সুকান্ত বিকাশ ধর, সাতকানিয়া: গ্রাম্য সালিশি বৈঠকে জরিমানা, কান ধরে ওঠবস, মাটিতে সিজদা সর্বোপরি সমাজচ্যুত হয়ে প্রথমে পার পেয়ে গিয়েছিল বাক প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণের চেষ্টাকারী সাতকানিয়ার চরতি ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর ব্রাহ্মণডেঙ্গা গ্রামের আনার বাপের বাড়ির মৃত সফর মুল্লুকের ৫৫ বছর বয়সী পুত্র মো. আজিজ। কিন্তু বাদ সাধল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (ফেসবুক)। সালিশি বৈঠকের বিষয়টি ফেসবুকে ভাইরাল হলে নজর পড়ে সাংবাদিকদের।
কয়েকটি অনলাইন ও জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রচারের পর থানা পুলিশের উপর চাপ আসে ওই ধর্ষণের চেষ্টাকারী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের জন্য । অবশেষে থানা পুলিশ বাধ্য হয়ে শুক্রবার (০৪ এপ্রিল)ধর্ষণকারী আজিজকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসে। এ ঘটনায় বাক প্রতিবন্ধী ওই নারীর বড় ভাই বাদী হয়ে ধর্ষণকারীকে একমাত্র আসামী করে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার বিষয়টি জানাজানি হলে ক্ষু্দ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সচেতনমহল ও মানবাধিকার কর্মীরা। তাদের দাবী, ফৌজদারি অপরাধের মত একটি বিষয়কে যারা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ভূমিকা রাখা সালিশকারকদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
জানা যায়, সাতকানিয়া উপজেলার চরতি ইউনিয়নের এক বাকপ্রতিবন্ধী নারীকে বসতঘরে প্রবেশ করে জোরপূর্বক ধর্ষণকরার অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় সালিশি বৈঠকের মাধ্যমে অভিযুক্তকে ১০ বার কান ধরে ওঠবস, সিজদা, বিশ হাজার টাকা জরিমানা ও সমাজচ্যুত করার সিদ্ধান্ত দিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করে দেন স্থানীয় “সমাজপতিরা”। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (ফেসবুক) এ প্রকাশ হলে শুক্রবার (০৪এপ্রিল) কয়েকটি অনলাইন ও জাতীয় দৈনিকে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
বিষয়টি পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আসলে সাতকানিয়া থানা পুলিশ শুক্রবারই আজিজকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসে। এ ঘটনায় শুধুমাত্র আজিজকে গ্রেপ্তারে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মী ও সচেতন মহল।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সহকারি পাবলিক ও প্রসিকিউটর (এপিপি) ও সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম মহানগরীর সদস্য এডভোকেট এনামুল হক বলেন, ধর্ষণের চেষ্টায় বিষয়টি ফৌজদারি অপরাধের আওতায় পড়ে। এখানে শুধুমাত্র ধর্ষণের চেষ্টাকারীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠালে অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি হবে না। যারাই আইনবহির্ভূতভাবে এ ধরনের অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত সেই সালিশকারকরাও এ অপরাধের দায় এড়াতে পারে না। এ রকম অপরাধ থেকে সালিশকারকদের দায়মুক্তি দিলে সমাজে এমন অপরাধের সাথে জড়িতরা আরও দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে নতুন কোন অপরাধে যুক্ত হতে উৎসাহিত হবে।
সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনার শুরুতে বিষয়টি কেউ থানায় জানায়নি। অললাইন ও জাতীয় কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা থেকে এ বিষয়ে জানার পর ধর্ষণের চেষ্টায় লিপ্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছি। এ ঘটনায় ভিকটিমের বড় ভাই বাদী হয়ে আজিজকে একমাত্র আসামি করে থানায় একটি মামলা করেছেন। গ্রেপ্তারকৃত আজিজকে শনিবার সকালে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ধর্ষণের শিকার ওই বাক প্রতিবন্ধী নারী তার স্বামীসহ সাতকানিয়া উপজেলার চরতী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর ব্রাহ্মণডেঙ্গা গ্রামে তার বাবার বাড়ির পাশেই আলাদা বসতঘর নির্মাণ করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছিলেন। মঙ্গলবার (০১ এপ্রিল) রাত ৯ টার দিকে ওই প্রতিবন্ধী নারী বসতঘরে একা ছিলেন। সেই সুবাদে অভিযুক্ত মো. আজিজ তার বসতঘরে প্রবেশ করে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। এ সময় ওই বাকপ্রতিবন্ধী নারী চিৎকার করলে তার ভাই ও আশেপাশের লোকজন এসে অভিযুক্ত মো. আজিজকে ধরে মারধর করেন। এক পর্যায়ে তিনি কৌশলে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। এর পরদিন বুধবার (০২ এপ্রিল) বিকাল ৩ টার দিকে উভয় পক্ষের সম্মতিতে স্থানীয় ইউপি সদস্য আলহাজ নুরুল আমিন, আবদুল মন্নান, জামাল উদ্দিন, মোরশেদুল আলম টিপু, নুরুল আলম সওদাগর ও আলী নবী লেদুদের নিয়ে একটি সালিসী বৈঠকের মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করা হয়। ওই সালিশী বৈঠকে অভিযুক্ত মো. আজিজকে ধর্ষণচেষ্টার শাস্তি হিসেবে ১০ বার কান ধরে ওঠবস, সিজদা, বিশ হাজার টাকা জরিমানা ও সমাজচ্যুত করা হয়। এ ছাড়াও সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে তাকে উপস্থিত না হওয়ার জন্য নিষেধ করা হয়।




