টেকনাফ থেকে ফিরে,তৈয়ব চৌধুরী: ছোট্ট একটা করিডোর ঘিরে ৫০ হাজার পরিবারের অর্থ ও খাদ্যের যোগানদার ছিলো টেকনাফ শাহ্পরীর দ্বীপ। সূর্য উদয় থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতো হাজার মানুষের সমাগম, তৈরি হতো কর্মযজ্ঞ। বৈধ আয়ের পথ ছিলো সাধারণ খেটেখুটে খাওয়া মানুষগুলোর। কিন্তু শকুনের নজর থেকে রক্ষা পায়নি বৈধতা। অবৈধভাবে আয়ের পথ তৈরি করতে সুকৌশলে শাহ্পরীর দ্বীপের করিডোর বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গত ২০০৩ সালে জানুয়ারী থেকে ক্যাটল করিডোর হিসেবে চালু হয়। মায়ানমার থেকে স্বল্প মূল্যে গরু আমদানি করার জন্য এবং গরুর মাংস সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার চিন্তাভাবনায় শাহ্পরীর দ্বীপ গবাদিপশু ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিঃ- কে সরকার অনুমোদন দেয়। প্রতি গরু ৫০০ টাকা প্রতি ছাগল ৩০০ টাকা হারে সরকারের রাজস্ব আদায়ের নির্ধারণ করে করিডোর চালু করা হয়। ব্যবসায়ীরাও সরকারের রাজস্ব দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিল এবং ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত গরুর মাংস সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই ছিলো।বৈধ ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলেই এক লাফে গরুর মাংস ৮০০-৯০০ টাকা ও ছাগলের মাংস ১২০০-১৪০০ টাকা হলেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়।
শকুনের নজর করিডোরে
শাহ্পরীর দ্বীপ ক্যাটল করিডোর চালু হলে পরে গবাদিপশু ব্যাবসায়ীরা প্রতিদিন গড়ে ১০০০ – ২০০০ গরু আমদানি করে নিয়ে আসতো, এবং সরকারও প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা করে রাজস্ব পেতো। সেখানে কোনো দলের নেতাকর্মীদের দেওয়া হতো না চাঁদা। স্হানীয় ছাত্রলীগ যুবলীগ চাঁদা আদায়ে ব্যর্থ হলেই বড়ো শকুন সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি’র নজরে আনেন। দুই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন সুকৌশলে সমিতির সভাপতির সাথে। প্রথম প্রস্তাব গরু বহনকারী বড় ট্রলারে বদির লোক আশা যাওয়া করবে, তার মানে হচ্ছে মায়ানমার থেকে ইয়াবা, আইচ, গোল্ড ও যতসব মাদকদ্রব্য আনা নেওয়া হবে এই করিডোর দিয়ে। সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম প্রস্তাব নাখোশ করে দিলে বদি’র পক্ষে দ্বিতীয় প্রস্তাব দেওয়া হয় এককালীন ৩ কোটি টাকা ও প্রতিমাসে ২০ লাখ টাকা করে চাঁদা দিতে হবে।
স্পষ্টভাবে বদি জানান, এই তিন কোটি টাকার ভাগ দিতে হবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী স ম রেজাউল করিম, কক্সবাজার ৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল ও চাকরিয়া ১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম ওরফে বাইট্টা জাফরকে। সমিতিও স্পষ্টভাবে বলে দেন এখানে কোনো অবৈধভাবে ব্যবসা করা হচ্ছে না, সরকার অনুমোদন দিয়েছে ও বৈধভাবে সরকারের রাজস্ব দিয়ে ব্যবসা করা হয়। চাঁদা দিতে পারবেনা বললেই খড়গ নামে গবাদিপশু ব্যবসায়ীদের উপর। ইয়াবা ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বদি’র কুপ্রস্তাবে ব্যবসায়ীরা রাজি না হওয়ায় করিডোর বন্ধ করে দিতে উঠেপড়ে লাগে। কোনো কারণ ছাড়াই ২০২১ সালের ৫ জুলাই জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদনের এক চিঠির মাধ্যমে শাহ্পরীর দ্বীপ করিডোর বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীদের মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে। আটকে যায় ওপারে মায়ানমারে এলসির টাকা। তৎকালীন ৯০ লাখ ডলারে ছিয়াত্তর কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা। ব্যবসায়ীরা সমিতির মাধ্যমে এলসি করা হয় গরু আমদানির জন্য। করিডোর বন্ধ হয়ে গেলে এলসির টাকা আর ফেরত আনতে পারেননি বলে জানায় ব্যাবসায়ীরা।
যেভাবে করিডোর বন্ধ হয়
