খন রঞ্জন রায়: নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম। প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ছড়িয়ে রয়েছে চট্টগ্রামের পরতে পরতে। কোথাও সুউচ্চ পাহাড়, বনানী, বয়ে যাওয়া ঝর্ণা কিংবা সাগরের স্বপ্নীল হাতছানি সৌন্দর্য পিপাসু প্রত্যেককে করে মোহাবিষ্ট। বিভিন্ন আউলিয়া, সুফি-সাধক, সাধু-সন্ন্যাসী, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণ এবং সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।

চট্টগ্রামের নামকরণের ইতিহাসে বৌদ্ধদের ধারণা চট্টগ্রামের নামটি চৈত কেয়াং বা চৈতা গ্রাম থেকে এসেছে। বার্মিজদের মতে কোন এক আরাকান রাজা ৯ম শতাব্দীতে জয় করে বিজয়ের স্মৃতি হিসেবে চট্টগ্রাম একটা পিলার স্থাপন করেন। পিলার গায়ে উৎকীর্ণ করা হয় সিট-টা-গং শব্দটি-যার অর্থ যুদ্ধ করা অযৌক্তিক । আরাকানদের কাছ থেকে মোগলরা ১৬৬৬ সালে এ অঞ্চল জয় করে এর নাম রাখেন ইসলামাবাদ।

১৭৬০ সালে বাংলার নবাব মীর কাশিম আলী খানের নিকট থেকে ইংরেজরা এ অঞ্চলের দখল নিয়ে এর নাম দেন চিটাগাং ’। আরবীয় বণিকরা বাণিজ্য করতে এসে এ অঞ্চলকে আখ্যায়িত করেন ‘মদিনাতুল আখজার’- যার অর্থ চির সবুজের শহর পতুর্গীজরা চট্টগ্রামের নাম দেন পোর্টো গ্রান্ডে । ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁও এর সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ এ অঞ্চল দখল করেন এবং নাম দেন চাটিগাঁও বা চাটগাঁও।

চট্টগ্রাম এখন- চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এই ১১টি জেলার সমন্বয়ে বিভাগীয় শহরের মর্যাাদায় সমাসীন। এখানের প্রকৃত আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ- ২৫৯৬১৪৪, আউস ধান- ৪২৫০৯৫, আমন ধান- ৬৩৫২৪৬, বোরো ধান – ২৬৪১৫৮, গম – ১৭৩২৭, পাট- ১৯৬২০ একরের। কর্ণফুলী, সাঙ্গু, ফেনী, মুহুরী, সোনাদিয়া, তিতাস, মেঘনা, সালদা, ডাকাতিয়া, নাফ, শঙ্খ, কাশালঙ, রানখিয়াং ইত্যাদি নদ-নদীবেষ্টিত। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, কাপ্তাই লেক, রাঙ্গামাটি ঝুলন্ত ব্রীজ, ফয়’জ লেক, শালবন বিহার, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, আদিনাথ মন্দির, আলুটিলা, চন্দ্রনাথ মন্দির, মুহুরী প্রজেক্ট, কমলা রাণীর দীঘি, পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাধি, ময়নামতি পাহাড়, বৌদ্ধ সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ, নদী গবেষণা ইনষ্টিটিউট চাঁদপুর, তিতাস গ্যাসক্ষেত্র, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, চন্দ্রঘোনা কাগজ কল, হিমছড়ি, শুভলং, নিঝুম দ্বীপ ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান।

আয়েত আলী খাঁ, কবি ও সাহিত্যিক কবির চৌধুরী, চারুশিল্পী হাসেম খান অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, মহাকবি আলাওল, সাহিত্যিক আবদুল করিম, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, মাষ্টারদা সূর্যসেন, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ, সাহিত্যিক মোতাহার হোসেন চৌধুরী, কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা, ইঞ্জি. সাঈদ মাহবুবুল হক, ইঞ্জি. মিয়া মো. কাইয়ুম, ড: ইঞ্জি: মো. তারেক উদ্দীন প্রমূখ বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর জন্ম ধণ্য চট্টগ্রাম।

