মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়া-কুতুবদিয়া: কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সাত ইউনিয়নের ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি’র) উপকারভোগী তালিকা তৈরীতে সীমাহীন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অতি দরিদ্র জনগোষ্টীকে তালিকায় উপকারভোগী হিসেবে অন্তর্ভূক্তির জন্য সরকারী নির্দেশনা থাকলেও উপজেলার সাত ইউনিয়নে সেটি মানা হয়নি।
উপজেলার সাত ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ড়ের জনপ্রতিনিধি ও চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন লোকজনকে তালিকাভুক্ত করে গতকাল ৬ মার্চ উপকারভোগীদের তালিকা পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
সাত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা নিজেদের ইচ্ছেমতো স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিজস্ব লোকজনদের তালিকাভুক্ত করে সরকারের একটি জনহিতকর মহৎ কাজকে বিতর্কের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সচেতন মহল।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, পেকুয়া উপজেলার সদর, মগনামা, উজানটিয়া, রাজাখালী, বারবাকিয়া, টইটং ও শিলখালী ইউনিয়নে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অতি দরিদ্র লোকদের তালিকাভুক্ত করা হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদে বসে বসেই টিসিবির উপকারভোগীদের তালিকা তৈরী করা হয়েছে। তালিকায় একই পরিবারের একাধিক সদস্য, মেম্বার-চেয়ারম্যানদের আত্মীয়-স্বজন, স্বচ্ছল, প্রবাসীর স্ত্রী ও সরকারী সুবিাধাভোগী লোকজনদের উপকারভোগীর তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
সরেজমিনে পরিদর্শনকালে স্থানীয়দের কথা বলে জানা গেছে, তালিকা তৈরীতে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে মগনামা, পেকুয়া সদর, রাজাখালী ও টইটং ইউনিয়নে। এছাড়াও বারবাকিয়া, উজানটিয়া ও শিলখালী ইউনিয়নেও তালিকা তৈরীতে অনিয়ম হয়েছে। অধিকাংশ ইউনিয়নে দরিদ্র লোকজনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে উপকারভোগী যাচাই-বাচাই করা হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের অনুগত লোকজনদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। ফলে প্রকৃত দরিদ্র জনগোষ্টী আসন্ন রমজান মাসে ন্যায্য মূল্যে সরকারী পণ্য ক্রয় থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকা রয়েছে।
তালিকায় অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে পেকুয়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুহসিন উদ্দিন আহমেদ জানান, ইউপি মেম্বার ও চেয়ারম্যান যাচাই-বাচাই করে তালিকা তৈরী করেছেন। আর চেয়ারম্যানের সই করা তালিকাটি তিনি পেকুয়া ইউএনও অফিসে প্রেরণ করেছেন।
পেকুয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি মো: বেলাল উদ্দিন মিয়াজি অভিযোগ করে জানান, পেকুয়া সদর ইউনিয়নে টিসিবি’র তালিকা তৈরীতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের অনুগত লোকজনকে টিসিবি’র উপকারভোগীর তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে সরকারী ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছেন। এর ফলে প্রকৃত দরিদ্র জনগোষ্টী বঞ্চিত হবে।
অপরদিকে পেকুয়া উপজেলার মগনামা, রাজাখালী ও উজানটিয়া ইউনিয়নেও উপকারভোগীদের তালিকা তৈরীতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। এখনকার মেম্বার-চেয়াম্যানেরাও নিজেদের ইচ্ছেমতো উপকারভোগীদের তালিকা তৈরী করে ইউএনও অফিসে জমা দিয়েছে।
পেকুয়া উপজেলা বারবাকিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা বদিউল আলম জিহাদি তার ইউনিয়নে তালিকা তৈরীতে কোন ধরনের অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন। তবে এ জনপ্রতিরিধির সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন ওই ইউনিয়নের দরিদ্র বাসিন্দারা।
জানা যায়, মগনামা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পেকুয়া ইউএনও অফিসে প্রেরিত টিসিবি’র উপকারভোগীর তালিকা বাতিলপূর্বক সরেজমিনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালিকা তৈরী করার জন্য গতকাল ৬ মার্চ পেকুয়ার ইউএনও’র দফতরে লিখিত অভিযোগ করেছেন মগনামার স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে, অভিযোগের প্রেক্ষিতে পেকুয়ার ইউএনও কার্যালয় কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি মর্মে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগের বিষয়ে পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের প্রধান সহকারী মো: শরিফ জানান, টিসিবি’র তালিকা তৈরীর বিষয়ে মগনামা ইউনিয়নে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে এ ধরনের একটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মগনামার চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক ও পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে টিসিবি তালিকাভুক্ত পরিবারের জন্য দুই দফায় সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ ও খেজুর সরবরাহ করবে সরকার। আর পেকুয়ার সাত ইউনিয়নে উপকারভোগীদের তালিকা সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে তৈরী করে সেটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠাবেন পেকুয়ার ইউএনও। কিন্তু ইউপি চেয়ারম্যানদের পাঠানো তালিকা ট্যাগ অফিসারদের মাধ্যমে সরেজমিনে যাচাই-বাচাই না করেই জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে প্রেরণ করেছেন এমনটাই অভিযোগ করেছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
এ প্রসঙ্গে পেকুয়ার ইউএনও পূর্বিতা চাকমা জানান, ইউপি চেয়ারম্যানেরা স্ব স্ব ইউনিয়নের উপকারভোগীদের তালিকা তার কার্যালয়ে জমা দিয়েছে। অনিয়ম হলে তিনি ব্যবস্থা নিবেন।
প্রসঙ্গত: বর্তমানে চলমান কোভিড পরিস্থিতিতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় কমে যাওয়া ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আসন্ন রমজানে টিসিবিরি তালিকাভূক্ত পরিবারগুলোকে দুই দফা ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করবে সরকার। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে সারাদেশে খোলা ট্রাকে টিসিবির পণ্য বিক্রি। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সরকারী বিক্রয় সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তালিকাভুক্ত পরিবারের জন্য সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ ও খেজুর সরবরাহ করবে। প্রতিটি পরিবার রমজানের আগে একবার দুই লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি চিনি, দুই কেজি মসুর ডাল ও এক কেজি ছোলা পাবে। আবার রমজানের মাঝামাঝি সময় থেকে ঈদের আগ পর্যন্ত একই পরিমাণ পণ্য আরেক দফা দেওয়া হবে পরিবারগুলোকে।
কিন্তু উপকার ভোগীদের তালিকা তৈরীতে পেকুয়া উপজেলার সাত ইউনিয়নে ব্যাপক অনিয়ম স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নেওয়ায় এর সুফল পাবেনা প্রান্তিক পর্যায়ের দরিদ্র জনগোষ্টী। অধিকাংশ ইউনিয়নে গোপনে তালিকা তৈরী করা হয়েছে। উপকারভোগীদের তালিকা তৈরীর বিষয়টি এলাকার কেউ জানেনা।
গোপনে তালিকা তৈরীর প্রসঙ্গে মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা অনিল কান্তি শীল জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাই তালিকা তৈরী করেছে। আর সেই তালিকাটি তিনি পেকুয়া ইউএনও অফিসে প্রেরণ করেছেন। তালিকায় অনিয়ম করার প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।