মাদকসম্রাট আবদুর রহমান বদি’র কুপ্রস্তাবে রাজি না হলেই সুকৌশলে স্হানীয় তৎকালীন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পারভেজ চৌধুরী, বিজিবি’র লেফটেন্যন্ট কমান্ডার এম নঈম উল হক ও পুলিশ সুপার মোঃ হাসানুজ্জামানকে দিয়ে ও চোরাচালান প্রতিরোধ টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন প্রেরণের মাধ্যমে এবং ২৭ জুন ২০২১ পরবর্তী মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভার সিদ্ধান্তে উপনীত গবাদিপশু অনুপ্রবেশের পক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে বলে ৪ জুলাই ২০২১ চোরাচালান প্রতিরোধ টাস্কফোর্সের সমবায় কমিটির বিশেষ সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়।
চোরাচালান ও করিডোর ঝুকিপূর্ণ আছে বলে এক প্রতিবেদনের আলোকে তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ মামুনুর রশীদ স্বাক্ষরিত স্মারক নম্বর ৫,২০,২২০০,১২৩,০৭৭,০০৩,২০২১-৪৭১ মূলে প্রতিবেদন দাখিল করে ৫ জুলাই ২০২১ সালে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ব্যাপরে নির্দেশনা করা হয়েছে ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফোন করে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে গবাদিপশু প্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে বলা হয়েছে।
পরবর্তীতে বিজিবি’র লেফটেন্যন্ট কমান্ডার এম নঈম উল হকে’র মাধ্যমে মৌখিক ভাবে গবাদিপশু ব্যবসায়ীদের ডেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বলা হয় এবং আজ থেকে টেকনাফ শাহ্পরীর দ্বীপ ক্যাটল করিডোর বন্ধ করে দেওয়া হলো।
শাহ্পরীর দ্বীপ গবাদিপশু ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিঃ এ অভিযোগ করে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটা ফোনের মাধ্যমে নাকি করিডোর বন্ধ করে দেওয়া হয়, কিন্তু কোনো চিঠি বা করিডোর বন্ধ করার বিষয়ে নির্দেশনা না দিয়ে মৌখিক ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়।
করিডোর বন্ধ নাকি চোরাচালান বৃদ্ধি?
টেকনাফবাসীর মধ্যে এখন একটাই প্রশ্ন শাহ্পরীর দ্বীপ করিডোর বন্ধ হলো নাকি মাদক ও সোনা চোরাচালান বৃদ্ধি পেলো। মায়ানমার থেকে গরু আমদানি করে ব্যবসায়ীরা শাহ্পরীর দ্বীপ করিডোর দিয়ে সরকারের দেওয়া নীতিমালা অনুসারে রাজস্ব পরিশোধের মাধ্যমে বৈধতার ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করতো এবং ট্রলার দিয়ে যখন গরু শাহ্পরীর দ্বীপ করিডোরে আনা হতো সেখানে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে উপস্থিত থাকতো কাস্টমস কর্মকর্তা, এনবিআর কর্মকর্তা ও বিজিবি। অথচ বৈধ ব্যবসা ও সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করে অবৈধভাবে গরু আনা হচ্ছে মিয়ানমার থেকে।
বিশস্ত সুত্রে জানা যায়, তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী স ম রেজাউল করিম গোপন সিন্ডিকেট তৈরি করার মাধ্যমে মাদকসম্রাট আবদুর রহমান বদি, সাইমুম সরওয়ার কমল ও জাফর আলম ওরফে বাইট্টা জাফরের তত্ত্বাবধানে অবৈধভাবে গরু আনার পরিকল্পনায় মাদক ও সোনা চোরাচালান ব্যবসা বৃদ্ধি করে দেয়। নাইক্ষ্যাংছড়ির স্হানীয় নজরুল ইসলাম ও নুরুল আবছার সোহেলকে দিয়ে মায়ানমার থেকে অবৈধভাবে চোরাচালান মাধ্যমে গরুর সাথে ইয়াবা, আইচ ও সোনা আনা হয়। নাইক্ষ্যাংছড়ির সীমান্ত ফুলতলী, দোছড়ি, আশারতলীর জামছড়ি ও ধুমধুমে বাইশপারী দিয়ে গভীর রাতে ওপার মায়ানমার পান্ডো ও মন্ডু হয়ে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১ থেকে ২ কোটি টাকার চোরাচালান পন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করতো। এই চোরাচালান পন্য আসায় স্হানীয় বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যাংছড়ি থানা ও কক্সবাজার জেলার রামু থানার কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা এবং স্হানীয় দায়িত্বরত প্রশাসনের কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত ভাবে লাভবান হচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
স্হানীয়দের সাথে আলাপ করে জানা যায়, স্হানীয় সকল প্রশাসনকে ম্যনেজ করে মায়ানমার থেকে গভীর রাতে গরু আনাটা হচ্ছে লোক দেখানো মূল ব্যবসা হচ্ছে ইয়াবা, আইচ ও সোনা চোরাচালান। মাদক ও সোনা চোরাচালানের ট্রানজিট হিসেবে নাইক্ষ্যাংছড়ি সীমান্ত এলাকা গুলো চোরাকারবারিদের সহজ সুবিধাজনক বলে যুবসমাজও চোরাকারবারিতে ঝুঁকে পড়েছিল।