প্রাকৃতিক সম্পদ, জলজ সম্পদ, উদ্ভিদ সম্পদ, মৎস্য সম্পদ, খনিজ সম্পদে ভরপুর চট্টগ্রাম বিভাগ। সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম ছিল ভারতবর্ষের একটি শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চল। সময়ের বিবর্তনে চাহিদা অনুযায়ী এই অঞ্চলের জনগণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে জীবিকা নির্ধারণ করে আসছে। বর্ণিল বিশেষণে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। প্রায় হাজার বছর নানা জাতিগোষ্ঠীর আগমন-আক্রমণে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ছিল নিয়তির খেলা আর মানুসের স্বাভাবিক প্রবণতারও বাইরে মানিয়ে নেয়ার এক অসম্ভব শক্তি। মধ্যযুগের প্রাচীন হরিকেল রাজ্য কিংবা দেয়াঙ পরগনার সমৃদ্ধ ইতিহাসে মগ, পর্তুগিজ কিংবা ওলন্দাজদের আগমনের শেষার্ধে ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলেই প্রতিরোধ সংগ্রামের ঝলক দেখায় এ অঞ্চলের ভূমিপুত্ররা।

জেমস ফিনলে, ডানকান ব্রাদার্স কিংবা লিভার ব্রাদার্সের মতো বিশ্বখ্যাত বাণিজ্য গ্রুপ চট্টগ্রামেই তাদের পণ্য উৎপাদনের স্থানীয় কারখানা তৈরি করে। পরবর্তীতে তা পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রোথিত হয়। আর পাকিস্তান সরকারই চট্টগ্রামের এ অপারসম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগোলিকভাবে সমৃদ্ধ এ অঞ্চলে একের পর এক শিল্প স্থাপনে মনোযোগী হয়, যা ঐতিহ্য আর পরম্পরায় বাংলাদেশের ভারী শিল্প কিংবা যেকোনো নতুন শিল্প সম্ভাবনার সূতিগাকার হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম। পর্তুগিজ কিংবা তারও আগের চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শিল্পের যে সূত্রপাত, তারই ধারাবাহিকতা চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে। জাহাজ ভাঙা শিল্প, কাগজ, কেমিক্যাল, প্রসাধনী, ইস্পাত, পাট ও পাটজাত পণ্যের চট্টগ্রামের গর্ব করার মতো আছে নানা অনুষঙ্গ। শৌর্য-বীর্যেও চাটগাঁ আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লবেও কখনো পিছিয়ে ছিল না।

নান্দনিক দৃষ্টিনন্দন অপ্সরীস্থানও হাতেগোনা নয়। তবে ভৌগোলিক ও প্রকৃতিগত কারণে উপমহাদেশের অনেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, শিল্পগোষ্ঠীর দৃষ্টি ছিল এই চট্টগ্রাম। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি শিল্পবান্ধব করে তুলেছে চট্টগ্রামকে। অথচ তৎকালীন স্থাপিত বেশকিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, কিছু কিছু এখন মৃতপ্রায় হলেও চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের প্রধান শিল্প-কারখানা এখানেই। নানা পথ পরিক্রমা, নানামাত্রিক পরিবর্তিত, পরিস্থিতি, যোগাযোগ ব্যবস্থার ছন্দপতন, ব্যবসায়ীদের চিন্তাচেতনার পরিবর্তন, কিছু ব্যবসায়ীর ঢাকাকেন্দ্রিক মানসিকতা ও দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক অবয়বে।

পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক ইস্পাতের চাহিদা ছিল ব্যাপক। এ চাহিদা বিবেচনা করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৬০ সালের দিকে চট্টগ্রামে ‘চিটাগং স্টিল মিলস’ নামে একটি ইস্পাত কারখানা কর্ণফুলী নদীর পাড়ে স্থাপন করে। প্রায় ২২২ দশমিক ৪২ একর জমির উপর স্থাপিত এই কারখানা বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায় ১৯৬৭ সালের আগস্টে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে এটিকে একটি পৃথক কোম্পানিতে পরিণত করা হয়। ১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে সরকার কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করে। এ কারখানাই পূর্ব পাকিস্তানসহ ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ও প্রসিদ্ধ ভারী ইস্পাত শিল্প হিসেবে পরিচিত ছিল। চট্টগ্রামের ইস্পাত শিল্পের বিকাশে তৎকালীন চিটাগং স্টিল মিলসের অবদান এখনো অনস্বীকার্য।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নে প্রায় ৯২ একর জমির ওপর ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘চিটাগাং কেমিক্যাল কমপ্লেক্স’ বার্ষিক প্রায় ২২ হাজার টন রাসায়নিক পণ্য উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানটিতে সাত হাজার টন কস্টিক সোডা, ৪ হাজার ৬০০ টন তরল ক্লোরিন পাউডার ও ২ হাজার ৪০০ টন ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্লোরাইড উৎপাদনক্ষমতা ছিল। দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠানটি লাভজনকভাবে চালু ছিল। কিন্তু সরকার, বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে ২০০২ সালে কারখানাটির উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।

চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় ১৯৫৩ সালে কর্ণফুলী পেপার মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন ‘পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা’ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পেপার মিলটি ১৯৫৩ সালের ১৬ অক্টোবর বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্যমাত্রা ছিল বার্ষিক ৩০ হাজার টন কাগজ উৎপাদনের। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ কাগজ উৎপাদন কারখানা স্থাপন করলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের বৃহৎ দাউদ গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়। দৈনিক ১৫০ টনেরও বেশি কাগজ উৎপাদনের মাধ্যমে কারখানাটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় কাগজ কারখানায় রূপান্তর হয়। পরে স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের আওতায় নিয়ে এসে পরিচালনা শুরু করে সরকার।

বর্তমানে প্রযুক্তি প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে কর্ণফুলী পেপার মিল। বেসরকারি গোল্ডেন বেঙ্গল টোব্যাকোসহ অনেক প্রসিদ্ধ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি মালিকানাধীন এসকেএম জুট মিল, আর আর টেক্সটাইল, হাফিজ টেক্সটাইল, অ্যারোমা টি কোম্পানি, লিপটন চা কোম্পানিও বন্ধ। পাহাড়তলী শিল্পাঞ্চলে ইস্পাহানির ভিক্টোরি জুট প্রডাক্টস বন্ধ ১৯৯৫ সাল থেকে। একই সময় বন্ধ হয় এ কে খান জুট, আমীন জুট মিল ইত্যাদি। রাঙ্গুনিয়ার কর্ণফুলী জুট মিল ও ফোরাত-কর্ণফুলী কার্পেট মিলস বন্ধ ঘোষণার পর শিল্পাঞ্চলটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।

সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডে ১৯৬৬ সালে গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রিজ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গাড়ি সংযোজন কারখানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তান। স্বাধীনতাপরবর্তী ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের আওতায় প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ নামে যাত্রা করে রাষ্ট্রীয় মলিকানায়, যা দেশের গাড়ি সংযোজনের ক্ষেত্রে এখনো শীর্ষস্থানীয়। বছরে প্রায় এক হাজার নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি সংযোজন ও বিপণনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি দেশে ভারী শিল্প হিসেবে অগ্রগণ্য। ইংল্যান্ডের জেনারেল মোটরসের কারিগরি সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত প্রগতি দীর্ঘদিন ধরে জাপানের মিৎসুবিশি কর্পোরেশন ছাড়াও বর্তমানে ভারতের মাহিন্দ্রা, টাটাসহ বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কারিগরি সহযোগিতায় দেশে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান তৈরির স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছে।

খাদ্যের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড । সমুদ্রের পানি কাজে লাগিয়ে অথবা খনি থেকে লবণ আহরণ করা হয়। খ্রিস্টের জন্মের ছয় হাজার বছর আগেও মানুষ খনি থেকে লবণ উত্তোলন করতো বলে ইতিহাস থেকে ধারণা পাওয়া যায়। লবণের ইতিহাস শুধু খাওয়ার লবণের ব্যবহার বা লবণ নিয়ে বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রাচীন রোমের সৈন্যদের বেতন দেয়া হতো লবণ দিয়ে। ইংরেজিতে শব্দের মানে হলো সৈন্য। আর মানে বেতন। এ শব্দ দুটি থেকে সল্ট শব্দের উৎপত্তি। মিসরীয়রা লবণ মাখিয়ে প্রথম খাবার সংরক্ষণের পদ্ধতি আবিষ্কার করে। লবণ নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে আন্দোলন হয়েছিল, যাকে ‘সল্ট মার্চ’ নামে অভিহিত করা হয়। এ আন্দোলনের আহ্বয়ক ছিলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। লবণের ওপর ব্রিটিশ সরকার করারোপ করে। তারই প্রতিবাদে এ যাত্রার আয়োজন করা হয়। মুলঞ্চী নামে খ্যাত চট্টগ্রামের একশ্রেণীর লোক অতীতকাল থেকে সমুদ্রের পানি সিদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করত।

