খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি: খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পৃথকভাবে রামগড় ও লক্ষীছড়ি উপজেলায় সেনা অভিযানের নামে দমন-পীড়নের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা অভিযানের নামে স্কুলভবন দখল করে ‘অস্থায়ী ক্যাম্প’ বানানো, গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে তল্লাশি, নারীদের সাথে অসদাচরণ, লুটপাট, ধরপাকড়, শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করা এবং অবর্ণনীয় জনদুর্ভোগ সৃষ্টির প্রতিবাদে রামগড়ে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি) ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম।
সোমবার(০১ সেপ্টেম্বর) সকালে রামগড় উপজেলার খাগড়াছড়ি-ঢাকা সড়কের দাতারাম পাড়া মুখ এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়। মিছিলটি নিপীড়ন বিরোধী বিভিন্ন প্রতিবাদী শ্লোগানে প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে যৌথ খামার এলাকায় গিয়ে সমাবেশে মিলিত হয়।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রামগড় উপজেলা শাখার সাংগঠনিক সংম্পাদক সুরেশ ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের রামগড় উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শান্ত চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রামগড় উপজেলা শাখার সভাপতি তৈমাং ত্রিপুরা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের রামগড় উপজেলা শাখার সভাপতি ধনু ত্রিপুরা।
শান্ত চাকমা বলেন, সেনা অভিযানের নামে গ্রামে গ্রামে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে। নিরীহ মানুষকে হয়রানি ও আটক করা হচ্ছে। শিশুদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এভাবে একটি জাতিকে অশিক্ষার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সেনারা যদি সত্যিই নিরাপত্তার জন্য কাজ করতো তবে স্কুল ভবন দখল না করে শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা করত।
তিনি আরও বলেন, ইউপিডিএফ সবসময় পাহাড়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। তারা বারবার সংলাপ ও রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানিয়েয়ে আসছে। কিন্তু সেনারা উল্টো ইউপিডিএফসহ সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে দমননীতিকে বেছে নিয়েছে। শান্তি অস্ত্রের মুখে প্রতিষ্ঠিত হয় না, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যায়বিচার ও জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে-বলেন তিনি।
তৈমাং ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে সেনাঅপারেশনের নামে অন্যায় ও নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। গ্রামে প্রবেশ করে ঘরবাড়িতে তল্লাশি চালানো, মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ ও দলিলপত্র লুট করা হচ্ছে। মানুষের মৌলিক অধিকার পদদলিত হচ্ছে। আমরা পাহাড়ি জনগণও এই দেশের নাগরিক। সংবিধান আমাদের সমান অধিকার দিয়েছে। তাহলে কেন বারবার সেই অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে?
ইউপিডিএফ জনগণের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। পাহাড়ের ছাত্র, যুব, নারী, কৃষক সবাইকে সংগঠিত করে ইউপিডিএফ আজ জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ এই সংগঠনকে দুর্বল করতে সেনারা নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে ইউপিডিএফ সবসময় ন্যায়বিচার ও অধিকারের সংগ্রামে অবিচল থেকেছে।
ধনু ত্রিপুরা বলেন, সেনা অভিযানের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে। কৃষকরা ক্ষেতে যেতে পারছে না, দিনমজুররা কাজ পাচ্ছে না, বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে গেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে যেতে পারছে না, কারণ ভবনগুলো দখল করে অস্থায়ীভাবে ক্যাম্প বানানো হয়। মা- বোনেরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন, কারণ অতীতে এই ধরনের অভিযানের সময় নারীদের ওপর নির্যাতন, অপহরণ ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, সেনারা বলে তারা সন্ত্রাসী খুঁজছে। কিন্তু সত্য হলো ইউপিডিএফ প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ করে, জনগণের সঙ্গে থাকে,জনগণের ন্যায্য দাবি তুলে ধরে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারে না সেনারা। কারণ ইউপিডিএফ কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয়, এটি পাহাড়ি জনগণের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের সংগঠন। সেনারা প্রকৃত সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে সাধারণ মানুষকেই টার্গেট করছে।
