রানা চক্রবর্তী: ১৪৪২ খৃষ্টাব্দে বাংলায় ইলিয়াসশাহী বংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল। গৌড়ের মসনদ নিয়ে দীর্ঘকালীন অশান্তির শেষে উক্ত বংশের হাত ধরে বঙ্গদেশে তখন শান্তি ফিরে এসেছিল, এবং বাংলার জনসাধারণ অবশেষে সুখে ও সমৃদ্ধিতে বসবাস করবার সুযোগ লাভ করেছিলেন। বাংলায় সুলতানি শাসনের ইতিহাসের প্রথম পর্বে (১৩৪২-১৪১৪ খৃষ্টাব্দ) যেমন সুলতান ইলিয়াস শাহ, সিকান্দর শাহ ও গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ; তেমনি দ্বিতীয় পর্বে (১৪৪২-১৪৮৭ খৃষ্টাব্দ) সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ, রুকনউদ্দীন বারবক শাহ ও সামসউদ্দীন ইউসুফ শাহ- দৃঢ়তা ও দক্ষতার সঙ্গে শান্তি ও সমৃদ্ধির মধ্যে রাজত্ব করেছিলেন। নানা লোকহিতকর কর্ম, স্বধর্ম বিস্তার ও সাহিত্য সংস্কৃতির উন্নতির জন্য তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন।

সমকালীন সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাঁরা কখনো সংকীর্ণতার পরিচয় দেননি। বাংলার জন্য সমগ্র সুলতানি যুগ বড়োই অদ্ভুত একটা সময় ছিল। তখন বাংলার রাজভাষা ছিল ফারসি, শাসকদের মাতৃভাষা ছিল তুর্কি (রাজা গণেশের বংশ বাদে), ইসলামী শাস্ত্রের ভাষা ছিল আরবি, বাংলার জনসাধারণের মুখের ভাষা ছিল বাংলা, এবং হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের ভাষা ছিল সংস্কৃত। সুলতানি যুগের বাংলায় গৌড়ের বেশ কয়েকজন সুলতান যে কোন ভাষাতেই শাস্ত্র ও সাহিত্যচর্চার ব্যাপারে সমানভাবে নিজেদের উৎসাহ জ্ঞাপন করেছিলেন। তাঁরা বাংলা ভাষার চর্চার উপরে এই কারণে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন যে, সেই সময়ে বাংলা ভাষার মাধ্যমে রাজ্যশাসন করবার ব্যাপারে জনসাধারণের নিবিড়তা লাভ করবার সুযোগ ছিল। তখন বেশকিছু বাঙালী কবি ও শিল্পীরা কিছু সুলতানের অনুগ্রহ ও অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন, এবং সেসবের ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ধাপে ধাপে বিস্তৃতি এবং সমৃদ্ধির পথের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ যেমন মুহম্মদ সগীরকে অনুগ্রহ দান করেছিলেন, সুলতান জালালউদ্দীন যেমন কৃত্তিবাস ওঝাকে সম্বর্ধনা জানিয়েছিলেন, সুলতান রুকউদ্দীন বারবক শাহ (১৪৬৯-১৪৭৪ খৃষ্টাব্দ) তেমনি মালাধর বসুকে এমন একটি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন-বাংলা ভাষার অন্য কবি এর আগে যে উপাধি কখনো পাননি।

বর্ধমান জেলার কুলীন গ্রাম নিবাসী মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন। গবেষকদের মতে তাঁর রচিত গ্রন্থটি কোন মৌলিক গ্রন্থ নয়, সেটা ভাগবতের অনুবাদমাত্র। গ্রন্থটির অংশবিশেষ আসল সংস্কৃত গ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদ, এবং অংশবিশেষ সেটির ভাবানুসরণ। কবি ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্ধের কাহিনী অবলম্বনে কাব্যরচনা করতে গিয়ে কৃষ্ণবিষয়ক অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থ (বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশ) এবং প্রচলিত লোককাহিনীরও সাহায্য নিয়েছিলেন বলে দেখা যায়। সুতরাং গ্রন্থটির অংশবিশেষে কবি মৌলিকতা প্রদর্শন করেছিলেন বলা চলে। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের কাব্যমূল্য বিচার করতে গিয়ে ডঃ অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ৫৯৭ নং পৃষ্ঠায় বলেছিলেন-“এই কাব্যের বৃন্দাবনলীলায় কিছু কিছু আদিরস থাকিলেও কাব্যটিকে বীররসাত্মক মহাকাব্য শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করিতে পারা যায়। বৃন্দাবন, মথুরা ও দ্বারকালীলায় কৃষ্ণের ঐশ্বর্যবীরত্বের দিকটি অধিকতর ফুটিয়াছে।”

এরপরে তিনি তাঁর গ্রন্থের ৬০৮ নং পৃষ্ঠায় পুনরায় বলেছিলেন- “ভাগবত অপেক্ষা শ্রীকৃষ্ণবিজয়েই কৃষ্ণের প্রতাপের রূপটি অধিকতর প্রাধান্য পাইয়াছে; রাস, গোপীলীলা প্রভৃতি আদিরসাশ্রিত বর্ণনাকে মালাধর অনেকটা সঙ্কুচিত আকারে বর্ণনা করিয়াছেন।”
শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের কাহিনী পরিকল্পনা ও রসবর্ণনায় যে ঐশ্বর্যভাবের প্রকাশ ঘটেছে বলে দেখতে পাওয়া যায়, সে বিষয়ে তাঁর পৃষ্ঠপোষক ও উপাধিদাতা তৎকালীন গৌড়েশ্বরের রাজকীয়তার অনুকূল পরিবেশ রচনার একটা প্রচ্ছন্ন ইংগিত থাকাও কিন্তু একেবারে অযৌক্তিক বলে মনে হয় না। অনেকেই মনে করেন যে, শ্রীকৃষ্ণের বীর্যবানতায় তৎকালীন হিন্দুদের জাতীয় মানসিকতায় মুক্তির আস্বাদলাভের প্রচেষ্টা নিহিত ছিল; কিন্তু সেযুগের নির্জীব সমাজ চৈতন্যের প্রেক্ষাপটে এই ধরণের ধারণাকে ভ্রমাত্মক ছাড়া অন্যকিছু বলা চলে না। কারণ, সেযুগের রাজা-বাদশাহ-মাত্রই এক একজন বীর সৈনিক ছিলেন; সেই যুগটা ছিল কথায় কথায় অসির ঝংকার ও তরবারির খেলা দেখানোর যুগ। তখন যাঁর যত বাহুবল থাকত এবং যিনি যত অসি-কৌশল জানতেন -জয়ের রাজটীকা তাঁরই ললাটে শোভা পেত।

‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’- প্রবাদটি তখন বঙ্গদেশের ক্ষেত্রে সুপ্রযোজ্য ছিল। ইতিহাস বলে যে, যুদ্ধের খেলায় বাংলার পাঠান সুলতানেরা বরাবরই বেপরোয়া ছিলেন। বলাই বাহুল্য যে, সুলতান বারবক শাহের আমলও যুদ্ধহীন হয়ে অতিবাহিত হয়নি। তিনি তৎকালীন উড়িষ্যার শাসক গজপতির বিরুদ্ধে, কামরূপের রাজা কামেশ্বরের বিরুদ্ধে এবং চট্টগ্রামের মগরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।

(History of Bengal, Vol. II, Edited by Sir Jadunath Sarkar, p: 133-135) তিনি যুদ্ধের কাহিনী শুনতে ভালবাসতেন; এবং সুলতানের এই পছন্দ কিন্তু মালাধর বসুর কাছে অজ্ঞাত ছিল না। সেই কারণে তিনি তাঁর কাব্যে শ্রীকৃষ্ণের মথুরালীলা ও দ্বারকালীলার কথা বিস্তৃতভাবে বলেছিলেন, যেখানে অত্যাচারী কংসকে বধ করা হয়েছিল এবং যেখানে যদু বংশের ধ্বংসপর্ব বর্ণনা করা হয়েছিল।

বিশেষতঃ দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থের ৭৪ নং পৃষ্ঠায় অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে- “রাজকার্যাবসানে মুসলমান সম্রাটগণ পাত্রমিত্র পরিবেষ্টিত হইয়া হিন্দু শাস্ত্রের বঙ্গানুবাদ শুনিতে আগ্রহ প্রকাশ করিতেন”-কারণ, রামায়ণ ও পুরাণগুলির প্রভাব তাঁরা তৎকালীন বাংলার জনজীবনে লক্ষ্য করেছিলেন, তখন বিশেষ অর্থে – শ্রীকৃষ্ণেবিজয়ে বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে যে গৌড়েশ্বরের সন্তোষবিধান করবার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেটা অনেকটা সহজ ও যথার্থ অনুমান বলেই বোধ হয়।

গ্রন্থটির আত্মপরিচয় অংশে মালাধর বসু লিখেছিলেন-
“গুন নাহি অধম মুঞি নাহি কোন জ্ঞান।
গৌড়েশ্বর দিলা নাম গুণরাজ খান॥
সত্যরাজ খান হয় হৃদয় নন্দন।
তারে আশীর্বাদ কর যত সাধুজন॥

কায়স্থকুলেতে জন্ম কুলীন গ্রামে বাস।
স্বপ্নে আদেশ দিলেন প্রভু ব্যাস॥
তাঁর আজ্ঞামতে গ্রন্থ করিনু রচন।
বদন ভরিয়ে হরি বল সর্ব্বজন॥”

উপরোক্ত অংশে কবি স্পষ্টভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, গৌড়েশ্বর তাঁকে গুণরাজ খান নাম বা উপাধি দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন গৌড়েশ্বর কেন তাঁকে সেই উপাধিটি দিয়েছিলেন- সেকথা তিনি বলেননি। মালাধর বসু তাঁর গ্রন্থের কোথাও নিজের পৃষ্ঠপোষক সুলতানের নাম না করলেও কবির পুস্তক রচনার কালটি বর্তমান সময়ে আর রহস্যাচ্ছন্ন নয়। বিশেষতঃ তাঁর গ্রন্থে কালজ্ঞাপক দুটি চারণ সেই সংশয় নিরসন করবার ব্যাপারে গবেষকদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। সেই চারণ দুটি এরকম-
“তের শ পঁচানব্বই শকে গ্রন্থ আরম্ভন।
চতুর্দশ দুই শকে হৈলা সমাপন॥”

সংখ্যায় লিখলে বলা যায় যে, কবি ১৩৯৫ শকাব্দে তাঁর কাব্যটি রচনা করতে শুরু করেছিলেন, এবং ১৪০২ শকাব্দে কাব্যটি সমাপ্ত করেছিলেন। খৃষ্টাব্দের হিসাবে সময়টা দাঁড়ায় ১৪৭৩-৮১ সাল। ঐতিহাসিকেরা ১৪৭৪ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে সুলতান রুকনউদ্দীন বারবক শাহের রাজত্বকালের সময় বলে নির্ণীত করেছেন। কবি তাঁর কাব্যের সূচনা থেকেই বিভিন্ন জায়গায় ‘গুণরাজ খান’ উপাধিটি ভনিতায় ব্যবহার করেছিলেন বলে দেখা যায়। এ থেকে অনেক পণ্ডিতই মতপ্রকাশ করেছিলেন যে, মালাধর বসু হয় তাঁর গ্রন্থটি রচনা করবার আগে, আর নয়ত গ্রন্থটি রচনা করবার শুরুর দিকে সুলতানের কাছ থেকে উপাধিটি পেয়েছিলেন। তাঁদের এই ধারণা সত্যি হলে সুলতান বারবক শাহই কবি মালাধর বসুর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কবি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে সেই কাব্যরচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন, গ্রন্থটির কোথাও তিনি সেই ব্যাপারে সুলতানের কোন ধরণের আদেশ-নির্দেশের কথা উল্লেখ করেন নি। সে যুগের জনসাধারণের কাছে ভাগবতের বাণী পৌঁছে দেওয়াই তাঁর কাব্যরচনার মৌল উদ্দেশ্য ছিল। এই প্রসঙ্গে কবি নিজেই উক্তি করেছিলেন-
“ভাগবত শুনিল আমি পণ্ডিতের মুখে।
লৌকিকে কহিয়ে সার বুঝ মহাসুখে॥
ভাগবত অর্থ যত পয়ারে বান্ধিয়া।
লোক নিস্তারিতে যাই পাঁচালী রচিয়া॥”
সুতরাং, একথা বলা চলে যে, ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যগ্রন্থটির জন্য সুলতান কবিকে পুরস্কৃত করেননি। আসলে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ রচনার আগে থেকেই তাঁর কবিখ্যাতি বর্তমান ছিল। তবে এই বিষয়ে কোন অকাট্য ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি, হয়ত সেটা কালের গর্ভে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু উপরোক্ত অনুমানের ভিত্তিতে মালাধর বসু সুলতান বারবক শাহ কর্তৃক অনুগৃহীত হওয়াই স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হয়।