পরবর্তীতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি কাজে লাগিয়ে লবণ উৎপাদন শুরু হয় মাঠপর্যায়ে। এক্ষেত্রে জোয়ারের সময় জমিতে পানি জমা করে রেখে তা সূর্যের আলো ও বাতাসের উপস্থিতিতে বাষ্প হয়ে গেলে তা জমিতে লবণের আস্তরণ পড়ে, তা-ই লবণ। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় সুদীর্ঘকাল থেকে অপরিকল্পিতভাবে সৌরপদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন হয়ে আসছে। বিসিকের হিসাবমতে ৭৪ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হয়। এ শিল্পে নিয়োজিত রয়েছেন ৫৫ হাজার চাষী। এছাড়া লবণ উৎপাদনের ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বড়ঘোনা, পটুয়াখালী উপকূলীয় এলাকায়ও পরীক্ষামূলকভাবে লবণ চাষ হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হয় চীনে, ৫৮ মিলিয়ন টন, যুক্তরাষ্ট্রে হয় ৪২ মিলিয়ন ও ভারতে ১৯ মিলিয়ন টন। দেশে গুরুত্বপূর্ণ যে কয়টি শিল্প রয়েছে, তার মধ্যে লবণ শিল্প অন্যতম। বাংলাদেশে জাতীয় অর্থনীতিতে লবণ শিল্পের অবদান ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা। চাহিদা আর যোগানের গড়পড়তা হিসাবের মারপ্যাঁচে এই শিল্পও নানা চড়াই উৎরাই কাটিয়ে কোনোমতে টিকে আছে।

বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মহাসাগর হচ্ছে শক্তির সবচেয়ে ভাল উৎস। বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সমুদ্রের সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। অর্থনীতি এখন সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে এবং সমুদ্রের রং যেহেতু নীল তাই এই নীলকান্ত ভিত্তিক অর্থনীতিকে ‘ব্লু ইকোনমি’ বা সুনীল অর্থনীতি বলে। সমুদ্র বাণিজ্যের মাধ্যমে জিডিপিতে ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবদান নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিশ্বের ৪৪তম অবস্থানে। আনুমানিক ৩০ লক্ষ বাংলাদেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামুদ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের উপর নির্ভরশীল। এই বিপুল জনগোষ্ঠী মৎস্য ও সামুদ্রিক পরিবহনের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে।

উপকূলীয় এবং দ্বীপ, উন্নয়নশীল দেশগুলি এই ব্লু ইকোনোমি’র দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মানবতার ভবিষ্যৎ উন্নয়নে সমুদ্র একটি বড় ভূমিকা পালন করে। উন্নত দেশের অর্থনীতির সিংহভাগ অর্জন হয় তাদের ব্লু ইকোনোমির সুনীল সাগরের সম্পদ থেকে। বাংলাদেশের ব্লু ইকোনোমির সম্পদের মধ্যে রয়েছে- সামুদ্রিক খাবার, সামুদ্রিক মৎস্য, সামুদ্রিক পরিবহন, সামুদ্রিক একোয়া কালচার, সামুদ্রিক পর্যটন, সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তি, সামুদ্রিক জৈব প্রযুক্তি ইত্যাদি, এই সবের সুষম আহরণ বাজারজাতকরণ ও পরিচালনায় চট্টগ্রাম বিভাগ হয়ে উঠুক অনন্য ভূমিকা পালনকারী। এজন্য দরকার প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত চৌকষ দক্ষ জনবল।

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশের অন্যতম দ্বার হিসেবে চট্টগ্রাম প্রাচীনকাল থেকেই পরিচিত হয়ে আসছিল। ফাহিয়ান, ডিওন, ক্লিমেন্স, জোহানস, টলেমি, স্ট্রাবো, প্লিনির ভ্রমণবৃত্তান্তে জানা যায়, আদিতে চট্টগ্রামের সাথে আরব, চীন, গ্রিকের সাথে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। ইবনে বতুতা, ইরান বুধ, ইদ্রিসীর ভ্রমণকাহিনীতেও চাটগাঁর সুবিস্তৃত বাণিজ্যের কথা উল্লেখ আছে। চাটগাঁর নৌযান নিয়ে চট্টগ্রামের নাবিকরা নক্ষত্রের সাহায্যে ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপ, পারস্য, সিংহল, সুমাত্রা, জাবা, মিসর দেশ পর্যন্ত গমন করত। এর মধ্যে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। বর্তমানেও দেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড চট্টগ্রাম বন্দর। সাথে যুক্ত হচ্ছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। ব্যবসা বাণিজ্যের সূতিকাগার চট্টগ্রাম দেশের জন্য আরো অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করবে।

