বান্দরবান প্রতিনিধি: একসময় ম্যালেরিয়ার পার্দুভাবের কারণে পার্বত্যঞ্চলে সরকারী চাকুরী করা দুষ্কুর ছিল। তখন ম্যালেরিয়াকে ভয়ঙ্কর রোগ হিসেবে দেখা হতো। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ মারা যেতো মানুষ। এখন ম্যালেরিয়াার ভয় কমছে পাহাড়ে। এই রোগটি নিয়ে মানুষের মাঝে একসময় উদ্বেগ, উৎকন্ঠা থাকলেও এখন অনেকটা স্বস্তি ফিরে এসেছে বান্দরবানের পাহাড়ী অঞ্চলে।
এরপরও এখনো মাঝে মাঝে জুম্ম জনগোষ্টীসহ কাঠুরিয়া ও শ্রমজীবি মানুষকে হানা দেয় ম্যালেরিয়া। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, অসচেতনতার কারণে এখনো পাহাড়ে ম্যালেরিয়ার পার্দুভাব থাকলেও পূর্বের তুলনায় কমেছে মৃত্যুর হার।
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে এখনো ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি পার্বত্য জেলা বান্দরবানে। এখানে এই রোগের প্রবণতার হার ৭২শতাংশ। এই জেলার থানচি, আলীকদম, লামা উপজেলাকে উচ্চ ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে যৌথভাবে কাজ করছে স্বাস্থ্য বিভাগ ও বেসরকারী এনজিও সংস্থা ব্রাক ও একতা মহিলা সমিতি। পাশাপাশি বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি ও নাইক্ষ্যংছড়িতেও কম নয় এই রোগের প্রার্দুভাব।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, ২০১৯সালে বান্দরবানে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫হাজার ৭০৯জন। ২০২০ সালে আক্রান্ত হয়েছে ৪হাজার ১৬৬জন এবং সর্বশেষ ২০২১সালে ৫হাজার ২২৮জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।
আর ২০২০ ও ২০২১ সালে দুইজন করে মোট ৪জনের মৃত্যু হয়েছে পুরো জেলায়। তিন বছরের এই তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বান্দরবানে হঠাৎ বেড়েছে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের হার। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে এই রোগের প্রার্দুভাব বৃদ্ধি পায় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বান্দরবানের বাঘমারা এলাকায় কর্মরত ব্র্যাকের ল্যাব টেকনিশিয়ান চৌখিং প্রু মারমা ও স্বাস্থ্যকর্মী মিরা সেন বলেন- গ্রামে মানুষ অসুস্থ্য হলে তাদের ম্যালেরিয়া পরীক্ষার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়। তাদের এলাকায় বিশেষ করে মধ্যবয়সী মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় বলে জানান।
রোয়াংছড়ি উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার সত্যজিত মজুমদার বলেন, ম্যালেরিয়ার ভয়ে একসময় পাহাড়ে সরকারী চাকুরী করতে আসতে ভয় পেতো মানুষ। কিন্তু এখন রোয়াংছড়ি, থানচি, রুমার মতো দূর্গম এলাকায় নিয়মিত কাজ করেন তারা। আগের মতো ম্যালেরিয়ার ভয় তাদের নেই। এরপরও এখনো দূর্গম এলাকায় সাধারণ মানুষ অসচেতনতার কারণে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়।
ভারত ও মিয়ানমার দুই দেশের সীমান্ত লাগোয়া জেলা বান্দরবান। প্রতিবেশী এই দুই দেশের সীমান্তঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রার্দুভাব বেশি। বর্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ম্যালেরিয়ার বাহক মশা পাহাড়ি জঙ্গলে ফিরে আসে। এ সময় পাহাড়ী জনগোষ্টী দুর্গম পাহাড়ে গেলে মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। এছাড়া বেশি বৃষ্টিপাত, বনাঞ্চল, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অশিক্ষা ও দারিদ্র্য, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইত্যাদি নানা কারণে বান্দরবানের পাহাড়ী অঞ্চলের মানুষকে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যেতে হচ্ছে।
ব্র্যাকের জেলা সমন্বয়ক মো: আরিফ জানান, ম্যালেরিয়ার জন্য বান্দরবান গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলা। আলীকদম, থানচি উপজেলায় ম্যালেরিয়া প্রকোপ এলাকা। এজন্য স্বাস্থ্যবিভাগ ও ব্র্যাকের পক্ষ থেকে এসব এলাকায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জেলায় মোট ৮০১জন স্বাস্থ্যসেবিকা এবং ১৫১জন স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছেন। স্বাস্থ্যসেবিকারা গ্রাম পর্যায়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে আরডিটি পরীক্ষা করে থাকেন। তাঁরমতে পাহাড়ে বৃষ্টি হলে ম্যালেরিয়া বৃদ্ধি পায়।
হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকসহ প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে স্বাস্থ্য বিভাগ ও এনজিও সংস্থা ব্রাকের স্বাস্থ্যকর্মীরা ম্যালেরিয়া শনাক্তে দীর্ঘদিন ধরে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে দূর্গম এলাকায় তাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা ম্যালেরিয়া নির্মূলে অবদান রাখার পাশাপাশি কিটের বিস্তার রোধ, কীটনাশকযুক্ত মশারি ব্যবহারের উৎসাহ প্রদান করছে। এতে করে বান্দরবানে ম্যালেরিয়ার বিস্তার রোধ ও মৃত্যু হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ২০১৭সাল থেকে ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকায় নিয়োগ করা হয়েছে স্পেশাল হেলথ ওয়ার্কার।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বান্দরবান সিভিল সার্জন ডা: নীহার রঞ্জন নন্দী বলেন, বান্দরবান ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় এখানে। গেল বছর ৭২শতাংশ রোগী আক্রান্ত হয়েছে। এই জন্য আমাদের সবসময় বান্দরবানকে নিয়ে আলেদাভাবে চিন্তা করতে হয়। ম্যালেরিয়া যাতে আক্রান্ত কম হয় এবং মৃত্যু কমে যায় সে লক্ষ্যেই তারা কাজ করছেন। জেলার স্বাস্থ্যবিভাগের প্রধান এই কর্মকর্তার মতে, জেলার থানচি, লামা ও আলীকদম ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা। ম্যালেরিয়া নির্মূলে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে মশারী ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে।
‘উদ্ভাবনী কাজে লাগাই, ম্যালেরিয়া রোগীর জীবন বাচাই’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে ২৫এপ্রিল পালিত হবে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। ২০১৫সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূলের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের। আর তাই শুধু দৃশ্যমান এলাকা নয়, স্বাস্থ্যবিভাগ ও এনজিও কর্মীদের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড ভিত্তিক কার্যক্রম আরো জোরদারের দাবী জানিয়েছেন সচেতন মহল।



