খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি: খাগড়াছড়ি, রাংগামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায় অপহরণ যেন থামছেই না, বেড়েই চলছে। এতে সাধারণ মানুষের মনে আতংক বিরাজ করতে শুরু করেছে। পাহাড়ে একের পর এক অপহরণ চলছেই। ইনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ(প্রসিত) এর সশস্ত্র কর্মীদের এহেনও কার্যক্রম দেখে সবাই এখন উদ্বিগ্ন। তাদের কার্যক্রম দিন-দিন এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যেন তারা এখন প্রশাসনের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
এদিকে অপহরণের ৫ দিন পার হয়ে গেলেও খাগড়াছড়িতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী এখনো উদ্ধার হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁদের পরিবার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-পিসিজেএসএস –সন্তু লারমা– সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সদস্যরা।
ইউপিডিএফ(প্রসিত) এর সশস্ত্র কর্মী কর্তৃক টমটম গাড়ির চালকসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫জন শিক্ষার্থীকে গত ১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি সদরস্থ গিরিফুল নামক স্থান হতে অপহরণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে চালককে ছেড়ে দিলেও পাঁচ শিক্ষার্থীর খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। অপহৃত রিশন চাকমা পিসিজেএসএস(মুলদল) সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ-পিসিপি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য।
অন্য চার শিক্ষার্থী হলেন, চবির চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মৈত্রীময় চাকমা ও অলড্রিন ত্রিপুরা, নাট্যকলা বিভাগের দিব্যি চাকমা ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগের লংঙি ম্রো। তাঁরা ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পিসিমজেএসএস(সন্তু) ও ইউপিডিএফ(প্রসিত) সমর্থিত পিসিপির মধ্যে প্রকাশ্য এবং মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। সেই ক্ষোভে খাগড়াছড়িতে পিসিজেএসএস সন্তু সমর্থিত পিসিপির ছেলে মেয়েরা বিজু উপলক্ষে বেড়াতে আসলে ইউপিডিএফ(প্রসিত) সমর্থিত সশস্ত্র গ্রুুপের সদস্যরা তাদেরকে অপহরণ করে বলে জানা যায়।
জানা যায়, সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দলের পিসিপি কর্তৃক পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে উভয় দলের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। সেই ঘটনার প্রেক্ষিতেও অপহরণ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অপরদিকে গত শনিবার বিকেলে মানিকছড়ি উপজেলার ময়ুরখীল থেকে ২জন রবি মোবাইল নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ানকে অপহরণ করা হয়।
ঘটনার শুরু ২২ জানুয়ারি ২০২৫ রাতে। ঐ রাতে একযোগে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, মাটিরাংগা ও মানিকছড়ি উপজেলার ৮টি মোবাইল টাওয়ারের যন্ত্রাংশ ভাংচুর ও মালামাল তছনছের ঘটনায় জড়িত কেউ আজও সনাক্ত হয়নি। ফলে ওই সব টাওয়ার এখনও বন্ধ রয়েছে। আর গত শনিবার বিকেলে ওই এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত সেই রবি টাওয়ার মেরামত করতে যান ২জন টেকনিশিয়ান। মুহূতের মধ্যেই সেখানে হাজির কয়েকজন সশস্ত্র সন্ত্রাসী। টেকনিশিয়ানদের টাওয়ার থেকে নামিয়ে জোরপূর্বক মোটর সাইকেলে তুলে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। এ ঘটনায় আবারও পাহাড়ে অনিশ্চিত হয়ে গেল নষ্ট হওয়া রবি টাওয়ার মেরামত বা রবি সেবা। কিন্তু কী কারণে রবি টাওয়ারে দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে তা বন্ধ রেখেছে সেটির সদুত্তর মিলছে না কোথাও।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অপহৃত পাঁচ শিক্ষার্থীকে নিশর্ত মুক্তিসহ আরো দুই টেকনিশিয়ানদের মুক্তির দাবিতে খাগড়াছড়ি শহর ও বান্দরবানে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। রোববার ও সোমবার দুপুরে শহরে প্রেসক্লাব চত্বরের সামনে পৃথক এই প্রতিবাদ সমাবেশ কর্মসূচী পালন করা হয়।
এসময় হাতে ফেস্টুন ও প্ল্যার্কার্ড হাতে নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেন শিক্ষার্থীরা এবং অতিদ্রুুত নিঃশর্তভাবে সুস্থ শরীরে তাদের মুক্তির দাবিসহ অপরাধীদের দ্রুুত আইনের আওতায় এনে সুষ্ঠু বিচারের জন্য যথাযথ প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানান।
এদিকে চাঁদার দাবিতে অজ্ঞাত সন্ত্রাসী কর্তৃক মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করার কয়েকটি ঘটনা ঘটার মাসাধিককাল পার হলেও এখনো অভিযুক্ত কাউকে আটক করা যায়নি। নেটওয়ার্কও পুরোপুরি সচল হয়নি। মাঝে মধ্যেই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অভ্যন্তরীণ বন্দুকযুদ্ধে কেঁপে উঠছে পাহাড়ি জনপদ। ফলে একের পর এসব ঘটনা চলমান থাকায় দেশের মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, কোন পথে চলে পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস। অপরদিকে বিভিন্ন আস্তানায় সেনাবাহিনীর ব্যাপক অভিযান,ঘরবাড়ি তল্লাশিসহ নানা হয়রানির অভিযোগ উঠেছে।
