খন রঞ্জন রায় : ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি, পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে’…..জীবনানন্দ দাশের সমুদ্রজীবনভিত্তিক ‘বনলতা সেন’ কবিতার বহুলপঠিত জনপ্রিয় ২টি চরণ।
সাহিত্য সংস্কৃতি জীবনপ্রীতির সাথে সমুদ্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ বাণিজ্য ও পরিবহনের প্রধান সঙ্গী হিসাবে বিবেচ্য হয়ে চলছে সমুদ্র। সমুদ্রভাবনার অন্তহীন রহস্য এখনো উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। আকার আয়তন পাকাপোক্ত করতে পারলেও এর অভ্যন্তরে স্থিত সংরক্ষিত রতনভাণ্ডার নিয়ে ভাবনার দিগন্ত এখনো রহস্যবৃত। অমরত্ব লাভের আশায় জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় নানা উপকরণ সন্ধান করতে ‘সমুদ্রমন্থন’ নামে বিশাল এক আখ্যান আছে হিন্দু পুরাণ ‘মহাভারতে’।
স্বর্গের রাজা দেবরাজ ‘ইন্দ্র’ থেকে বিশ্ব ব্রাহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রণ হস্তোগত করেছিলেন অসুররাজ ‘মহাবলী’। তা উদ্ধার করতে নানাভাবে চেষ্টা তদ্বির কূটনৈতিক সম্বন্ধ্য স্থাপনের মাধ্যমে অমৃতের সন্ধানে সমুদ্রমন্থনের ব্যবস্থা করা হয়। জটিল সব প্রচেষ্ঠা অব্যহত রেখে শেষে তা সম্পন্ন হয়। সমুদ্রমন্থনের ফলে উত্থিত রত্ম দ্বারাই পৃথিবীর সকল মানুষের সর্ববিধ চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। হাল আমলে সমুদ্রবিজ্ঞানের মোটামুটি চর্চার রেখাপাত হয় ১৭৬৮ সালে ক্যাপ্টেন জেমস কুক কর্তৃক প্রশান্ত মহাসাগর অভিযানের পর থেকে।
ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে, পৃথিবীর ভূ-ভাগের ৭০ শতাংশই সমুদ্রের জলরাশি। বিশ্বের সকল প্রাণীকূলকে আবৃত করে রেখেছে, আগলে রেখেছে খাদ্যভাণ্ডার, পরিবহন বেষ্টণী, সাহিত্য সংস্কৃতির বিনোদন, সবকিছুরই আধাঁর সমুদ্র। ভূ-মণ্ডলের জলবায়ুকে সহনীয়, মানুষের জীবনপ্রণালীর উপযোগী করে রাখে এই সমুদ্রের বিশাল জলরাশি। সমুদ্রের পানিতে সর্বাধিক পরিমাণ ঘনবস্তু দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে, এর মধ্যে লবণের পরিমান নিয়ে তো আর নতুন করে বলার কিছু নাই ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়ামের মতো অতিসূক্ষ্ণ মানুষের প্রয়োজনীয় মৌলও দ্রবিভূত অবস্থায় থাকে।
সমুদ্রে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, প্রোটিস্ট, শৈবাল, উদ্ভিদ, ছত্রাক আর অত্যাশ্চার্যের নানা প্রাণীর সন্ধানতো রীতিমতো বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে। সমুদ্রের তলপৃষ্টের রহস্যঘন বাসস্থান ও বাস্তুতন্ত্র বৈচিত্র্যময় ভূ-ভাগকে সমৃদ্ধ করছে। প্রাণের উৎপত্তিস্থান সমুদ্র। তা অনেক গবেষণায়ও স্বীকার করা হয়েছে পুরো পৃথিবীর সকল প্রাণীকূলের বিবর্তন প্রকৃতির নিদর্শন বলে সমুদ্রবিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন। উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বেশ কিছু বড় বড় গোষ্ঠী তো এখনো সমুদ্রেকেই তাঁদের আবাসস্থল হিসাবে নির্ভর করছে। শান্তি-প্রশান্তিতে বসবাস করছে। মাঝে মধ্যে সমুদ্রের উপরিভাগে ঝুকি দিয়ে জানান দিচ্ছে যে তারা ভাল আছে। বেশ ভাল আছে। এখানে প্রাণীর ভাগাভাগিকে ধরলে স্তন্যপায়ী, মেরুদণ্ডী, অমেরুদণ্ডী সবাইতো সমুদ্রের বাসিন্দা।
পুরো পৃথিবীর সকল মানুষের ব্যবহারের জন্য খাদ্য তালিকার প্রধান কিছু উপকরণ সমুদ্র ছাড়া কল্পনা করা যায় না। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের নিত্যব্যবহার্য্য জ্বালানি, বিদ্যুৎ, খনিজ সম্পদ, সমুদ্রকেন্দ্রীক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত। সমুদ্রবিজ্ঞানীদের গত কয়েক শতাব্দীর ক্লান্তিহীন ধারাবাহিক গবেষণায় এ পর্যন্ত ২ লক্ষ ৩০ হাজারের মতো শুধু সামুদ্রিক ও জলজ প্রাণীর সন্ধান পেয়েছেন। ধারনা করছেন তারও অন্তত ১০ গুণ বেশি প্রাণী এখনো অনাবিস্কৃত রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বিশুদ্ধ নির্মল বায়ুর অবস্থানও সাগরে ‘আটলান্টিক মহাসাগরে’।
