভা হয়েছে। আশা করছি, খুব শিগগির এখানে কমিটি হবে। যারা যুবলীগের হয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদেরকে মূল্যায়ন করে কমিটি গঠন করা হলে চট্টগ্রামে যুবলীগের রাজনীতি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আমি করোনা মহামারির শুরু থেকে মাঠে ছিলাম, এখনও আছি। চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের দায়িত্ব পেলে সকলকে নিয়ে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করে যাবো।
চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও ওমরগণি এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এমআর আজিম বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে রাজনীতি চাঙ্গা রাখতে যুবলীগের অন্যন্য ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে যুবলীগের কমিটি না থাকায় এই বন্দর নগরীতে যুবলীগের রাজনীতিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। সেইসঙ্গে দেখা দিয়েছে নেতৃত্বের জটও। আমি মনে করি অবিলম্বে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের নতুন কমিটি গঠন করা উচিত।
চট্টগ্রাম নগরীর ৩৩ নং ফিরিঙ্গীবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, নয় বছর আগে যে আশা-আকাংখা নিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই আশা-আকাংখা পূরণ করতে পারেনি ১০১ সদস্যের আহবায়ক কমিটি। এই কমিটির মেয়াদ ছিল তিন মাস। সেখানে তারা নয় বছর পার করলেও সম্মেলন করতে পারেনি। ওয়ার্ড পর্যায়েও কমিটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। একেকটি ওয়ার্ড কমিটি ২০ থেকে ৩০ বছরের পুরোনো। এমনকি তাদের নিষ্ক্রিয়তায় এখানে যুবলীগের রাজনীতিও স্থবির হয়ে পড়ে আছে।
এদিকে যুবলীগকে চাঙা রাখতে বিভাগীয় টিম সফরের অংশ হিসেবে গত ২৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম আসেন কেন্দ্রীয় নেতারা। চট্টগ্রাম নগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা যুবলীগকে চাঙা করতে আসেন চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নাঈম ও চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িতপ্রাপ্ত যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুর রহমান সোহাগসহ অন্যরা। এ সময় নগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা যুবলীগের নেতাদের নিয়ে বর্ধিত সভা করেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
কখন হচ্ছে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের নতুন কমিটি এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নাঈম ও চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িতপ্রাপ্ত যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুর রহমান সোহাগের বক্তব্য জানার জন্য বারবার ফোন করার হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।
একই প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহবায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের নেতারা চট্টগ্রামে এসে মহানগর যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সঙ্গে যে বর্ধিত সভা করেছেন, সেখানে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সে সিদ্ধান্তগুলো স্থগিত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতারা আমাদেরকে এখন দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশ দিয়েছেন।