নিজস্ব প্রতিবেদক: সময়ের সাথে সাথে স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিট। বিএম কন্টেনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় চমেকের ইমারর্জেন্সি থেকে বার্ন ইউনিট, সার্জারিসহ অন্যান্য ইউনিটগুলোতে ভর্তি হয়েছে শতাধিকের বেশি আহত ও দগ্ধ রোগী। পাশাপাশি হতাহতদের ঘিরে স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতালের পরিবেশ।
এদিকে অসংখ্য মানুষ হাসপাতাল এলাকায় ভিড় জমিয়ে খোঁজ করছেন নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের। এসব শত শত স্বজনদের ভিড়ে চিকিৎকসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও নার্সদের। তবু নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলেন জানিয়েছেন চমেক হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক।
রবিবার (৫ জুন) ভোর হতে চমেকের প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে যেন পর্যায়ক্রমে মৃত্যু হচ্ছে একের পর এক অগ্নিদগ্ধদের। ফলে বার্ন ইউনিট থেকে সময়ের ব্যবধানে একে একে বের হচ্ছে লাশ। আর প্রিয়জনের পোড়া লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন স্বজনরা।
চমেকের বার্ন ইউনিট ও জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্য মতে, সীতাকুণ্ডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত মৃত্যু বরণ করছে ৪৬ জন। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ৯ জন। ২১ জনের মরদেহ শনাক্ত করেছে স্বজনরা। চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৬৩ জন।
সরেজমিনে4 দেখা যায়, সকাল হতে চমেক হাসপাতালের পুরাতন জরুরী বিভাগের সামনে অগ্নিদগ্ধদের স্বজনদের উপচে পড়া ভিড়। সেই সঙ্গে একের পর এক লাশের সারি। মৃতদের স্বজনদের তীব্র আর্তনাদে আশপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। কে কাকে সান্ত্বনা দিবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান বলেন, এটি একটি মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। শনিবার দিনগত রাত থেকে রবিবার রাত ১০টা ৪৬ জনের মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত হয়েছি। সকাল থেকে মানুষের উপচেপড়া ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও শৃঙ্খলা বাহিনীকে। সারাদিনই নতুন রোগী এসেছে। বাড়ছে লাশের সারি। একের পর এক লাশের তালিকা বাড়ায় স্বজনদের আহাজারিও বাড়ছে।
পাঁচলাইশ এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি হাসপাতালের পিআরও কাওসার আলম বলেন, হাসপাতাল কেন্দ্রিক দু’যুগেরও বেশি সময় পার করছি। কিন্তু সীতাকুণ্ডের অগ্নিকান্ডের মতো একদিনে এত লাশের সারি অতীতে কখনোই দেখা হয়নি। কাটা-ছেঁড়ার মধ্যেই আমাদের নিত্যবাস। এরপরও অগ্নিকাণ্ডে মারাত্মক দগ্ধ হয়ে মৃতদের লাশ আমাদের হৃদয়কেও নাড়া দিয়েছে। এতে নিহতদের স্বজনদের মনের অবস্থা কি হচ্ছে তা সহজে অনুমেয়। এতগুলো লাশের স্বজনদের আহাজারি কঠিন হৃদয়কেও ব্যতীত করছে।
ভয়াবহ এই ট্র্যাজেডির পর হাসপাতাল এলাকায় জরুরি দায়িত্বপালন করতে আসা পুলিশ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, চাকরি জীবন একযুগ পার করছি, এমন ট্র্যাজেডির মুখোমুখি কখনো হয়নি। একদিনে এত লাশের সারি কখনো দেখতে হয়নি। মনে হচ্ছে আজরাইল (আ.) বার্ন ইউনিটে অবস্থান করছেন।
তিনি আরও বলেন, যারা কাটা-ছেঁড়ায় আঘাত পেয়েছেন তাদের কিছুটা রক্ত প্রয়োজন পড়ছে। পোড়া রোগীর রক্ত তেমন লাগে না। তাদের দরকার প্রপার ট্রিটমেন্ট। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। এখানে যাদের সেবা নিশ্চিত সম্ভব হবে না, তাদের ঢাকা পাঠানো হতে পারে। রোগীর চেয়ে ভিড় সামলানো কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়েছে। সার্বক্ষণিক কাজ করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
এদিকে, ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও আগুনে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৯ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াছ চৌধুরী। তবে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান জানিয়েছেন, এ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরও ১৬৩ জন।
শনিবার (৪ জুন) রাত ৯টার দিকে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করার সময় রাসায়নিক থাকা একটি কনটেইনারে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এটার পর আরও একাধিক কন্টেনার বিস্ফোরণ হয় বলে জানান আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করা প্রশাসনের টিম। এতে কয়েকশ মানুষ আহত হন। তাদের মধ্যে ডিপোর শ্রমিক, স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও রয়েছেন।
রাতেই আহতদের অধিকাংশকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এছাড়া চট্টগ্রামের অন্যান্য হাসপাতালেও অনেককে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়। নিহতদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মীও রয়েছেন। এ পর্যন্ত নিহত ২১ জনের পরিচয় সনাক্ত করেছে জেলা প্রশাসন। এদের মাঝে রাত ১০টা পর্যন্ত ১২ জনের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে চমেকের জরুরি বিভাগের বাইরে স্থাপন করা সহায়তা কেন্দ্রে টানানো নোটিশ বোর্ডে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিহতদের দাফনে জেলা প্রশাসনের পক্ষে জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। আহতদের প্রাথমিক ভাবে দেয়া হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। এসব টাকা চমেকে চিকিৎসাধীনরা পেলেও অন্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের ব্যাপারে এখনো কোন সিদ্ধান্ত জানায়নি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।