পিসিজেএসএস সন্তু গ্রুুপের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অভিযোগের ভিত্তিতে কথিত “অপহরণের” শিকার হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫শিক্ষার্থীকে উদ্ধারের নামে জেলা ব্যাপীী চলছে সেনাবাহিনীর ব্যাপক অভিযান। গত ১৬ এপ্রিল বিকেল থেকে শুরু হওয়া এ অভিযান এখনো চলমান রয়েছে। অভিযানকালে সাধারণ লোকজনের ঘরবাড়ি তল্লাশি, গাড়ি আটকিয়ে তল্লাশিসহ নানা হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত বুধবার(১৬ এপ্রিল) বিকেলের দিকে হঠাৎ করে পিসিজেএসএস সন্তু গ্রুুপের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নেতা- কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ৫জন শিক্ষার্থীকে(যারা সবাই তাদের ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত) খাগড়াছড়ি সদরের গিরিফুল এলাকা থেকে ‘অপহরণের” অভিযোগ করে এবং এর জন্য ইউপিডিএফকে দায়ি করে। আর বিভিন্ন মিডিয়া দ্রুুত এ খবরটিকে লুফে নেয় ও ছড়িয়ে দেয়। যদিও ইউপিডিএফ শুরু থেকে এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
এরপর বিকেল থেকে সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করে। তারা শিব মন্দিরসহ আশে-পাশের এলাকায় অভিযান চালাতে থাকে। গত ১৮ এপ্রিল সকালে খাগড়াছড়ি শহরের পানখাইয়া পাড়া, মধুপুরসহ আশে- পাশে এলাকায় কর্ডন দিয়ে পুলিশসহ সেনাবাহিনীকে অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায়। এ সময় তারা ঘরবাড়ি ও গাড়িতে তল্লাশি পরিচালনা করে বলে জানা গেছে। বিকেলে দক্ষিণ খবংপুজ্জে এলাকায় অভিযান চালানোর তথ্য পাওয়া যায়। গত শনিবার(১৯ এপ্রিল) ভোর থেকে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের সুরেন্দ্র মাষ্টার পাড়া, হেডম্যান পাড়া এলাকায় ব্যাপক সেনাবাহিনী উপস্থিতি ও ঘরবাড়ি তল্লাশি চালানোর খবর পাওয়া গেছে। খাগড়াছড়ি ছাড়াও গতকাল রাঙামাটির কুদুকছড়ি এলাকায়ও সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তারা রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি আন্ত: প্রধান সড়কের বিভিন্ন স্থানে চলাচলকারী গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি চালায়। অপরদিকে খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি-ঢাকা সড়কেও তল্লাশি কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে সেনাবাহিনী-পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
অভিযানকালে সাধারণ জনগণের ঘরবাড়িতে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের নামে জনগণকে নানা হয়রানি করা হচ্ছে বলে নাম প্রকাশ না করা শর্তে ভুক্তভোগী লোকজন অভিযোগ করেছেন।
অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ব্যাপক অভিযান সত্ত্বেও “অপহৃত” শিক্ষার্থীরা এখনো উদ্ধার না হওয়ায় জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। উক্ত ৫জন শিক্ষার্থী কী আসলে অপহরণের শিকার হয়েছেন, নাকি আত্মগোপনে রয়েছেন? কারণ তারা বাঘাইছড়িতে বিঝু উৎসবে যোগ দেয়ার নাম করে সন্তু গ্রুুপের সশস্ত্র ও ছাত্র সংগঠনের নেতা- কর্মীদের সাথে মিলিত হয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে।
একটি বিশ্বস্ত সূত্র মতে, পিসিজেএসএস সন্তু গ্রুুপ রাষ্ট্রীয় একটি বিশেষ মহলের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে খাগড়াছড়িতে কার্যক্রম শুরুর চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যেই শিক্ষার্থী ‘অপহরণ’ ঘটনা সাজানো হয়েছে কি-না সে প্রশ্ন উঠছে সচেতন মহলে।
সচেতন মহল বলছেন, অতীতে স্বনিভর বাজারের মতো জনসমাগম স্থানে প্রকাশ্যে দিবালোকে ব্রাশফায়ারে ছাত্র-যুব নেতাসহ ৬জন জনকে হত্যার ঘটনায় রাষ্ট্রীয় কোন বাহিনীর তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। অপরাধীরা প্রশাসনের নাকের ডগায় ঘুরলেও তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়নি। কিন্তু এখন একটি পক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় যৌথ বাহিনী যেভাবে তৎপরতা শুরু করেছে, অভিযান পরিচালনা করছে তা রীতিমত সন্দেহজনক।
অপরদিকে চবি ৫শিক্ষার্থী অপহরণের ৫দিন পরও যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। খাগড়াছড়ি শহরের সদর উপজেলার গিরিফুল এলাকা থেকে অপহৃত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করা যায়নি ঘটনার ৫দিন পার হলেও। উদ্ধারে যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
খাগড়াছড়ি সদর থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) মো: আব্দুল বাতেন মৃধা বলেন, “ঘটনার পর এখনো পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা দায়ের হয়নি। খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো: আরেফিন জুয়েল জানান, চবি’র ৫জন শিক্ষার্থীসহ ৬জনকে অপহরনের ঘটনায় পাহাড়ের আঞ্চলিক একটি সংগঠন জড়িত থাকতে পারে। আমরা মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের অবস্থান সনাক্ত করে উদ্ধারের চেষ্টা করছি।
খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো: আরেফিন জুয়েল আরো জানান, অপহৃতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ অভিযান চলছে। আমার অপহৃতদদের উদ্বারে সব ধরনের চেষ্টা করছে। সে সাথে বিভিন্ন সড়কে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।