খন রঞ্জন রায়: কলিযুগে ভয়ঙ্কর দুরবস্থার জন্য দায়ী মানুষের তমোগুণের মায়াহীন নিষ্ঠুর প্রভাব। নিদ্রা, তন্দ্রা, হিংসা, মায়া, অসত্য, বিষাদ, শোক, মোহ, শান্ত, ধীর, সহিষ্ণু, লোভ, লালসা সবকিছু আচ্ছন্ন থাকছে রজ ও তমোগুণের বর্বর আচরণে। সনাতন দর্শনে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি চারটি সময় বা যুগ চক্রাকারে পরিবর্তন হচ্ছে। যুগ চারটির আয়ুস্কাল নির্ধারণ করা আছে। সত্য যুগের ছিল সতের লক্ষ আটাশ হাজার বছর। ত্রেতা যুগের বার লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার, দ্বাপর যুগের ছিল আট লক্ষ চৌষট্টি হাজার বছর, আর সর্বশেষ কলির বয়স নির্ধারণ করা আছে চার লক্ষ বত্রিশ হাজার বছর। লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভৌমলীলা পরীক্ষিৎ মহারাজের রাজত্বকাল থেকে শুরু করলে ইতোমধ্যে আমরা কলিযুগ অতিক্রম করেছি পাঁচ হাজার বছর।

যুগ পরিক্রমায় সত্য যুগে ধর্ম আচরণ ছিল হাজার বছর ধরে ধ্যানে মগ্ন থাকা। ত্রেতাযুগের ধর্ম প্রক্রিয়া ছিল যজ্ঞ করা। দ্বাপরে ছিল মন্দিরে মন্দিরে ভগবান পরমেশ্বরের আরাধনা। বর্তমান কলিযুগে প্রেমভক্তিতে রসসুধা আস্বাদনে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবর্তন ‘হরিনাম সংকীর্তন’। ‘হরি’ মূলত সংস্কৃত শব্দ। হিন্দু ধর্মের মহত্তম দর্শনে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিষ্ণু দেবতার একটি নাম। বাংলা শব্দকোষের দ্বারস্থ হলে দেখা যায় বেদে বর্ণিত পরম পরমই হচ্ছে “হরি”।

এখানে শারীরিক সৌন্দর্য নয়, মেধা মনন, মূল্যবোধ, ন্যায়নীতি, সুবিচার, সুশাসন ইত্যাদি গুণাগুণের চরিত্র ও জীবন চর্চা বুঝায়। তুলনা চলে বাতাসের সঙ্গে, যতক্ষণ প্রবাহমান থাকে ততক্ষণে অভাব অনুভব হয় না, প্রবাহের সামান্য সংকট হলেই অভাবটা অনুভব করা যায় ব্যাপকভাবে। আরো পোক্ত করে বললে হরি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি তুলনারহিত শক্তি ধারণ করে আছেন। জীবনের স্মৃতি ও সত্তার পুননির্মাণ করেন। মনোজাগতিক অন্ধকার দূর করেন। মানুষকে পরমব্রহ্মের নিকট সমর্পন হতে উদ্বুদ্ধ করেন। জাগতিক সকল দুঃখ, যাতনা, বিবাদ-বিসংবাদ দূর করেন। মনের গহন অন্ধকার পরিশুদ্ধভাবে রূপায়নের আশ্চর্য রূপকার তিনি।