বন্ধ হয়নি চোরাচালান
শাহ্পরীর দ্বীপ করিডোর দিয়ে গরু আনা হচ্ছে বলে মাদকের চালান আসছে ও ঝুঁকি আছে বলে করিডোর বন্ধ করে দেওয়া হলে গরু আমদানি ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জনগনের বক্তব্য প্রশাসন কি চোরাচালান বন্ধ করতে পেরেছে, বরং আগের তুলনায় চোরাচালান আরো বেড়েছে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি মাদকসম্রাট আবদুর রহমান বদি’র সিন্ডিকেটের সুবিধা ও স্বার্থসিদ্ধি করতে সরকারের থাকা জেলা প্রশাসক সহ তৎকালীন দায়িত্বরত প্রশাসনের কর্মকর্তারাদের যোগসূত্রে বৈধ করিডোর বন্ধ করে দেওয়া হয়। শাহ্পরীর দ্বীপ করিডোর বন্ধ করে দিয়ে নাইক্ষ্যাংছড়ি সীমান্ত এলাকাকে চোরাচালানের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে সুবিধা হচ্ছে।
করিডোর খুলে দেওয়ার দাবিতে মানববন্ধন
বিগত আড়াই বছর ধরে করিডোর বন্ধ হয়ে থাকায় ব্যবসায়ীরা নিধারুণ কষ্টে পড়ে গেছে বলে জানান।এই গরু ব্যবসার সাথে প্রায় ৫০ হাজার পরিবারের আয়ের উৎসাহ ছিল। বর্তমানে প্রতিটি পরিবার কষ্টে দিনাতিপাত করছে বলে জানান। শাহ্পরীর দ্বীপ করিডোর খুলে দেওয়ার দাবিতে গত ৩০ অক্টোবর (বুধবার) টেকনাফবাসী মানববন্ধন করেন।
করিডোর বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ্পরীর দ্বীপ গবাদিপশু ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি’র সভাপতি আবুল কাসেম বলেন, ২০০৩ সাল থেকে বৈধভাবে বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব দিয়ে মায়ানমার থেকে গরু আমদানি করে ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের তৎকালীন ইয়াবা ও মাদকসম্রাট আবদুর রহমান বদি’র কুপ্রস্তাবে ও তার চাহিদা ৩ কোটি টাকা চাঁদা না দেওয়ায় করিডোর বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ সলিমুল্লা বলেন, আগে করিডোর চালু ছিলো আমরা গরু ব্যবসায়ীরা গরু আমদানি করেছি তখন গরুর মাংস প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে ছিলো, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা মধ্যেই ছিলো এখন নাইক্ষ্যাংছড়ি সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে গরু আনা হচ্ছে তারা সরকারকে কোনো রাজস্ব দিচ্ছে না তেমনি গরুর দাম তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়ায় মাংসের দামও ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা হয়ে যাওয়াতে সাধারণ মানুষ মাংস কিনে খেতে পারছেনা। নাইক্ষ্যাংছড়ি সীমান্ত দিয়ে গরু আনার নামে মাদকের চোরাচালান আসছে অহরহ। সরকার যদি অবৈধভাবে গরু আনা বন্ধ করে দিয়ে করিডোর খুলে দেয় তাহলে সরকার রাজস্ব পাবে প্রয়োজনে আগের নির্ধারিত প্রতি গরু ৫০০ টাকার স্হলে ১ হাজার টাকা করে দিলেও গরুর মাংস প্রতি কেজি ৫/৬ শত টাকার মধ্যে বিক্রি করা যাবে এবং সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে।
এলাকাবাসীও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা করিডোর খুলে দিয়ে ৫০ হাজার পরিবারের আয়ের উৎসাহ যোগান দিবে এবং মাদকসম্রাটদেরকে আইনের আওতায় আনবেন।
মুঠো ফোনে জানতে চাওয়া হলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আদনান জানান, তখনকার সময় ব্যবসায়ীদরকে উদ্বুদ্ধ করা হয় কিন্তু পরে পাচারের সমস্যার কারণে করিডোর বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মানববন্ধন বিষয় বলেন, ব্যবসায়ীরা এর আগেও কয়েকবার করেছে গত তিন মাস আগেও মানববন্ধন করে আমার কাছে স্মারকলিপি দেয় সেটা আমি উপরস্থ কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়েছি।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এ প্রতিবেদককে হোয়াটসঅ্যাপ এ জানান, এটা জেলা প্রশাসকের বিষয়। ওনার সাথে যোগাযোগ করার জন্য।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসকে একাধিক বার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি পরে হোয়াটসঅ্যাপ এ বিষয়টি জানতে চাইলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।




