দি ক্রাইম নিউজ ডেস্ক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার বিষয়টি এখন ক্যাম্পাসে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সিলেকশন বোর্ডে বিভাগসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ শিক্ষক না রাখা, আবেদনের সময়স্বল্পতা, আবেদন করেও মৌখিক পরীক্ষায় যোগ্য প্রার্থীরা ডাক না পাওয়া, উচ্চ আদালতের রুল নিষ্পত্তি না করেই নিয়োগপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখাসহ নানা অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের নিয়োগ কার্যক্রম।
এর মধ্যে প্রার্থীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতারের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) ডেপুটি রেজিস্ট্রার মিছবাহুল মোকর রবীন ও হিসাব নিয়ামক শাখার কর্মচারী আহমেদ হোসেনের আর্থিক লেনদেনবিষয়ক ফোনালাপের কয়েকটি অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। আর এ কারণে তোপের মুখে গতকাল বৃহস্পতিবার রবীনকে উপাচার্যের একান্ত সহকারী পদ থেকে সরিয়ে আগের কর্মস্থল পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরে বদলি করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে চবির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান বলেন, ‘ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অডিও প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তাই রবীনকে উপাচার্যের পিএস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করবে। ফাঁস হওয়া ফোনালাপের সত্যতা যাচাই শেষে অপরাধী কাউকে ছাড় দেবে না প্রশাসন। ’এ ছাড়া লেনদেনের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জসীম উদ্দিন নামের ফারসি বিভাগের সাবেক এক শিক্ষার্থীর ফোনালাপের অডিও ফাঁস হয়েছে। ফাঁস হওয়া অডিওগুলোতে উপাচার্যের ভাতিজা আজফার কামাল চৌধুরী শাওন ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ ইলিয়াছ সিদ্দিকী ও উপাচার্যের নামও উঠে আসে।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৬ মে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে তিনজন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞপ্তিতে ১৬ থেকে ২৬ মে পর্যন্ত আবেদনের সময় দেওয়া হয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে সাপ্তাহিক ও গ্রীষ্মকালীন ১০ দিন বন্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু ২৬ মে এক দিন বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ছিল। এ ছাড়া সব তথ্য ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করার নির্দেশনা থাকলেও ওয়েবসাইট সচল ছিল না। সরাসরি উপস্থিত হয়ে ফরম সংগ্রহের নির্দেশনা ছিল না। আবেদন করতে না পারায় কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী দরখাস্ত সংগ্রহ ও জমাদানের জন্য মৌখিক ও লিখিত আবেদন করলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। আবেদনের সময়স্বল্পতার কারণে অনেকে দরখাস্তই জমা দিতে পারেননি।
তাঁদের মধ্যে একজন চবি রেজিস্ট্রার বরাবর ২৬ মে আবেদনের সময় বাড়ানোর জন্য চিঠি দেন। এতে সাড়া না পেয়ে তিনি হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট ওই বিজ্ঞপ্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না মর্মে রুল জারি করেন এবং আবেদনকারীর দরখাস্ত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই আবেদনকারীর আবেদন গ্রহণ করেনি। পরে ওই রুলের পুরো নিষ্পত্তি না করেই কর্তৃপক্ষ নিয়োগদানের জন্য তৎপর হয়। গত ১৪ নভেম্বর ভাইভা বোর্ড বসে। এ বোর্ডে সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির দেওয়া নামের কাউকে রাখা হয়নি।
চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ, তাঁরা ভাইভা কার্ড পাননি। বিশ্ববিদ্যালয় বলছে কার্ড ফেরত এসেছে, কিন্তু যাঁকে কার্ড পাঠানো হয়েছে বলা হচ্ছে, তাঁর কাছে কোনো ফোনও যায়নি। আবার কার্ড না গেলেও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন দুজন। নাজমুন নাহার নামের একজন ভাইভা কার্ড না পাওয়ায় পুনরায় মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার জন্য রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দেন এবং উচ্চ আদালতে রিট করেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি এই রিটের রুল জারি হয়। এ রুলের বিষয়ে চবি ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মনিরুল হাসান বলেন, ‘ভাইভা কার্ড উনাকে পাঠানো হয়েছে। সেই প্রমাণ আছে। তিনি আদালতে যে অভিযোগ করেছেন সেটার জবাব আমরা দেব। ’
জানা যায়, আগের সিলেকশন বোর্ডে ছিলেন চবি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক মো. আবুল হাসেম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন। এই বোর্ডের মেয়াদ শেষ হলে প্ল্যানিং কমিটি চবি, রাবি ও ঢাবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চার অধ্যাপককে নিয়োগ বোর্ডের জন্য সুপারিশ করে। কিন্তু তাঁদের কাউকে বোর্ডে রাখেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বোর্ড গঠিত হয় চবির বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মহীবুল আজিজ ও ঢাবির আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক শামীম বানু এবং উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারকে নিয়ে। উপাচার্য পদাধিকারবলে বোর্ডের সভাপতি হন এবং তিনিও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। ১৪ নভেম্বর তিন সদস্যের এই বোর্ড বসে।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিশেষজ্ঞ না রেখে ফারসি ভাষা বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের সিলেকশন বোর্ড (ভাইভা বোর্ড) বাংলা বিভাগ ও আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক নিয়ে গঠিত হওয়াকে ‘হাস্যকর ও নিন্দনীয়’ বলেছেন ওই বিভাগের অধ্যাপক মো. আবুল হাসেম।
ফারসি বিশেষজ্ঞ না রাখার ব্যাখ্যায় রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান বলেন, শামীম বানু আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হলেও ফারসি বিষয়ে উনার ডিগ্রি আছে। মহীবুল আজিজকে ডিন হিসেবে রাখা হয়েছে।
এদিকে বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত তিনটি পদের বিপরীতে পাঁচজনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার সরাসরি লঙ্ঘন বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। যে পাঁচজনকে সুপারিশ করা হয়েছে তাঁদের চেয়ে যোগ্যরা ভাইভাতেও ডাক পাননি বলে অভিযোগ ওই বিভাগের শিক্ষকদের।
ভাইভা কার্ড না পেয়েও পরীক্ষা দেওয়া এক প্রার্থী বলেন, ‘আমি ভাইভা কার্ড পাইনি, একটা ফোনকলের মাধ্যমে ভাইভার বিষয়ে জানতে পারি। ওই ফোনে আমার কাছে টাকাও চাওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ভিসির পিএসও আমার কাছে টাকা চেয়েছেন। কিন্তু আমি টাকা দিতে আগ্রহী হয়নি, তাই আমাকে তাঁরা সিলেকশনও করেননি। ’
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও চাকরিপ্রার্থী বলছেন, এই নিয়োগপ্রক্রিয়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এখনো অনিয়মের বিষয়গুলো আমলে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বরত দুজনের লেনদেনের অডিও ক্লিপ ও নানা অনিয়মের বিষয়ে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে রেজিস্ট্রার মনিরুল হাসান বলেন, এ বিষয়ে একজনকে আপাতত দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টির তদন্ত হচ্ছে।
নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখনো নিয়োগ চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয়ে সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নেবে। ’ তবে এসব সমালোচনা ও নানা প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই আগামীকাল শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ এজেন্ডা হিসেবে উপস্থাপন হতে পারে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।-সূত্রঃ কালেরকন্ঠ