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত দুর্নীতি, সম্পদ পাচার, মিথ্যাচার, নারী নির্যাতনের মতো কাল সাপকে নির্মূল করতে সাহস যোগান। জীবনের গভীর উপলব্ধির গল্প এই নাম থেকেই শুরু করা যায়। মহাভারতে বিষ্ণুর সহস্রনামের ৬৫৬তম নাম হিসাবে ‘হরি’ হিন্দু ধর্মকে আচ্ছন্ন ও তাড়িত করে। হিন্দু ধর্মের পবিত্র শাস্ত্র ভগবদগীতা ও মহাভারতে হরির একাধিক নাম উল্লেখ আছে। বিষ্ণু, নারায়ণ, রমা, কৃষ্ণ, মাধব, দামোদর, গোবিন্দ, গোপাল এমন সহস্র নাম বিশ্বাসের জোর থেকে উৎসারিত হয়। মানবসংসারে এক অত্যাশ্চার্য অনুভূতির নাম ‘হরি’। সংস্কৃতির শক্তিকে যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁরা সবাই হরির প্রেমের চিহ্ন ছড়িয়ে দিয়ে নিজকে ভাগ্যবান মনে করেন। এখানে বিন্দুমাত্র সত্যের বরখেলাপ হয় না। বৈষ্ণধর্মের অনুসারিরা জীবনের বিভিন্ন পর্বে নানারকম প্রতিকূলতার মধ্যেও হরি শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মান্যজ্ঞান করেন। হিন্দু সংস্কৃতি বৈচিত্র্যের এক উজ্জ্বল প্রকাশ ‘হরি’। যে কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে বেদমন্ত্র ব্যবহার আবৃত্তির আগে ‘হরি ওম (ওঁ)’ মন্ত্রটি ব্যবহার করে ধর্মের প্রতি আত্মবিশ্বাস জাগানো হয়।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব ঐতিহ্যে হরি, কৃষ্ণ ও বিষ্ণু উভয়ের নাম ‘হরে কৃষ্ণ’ এর মাধ্যমে আহ্বান করা হয়। মানবজীবনের পরম উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ। আধুনিক আমলের ঈশ্বর লাভের বিজ্ঞানসম্মত উপায় ‘হরিনাম সংকীর্তন’ এর ভিত্তিভূমির নবজাগরণ ঘটান মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব। হিন্দু সমাজব্যবস্থায় শ্রেণি বিন্যাসের পবিত্রতার মানদণ্ড প্রবলভাবে আলোড়িত ছিল। বৈদিক আর প্রাকবৈদিক সংস্কৃতির সমন্বয়ে আধুনিক সভ্যতা গড়ে ওঠার চেষ্টা হচ্ছিল। প্রকৃতিবাদী হিন্দু রীতিতে সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি, আকাশ, বাতাস, প্রত্যুষ, বৃষ্টি সবাই দেবতা স্তবের বৈদিক ধারা।

খ্রিস্টের জন্মের চার হাজার পাঁচশত বছর আগে ঋগবেদ আর আড়াই হাজার বছর আগে যখন বেদ রচনা হয় তখন থেকেই ঈশ্বর প্রার্থনার জন্য হিন্দুরা আধুনিক মননরীতিতে প্রভাবিত হয়। রক্ষণশীলতা আচার সর্বস্বতা পরিত্যাগ করে সুনির্দিষ্ট দেবতা আরাধনায় মনোনিবেশ করে। বহু জাতি আর নানান সংস্কৃতির মিশ্রণের ফলে সিন্ধু তীরের হিন্দু সভ্যতার তাৎপর্যের ইতিহাস আধুনিক শাস্ত্রতত্তবিদগণকেও সম্মোহিত করে। বেদের আলোকে খ্রিস্টপূর্ব ষোলশ শতাব্দিতে উপনিষদ রচনার মাধ্যমে এর মূল বিষয় ব্রহ্ম আর আত্মার তত্তখোঁজা হয়েছিল। তখন প্রমাণ হয়েছিল ব্রহ্ম আর আত্মা অভিন্ন। উপনিষদ রচনার কিছুকাল পর প্রায় দুই হাজার নয়শত বছর আগে যখন শ্রীমদ্ভগবদগীতা আবির্ভাব হয় তখন থেকেই হিন্দু ধর্মের আচরণবিধি, গতিপথ প্রসারিত হতে থাকে।

পৌরাণিক কাহিনীর বৈচিত্র্যে, সংস্কৃতির বিস্তারে, নৈতিক আচরণবিধিবিধানে, অবৈদিক জনগোষ্ঠীও সর্বশক্তিমত্তার সর্বব্যাপী অবস্থান স্বীকার করে প্রার্থনারত হতে থাকে। চব্বিশ হাজার শ্লোকের রামায়ণ, আর নব্বই হাজার শ্লোকের মহাভারত হিন্দু দর্শনের অমূল্য সম্পদের বিশেষত্ব ‘অবতারবাদ’। যুগাবতার অবলম্বন করে ১৪৮৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ফাল্গুনী দোল পূর্ণিমায় আবির্ভাব ঘটে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর। পিতা পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতা শচীদেবী তখন পশ্চিমবঙ্গ জেলার নবদ্বীপ শহরে বসবাস করেছিলেন। তাঁদের আদি নিবাস বাংলাদেশে। সিলেট জেলার ঢাকা দক্ষিণ গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন জগন্নাথ মিশ্র। বিদ্যার্জনের মনোবাসনায় মহাপ্রভুর দাদা উপেন্দ্র মিশ্র বাবা জগন্নাথকে নবদ্বীপে পাঠিয়েছিলেন।

