কুমিল্লা প্রতিনিধি: কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটের মাঠে লড়ছেন বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে বহিষ্কৃত প্রভাবশালী দুই রাজনীতিক। এছাড়া সিটির ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডের ১৪টিতে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অন্তত ১৬ জন নেতাকর্মী কাউন্সিলর পদে ভোটে লড়ছেন। এদের মধ্যে এ সিটির সদ্য সাবেক ছয় জন এবং ২০১২ সালের প্রথম নির্বাচনে জয় পাওয়া তিন জন কাউন্সিলরও রয়েছেন। এর বাইরে আছেন জামায়াতে ইসলামীর তিন জন নেতাও, তাদের সবাই সদ্য সাবেক কাউন্সিলর। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি নির্বাচনে না থাকলেও দলটির নির্বাচনমুখী নেতাকর্মীরা ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না—দলটির এমন সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এসব প্রার্থী ভোটে অংশ নিয়েছেন। তারা বলছেন, নির্বাচনে অংশ নিয়ে এখন দুকূল হারানোর শঙ্কায় আছেন তারা, তাই নির্বাচনকে তারা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং আস্থা রেখেছেন নির্বাচন কমিশনের প্রতি। তাদের আশা, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে এটা প্রথম নির্বাচন, তাই সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ ভোট হলে তারা জয় পাবেন। এদিকে বুধবার দিনভর মেয়র ও কাউন্সিলরের তিনটি পদে ১৪৭ জন নারী-পুরুষ প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের উঠান বৈঠক ও পথসভাসহ প্রার্থীর গুণগান গেয়ে গানের সুরে সুরে মাইকিং ও প্রচার-প্রচারণায় সরগরম হয়ে উঠেছে নগরী।
স্থানীয় বিএনপির বিভিন্ন সূত্র ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর তৃতীয়বারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৫ জুন। এর আগে ২০১২ সালে প্রথম ও ২০১৭ সালে দ্বিতীয় নির্বাচন হয়। ঐ দুটি নির্বাচনের প্রথমটিতে অংশ নেয়নি বিএনপি। তাই দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে জয় পান কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুল হক সাক্কু। দ্বিতীয় নির্বাচনে দলের প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপির এই নেতা। এবার বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে দলটি আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এ অবস্থায় দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে টানা দুই বারের এই সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু মেয়র পদে স্বতন্ত্র (টেবিল ঘড়ি) প্রার্থী হন। কিন্তু এর আগে দুটি নির্বাচনে সাক্কুর প্রতিপক্ষ দলের (বিএনপি) কোনো প্রার্থী না থাকলেও দলে স্থানীয় নেতা-নেতৃত্বে চরম গ্রুপিংয়ের কারণে এবার স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও কুমিল্লা মহানগর শাখার সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার (ঘোড়া) স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ায় এই দুই প্রার্থীকেই আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে সংশ্লিষ্ট দল। শুধু তাই নয়, এই দুই প্রার্থীর নির্বাচনের প্রচারকাজে নেতাকর্মী-সমর্থকদের অংশ নিতে নিষেধ করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও প্রচার করে। তবে নির্বাচনে তারা দুজনই অনুসারী কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে দিনরাত ভোটের মাঠে নির্ঘুম প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন।
এদিকে, কাউন্সিলর পদে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পদ-পদবিধারী যেসব নেতা-কর্মী ভোটের মাঠে লড়ছেন তারা হলেন, নগরীর ৩ নম্বর ওয়ার্ড শাখা বিএনপির সভাপতি এনামুল হক। একই ওয়ার্ডে ভোটে লড়ছেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল মোমেন। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে লড়ছেন বিএনপির সদ্য সাবেক কাউন্সিলর শাখাওয়াত উল্লাহ শিপন ও তার ভাই রাজিউর রহমান। ৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির কর্মী মিজানুর রহমান মিলন, ৮ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির কর্মী সৈয়দ মহসিন আলী। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে শহর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও সদ্য সাবেক কাউন্সিলর সেলিম খান। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে কুমিল্লা মহানগর মত্স্যজীবী দলের আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম, ২০ নম্বর ওয়ার্ডে সদর দক্ষিণ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ও সদ্য সাবেক কাউন্সিলর হারুনুর রশিদ, ২১ নম্বর ওয়ার্ডে আছেন জেলা যুবদল নেতা ও সদ্য সাবেক কাউন্সিলর কাজী মাহাবুবুর রহমান, ২২ নম্বর ওয়ার্ডে জেলা বিএনপির সদস্য ও সদ্য সাবেক কাউন্সিলর শাহ আলম মজুমদার। ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে জেলা যুবদলের সহসভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর খলিলুর রহমান মজুমদার, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে সদর দক্ষিণ উপজেলা বিএনপি নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর কামাল হোসেন এবং ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে সদর দক্ষিণ উপজেলা বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে অন্তত ১২ জন কাউন্সিলর প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নেওয়া-না নেওয়ার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি। স্থানীয় পর্যায়ে আমরা জনগণের সেবা করেছি, করোনাকালে সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থেকেছি। তারা আমাদেরকে চায়, আমরা তাদের জন্য আরো কাজ করতে চাই। আর এ জন্যই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি। জয়ের ব্যাপারেও তারা আশা প্রকাশ করেন। এদিকে, জামায়াতে ইসলামীর মহানগরের তিন নেতাকর্মী ও সদ্য সাবেক কাউন্সিলর এ নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে লড়ছেন। তারা হলেন ১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী কাজী গোলাম কিবরিয়া, তিনি কুমিল্লা মহানগর জামায়াতের সদস্য, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মোশাররফ হোসেন, তিনিও একই কমিটির সদস্য। ৮ নম্বর ওয়ার্ডের একরাম হোসেন বাবু, তিনি এলাকায় জামায়াতের কর্মী হিসেবে পরিচিত।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির নবগঠিত কমিটির আহ্বায়ক আমিন উর রশিদ ইয়াছিন বলেন, বিএনপি এই সরকারের অধীনে আর কেনে নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় দুই জনকে (সাক্কু ও কায়সার) আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে আরো যারা নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের বিরুদ্ধেও দল সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে।
নৌকার প্রার্থীর গণসংযোগ: বুধবার নগরীর কান্দিরপাড়, গোবিন্দপুর, ঝাউতলা, উত্তর চর্থা, ছাতিপট্টি, মনোহরপুর, পাথুরিয়া পাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতের সমর্থনে একাধিক পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব পথসভায় প্রার্থী রিফাত ছাড়াও নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আবিদুর রহমান জাহাঙ্গীর, আমিনুল ইসলাম টুটুল, আবদুল হাই বাবলু, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদ, ফাহমিদা জেবিন, সৈয়দ নূরুর রহমান, আবদুল আজিজ সিয়ানুক প্রমুখ। এছাড়া প্রার্থী রিফাত নগরীর রানীর বাজার, রেইসকোর্স, স্টেশন রোডসহ বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগ করেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর গণসংযোগ: টেবিল ঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সদ্য সাবেক মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু বুধবার সকাল থেকে গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করেন। তিনি নগরীর ২৩ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের চাঙ্গিনী উত্তর, চাঙ্গিনী দক্ষিণ, বাতাবাড়িয়া, গন্ধমতি, বাগমারা, চাঁন্দপুর, সালমানপুরসহ বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগ করেন। এছাড়া অনুসারী কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে তিনি ঐ দুইটি ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্থানে পথসভায় বক্তব্য রাখেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সারের গণসংযোগ: ঘোড়া প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার বুধবার নগরীর বাগিচাগাঁও, স্টেশন রোডসহ সিটির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় দিনভর গণসংযোগ করেন। এদিন তিনি ঐ ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্থানে পথসভা ও উঠান বৈঠকে বক্তব্য রাখেন। এসব পথসভা-উঠান বৈঠকে স্থানীয় এলাকার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।