যদিও অনেকেই মালাধর বসুর কাব্যে কালজ্ঞাপক চারণটির প্রামাণিকতা ও মৌলিকতাকে স্বীকার করেন না। কারণ, শুধুমাত্র কেদারনাথ দত্ত সম্পাদিত এবং ‘বটতলা’ থেকে প্রকাশিত ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ গ্রন্থেই উক্ত চারণটি পাওয়া যায়; সেটা অন্যত্র কোথাও পাওয়া যায় না। কেদারনাথ দত্ত জানিয়েছিলেন যে, শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের একটি প্রাচীন পুঁথিতে তিনি চারণটি পেয়েছিলেন। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কেদারনাথ দত্ত সম্পাদিত গ্রন্থটির আদ্যন্ত পাঠ ও বিশ্লেষণ করে পুঁথি-আশ্রয়িতা ও সম্পাদককৃত সংশোধনের তুলনামূলক বিচারে গ্রন্থটির নির্ভরযোগ্যতা তথা চারণটির অভ্রান্ততা স্বীকার করবার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। (বিস্তারিত আলোচনার জন্য-বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, ডঃ অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়, পৃ: ৫৯০-৫৯৪ দ্রষ্টব্যঃ)

সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল যে, সুলতান রুকউদ্দীন বারবক শাহ যদি মালাধর বসুর পৃষ্ঠপোষক না হয়ে থাকেন, তাহলে কোন গৌড়েশ্বর তাঁর পৃষ্ঠপোষক হতে পারেন? উত্তরে সুলতান শামউদ্দীন ইউসুফ শাহের নাম করা যেতে পারে, তিনি ১৪৭৪ থেকে ১৪৮১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। গুণগ্রাহী ও বিদ্যোৎসাহী সুলতান হিসেবে ইতিহাসে ইউসুফ শাহের সুনাম রয়েছে। যেহেতু তিনি কবি জৈনুদ্দীনকে উৎসাহ দান করেছিলেন, সেহেতু কবি মালাধর বসু তাঁর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন- এমনটা হওয়া সম্ভব নয়। তাঁর রাজত্বকাল বরাবর মালাধরের কাব্যের রচনাকাল প্রবাহিত হয়েছিল। সুতরাং হতে পারে যে, এর মধ্যে কোন একসময়ে তিনি সুলতানের কাছ থেকে উপাধিটি পেয়ে নিজের কাব্যের ভনিতায় সেটার প্রয়োগ করেছিলেন।

কাব্যের ভণিতায় মালাধর বসু তাঁর সন্তান সত্যরাজ খানের জন্য সুধীজনের আশীর্বাদ কামনা করেছিলেন। সত্যরাজ খান কোন নাম নয়, এটি একটি উপাধি। হয়ত সুলতান বারবক শাহের কাছ থেকেই তিনি সেটা লাভ করেছিলেন। সত্যরাজ খান খুব সম্ভবতঃ সুলতানের সভাসদও ছিলেন। কোন সৎ কাজ করবার জন্য কিংবা সত্যের পথে চলবার জন্য মালাধরপুত্র যদি সুলতানের কাছ থেকে সত্যরাজ খান খেতাবটি পেয়ে থাকেন, তাহলে কাব্যগুণের জন্য তাঁর পিতার গুণরাজ খান উপাধি প্রাপ্তিও স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই মনে হয়। তাঁদের দু’জনের খেতাব প্রাপ্তির মধ্যে সময়ের পার্থক্য হয়ত বিশেষ ছিল না; কারণ- নিজের খেতাবের ঠিক পরের চারণেই তিনি সত্যরাজের কথা উল্লেখ করেছিলেন। হতে পারে যে, পুত্রের আগেই পিতা সম্মানিত হয়েছিলেন।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কুলধর নামের একজন সুবর্ণ বণিকও সুলতান বারবক শাহের কাছ থেকে ‘শুভরাজ খান’ উপাধিটি পেয়েছিলেন। ১৪৭৩-৭৪ খৃষ্টাব্দে সংকলিত ‘পুরাণসর্বস্ব’ গ্রন্থ থেকে এই বিষয়ে অবগত হওয়া যায়। (বাংলার ইতিহাসের দু’শো বছর, সুখময় মুখোপাধ্যায়, পৃ: ১০৯-১১০) খুব সম্ভবতঃ কোন শুভকাজ করবার জন্যই গৌড়েশ্বর তাঁকে সেই উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

সুলতান বারবক শাহ গুণীর সমাদর করতেন। তিনি নিজেও জ্ঞানী ও সুশিক্ষিত ছিলেন। সেই কারণেই ফারসি কোষগ্রন্থ ‘শরফনামার’ রচয়িতা ইব্রাহিম কাইয়ুম ফারুখি সুলতানের প্রশস্তি গেয়ে বলেছিলেন-
“বুল মুজাফফর বারবকশাহ শাহ আলম বাদুশত।
দরদ্গীন্ উ হামিশাহ মুলকাতে জম বাদুশত॥”
(The Social History of the Muslims in Bengal, Dr. Abdul Karim, p- 78)

ডঃ আবদুল করিম উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে লিখেছিলেন-
“May Abul Muzaffar Barbak Shah be Shah-i-Alam (king of the world) and he is. May the kingdom of Jamshid be under him and it is.” (The Social History of the Muslims in Bengal, Dr. Abdul Karim, p- 78)

অন্যদিকে, পেন্সিলভিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত সুলতান বারবক শাহের নামাঙ্কিত শিলালিপিতে খোদিত একটি আরবি কবিতায় সুলতানের চরিত্র এবং তাঁর রাজপ্রাসাদের সুরম্যতার বর্ণনা করা হয়েছিল বলে সুখময় মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলার ইতিহাসের দু’শো বছর’ গ্রন্থের ১২০ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছিলেন। তাতে তিনি সুলতানের প্রশস্তিবাচক কবিতাটির যে বঙ্গানুবাদ করেছিলেন, সেটা নিম্নরূপ-
“শাহ সুলতান রুন্‌ অল-দুনিয়া ওয়ালদীন
আমাদের সুলতান বারবকশাহ জ্ঞানী এবং মহিয়ান।
… বিধাতার সমগ্র রাজ্যে আর কেউই নেই
যিনি মহত্বে তাঁর সমান। তাঁর সময়ে তিনি
ছিলেন অদ্বিতীয় এবং অতুলনীয়।”