১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে ১৭ বছর বয়সে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব জলপথে সিলেটে আগমন করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল পিতৃপুরুষদের সম্পত্তি উদ্ধার। এখানেও তিনি ভক্তি অনুশীলনে মনোনিবেশ করেন। ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে ২৩ বছর বয়সে মহাপ্রভু বৈষ্ণব ভক্ত ‘ঈশ্বরপুরীর’ কাছে দশাক্ষর গোপালমন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন। তখন থেকে কৃষ্ণপ্রেমে আসক্ত হয়ে ছাত্র-শিষ্যদের স্বরচিত পদাবলী সংকীর্তনের শিক্ষা দিতে লাগলেন।
‘হরি হরয়ে নমো : কৃষ্ণ মাধ্বায়নম:
গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধুসুগণ’
বৈষ্ণবভক্ত প্রচারে শ্রী চৈতন্যদেব সংকীর্তন আন্দোলনের মধ্যদিয়ে আধুনিক হিন্দু সমাজ জাগরণে তখনকার সময়ের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হন। শ্রী চৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণবতত্ত সনাতন হিন্দুধর্ম মতাবলম্বীর নব সংস্করণ। বৈষ্ণবতত্ত জাতিভেদ প্রথায় নির্যাতিত মানুষের মনে প্রবল আবেগের সঞ্চার করে। জাতভেদ শ্রেণি বৈষম্যের শিকার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সংকীর্তন পরিক্রমণে আকৃষ্ট হয়ে অংশগ্রহণ করতে থাকে।

নিত্যানন্দ, হরিদাস, শ্রীরাম, মুকুন্দ দত্ত, অদৈত আচার্যসহ অনেক বৈষ্ণবভক্ত শ্রীচৈতন্যদেবের নবদ্বীপ সংকীর্তন যাত্রায় আত্মনিয়োগ করেন। হরিভক্তি আস্বাদনে মহাপ্রেমিক হতে শ্রীচৈতন্যদেব অনেককে আহ্বান করেন। সেই আহ্বান দিগিদিক ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি, দরিদ্র শ্রীধর পণ্ডিত, ভক্ত হরিদাসসহ অনেককে বুকে টেনে নিয়ে নব প্রবর্তিত প্রেমভক্তির শক্তিশালী দর্শন উপলব্ধিতে মনোনিবেশ ঘটান। চৈতন্যভক্তির ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে শিষ্যরা নবদ্বীপ ছেড়ে বৃন্দাবন, পুরী, শান্তিপুর, মায়া, দাক্ষিণাত্য, নীলাচল, কাশী, প্রয়োগ, মথুরা প্রভৃতি স্থানে মহাপ্রভুর সংকীর্তন আন্দোলন প্রসারিত করতে থাকেন। ২৪ বছর বয়সে ১৫১০ সালের ২৬ জানুয়ারি মাঘী শুক্লপক্ষে মহাপ্রভু গৃহত্যাগ করে আচার্য কেশব ভারতীর নিকট থেকে হিন্দু শাস্ত্রীয় সন্ন্যাস দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনিই মহাপ্রভুর নাম রাখেন ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’।

মহাপ্রভু ১৫১০ থেকে ১৫১২ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থানসমূহে পরিক্রমণ করে ভক্তিবাদ প্রচার করেন। লুপ্ত অনেক তীর্থ স্থান পুনরুদ্ধার করেন। ১৫১৬ সালে তিনি জন্মস্থান নবদ্বীপে এসে জন্মদাত্রী মা এবং স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়াকে দেখে কৃষ্ণপ্রিয়া হওয়ার আহ্বান জানান। মহাপ্রভু বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার ও সংস্কারের মাধ্যমে লীলামাধুর্য উপস্থাপন করে অচিন্ত্যভেদাভেদবাদের আদর্শকে বৈষ্ণববাদে রূপান্তর করেন। মহাপ্রভুর সংক্ষিপ্ত জীবনের বিশ্বরূপ সংসারের শেষ আঠার বছর পুরীতে বসবাস করে শুদ্ধচিত্তে কৃষ্ণ ভাবনায় মত্ত থাকেন। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন মাত্র ৪৭ বছর বয়সে জগন্নাথদেবের মন্দিরের কপাট বন্ধ করে বিগ্রহের সাথে বিলীন হয়ে গৌরবর্ণের কান্তি দেহখানির চিরতরে অন্তর্নিহিত হন।

