মো. আয়ুব মিয়াজী, চন্দনাইশ: উত্তরায়ণ সংক্রান্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী তীর্থস্থান চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার বরমা ইউনিয়নের শুচিয়ার বাইনজুরী গ্রামের শ্রীশ্রী শুক্লাম্বর (দিঘী) পীঠ মন্দির- এর বার্ষিক মেলা ও পূণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কনকনে শীত উপেক্ষা করে মনের বাসনা পূরণ করতে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সনাতন ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ একসাথে প্রায় ৩/৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত কয়েক লক্ষ মানুষ পালাক্রমে স্নানের জন্য বরমা শুক্লাম্বর দিঘিতে নেমে পড়ে। যে যার সাধ্যমত ছাগল, কবুতর, গাভীর দুধ, স্বর্ণালংকার দান ও প্রসাদ বিতরণ করেছেন উৎসব উপলক্ষে।
গতকাল সোমবার (১৫ জানুয়ারি) পৌষ সংক্রান্তি শেষে মাঘ মাসের প্রথম দিনে বসে এ মেলা। প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বসে বিশাল মেলা। সে মেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী ভারত, নেপাল, ভুটান থেকে আসে সনাতনী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন গৌত্রের ও শ্রেণির মানুষ মানত নিয়ে এ পীঠমন্দিরে। মেলার দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পুণ্যার্থীদের ঢল নামে।
স্থানীয়ভাবে জানা যায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নদীয়া থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য আসা শুক্লাম্বর ভট্টাচার্যের ধর্মদেশনা স্থানে ২ শতাধিক বছর পূর্বে শুক্লাম্বর ভট্টাচার্যের নামে এ মেলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রয়াত নিত্যানন্দ বৈলয়। লোকজন মেলা ছাড়াও বছরের প্রতিদিন কেউ না কেউ এ পীঠমন্দিরে তাদের মানত নিয়ে আসতে দেখা যায়। তবে সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এর সংখ্যা বেশি থাকে।
স্থানীয়দের মতে, শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য এ দিঘির পাড়ে বসে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। দীর্ঘদিন ধ্যান মগ্ন থাকার পর ২ শতাধিক বছর পূর্বে তিনি ইহ জগত ত্যাগ করলে, তাকে এ দিঘির পাড়ে সমাহিত করা হয়। তার সমাহিত স্থানে একটি অর্শ্বথ বৃক্ষ বিশাল জায়গা জুড়ে স্মৃতি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। পূজারীরা এ অর্শ্বথ বৃক্ষের ডালে সুতা বাঁধে মনোবাসনা পূরণের আশায় এবং কবুতর ছেড়ে দেয়। মন্দিরের জন্য মানত করা শত শত ছাগল বলী দেয়। বিভিন্ন পূজনীয় দান মন্দিরে উৎসর্গ করেন মেলায় আসা পুণ্যার্থীরা। তাছাড়া দিঘীতে মেলার দিনসহ বিভিন্ন সময়ে গাভীর দুধ ঢেলে দেয়, স্নান করে তাদের মনোবাসনা পূরণের জন্য। দিঘির দক্ষিণ পাড়ে একটি শিবমন্দির রয়েছে। যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মহিলারা তাদের সন্তানদের জন্য মানত করে পূজা দেয়, তাদের মনোবাসনা পূরণ হয় বলেও তাদের বিশ্বাস।
এছাড়া সারাবছর বিভিন্ন মানত নিয়ে পুণ্যের লক্ষ্যে দিঘিতে দুধ, ছাগল, কবুতর, ফল-ফলাদি উৎসর্গ করে থাকেন সনাতন ধর্মের অনুসারীরা। তাদের মতে দিঘির পানিতে উৎসর্গকৃত দুধ পানির সঙ্গে না মিশে তলদেশে চলে যায়। তাছাড়া এক সময় ছেলে-মেয়ের বিয়ের জন্য আবেদন জানালে বিয়ের সকল সরঞ্জাম দিঘিতে ভেসে উঠার অনেক গল্প-কাহিনীও রয়েছে। এ রকম নানা উপাখ্যান আছে দিঘিটিকে ঘিরে।
তাদের বিশ্বাস এখানে দুধ, ছাগল, কবুতর এমনকি স্বর্ণের অলংকার উৎসর্গ করলে মনের সব বাসনা পূর্ণ হবে। আর তাই সারা বাংলাদেশের হাজার হাজার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের নানা মনের বাসনা পূরণের লক্ষ্যে মানুষগুলো একই মোহনায় মিলিত হয় শুক্লাম্বর দিঘিতে পৌষ সংক্রান্তির এ মিলন মেলায়। এখানে দিনব্যাপী চলে পূজা-উৎসব। সে সাথে প্রত্যেকে স্ব-স্ব ধ্যানে-জ্ঞানে মগ্ন থাকে পূজা-অর্চনায়।
পুণ্যার্থীদের ভিড়ে এ দিনটি উৎসব মুখর থাকে দিঘীর চারপাশ। মেলায় আসা পুণ্যার্থী পুরুষ-মহিলারা একসাথে দিঘির চারপাশে ১০টি ঘাটে স্নান করার দৃশ্য লক্ষণীয়। সে সাথে অর্শ্বথ বৃক্ষে শত শত কবুতর অবস্থান করে, যা সবার নজর কাড়ে। একইভাবে পুণ্যার্থীদের দানের স্তুপ পড়ে যায় এ পীঠমন্দিরে যা ব্যবহার করে মন্দিরের পরিচালনা পরিষদ মন্দির সংস্কার ও নির্মাণ কাজে।
মেলা পরিচালনাকালীন থানা অফিসার ইনচার্জ ওবাইদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. বিপ্লব গাঙ্গুলী, মেলা আয়োজন কমিটির সভাপতি ও বরমা ইউপি চেয়ারম্যান মো: খোরশেদ আলম টিটু, আ’লীগ নেতা বলরাম চক্রবর্তী, আহসান ফরুক, মধু সুধন দত্ত, এড. রতন কুমার সেন, ডা. বিধান চন্দ্র ধর, ডা. কাজল বৈদ্য, মেম্বার নওশা মিয়া, শওকত হোসেন টিপু, উপজেলা পূজা উৎযাপন কমিটির আহ্বায়ক বিষ্ণু যশা চক্রবর্তী, সদস্য সচিব কৃষ্ণ চক্রবর্তী, আনিসুর রহমান, দিলীপ ভট্টাচার্য, জয়দেব গাঙ্গুলি, অশোক দত্ত, বিধান দেব, হারাধন ধর, নৃপতি দত্ত প্রমুখ মন্দির ও মেলা পরিদর্শন করেন।
পূণ্যার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সমাধান করার অনুরোধ শুনতে হয় আয়োজক কমিটির।