ফারুখি জানিয়েছিলেন যে, সুলতানের ক্ষুদ্রতম দান ছিল একটি ঘোড়া। তিনি পদচারীকে সহস্রাধিক ঘোড়া উপহার দিতেন। মানুষ তাঁর কাছে একটা ঘোড়া চাইলে অনেকগুলি পেতেন। ফারুখির উক্তির মধ্যে থেকে অতিরঞ্জিত অংশটি বাদ দিলেও তাতে সুলতানের বদান্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফারুখি সুলতানের অধীনস্থ রাজকর্মচারী ছিলেন। তিনি তাঁর ফারসি কোষগ্রন্থে সমসাময়িক যে ক’জন জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির নাম করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে- আমীর জৈনুদ্দিন হারয়ী, মনসুর সিরাজী, মালিক ইউসুফ বিন হামিদ, সৈয়দ জলাল, সৈয়দ মুহম্মদ রুকন এবং সৈয়দ হাসান কবি ছিলেন। ফারুখি-জৈনুদ্দিনকে ‘মালেকুল শোয়ারা’ বা রাজকবি; এবং মনসুর সিরাজীকে ফারসি ভাষার কবি বলে অভিহিত করেছিলেন। (History of the Muslims in Bengal, Dr. Abdul Karim, p- 79) আমীর জৈনুদ্দিন এবং ‘রসুলবিজয়’ কাব্যের রচয়িতা কবি জৈনুদ্দিন-অভিন্ন ব্যক্তি হতে পারেন; তবে সেই কবি তাঁর কাব্যের সর্বত্রই নিজের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বারবক শাহ নয়-‘ইছুপ খান’ বা ইউসুফ শাহের নাম করেছিলেন। তবে সুলতান বারবক শাহ শুধু বাংলা, আরবি বা ফারসি ভাষার ভক্ত ছিলেন না; তিনি সংস্কৃত ভাষারও ভক্ত ছিলেন। সেই কারণেই তিনি তাঁর মুদ্রায় আরবীর সঙ্গে সংস্কৃত ভাষাও ব্যবহার করেছিলেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সুলতান বারবক শাহ তাঁর রাজত্বকালে জাতিধর্ম নির্বিশেষে গুণীমাত্র ব্যক্তিকেই উপাধি ও পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। তাঁর প্রদত্ত উপাধিগুলির মধ্যে নাম সাদৃশ্যও লক্ষ্যণীয়-গুণরাজ, সত্যরাজ, শুভরাজ, কবিরাজ (Poet-laureate) ইত্যাদি। সুতরাং এগুলি একই সুলতান কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সুলতান ইউসুফ শাহ যেহেতু তাঁর আশ্রিত কবি জৈনুদ্দিনকে কোন উপাধি দেননি, সুতরাং মালাধর বসুর প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক গৌড়েশ্বর-সুলতান রুকউদ্দীন বারবক শাহই ছিলেন বলে মনে হয়।

কাব্যের বিচারে না হলেও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে, পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। কাব্যধৃত-“নন্দের নন্দন কৃষ্ণ মোর প্রাণনাথ”- ছত্রটি তাঁর চিত্তহরণ করেছিল। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের উল্লেখ্য বিষয় হল, সেটির রুচি-শালীনতা। কাব্যটিতে ব্যক্ত কাহিনীর প্রথমাংশে রাধাকৃষ্ণের লৌকিক প্রেমবর্ণনা করতে গিয়ে মালাধর বসু চাইলে ‘গীতগোবিন্দ’ ও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের অনুরূপ আদিরসের চর্চা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেন নি; কারণ-সেকাজ করলে তাঁর কাব্যটি স্বয়ং গৌড়েশ্বর ও রাজ-অমাত্যদের কাছে রুচি-বিগর্হিত বলে মনে হওয়াই সম্ভব ছিল। নিছক কাব্যিকতা তাঁর লক্ষ্য ছিল না, তাঁর লক্ষ্য ছিল শ্রীকৃষ্ণের মহিমা প্রচার করা; সেই মহিমা ভক্তের কাছে প্রেম-স্বরূপে ছিল না, কাব্যটির পাঠকের কাছে বীর্যত্বের গৌরবে ছিল।

সুলতানি যুগের বাংলার গৌড় দরবারের রাজছত্রের ছায়ান্তরালে বসে কবি রাজষিক ঐশ্বর্যকে যেমন অস্বীকার করেননি, তেমনি তৎকালীন মুসলমান রাজন্যবর্গের রুচি-আদর্শকেও অস্বীকার করেননি। মধ্যযুগের বাংলায় মুসলমানদের সমাজনীতির সঙ্গে তুলনায় অপেক্ষাকৃত শিথিল সমাজ ও জীবনরসে অভিষিক্ত হিন্দু-মানসিকতার এই ধরণের সংযমবোধ ও রুচি-রূপান্তরের মূল্যায়ন অন্য কেউ স্বীকার না করলেও, ইতিহাস সেটাকে কিন্তু অস্বীকার করে না। প্রশ্রয় পাওয়া মাত্র মানুষের মধ্যে নৈতিক শিথিলতার সুপ্তবীজ আবার কিভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে, সেটার প্রত্যক্ষ প্রমাণ খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর নদীয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার কবি ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যে দেখতে পাওয়া যায়।

বাঙালীর শক্তি তখন অবসিতপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। নবাবীবিলাসিতা ও আয়াসপ্রিয়তায় বাঙালীর নীতিবোধেও তখন ঘুণ ধরেছিল। কিন্তু সেই তুলনায় খৃষ্টীয় পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের বাঙালীর প্রাণপ্রাচুর্যে জীবনরুচি ও আদর্শের মান অনেক উন্নত ছিল। সেযুগের শিল্প-সংস্কৃতিতে সেটার ঐতিহাসিক চিহ্ন মুদ্রিত হয়ে রয়েছে। মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের ভেতর দিয়েই বাংলা ভাষার সেই বিজয়াভিযানের সূচনা হয়েছিল। লেখকঃরানা চক্রবর্তী, বিশিষ্ঠ প্রাবন্ধিক।