সনাতন ধর্মের দুর্যোগপূর্ণ সময়ে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব ঈশ্বর আরাধনাকে নবরূপে রূপায়িত করেছে। বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে বৈষ্ণবতত্ত অবলম্বন করে সংকীর্তনের মাধ্যমে ঈশ্বর প্রার্থনার অসাধারণ বৈচিত্র্যকে ‘চৈতন্যযুগ’ হিসাবে পরিগণিত করার কৃষ্ণভাবনামৃতের ক্ষেত্র তৈরি করেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তিত সংকীর্তন মহাযাত্রা পৃথিবীর প্রতিটি দেশে দেশে নগরে নগরে পরিভ্রমণ হতে থাকে। কৃষ্ণ ভাবনায় অন্তর্মুখী হওয়ার এই আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশকে প্রবলভাবে প্লাবিত করে। লাখ লাখ মানুষের ধর্ম বিশ্বাস ও দর্শন চিন্তাচেতনা ও ধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ধর্ম চর্চার যুগোপযোগী, কর্মোপযোগী, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পঞ্চত্বপ্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হয়।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণধর্মের অনুগাম নিষ্ঠার সঙ্গে গ্রহণ করেই সারা বিশ্বব্যাপি গড়ে ওঠে ‘আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ’ বা ‘ইসকন’। ভক্তিযোগে স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণকে তুষ্ট করা মূল উপজীব্য হলেও ধর্মীয় এই সংগঠন সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের নৈতিক শিক্ষা চর্চায় মূলনীতি গ্রহণ করে। জনসেবা, শিক্ষা, ধর্মচর্চা, নৈতিক শিক্ষা চর্চায় মূলনীতিধারণ করে। জনসেবা, শিক্ষা, ধর্মচর্চা, আধ্যাত্মচর্চার উদ্দেশ্যে ‘অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপদ’ ১৩ই জুলাই ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে ‘ইসকন’ প্রতিষ্ঠা করেন। চারটি নিয়ন্ত্রক নীতির অনুশীলনে সততার মশাল জ্বালিয়ে সংসার সমরাঙ্গণে এই ভাবনার দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। বিশুদ্ধ নিরামিষ জাতীয় আহার যেটি কৃষ্ণপ্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করে। অবৈধ যৌনাচার, জুয়া, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সহজাত নৈতিকতাবোধ, সততা, কর্তব্যপরায়ণতা, দায়িত্ববোধের বিরল চর্চা করে থাকে।

নৈতিকতার শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিবেকবান ও সৎ এই সংগঠনের সদস্যরা প্রাথমিকভাবে প্রকাশ্য স্থানে ‘হরে কৃষ্ণ’ মন্ত্র গেয়ে নিজেদের পরিশুদ্ধ করে, কৃষ্ণ চেতনা নিজেদের চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠায় এবং দিনরাত ‘হাঁড়মাস কালিকরা’ পরিশ্রমে সারাবিশ্বে ইসকনের প্রায় ৬০ হাজারেরও বেশি মন্দির এবং ২০ হাজারের অধিক উপাসনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একেশ্বরবাদী ধর্মোপসনার প্রচলিত ভক্তি বিশ্বাসের ভিত্তি নিয়ে শতাধিক আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলমান রয়েছে। একশরও বেশি ভোজনালয়ে ‘ফুড ফর লাইফ’ কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিদিন এক কোটির বেশি ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি গোত্র নির্বিশেষে মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্যবিতরণ করে জাতিসংঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সারা বিশ্বের বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপ, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়ার প্রায় সকল দেশে শরীর মন সুস্থ্য ও সতেজ রাখার নিরামিষভোজন অনুরাগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। এইজন্য ‘ফুড ফর লাইফ’ কর্মসূচিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করেছে।

দারিদ্রপীড়িত এলাকায় ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য আহারের ব্যবস্থার পাশাপাশি উদারনৈতিক হরে কৃষ্ণ মুভমেন্ট বিশ্বব্যাপি সমাদৃত হয়েছে। এতসব কিছুর সাফল্যের মূলে ‘শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু’ কর্তৃক প্রবর্তিত কৃষ্ণভক্তির আড়ালে মানবমুক্তির দর্শন। ষোড়শ শতাব্দীতে মহাপ্রভু রচিত চৈতন্যভাগবত বর্তমান সমাজব্যবস্থাতেও মুখোশধারী দুরাত্মাদের কর্মকাণ্ডকে অসারতা প্রমাণে যথেষ্ট। জাতভেদ প্রথা ঘিরে থাকা হিন্দু ধর্মের ছায়া শত্রুদের জন্য ‘শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু’ এক নিষ্ঠাবান ধর্মযাজক। সনাতন সংকীর্তন মহাযাত্রার সফল উদ্যোক্তার জন্মদিনে নতমস্তক শ্রদ্ধা।