চট্টগ্রাম শিল্পের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ চালানো চট্টগ্রামবাসীর আদি পেশা। চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক জাহাজ দূরদূরান্তে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করত। হালিশহরে অনেক ‘মালুম’ বংশের পরিচয় পাওয়া যায়। বার্মাটিক কাঠ দিয়ে চট্টগ্রামের কারিগরদের তৈরি জাহাজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ছিল। সুদূর ইউরোপ ও এশিয়া মাইনর থেকে এসে বণিকেরা চট্টগ্রামের জাহাজ কিনে নিয়ে যেত। কর্ণফুলীর তীরবর্তী গোসাইলডাঙ্গা, হালিশহর ও পতেঙ্গা জাহাজ নির্মাণের অনেক ডক ছিল। হালিশহরের ইশান চন্দ্র মিস্ত্রি, আগ্রাবাদ মিস্ত্রিপাড়ার ইমাম মিস্ত্রির নাম জাহাজ নির্মাণের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছে। জাহাজ নির্মাণের কারখানা ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত নিজ মাহাত্ম্য অক্ষুণ্ন রেখেছিল।

বিশ্বের মোট আয়তনের ৩ ভাগ জল এবং ১ ভাগ স্থল। এই ৩ ভাগ পানির পরিমাণ ১৩৮৬ মিলিয়ন ঘনমিটার। বিশাল এই জলরাশির ৯৭ শতাংশই লবণাক্ত এবং ৩ ভাগ মিঠা পানি। এই মিঠা পানির অধিকাংশই অর্থাৎ দুই মেরু অঞ্চলে জমাটবদ্ধ বরফ হিসেবে সংরক্ষিত। অবশিষ্ট ১ শতাংশ ব্যবহার-উপযোগী পানি। এই ১ শতাংশ মিষ্টি পানি ভূ-উপরিস্থ, ভূগর্ভস্থ ও বৃষ্টির পানি এ রকম একটি পানি চক্রের মাধ্যমে প্রাকৃতিক পানির স্তর পুনর্ভরণ করে চলেছে।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তিনটি প্রধান নদী অববাহিকা যথার্থ গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও মেঘনা উৎসের সঙ্গে প্রায় ২৩০টি বিভিন্ন আকার-আয়তনের নদনদী এবং অসংখ্য হাওড়-বাঁওড়-বিল-খাল-ঝরনা-ছড়া প্রভৃতিকে নিয়ে বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থা গঠিত। এই ২৩০টি নদীর মধ্যে ৫৭টি নদীর প্রবাহ বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত, চীন, নেপাল, মিয়ানমার ও ভুটানকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। অন্য আরেক হিসাবে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবাহিত নদনদীর সংখ্যা ২৩০ নয়, সাত শতাধিক। এক সুন্দরবন অঞ্চলেই রয়েছে ১৭০টি খাল ও নদী। এর মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের কর্ণফুলী। দেশের প্রাণশক্তি। অর্থনীতি সমৃদ্ধির অনন্ত সোপান চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাকৃতিক মূলধন।

চট্টগ্রাম বিভাগের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পর্যটন কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি। পাহাড়, অরণ্য, নদী, সাগর আর বিস্তীর্ণ বেলাভূমি কক্সবাজারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখানে রয়েছে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১১২কিঃমিঃ পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। সাগরের বুক চিরে ছোট বড় দ্বীপ। রয়েছে বিরল পাহাড়ী দ্বীপ মহেশখালী, মূল ভূখণ্ড থেকে ১৬ কিঃমিঃ দক্ষিণে নীল সাগরবেষ্টিত স্বপ্নের প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। হিমছড়ির পাহাড়ী ঝর্না, কক্সবাজার ও রামুর ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দির, কেয়াং, প্যাগোডা, অতিথি পাখির প্রিয়স্থান ও দেশের প্রধান শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্র সোনাদিয়া, আদিনাথ মন্দির, সৌন্দর্যের আদুরে কন্য ইনানী।

দেশের সর্ব দক্ষিণপ্রান্তে মায়ানমার সীমান্তের নাফ নদী ও সাগর বিধৌত টেকনাফ, ডুলাহাজরায় প্রতিষ্ঠিত সাফারি পার্ক, টেকনাফের মাথিনের কূপ, রাখাইন সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় জীবনাচার, বার্মিজ মার্কেট, ঝিনুক মার্কেটসহ আবহাওয়াকেন্দ্র। সম্পদ, মেধা, সাহস, ঐতিহ্য যে দিকেই চিন্তা করি না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই চট্টগ্রামের আছে উপচে পড়া সম্ভার। এর বাইরেও আছে অনবদ্য ভৌগোলিক অবস্থান। নিতান্তই অনবদ্য ভৌগোলিক অবস্থান। এত কিছু সত্তে্বও ‘গ্লোবাল সিটি’র মর্যাদার প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রামের অবস্থান নিতান্তই করুণ।