রানা চক্রবর্তী: ১৪৪২ খৃষ্টাব্দে বাংলায় ইলিয়াসশাহী বংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল। গৌড়ের মসনদ নিয়ে দীর্ঘকালীন অশান্তির শেষে উক্ত বংশের হাত ধরে বঙ্গদেশে তখন শান্তি ফিরে এসেছিল, এবং বাংলার জনসাধারণ অবশেষে সুখে ও সমৃদ্ধিতে বসবাস করবার সুযোগ লাভ করেছিলেন। বাংলায় সুলতানি শাসনের ইতিহাসের প্রথম পর্বে (১৩৪২-১৪১৪ খৃষ্টাব্দ) যেমন সুলতান ইলিয়াস শাহ, সিকান্দর শাহ ও গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ; তেমনি দ্বিতীয় পর্বে (১৪৪২-১৪৮৭ খৃষ্টাব্দ) সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ, রুকনউদ্দীন বারবক শাহ ও সামসউদ্দীন ইউসুফ শাহ- দৃঢ়তা ও দক্ষতার সঙ্গে শান্তি ও সমৃদ্ধির মধ্যে রাজত্ব করেছিলেন। নানা লোকহিতকর কর্ম, স্বধর্ম বিস্তার ও সাহিত্য সংস্কৃতির উন্নতির জন্য তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন।

সমকালীন সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাঁরা কখনো সংকীর্ণতার পরিচয় দেননি। বাংলার জন্য সমগ্র সুলতানি যুগ বড়োই অদ্ভুত একটা সময় ছিল। তখন বাংলার রাজভাষা ছিল ফারসি, শাসকদের মাতৃভাষা ছিল তুর্কি (রাজা গণেশের বংশ বাদে), ইসলামী শাস্ত্রের ভাষা ছিল আরবি, বাংলার জনসাধারণের মুখের ভাষা ছিল বাংলা, এবং হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের ভাষা ছিল সংস্কৃত। সুলতানি যুগের বাংলায় গৌড়ের বেশ কয়েকজন সুলতান যে কোন ভাষাতেই শাস্ত্র ও সাহিত্যচর্চার ব্যাপারে সমানভাবে নিজেদের উৎসাহ জ্ঞাপন করেছিলেন। তাঁরা বাংলা ভাষার চর্চার উপরে এই কারণে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন যে, সেই সময়ে বাংলা ভাষার মাধ্যমে রাজ্যশাসন করবার ব্যাপারে জনসাধারণের নিবিড়তা লাভ করবার সুযোগ ছিল। তখন বেশকিছু বাঙালী কবি ও শিল্পীরা কিছু সুলতানের অনুগ্রহ ও অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন, এবং সেসবের ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ধাপে ধাপে বিস্তৃতি এবং সমৃদ্ধির পথের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ যেমন মুহম্মদ সগীরকে অনুগ্রহ দান করেছিলেন, সুলতান জালালউদ্দীন যেমন কৃত্তিবাস ওঝাকে সম্বর্ধনা জানিয়েছিলেন, সুলতান রুকউদ্দীন বারবক শাহ (১৪৬৯-১৪৭৪ খৃষ্টাব্দ) তেমনি মালাধর বসুকে এমন একটি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন-বাংলা ভাষার অন্য কবি এর আগে যে উপাধি কখনো পাননি।

বর্ধমান জেলার কুলীন গ্রাম নিবাসী মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন। গবেষকদের মতে তাঁর রচিত গ্রন্থটি কোন মৌলিক গ্রন্থ নয়, সেটা ভাগবতের অনুবাদমাত্র। গ্রন্থটির অংশবিশেষ আসল সংস্কৃত গ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদ, এবং অংশবিশেষ সেটির ভাবানুসরণ। কবি ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্ধের কাহিনী অবলম্বনে কাব্যরচনা করতে গিয়ে কৃষ্ণবিষয়ক অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থ (বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশ) এবং প্রচলিত লোককাহিনীরও সাহায্য নিয়েছিলেন বলে দেখা যায়। সুতরাং গ্রন্থটির অংশবিশেষে কবি মৌলিকতা প্রদর্শন করেছিলেন বলা চলে। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের কাব্যমূল্য বিচার করতে গিয়ে ডঃ অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ৫৯৭ নং পৃষ্ঠায় বলেছিলেন-“এই কাব্যের বৃন্দাবনলীলায় কিছু কিছু আদিরস থাকিলেও কাব্যটিকে বীররসাত্মক মহাকাব্য শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করিতে পারা যায়। বৃন্দাবন, মথুরা ও দ্বারকালীলায় কৃষ্ণের ঐশ্বর্যবীরত্বের দিকটি অধিকতর ফুটিয়াছে।”

এরপরে তিনি তাঁর গ্রন্থের ৬০৮ নং পৃষ্ঠায় পুনরায় বলেছিলেন- “ভাগবত অপেক্ষা শ্রীকৃষ্ণবিজয়েই কৃষ্ণের প্রতাপের রূপটি অধিকতর প্রাধান্য পাইয়াছে; রাস, গোপীলীলা প্রভৃতি আদিরসাশ্রিত বর্ণনাকে মালাধর অনেকটা সঙ্কুচিত আকারে বর্ণনা করিয়াছেন।”
শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের কাহিনী পরিকল্পনা ও রসবর্ণনায় যে ঐশ্বর্যভাবের প্রকাশ ঘটেছে বলে দেখতে পাওয়া যায়, সে বিষয়ে তাঁর পৃষ্ঠপোষক ও উপাধিদাতা তৎকালীন গৌড়েশ্বরের রাজকীয়তার অনুকূল পরিবেশ রচনার একটা প্রচ্ছন্ন ইংগিত থাকাও কিন্তু একেবারে অযৌক্তিক বলে মনে হয় না। অনেকেই মনে করেন যে, শ্রীকৃষ্ণের বীর্যবানতায় তৎকালীন হিন্দুদের জাতীয় মানসিকতায় মুক্তির আস্বাদলাভের প্রচেষ্টা নিহিত ছিল; কিন্তু সেযুগের নির্জীব সমাজ চৈতন্যের প্রেক্ষাপটে এই ধরণের ধারণাকে ভ্রমাত্মক ছাড়া অন্যকিছু বলা চলে না। কারণ, সেযুগের রাজা-বাদশাহ-মাত্রই এক একজন বীর সৈনিক ছিলেন; সেই যুগটা ছিল কথায় কথায় অসির ঝংকার ও তরবারির খেলা দেখানোর যুগ। তখন যাঁর যত বাহুবল থাকত এবং যিনি যত অসি-কৌশল জানতেন -জয়ের রাজটীকা তাঁরই ললাটে শোভা পেত।

‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’- প্রবাদটি তখন বঙ্গদেশের ক্ষেত্রে সুপ্রযোজ্য ছিল। ইতিহাস বলে যে, যুদ্ধের খেলায় বাংলার পাঠান সুলতানেরা বরাবরই বেপরোয়া ছিলেন। বলাই বাহুল্য যে, সুলতান বারবক শাহের আমলও যুদ্ধহীন হয়ে অতিবাহিত হয়নি। তিনি তৎকালীন উড়িষ্যার শাসক গজপতির বিরুদ্ধে, কামরূপের রাজা কামেশ্বরের বিরুদ্ধে এবং চট্টগ্রামের মগরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।

(History of Bengal, Vol. II, Edited by Sir Jadunath Sarkar, p: 133-135) তিনি যুদ্ধের কাহিনী শুনতে ভালবাসতেন; এবং সুলতানের এই পছন্দ কিন্তু মালাধর বসুর কাছে অজ্ঞাত ছিল না। সেই কারণে তিনি তাঁর কাব্যে শ্রীকৃষ্ণের মথুরালীলা ও দ্বারকালীলার কথা বিস্তৃতভাবে বলেছিলেন, যেখানে অত্যাচারী কংসকে বধ করা হয়েছিল এবং যেখানে যদু বংশের ধ্বংসপর্ব বর্ণনা করা হয়েছিল।

বিশেষতঃ দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থের ৭৪ নং পৃষ্ঠায় অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে- “রাজকার্যাবসানে মুসলমান সম্রাটগণ পাত্রমিত্র পরিবেষ্টিত হইয়া হিন্দু শাস্ত্রের বঙ্গানুবাদ শুনিতে আগ্রহ প্রকাশ করিতেন”-কারণ, রামায়ণ ও পুরাণগুলির প্রভাব তাঁরা তৎকালীন বাংলার জনজীবনে লক্ষ্য করেছিলেন, তখন বিশেষ অর্থে – শ্রীকৃষ্ণেবিজয়ে বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে যে গৌড়েশ্বরের সন্তোষবিধান করবার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেটা অনেকটা সহজ ও যথার্থ অনুমান বলেই বোধ হয়।

গ্রন্থটির আত্মপরিচয় অংশে মালাধর বসু লিখেছিলেন-
“গুন নাহি অধম মুঞি নাহি কোন জ্ঞান।
গৌড়েশ্বর দিলা নাম গুণরাজ খান॥
সত্যরাজ খান হয় হৃদয় নন্দন।
তারে আশীর্বাদ কর যত সাধুজন॥

কায়স্থকুলেতে জন্ম কুলীন গ্রামে বাস।
স্বপ্নে আদেশ দিলেন প্রভু ব্যাস॥
তাঁর আজ্ঞামতে গ্রন্থ করিনু রচন।
বদন ভরিয়ে হরি বল সর্ব্বজন॥”

উপরোক্ত অংশে কবি স্পষ্টভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, গৌড়েশ্বর তাঁকে গুণরাজ খান নাম বা উপাধি দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন গৌড়েশ্বর কেন তাঁকে সেই উপাধিটি দিয়েছিলেন- সেকথা তিনি বলেননি। মালাধর বসু তাঁর গ্রন্থের কোথাও নিজের পৃষ্ঠপোষক সুলতানের নাম না করলেও কবির পুস্তক রচনার কালটি বর্তমান সময়ে আর রহস্যাচ্ছন্ন নয়। বিশেষতঃ তাঁর গ্রন্থে কালজ্ঞাপক দুটি চারণ সেই সংশয় নিরসন করবার ব্যাপারে গবেষকদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। সেই চারণ দুটি এরকম-
“তের শ পঁচানব্বই শকে গ্রন্থ আরম্ভন।
চতুর্দশ দুই শকে হৈলা সমাপন॥”

সংখ্যায় লিখলে বলা যায় যে, কবি ১৩৯৫ শকাব্দে তাঁর কাব্যটি রচনা করতে শুরু করেছিলেন, এবং ১৪০২ শকাব্দে কাব্যটি সমাপ্ত করেছিলেন। খৃষ্টাব্দের হিসাবে সময়টা দাঁড়ায় ১৪৭৩-৮১ সাল। ঐতিহাসিকেরা ১৪৭৪ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে সুলতান রুকনউদ্দীন বারবক শাহের রাজত্বকালের সময় বলে নির্ণীত করেছেন। কবি তাঁর কাব্যের সূচনা থেকেই বিভিন্ন জায়গায় ‘গুণরাজ খান’ উপাধিটি ভনিতায় ব্যবহার করেছিলেন বলে দেখা যায়। এ থেকে অনেক পণ্ডিতই মতপ্রকাশ করেছিলেন যে, মালাধর বসু হয় তাঁর গ্রন্থটি রচনা করবার আগে, আর নয়ত গ্রন্থটি রচনা করবার শুরুর দিকে সুলতানের কাছ থেকে উপাধিটি পেয়েছিলেন। তাঁদের এই ধারণা সত্যি হলে সুলতান বারবক শাহই কবি মালাধর বসুর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কবি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে সেই কাব্যরচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন, গ্রন্থটির কোথাও তিনি সেই ব্যাপারে সুলতানের কোন ধরণের আদেশ-নির্দেশের কথা উল্লেখ করেন নি। সে যুগের জনসাধারণের কাছে ভাগবতের বাণী পৌঁছে দেওয়াই তাঁর কাব্যরচনার মৌল উদ্দেশ্য ছিল। এই প্রসঙ্গে কবি নিজেই উক্তি করেছিলেন-
“ভাগবত শুনিল আমি পণ্ডিতের মুখে।
লৌকিকে কহিয়ে সার বুঝ মহাসুখে॥
ভাগবত অর্থ যত পয়ারে বান্ধিয়া।
লোক নিস্তারিতে যাই পাঁচালী রচিয়া॥”
সুতরাং, একথা বলা চলে যে, ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যগ্রন্থটির জন্য সুলতান কবিকে পুরস্কৃত করেননি। আসলে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ রচনার আগে থেকেই তাঁর কবিখ্যাতি বর্তমান ছিল। তবে এই বিষয়ে কোন অকাট্য ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি, হয়ত সেটা কালের গর্ভে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু উপরোক্ত অনুমানের ভিত্তিতে মালাধর বসু সুলতান বারবক শাহ কর্তৃক অনুগৃহীত হওয়াই স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হয়।