লেখকঃ খন রঞ্জন রায়,সমাজচিন্তক, গবেষক ও সংগঠক।

খন রঞ্জন রায়: কলিযুগে ভয়ঙ্কর দুরবস্থার জন্য দায়ী মানুষের তমোগুণের মায়াহীন নিষ্ঠুর প্রভাব। নিদ্রা, তন্দ্রা, হিংসা, মায়া, অসত্য, বিষাদ, শোক, মোহ, শান্ত, ধীর, সহিষ্ণু, লোভ, লালসা সবকিছু আচ্ছন্ন থাকছে রজ ও তমোগুণের বর্বর আচরণে। সনাতন দর্শনে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি চারটি সময় বা যুগ চক্রাকারে পরিবর্তন হচ্ছে। যুগ চারটির আয়ুস্কাল নির্ধারণ করা আছে। সত্য যুগের ছিল সতের লক্ষ আটাশ হাজার বছর। ত্রেতা যুগের বার লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার, দ্বাপর যুগের ছিল আট লক্ষ চৌষট্টি হাজার বছর, আর সর্বশেষ কলির বয়স নির্ধারণ করা আছে চার লক্ষ বত্রিশ হাজার বছর। লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভৌমলীলা পরীক্ষিৎ মহারাজের রাজত্বকাল থেকে শুরু করলে ইতোমধ্যে আমরা কলিযুগ অতিক্রম করেছি পাঁচ হাজার বছর।

যুগ পরিক্রমায় সত্য যুগে ধর্ম আচরণ ছিল হাজার বছর ধরে ধ্যানে মগ্ন থাকা। ত্রেতাযুগের ধর্ম প্রক্রিয়া ছিল যজ্ঞ করা। দ্বাপরে ছিল মন্দিরে মন্দিরে ভগবান পরমেশ্বরের আরাধনা। বর্তমান কলিযুগে প্রেমভক্তিতে রসসুধা আস্বাদনে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবর্তন ‘হরিনাম সংকীর্তন’। ‘হরি’ মূলত সংস্কৃত শব্দ। হিন্দু ধর্মের মহত্তম দর্শনে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিষ্ণু দেবতার একটি নাম। বাংলা শব্দকোষের দ্বারস্থ হলে দেখা যায় বেদে বর্ণিত পরম পরমই হচ্ছে “হরি”।

এখানে শারীরিক সৌন্দর্য নয়, মেধা মনন, মূল্যবোধ, ন্যায়নীতি, সুবিচার, সুশাসন ইত্যাদি গুণাগুণের চরিত্র ও জীবন চর্চা বুঝায়। তুলনা চলে বাতাসের সঙ্গে, যতক্ষণ প্রবাহমান থাকে ততক্ষণে অভাব অনুভব হয় না, প্রবাহের সামান্য সংকট হলেই অভাবটা অনুভব করা যায় ব্যাপকভাবে। আরো পোক্ত করে বললে হরি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি তুলনারহিত শক্তি ধারণ করে আছেন। জীবনের স্মৃতি ও সত্তার পুননির্মাণ করেন। মনোজাগতিক অন্ধকার দূর করেন। মানুষকে পরমব্রহ্মের নিকট সমর্পন হতে উদ্বুদ্ধ করেন। জাগতিক সকল দুঃখ, যাতনা, বিবাদ-বিসংবাদ দূর করেন। মনের গহন অন্ধকার পরিশুদ্ধভাবে রূপায়নের আশ্চর্য রূপকার তিনি।