মহাসাগর বিশারদরা ভূ-গঠন এবং জীবন ধারার উপযোগী পরিবেশকে উপজীব্য করে মোট জলরাশিকে বিভিন্ন অঞ্চলে মহাসগর, সাগর নামে নামাঙ্কিত করছেন। মহাসাগরবিদ্যার মৌলিক গুরুত্বকে তুলে ধরে পাশ্চাত্যে ভূগোলবিদরা তাঁদের সুবিধার জন্য মোট জলরাশিকে ৫টি অংশে বিভক্ত করেছেন। মহাদেশ, মাটির স্তর ও অন্যান্য বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে আমেরিকাকে এশিয়া-অস্ট্রেলিয়া থেকে বিভক্তকারী জলরাশিকে ‘প্রশান্ত মহাসগর’, আফ্রিকা ও ইউরেশিয়া থেকে আমেরিকাকে বিভক্ত করা জলরাশির নাম ‘আটলান্ট্রিক মহাসাগর’।
দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে অস্ট্রেলিয়া-আফ্রিকা বিভক্তকারী জলরাশি ‘ভারত মহাসাগর’, আটলান্টিক, প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের বহিরাংশ হিসাবে এন্টারর্কটিকা মহাদেশকে ঘিরে রেখেছে ‘দক্ষিণ মহাসাগর’ শেষে আটলান্টিক মহাসাগরের এক সমুদ্রের মর্যাদা নিয়ে উত্তর আমেরিকা ও ইউরেশিয়ার একাশংকে ঘিরে রাখা জলরাশিকে ‘উত্তর মহাসাগর’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
অতি প্রাচীনকাল থেকেই এই সব জলরাশিকে ঘিরে পুরো পৃথিবীর ব্যবসা বাণিজ্য, ভ্রমণ, আবিস্কার, পরিবহন এমনকি ‘যুদ্ধ’ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ হতো। এখন তো আরো প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপন হচ্ছে, বলা হয় পৃথিবীর মোট প্রাণীর ৯৭ ভাগই সমুদ্র বুকে ধারন করে রেখেছে।
জীবিত প্রাণীর ৯৯ শতাংশের বসবাস সমুদ্রে। উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য নামে তো আলাদা বিজ্ঞান চালু হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে নানা সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। রত্মাকর এই সমুদ্ররাশির উপর নির্ভর করে পৃথিবীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিচারে নিয়ন্ত্রণ করে ‘সমুদ্র’ মোট জিডিপি’র ৫ ভাগ। আমরা মানুষেরা যে কার্বণ নিঃস্মরণ করি তার ৩০ ভাগ সমুদ্র ধারাবাহিকভাবে শোষে নেয়। সারা বিশ্বের ৩শ মিলিয়ন মানুষের জীবন জীবিকা সরাসরি সমুদ্র নির্ভর। অন্তহীন উপকারী এই সমুদ্রকে আমরা নানাভাবে আক্রান্ত করছি, দূষিত করছি, মারাত্মকবাবে ক্ষতিগ্রস্থ করছি।
স্বাভাবিক প্রাকৃতিক এই সম্পদ তার সাবলীলতা হারাচ্ছে। সারাবিশ্বের টেকসই উন্নয়ন, মানবজাতির শান্তিময় জীবন ধারণের জন্য সমুদ্রকে তাঁর স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে দিতে হবে। আর তা উপলব্ধি করে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের রি-ও-ডি জেনেরিওর বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে সমুদ্র নিয়ে বিশেষ ভাবনার কথা ওঠে। প্রাসঙ্গিকভাবেই ওঠে আসে দিবসের প্রস্তাব।
সমুদ্রকে তাঁর স্বাভাবিকতা অক্ষুণ্ন রাখার অনিবার্য স্বার্থে ৮ জুন পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মহাসাগর দিবস। অবশ্য ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছে। সমুদ্র সম্পদকে যথাযথভাবে লালন, পালন, মূল্যায়ন এর অপরিহার্য্যতা প্রয়োজনীয়তার বিশেষত্বকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরাই এই দিবসের উদ্দেশ্যে।
আমরা সমুদ্রজাতি। আমাদেরও বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। যে দায়িত্ব নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সমুদ্রসম্পদের টেকসই ব্যবহারে সর্বজনগ্রাহী পরিকল্পিত পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। সমুদ্র সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো আঞ্চলিকভাবে সমুদ্রগবেষণা জোরদার করা, উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ, সমুদ্রের বিশাল বিপুল নীল জলরাশিকে আপন আলোয় উদ্ভাসিত করে নিজেদের মতো করে নেয়ার অনুকম্পন সৃষ্টি হোক আমাদের মাঝে এই প্রত্যাশা করি।লেখকঃ খন রঞ্জন রায়,সমাজচিন্তক, গবেষক ও সংগঠক।