যদিও অনেকেই মালাধর বসুর কাব্যে কালজ্ঞাপক চারণটির প্রামাণিকতা ও মৌলিকতাকে স্বীকার করেন না। কারণ, শুধুমাত্র কেদারনাথ দত্ত সম্পাদিত এবং ‘বটতলা’ থেকে প্রকাশিত ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ গ্রন্থেই উক্ত চারণটি পাওয়া যায়; সেটা অন্যত্র কোথাও পাওয়া যায় না। কেদারনাথ দত্ত জানিয়েছিলেন যে, শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের একটি প্রাচীন পুঁথিতে তিনি চারণটি পেয়েছিলেন। ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কেদারনাথ দত্ত সম্পাদিত গ্রন্থটির আদ্যন্ত পাঠ ও বিশ্লেষণ করে পুঁথি-আশ্রয়িতা ও সম্পাদককৃত সংশোধনের তুলনামূলক বিচারে গ্রন্থটির নির্ভরযোগ্যতা তথা চারণটির অভ্রান্ততা স্বীকার করবার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। (বিস্তারিত আলোচনার জন্য-বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, ডঃ অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়, পৃ: ৫৯০-৫৯৪ দ্রষ্টব্যঃ)

সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল যে, সুলতান রুকউদ্দীন বারবক শাহ যদি মালাধর বসুর পৃষ্ঠপোষক না হয়ে থাকেন, তাহলে কোন গৌড়েশ্বর তাঁর পৃষ্ঠপোষক হতে পারেন? উত্তরে সুলতান শামউদ্দীন ইউসুফ শাহের নাম করা যেতে পারে, তিনি ১৪৭৪ থেকে ১৪৮১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। গুণগ্রাহী ও বিদ্যোৎসাহী সুলতান হিসেবে ইতিহাসে ইউসুফ শাহের সুনাম রয়েছে। যেহেতু তিনি কবি জৈনুদ্দীনকে উৎসাহ দান করেছিলেন, সেহেতু কবি মালাধর বসু তাঁর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন- এমনটা হওয়া সম্ভব নয়। তাঁর রাজত্বকাল বরাবর মালাধরের কাব্যের রচনাকাল প্রবাহিত হয়েছিল। সুতরাং হতে পারে যে, এর মধ্যে কোন একসময়ে তিনি সুলতানের কাছ থেকে উপাধিটি পেয়ে নিজের কাব্যের ভনিতায় সেটার প্রয়োগ করেছিলেন।

কাব্যের ভণিতায় মালাধর বসু তাঁর সন্তান সত্যরাজ খানের জন্য সুধীজনের আশীর্বাদ কামনা করেছিলেন। সত্যরাজ খান কোন নাম নয়, এটি একটি উপাধি। হয়ত সুলতান বারবক শাহের কাছ থেকেই তিনি সেটা লাভ করেছিলেন। সত্যরাজ খান খুব সম্ভবতঃ সুলতানের সভাসদও ছিলেন। কোন সৎ কাজ করবার জন্য কিংবা সত্যের পথে চলবার জন্য মালাধরপুত্র যদি সুলতানের কাছ থেকে সত্যরাজ খান খেতাবটি পেয়ে থাকেন, তাহলে কাব্যগুণের জন্য তাঁর পিতার গুণরাজ খান উপাধি প্রাপ্তিও স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই মনে হয়। তাঁদের দু’জনের খেতাব প্রাপ্তির মধ্যে সময়ের পার্থক্য হয়ত বিশেষ ছিল না; কারণ- নিজের খেতাবের ঠিক পরের চারণেই তিনি সত্যরাজের কথা উল্লেখ করেছিলেন। হতে পারে যে, পুত্রের আগেই পিতা সম্মানিত হয়েছিলেন।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কুলধর নামের একজন সুবর্ণ বণিকও সুলতান বারবক শাহের কাছ থেকে ‘শুভরাজ খান’ উপাধিটি পেয়েছিলেন। ১৪৭৩-৭৪ খৃষ্টাব্দে সংকলিত ‘পুরাণসর্বস্ব’ গ্রন্থ থেকে এই বিষয়ে অবগত হওয়া যায়। (বাংলার ইতিহাসের দু’শো বছর, সুখময় মুখোপাধ্যায়, পৃ: ১০৯-১১০) খুব সম্ভবতঃ কোন শুভকাজ করবার জন্যই গৌড়েশ্বর তাঁকে সেই উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

সুলতান বারবক শাহ গুণীর সমাদর করতেন। তিনি নিজেও জ্ঞানী ও সুশিক্ষিত ছিলেন। সেই কারণেই ফারসি কোষগ্রন্থ ‘শরফনামার’ রচয়িতা ইব্রাহিম কাইয়ুম ফারুখি সুলতানের প্রশস্তি গেয়ে বলেছিলেন-
“বুল মুজাফফর বারবকশাহ শাহ আলম বাদুশত।
দরদ্গীন্ উ হামিশাহ মুলকাতে জম বাদুশত॥”
(The Social History of the Muslims in Bengal, Dr. Abdul Karim, p- 78)

ডঃ আবদুল করিম উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে লিখেছিলেন-
“May Abul Muzaffar Barbak Shah be Shah-i-Alam (king of the world) and he is. May the kingdom of Jamshid be under him and it is.” (The Social History of the Muslims in Bengal, Dr. Abdul Karim, p- 78)

অন্যদিকে, পেন্সিলভিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত সুলতান বারবক শাহের নামাঙ্কিত শিলালিপিতে খোদিত একটি আরবি কবিতায় সুলতানের চরিত্র এবং তাঁর রাজপ্রাসাদের সুরম্যতার বর্ণনা করা হয়েছিল বলে সুখময় মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলার ইতিহাসের দু’শো বছর’ গ্রন্থের ১২০ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছিলেন। তাতে তিনি সুলতানের প্রশস্তিবাচক কবিতাটির যে বঙ্গানুবাদ করেছিলেন, সেটা নিম্নরূপ-
“শাহ সুলতান রুন্‌ অল-দুনিয়া ওয়ালদীন
আমাদের সুলতান বারবকশাহ জ্ঞানী এবং মহিয়ান।
… বিধাতার সমগ্র রাজ্যে আর কেউই নেই
যিনি মহত্বে তাঁর সমান। তাঁর সময়ে তিনি
ছিলেন অদ্বিতীয় এবং অতুলনীয়।”