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত দুর্নীতি, সম্পদ পাচার, মিথ্যাচার, নারী নির্যাতনের মতো কাল সাপকে নির্মূল করতে সাহস যোগান। জীবনের গভীর উপলব্ধির গল্প এই নাম থেকেই শুরু করা যায়। মহাভারতে বিষ্ণুর সহস্রনামের ৬৫৬তম নাম হিসাবে ‘হরি’ হিন্দু ধর্মকে আচ্ছন্ন ও তাড়িত করে। হিন্দু ধর্মের পবিত্র শাস্ত্র ভগবদগীতা ও মহাভারতে হরির একাধিক নাম উল্লেখ আছে। বিষ্ণু, নারায়ণ, রমা, কৃষ্ণ, মাধব, দামোদর, গোবিন্দ, গোপাল এমন সহস্র নাম বিশ্বাসের জোর থেকে উৎসারিত হয়। মানবসংসারে এক অত্যাশ্চার্য অনুভূতির নাম ‘হরি’। সংস্কৃতির শক্তিকে যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁরা সবাই হরির প্রেমের চিহ্ন ছড়িয়ে দিয়ে নিজকে ভাগ্যবান মনে করেন। এখানে বিন্দুমাত্র সত্যের বরখেলাপ হয় না। বৈষ্ণধর্মের অনুসারিরা জীবনের বিভিন্ন পর্বে নানারকম প্রতিকূলতার মধ্যেও হরি শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মান্যজ্ঞান করেন। হিন্দু সংস্কৃতি বৈচিত্র্যের এক উজ্জ্বল প্রকাশ ‘হরি’। যে কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে বেদমন্ত্র ব্যবহার আবৃত্তির আগে ‘হরি ওম (ওঁ)’ মন্ত্রটি ব্যবহার করে ধর্মের প্রতি আত্মবিশ্বাস জাগানো হয়।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব ঐতিহ্যে হরি, কৃষ্ণ ও বিষ্ণু উভয়ের নাম ‘হরে কৃষ্ণ’ এর মাধ্যমে আহ্বান করা হয়। মানবজীবনের পরম উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ। আধুনিক আমলের ঈশ্বর লাভের বিজ্ঞানসম্মত উপায় ‘হরিনাম সংকীর্তন’ এর ভিত্তিভূমির নবজাগরণ ঘটান মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব। হিন্দু সমাজব্যবস্থায় শ্রেণি বিন্যাসের পবিত্রতার মানদণ্ড প্রবলভাবে আলোড়িত ছিল। বৈদিক আর প্রাকবৈদিক সংস্কৃতির সমন্বয়ে আধুনিক সভ্যতা গড়ে ওঠার চেষ্টা হচ্ছিল। প্রকৃতিবাদী হিন্দু রীতিতে সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি, আকাশ, বাতাস, প্রত্যুষ, বৃষ্টি সবাই দেবতা স্তবের বৈদিক ধারা।

খ্রিস্টের জন্মের চার হাজার পাঁচশত বছর আগে ঋগবেদ আর আড়াই হাজার বছর আগে যখন বেদ রচনা হয় তখন থেকেই ঈশ্বর প্রার্থনার জন্য হিন্দুরা আধুনিক মননরীতিতে প্রভাবিত হয়। রক্ষণশীলতা আচার সর্বস্বতা পরিত্যাগ করে সুনির্দিষ্ট দেবতা আরাধনায় মনোনিবেশ করে। বহু জাতি আর নানান সংস্কৃতির মিশ্রণের ফলে সিন্ধু তীরের হিন্দু সভ্যতার তাৎপর্যের ইতিহাস আধুনিক শাস্ত্রতত্তবিদগণকেও সম্মোহিত করে। বেদের আলোকে খ্রিস্টপূর্ব ষোলশ শতাব্দিতে উপনিষদ রচনার মাধ্যমে এর মূল বিষয় ব্রহ্ম আর আত্মার তত্তখোঁজা হয়েছিল। তখন প্রমাণ হয়েছিল ব্রহ্ম আর আত্মা অভিন্ন। উপনিষদ রচনার কিছুকাল পর প্রায় দুই হাজার নয়শত বছর আগে যখন শ্রীমদ্ভগবদগীতা আবির্ভাব হয় তখন থেকেই হিন্দু ধর্মের আচরণবিধি, গতিপথ প্রসারিত হতে থাকে।

পৌরাণিক কাহিনীর বৈচিত্র্যে, সংস্কৃতির বিস্তারে, নৈতিক আচরণবিধিবিধানে, অবৈদিক জনগোষ্ঠীও সর্বশক্তিমত্তার সর্বব্যাপী অবস্থান স্বীকার করে প্রার্থনারত হতে থাকে। চব্বিশ হাজার শ্লোকের রামায়ণ, আর নব্বই হাজার শ্লোকের মহাভারত হিন্দু দর্শনের অমূল্য সম্পদের বিশেষত্ব ‘অবতারবাদ’। যুগাবতার অবলম্বন করে ১৪৮৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ফাল্গুনী দোল পূর্ণিমায় আবির্ভাব ঘটে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর। পিতা পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতা শচীদেবী তখন পশ্চিমবঙ্গ জেলার নবদ্বীপ শহরে বসবাস করেছিলেন। তাঁদের আদি নিবাস বাংলাদেশে। সিলেট জেলার ঢাকা দক্ষিণ গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন জগন্নাথ মিশ্র। বিদ্যার্জনের মনোবাসনায় মহাপ্রভুর দাদা উপেন্দ্র মিশ্র বাবা জগন্নাথকে নবদ্বীপে পাঠিয়েছিলেন।

