সুকান্ত বিকাশ ধর, সাতকানিয়া: সাতকানিয়ায় নুরুল ইসলাম প্রকাশ নুরাইয়্যা (২৮) নামে এক মাদকসেবী ও বিক্রেতার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে রাতের আঁধারে প্রথমে বসতঘর ভাংচুর ও পরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে স্থানীয় বিক্ষুব্ধ লোকজন। মঙ্গলবার (০৮ এপ্রিল) রাতে উপজেলার বাজালিয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের হলুদিয়া গ্রামের উদ্দুরিক্যা পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে।
নুরাইয়্যা উপজেলার বাজালিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সিকদার পাড়ার বাসিন্দা মৃত উলা মিয়ার ছেলে । সে দীর্ঘদিন ধরে একই ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের হলুদিয়া গ্রামের উদ্দুরিক্যা পাড়ায় অসাধু বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বন বিভাগের সংরক্ষিত এলাকায় অবৈধভাবে ঘর স্থাপন করে পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বছরের পর বছর বন বিভাগের জায়গায় অবৈধভাবে লোকজন পরিবার নিয়ে বসত করে আসলেও ম্যানেজ হওয়ায় কোন ব্যবস্থা নেয়নি বন বিভাগের কর্তা ব্যক্তিরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উদ্দুরিক্যা পাড়াটি বান্দরবান সদর উপজেলা ও সাতকানিয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী। বিভিন্ন স্থান থেকে আগত বাসিন্দারা বন কর্মকর্তাদের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে সেখানকার বন বিভাগের সংরক্ষিত এলাকায় বসতি স্থাপন করে দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছিল। পরে ওই পাড়ার অন্যান্যদের মত নুরাইয়্যাও একই কায়দায় পার্শ্ববর্তী ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে এসে দীর্ঘ দিন ধরে উদ্দুরিক্যা পাড়ায় বসবাস শুরু করে। পরে সেখানে এসে সে বান্দরবান সদর উপজেলার রেইচা, মাঝের পাড়া, থলি পাড়া ও সুয়ালক থেকে দেশীয় চোলাই মদ সংগ্রহ করে তার বসতঘরে মজুদ করতেন। পরে সেখান থেকে সংগ্রহকৃত দেশীয় চোলাই মদ বিভিন্ন জায়গায় পাচার ও বিক্রয় করতেন। অনেকেই আবার তার ঘরে মদ পান করতে যেতেন।
এলাকাবাসী আরও জানান, নুরাইয়্যা নিজে মদ পান করে প্রায় সময় রাতের অন্ধকারে স্থানীয়দের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করত। তার এমন কর্মকাণ্ডে এলাকাবাসী রীতিমত অতিষ্ঠ ছিল। কেউ কেউ প্রতিবাদ করলে নুরাইয়্যা ও তার ভাইরা মিলে প্রতিবাদকারীদের উপর আক্রমণ করত। এ ঘটনায় বছর খানেক আগে স্থানীয়রা একটি মানববন্ধনও করেছিল। কিছু দিন আগে নুরাইয়্যা ও তার তিন ভাইসহ মিলে উদ্দুরিক্যা পাড়ার লোকজনের চলাচলের একটি কাঠের কালভার্ট কেটে দেয়। এ ঘটনায় স্থানীয়দের সাথে তাদের কথা কাটাকাটি হয়। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তার ভাইয়েরা মিলে বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দাদের মারধর করেন। পরে স্থানীয়রা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করলে তার ভাইয়েরা পালিয়ে যায়। পরে এলাকার লোকজনের চাপাচাপিতে মঙ্গলবার (৮এপ্রিল) নুরাইয়্যা তার ভাইদের কালভার্ট ও রাস্তা ঠিক করে দেওয়ার জন্য পাঠায়। তবে নুরাইয়্যা না আসায় এলাকার লোকজন কাজ করতে নিষেধ করে। এতে তর্কাতর্কি ও ধাক্কাধাক্কি হয় উভয়দের মধ্যে। পরে বিক্ষুব্ধ স্থানীয় লোকজন মঙ্গলবার রাতে তার বসতঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। নুরাইয়্যার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।
স্থানীয় মো.আনোয়ার, পিংকি আকতার ও বুলু আকতার বলেন, মাদক বিক্রেতা ও সেবী নুরুল ইসলাম প্রকাশ নুরাইয়্যার অত্যাচারে এলাকাবাসী রীতিমতো অতিষ্ঠ। সে বিভিন্ন সময় মাদকসেবন করে স্থানীয়দের গতিরোধ করে টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিত। এ ছাড়া সে আমাদের পাড়ায় কেউ নতুন করে বসতঘর স্থাপন করলে তার কাছ থেকে চাঁদা নিত। কেউ তাকে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে বসতঘর নির্মাণ করতে দিতেন না। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকাবাসী তার বসতঘরটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে।