ফারুখি জানিয়েছিলেন যে, সুলতানের ক্ষুদ্রতম দান ছিল একটি ঘোড়া। তিনি পদচারীকে সহস্রাধিক ঘোড়া উপহার দিতেন। মানুষ তাঁর কাছে একটা ঘোড়া চাইলে অনেকগুলি পেতেন। ফারুখির উক্তির মধ্যে থেকে অতিরঞ্জিত অংশটি বাদ দিলেও তাতে সুলতানের বদান্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফারুখি সুলতানের অধীনস্থ রাজকর্মচারী ছিলেন। তিনি তাঁর ফারসি কোষগ্রন্থে সমসাময়িক যে ক’জন জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির নাম করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে- আমীর জৈনুদ্দিন হারয়ী, মনসুর সিরাজী, মালিক ইউসুফ বিন হামিদ, সৈয়দ জলাল, সৈয়দ মুহম্মদ রুকন এবং সৈয়দ হাসান কবি ছিলেন। ফারুখি-জৈনুদ্দিনকে ‘মালেকুল শোয়ারা’ বা রাজকবি; এবং মনসুর সিরাজীকে ফারসি ভাষার কবি বলে অভিহিত করেছিলেন। (History of the Muslims in Bengal, Dr. Abdul Karim, p- 79) আমীর জৈনুদ্দিন এবং ‘রসুলবিজয়’ কাব্যের রচয়িতা কবি জৈনুদ্দিন-অভিন্ন ব্যক্তি হতে পারেন; তবে সেই কবি তাঁর কাব্যের সর্বত্রই নিজের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বারবক শাহ নয়-‘ইছুপ খান’ বা ইউসুফ শাহের নাম করেছিলেন। তবে সুলতান বারবক শাহ শুধু বাংলা, আরবি বা ফারসি ভাষার ভক্ত ছিলেন না; তিনি সংস্কৃত ভাষারও ভক্ত ছিলেন। সেই কারণেই তিনি তাঁর মুদ্রায় আরবীর সঙ্গে সংস্কৃত ভাষাও ব্যবহার করেছিলেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সুলতান বারবক শাহ তাঁর রাজত্বকালে জাতিধর্ম নির্বিশেষে গুণীমাত্র ব্যক্তিকেই উপাধি ও পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। তাঁর প্রদত্ত উপাধিগুলির মধ্যে নাম সাদৃশ্যও লক্ষ্যণীয়-গুণরাজ, সত্যরাজ, শুভরাজ, কবিরাজ (Poet-laureate) ইত্যাদি। সুতরাং এগুলি একই সুলতান কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সুলতান ইউসুফ শাহ যেহেতু তাঁর আশ্রিত কবি জৈনুদ্দিনকে কোন উপাধি দেননি, সুতরাং মালাধর বসুর প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক গৌড়েশ্বর-সুলতান রুকউদ্দীন বারবক শাহই ছিলেন বলে মনে হয়।

কাব্যের বিচারে না হলেও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে, পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। কাব্যধৃত-“নন্দের নন্দন কৃষ্ণ মোর প্রাণনাথ”- ছত্রটি তাঁর চিত্তহরণ করেছিল। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের উল্লেখ্য বিষয় হল, সেটির রুচি-শালীনতা। কাব্যটিতে ব্যক্ত কাহিনীর প্রথমাংশে রাধাকৃষ্ণের লৌকিক প্রেমবর্ণনা করতে গিয়ে মালাধর বসু চাইলে ‘গীতগোবিন্দ’ ও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের অনুরূপ আদিরসের চর্চা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেন নি; কারণ-সেকাজ করলে তাঁর কাব্যটি স্বয়ং গৌড়েশ্বর ও রাজ-অমাত্যদের কাছে রুচি-বিগর্হিত বলে মনে হওয়াই সম্ভব ছিল। নিছক কাব্যিকতা তাঁর লক্ষ্য ছিল না, তাঁর লক্ষ্য ছিল শ্রীকৃষ্ণের মহিমা প্রচার করা; সেই মহিমা ভক্তের কাছে প্রেম-স্বরূপে ছিল না, কাব্যটির পাঠকের কাছে বীর্যত্বের গৌরবে ছিল।

সুলতানি যুগের বাংলার গৌড় দরবারের রাজছত্রের ছায়ান্তরালে বসে কবি রাজষিক ঐশ্বর্যকে যেমন অস্বীকার করেননি, তেমনি তৎকালীন মুসলমান রাজন্যবর্গের রুচি-আদর্শকেও অস্বীকার করেননি। মধ্যযুগের বাংলায় মুসলমানদের সমাজনীতির সঙ্গে তুলনায় অপেক্ষাকৃত শিথিল সমাজ ও জীবনরসে অভিষিক্ত হিন্দু-মানসিকতার এই ধরণের সংযমবোধ ও রুচি-রূপান্তরের মূল্যায়ন অন্য কেউ স্বীকার না করলেও, ইতিহাস সেটাকে কিন্তু অস্বীকার করে না। প্রশ্রয় পাওয়া মাত্র মানুষের মধ্যে নৈতিক শিথিলতার সুপ্তবীজ আবার কিভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে, সেটার প্রত্যক্ষ প্রমাণ খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর নদীয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার কবি ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যে দেখতে পাওয়া যায়।

বাঙালীর শক্তি তখন অবসিতপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। নবাবীবিলাসিতা ও আয়াসপ্রিয়তায় বাঙালীর নীতিবোধেও তখন ঘুণ ধরেছিল। কিন্তু সেই তুলনায় খৃষ্টীয় পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের বাঙালীর প্রাণপ্রাচুর্যে জীবনরুচি ও আদর্শের মান অনেক উন্নত ছিল। সেযুগের শিল্প-সংস্কৃতিতে সেটার ঐতিহাসিক চিহ্ন মুদ্রিত হয়ে রয়েছে। মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের ভেতর দিয়েই বাংলা ভাষার সেই বিজয়াভিযানের সূচনা হয়েছিল। লেখকঃরানা চক্রবর্তী, বিশিষ্ঠ প্রাবন্ধিক।