১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে ১৭ বছর বয়সে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব জলপথে সিলেটে আগমন করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল পিতৃপুরুষদের সম্পত্তি উদ্ধার। এখানেও তিনি ভক্তি অনুশীলনে মনোনিবেশ করেন। ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে ২৩ বছর বয়সে মহাপ্রভু বৈষ্ণব ভক্ত ‘ঈশ্বরপুরীর’ কাছে দশাক্ষর গোপালমন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন। তখন থেকে কৃষ্ণপ্রেমে আসক্ত হয়ে ছাত্র-শিষ্যদের স্বরচিত পদাবলী সংকীর্তনের শিক্ষা দিতে লাগলেন।
‘হরি হরয়ে নমো : কৃষ্ণ মাধ্বায়নম:
গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধুসুগণ’
বৈষ্ণবভক্ত প্রচারে শ্রী চৈতন্যদেব সংকীর্তন আন্দোলনের মধ্যদিয়ে আধুনিক হিন্দু সমাজ জাগরণে তখনকার সময়ের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হন। শ্রী চৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণবতত্ত সনাতন হিন্দুধর্ম মতাবলম্বীর নব সংস্করণ। বৈষ্ণবতত্ত জাতিভেদ প্রথায় নির্যাতিত মানুষের মনে প্রবল আবেগের সঞ্চার করে। জাতভেদ শ্রেণি বৈষম্যের শিকার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সংকীর্তন পরিক্রমণে আকৃষ্ট হয়ে অংশগ্রহণ করতে থাকে।

নিত্যানন্দ, হরিদাস, শ্রীরাম, মুকুন্দ দত্ত, অদৈত আচার্যসহ অনেক বৈষ্ণবভক্ত শ্রীচৈতন্যদেবের নবদ্বীপ সংকীর্তন যাত্রায় আত্মনিয়োগ করেন। হরিভক্তি আস্বাদনে মহাপ্রেমিক হতে শ্রীচৈতন্যদেব অনেককে আহ্বান করেন। সেই আহ্বান দিগিদিক ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি, দরিদ্র শ্রীধর পণ্ডিত, ভক্ত হরিদাসসহ অনেককে বুকে টেনে নিয়ে নব প্রবর্তিত প্রেমভক্তির শক্তিশালী দর্শন উপলব্ধিতে মনোনিবেশ ঘটান। চৈতন্যভক্তির ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে শিষ্যরা নবদ্বীপ ছেড়ে বৃন্দাবন, পুরী, শান্তিপুর, মায়া, দাক্ষিণাত্য, নীলাচল, কাশী, প্রয়োগ, মথুরা প্রভৃতি স্থানে মহাপ্রভুর সংকীর্তন আন্দোলন প্রসারিত করতে থাকেন। ২৪ বছর বয়সে ১৫১০ সালের ২৬ জানুয়ারি মাঘী শুক্লপক্ষে মহাপ্রভু গৃহত্যাগ করে আচার্য কেশব ভারতীর নিকট থেকে হিন্দু শাস্ত্রীয় সন্ন্যাস দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনিই মহাপ্রভুর নাম রাখেন ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’।

মহাপ্রভু ১৫১০ থেকে ১৫১২ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থানসমূহে পরিক্রমণ করে ভক্তিবাদ প্রচার করেন। লুপ্ত অনেক তীর্থ স্থান পুনরুদ্ধার করেন। ১৫১৬ সালে তিনি জন্মস্থান নবদ্বীপে এসে জন্মদাত্রী মা এবং স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়াকে দেখে কৃষ্ণপ্রিয়া হওয়ার আহ্বান জানান। মহাপ্রভু বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার ও সংস্কারের মাধ্যমে লীলামাধুর্য উপস্থাপন করে অচিন্ত্যভেদাভেদবাদের আদর্শকে বৈষ্ণববাদে রূপান্তর করেন। মহাপ্রভুর সংক্ষিপ্ত জীবনের বিশ্বরূপ সংসারের শেষ আঠার বছর পুরীতে বসবাস করে শুদ্ধচিত্তে কৃষ্ণ ভাবনায় মত্ত থাকেন। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন মাত্র ৪৭ বছর বয়সে জগন্নাথদেবের মন্দিরের কপাট বন্ধ করে বিগ্রহের সাথে বিলীন হয়ে গৌরবর্ণের কান্তি দেহখানির চিরতরে অন্তর্নিহিত হন।