ইউপিডিএফ শান্তিপূর্ণ উপায়ে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে আসছে এবং চালিয়ে যাবে। পাহাড়ি জনগণের প্রথাগত ভূমি অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ইউপিডিএফ সবসময় সোচ্চার রয়েছে এবং অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত সোচ্চার থাকবে। যদি সরকারের পক্ষ থেকে দমননীতি চালু থাকে, তবে পাহাড়ের আন্দোলন আরও তীব্র হবে। এর দায়ভার একমাত্র সরকার ও সেনাবাহিনীকেই বহন করতে হবে।
সমাবেশ শেষে উপস্থিত সকলে একযোগে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ আর দমন-পীড়ন মেনে নেবে না। সেনা অভিযান ও অস্থায়ী ক্যাম্প অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। পাহাড়িদের অধিকার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হলে দমননীতি নয়, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
সমাবেশে শেষে গাড়িতে করে ফেরার পথে নাকাবা বাজারে সেনা মদদপুষ্ট একদল ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীরা অস্ত্র তাক করে পথরোধ করে এবং গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের রামগড় উপজেলা শাখার সভাপতি ধনু ত্রিপুরার ওপর হামলার চেষ্টা চালায়। এ সময় সন্ত্রাসীরা বাসনা মোহন চাকমা নামে এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা অভিযানের নামে দমন-পীড়ন, বাড়িঘরে তল্লাশি, নারীদের সাথে অসদাচরণ, লুটপাট ও স্কুল ভবন দখলের প্রতিবাদে লক্ষীছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন, লক্ষীছড়ি থানা শাখা।
সোমবার(১ সেপ্টেম্বর ) সকাল ১১টায় উপজেলার যতীন্দ্র কার্বারি পাড়া থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে মরাচেঙ্গী মুখপাড়া ঘুরে পূনরায় যতীন্দ্র কার্বারি পাড়ায় এসে সমাবেশে মিলিত হয়। এতে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচ শতাধিক ছাত্র-জনতা অংশ গ্রহণ করেন।
এ সময় তারা সেনা নিপীড়ন বিরোধী বিভিন্ন শ্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পিসিপি লক্ষীছড়ি থানা শাখার সভাপতি জয়সেন চাকমা এবং সঞ্চালনা করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন লক্ষীছড়ি থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক এলি চাকমা।
বক্তব্য রাখেন- পিসিপির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি কুনেন্টু চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের অর্থ সম্পাদক মনিকা চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি ক্যামেরন দেওয়ান।
বক্তারা অভিযোগ করেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে আংশিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে আগের মতোই সেনাশাসন চলছে। ড. ইউনুসের অন্তবরতী সরকার সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার পর থেকে দমন-পীড়নের মাত্রা আরও বেড়েছে।
তারা বলেন, সেনা সদস্যরা নির্বিচারে বাড়িঘরে ঢুকে টাকা- পয়সা, দলিলপত্র লুট করছে, জিনিসপত্র তছনছ করছে এবং স্কুল ভবন দখল করে অস্থায়ী ক্যাম্প বানানোর কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বিঘ্ধসঢ়;ন ঘটছে। সেনা অভিযানের সময় নারীরা যৌন হয়রানি ও আতঙ্কের শিকার হচ্ছেন।
বক্তারা আরও বলেন, সেনারা অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে সাধারণ মানুষকে আটক ও নির্যাতন করছে, অথচ আসল সন্ত্রাসীদের আশ্রয়- প্রশ্রয় দিচ্ছে। সেনা অভিযানের নামে জনগণকে আতঙ্কে রাখা হচ্ছে।
তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, পাহাড়ি জনগণ আর দমন-পীড়ন মেনে নেবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।