এ ব্যাপারে নুরুল ইসলাম প্রকাশ নুরাইয়্যা বলেন, স্থানীয় ওচমানের কাছ থেকে আমি ৬ হাজার টাকা পাওনা রয়েছি। টাকা খুঁজলে সে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। তাই আমি রাগান্বিত হয়ে চলাচলের রাস্তার সামান্য অংশ কেটে দিয়েছি। ওচমানসহ এলাকার লোকজন আমার মা ও বউ-ছেলেকেও মারধর করেছে।
তিনি বলেন, আমি কয়েকদিন ধরে চন্দনাইশের ধোপাছড়ি এলাকায় নলকুপ বসানোর কাজ করছিলাম। মঙ্গলবার রাতে ওচমানের নির্দেশে এলাকার লোকজন মিলে আমার বসতঘরে ভাংচুর ও আগুন দিয়েছে। আমি যদি অপরাধী হই স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ রয়েছে। তাদের নিকট আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যেত। কেন তারা আমার বসতঘরে আগুন দিল, এর আমি সুষ্ঠু বিচার চাই। তার বিরুদ্ধে মাদক ও বন আইনে মামলা থাকার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন।
এব্যাপারে অভিযুক্ত ওচমান গণি তার কাছ নুরাইয়্যা টাকা পাওনার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, সে (নুরাইয়্যা) এলাকায় মদ পান ও বিক্রি করে। মদ পান করে লোকজনকে গালিগালাজ করে। রাতের আঁধারে মহিলাদের ঘরে হানা দেয়। এ বিষয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নিকট এলাকাবাসী অভিযোগ দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মানববন্ধনও হয়েছে। এসব বিষয় এলাকায় না করতে নিষেধ করলে সে মঙ্গলবার তার ভাইদের পাঠিয়ে প্রতিবাদকারীদের রাম দা ও লাঠি নিয়ে মারতে আসে। ফলে এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে তার ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
বাজালিয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. নাছির উদ্দিন সিকদার বলেন, নুরাইয়্যা মদ পান করে এলাকার লোকজনকে গালিগালাজ করার অভিযোগ করছেন এলাকার লোকজন । এছাড়া মামলা ও জায়গা দখল নিয়ে এলাকার লোকজনের সাথে তার (নুরাইয়্যা) মনোমালিন্য ও পূর্ব বিরোধ রয়েছে। ওচমানের সাথে টাকা সংক্রান্ত বিষয়ে নুরাইয়্যার ঝগড়া হয়, সে কারণে নুরাইয়্যা কালভার্ট কেটে দিয়েছে ও রাস্তা খুঁড়ে দিয়েছে বলে এলাকার লোকজন থেকে জানতে পেরেছি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এলাকার লোকজন তার ঘর পুড়ে দিয়েছে বলে শুনেছি।
সাতকানিয়ার বড়দুয়ারা বন বিট কাম চেক স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা মো.বজলুর রশিদ দীর্ঘদিন ধরে বন বিভাগের জায়গায় অবৈধভাবে বসত ঘর নির্মাণ করে বসবাসের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, শতাধিক বছর আগে থেকে পাহাড় দখল করে ওই এলাকায় লোকজন বসত করে আসছে। এ বিষয়ে উচ্ছেদের তালিকা করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে।
সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, খবর পেয়ে রাতেই পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, নুরুল ইসলাম নুরাইয়্যার বিরুদ্ধে মদ বিক্রি ও পান করে এলাকায় মাতলামি করার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়রা চলাচলের জন্য একটি কালভার্ট তৈরি করলে সেটি সে কেটে দেয়। এজন্য এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়। এলাকার লোকের চাপে মঙ্গলবার দিনের বেলা তার লোকজন কালভার্টটি তৈরি করতে আসে। তবে এলাকার লোকজন বলছে, নুরাইয়্যাকেও আসতে হবে। এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে ঝগড়া ও সামান্য মারামারি হয়। এতে লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে রাতে প্রথমে তার বসতঘর ভাংচুর ও পরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ ঘটনায় এখনও কেউ থানায় অভিযোগ করেনি। অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।