সনাতন ধর্মের দুর্যোগপূর্ণ সময়ে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব ঈশ্বর আরাধনাকে নবরূপে রূপায়িত করেছে। বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে বৈষ্ণবতত্ত অবলম্বন করে সংকীর্তনের মাধ্যমে ঈশ্বর প্রার্থনার অসাধারণ বৈচিত্র্যকে ‘চৈতন্যযুগ’ হিসাবে পরিগণিত করার কৃষ্ণভাবনামৃতের ক্ষেত্র তৈরি করেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তিত সংকীর্তন মহাযাত্রা পৃথিবীর প্রতিটি দেশে দেশে নগরে নগরে পরিভ্রমণ হতে থাকে। কৃষ্ণ ভাবনায় অন্তর্মুখী হওয়ার এই আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশকে প্রবলভাবে প্লাবিত করে। লাখ লাখ মানুষের ধর্ম বিশ্বাস ও দর্শন চিন্তাচেতনা ও ধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ধর্ম চর্চার যুগোপযোগী, কর্মোপযোগী, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পঞ্চত্বপ্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হয়।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণধর্মের অনুগাম নিষ্ঠার সঙ্গে গ্রহণ করেই সারা বিশ্বব্যাপি গড়ে ওঠে ‘আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ’ বা ‘ইসকন’। ভক্তিযোগে স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণকে তুষ্ট করা মূল উপজীব্য হলেও ধর্মীয় এই সংগঠন সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের নৈতিক শিক্ষা চর্চায় মূলনীতি গ্রহণ করে। জনসেবা, শিক্ষা, ধর্মচর্চা, নৈতিক শিক্ষা চর্চায় মূলনীতিধারণ করে। জনসেবা, শিক্ষা, ধর্মচর্চা, আধ্যাত্মচর্চার উদ্দেশ্যে ‘অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপদ’ ১৩ই জুলাই ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে ‘ইসকন’ প্রতিষ্ঠা করেন। চারটি নিয়ন্ত্রক নীতির অনুশীলনে সততার মশাল জ্বালিয়ে সংসার সমরাঙ্গণে এই ভাবনার দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। বিশুদ্ধ নিরামিষ জাতীয় আহার যেটি কৃষ্ণপ্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করে। অবৈধ যৌনাচার, জুয়া, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সহজাত নৈতিকতাবোধ, সততা, কর্তব্যপরায়ণতা, দায়িত্ববোধের বিরল চর্চা করে থাকে।

নৈতিকতার শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিবেকবান ও সৎ এই সংগঠনের সদস্যরা প্রাথমিকভাবে প্রকাশ্য স্থানে ‘হরে কৃষ্ণ’ মন্ত্র গেয়ে নিজেদের পরিশুদ্ধ করে, কৃষ্ণ চেতনা নিজেদের চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠায় এবং দিনরাত ‘হাঁড়মাস কালিকরা’ পরিশ্রমে সারাবিশ্বে ইসকনের প্রায় ৬০ হাজারেরও বেশি মন্দির এবং ২০ হাজারের অধিক উপাসনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একেশ্বরবাদী ধর্মোপসনার প্রচলিত ভক্তি বিশ্বাসের ভিত্তি নিয়ে শতাধিক আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলমান রয়েছে। একশরও বেশি ভোজনালয়ে ‘ফুড ফর লাইফ’ কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিদিন এক কোটির বেশি ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি গোত্র নির্বিশেষে মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্যবিতরণ করে জাতিসংঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সারা বিশ্বের বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপ, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়ার প্রায় সকল দেশে শরীর মন সুস্থ্য ও সতেজ রাখার নিরামিষভোজন অনুরাগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। এইজন্য ‘ফুড ফর লাইফ’ কর্মসূচিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করেছে।

দারিদ্রপীড়িত এলাকায় ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য আহারের ব্যবস্থার পাশাপাশি উদারনৈতিক হরে কৃষ্ণ মুভমেন্ট বিশ্বব্যাপি সমাদৃত হয়েছে। এতসব কিছুর সাফল্যের মূলে ‘শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু’ কর্তৃক প্রবর্তিত কৃষ্ণভক্তির আড়ালে মানবমুক্তির দর্শন। ষোড়শ শতাব্দীতে মহাপ্রভু রচিত চৈতন্যভাগবত বর্তমান সমাজব্যবস্থাতেও মুখোশধারী দুরাত্মাদের কর্মকাণ্ডকে অসারতা প্রমাণে যথেষ্ট। জাতভেদ প্রথা ঘিরে থাকা হিন্দু ধর্মের ছায়া শত্রুদের জন্য ‘শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু’ এক নিষ্ঠাবান ধর্মযাজক। সনাতন সংকীর্তন মহাযাত্রার সফল উদ্যোক্তার জন্মদিনে নতমস্তক শ্রদ্ধা।

লেখকঃ খন রঞ্জন রায়,সমাজচিন্তক, গবেষক ও সংগঠক।