অর্থনীতি, অবকাঠামো ও শিক্ষা এ তিন উপাদান ছাড়াও আরো দুটি উপাদান চট্টগ্রামের গেøাবাল সিটি স্বপ্নের জন্য জরুরি ঐতিহ্য ও প্রকৃতি। পাহাড় ও সমুদ্রের লীলাভূমিতে পৃথিবীর খুব কম শহরই সমৃদ্ধ। ভৌগোলিক অবস্থানের এ অপার ভাগ্যকে শুভ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় নাই। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐতিহ্যের বিশাল ইতিহাস চট্টগ্রামের। এ ইতিহাসকে চট্টগ্রামের জন্য বিশ্বমানের সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করা হয়নি।
গ্লোবাল বাল সিটি’র স্বপ্ন অলীক নয়। কিন্তু অর্জনের দায়িত্ব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাঁধে তুলে নেয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করত হবে।

চট্টগ্রাম শহর ঢাকার সমকক্ষ শহর ছিল প্রায় স্বাধীনতার সময়, সেটাও এখন অনেক পিছিয়ে পড়েছে। ঐতিহাসিক সমৃদ্ধ পুরনো শহর এখনও সেই মফস্বল চেহারাই রয়ে গেছে। এক ধরনের তথাকথিত অবকাঠামোর বিকাশ ঘটেছে। সার্বিক অর্থে ঢাকার সঙ্গে তুলনা করলে আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টা স্পষ্ট হয়। বৈষম্য দূর করতে প্রাকৃতিক সম্পদকে প্রযুক্তিশক্তির সাহায্যে নান্দনিকরূপে ফুটিয়ে তুলতে হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘকাল এ চট্টগ্রাম বিভাগের ভাগ্যাহত মানুষের কল্যাণে বিশেষ কোন উদ্যোগ বা কোন উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯০ (নব্বই) দশকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলে দেশের ভাগ্যাহত মানুষের কল্যাণে নবদিগন্তের সূচনা হয়। চট্টগ্রামের জন্যও বড় বড় কিছু প্রকল্প বৃহত্তর পরিসরে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।কল্যাণমূলক কিছু বৃহৎ প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর পাশাপাশি বর্ণনাকৃত ভূ-প্রাকৃতিক সম্পদগুলিকে জনকল্যাণে ব্যবহার করার বড় ধরণের পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। তবেই অধিকারহারা চট্টগ্রাম ফিরে পাবে তার হারানো গৌরব। আমাদের প্রত্যাশা ও অপেক্ষা তাই দেখার।লেখকঃ খন রঞ্জন রায়,সমাজচিন্তক, গবেষক ও সংগঠক

খন রঞ্জন রায়: নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম। প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ছড়িয়ে রয়েছে চট্টগ্রামের পরতে পরতে। কোথাও সুউচ্চ পাহাড়, বনানী, বয়ে যাওয়া ঝর্ণা কিংবা সাগরের স্বপ্নীল হাতছানি সৌন্দর্য পিপাসু প্রত্যেককে করে মোহাবিষ্ট। বিভিন্ন আউলিয়া, সুফি-সাধক, সাধু-সন্ন্যাসী, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণ এবং সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।

চট্টগ্রামের নামকরণের ইতিহাসে বৌদ্ধদের ধারণা চট্টগ্রামের নামটি চৈত কেয়াং বা চৈতা গ্রাম থেকে এসেছে। বার্মিজদের মতে কোন এক আরাকান রাজা ৯ম শতাব্দীতে জয় করে বিজয়ের স্মৃতি হিসেবে চট্টগ্রাম একটা পিলার স্থাপন করেন। পিলার গায়ে উৎকীর্ণ করা হয় সিট-টা-গং শব্দটি-যার অর্থ যুদ্ধ করা অযৌক্তিক । আরাকানদের কাছ থেকে মোগলরা ১৬৬৬ সালে এ অঞ্চল জয় করে এর নাম রাখেন ইসলামাবাদ।

১৭৬০ সালে বাংলার নবাব মীর কাশিম আলী খানের নিকট থেকে ইংরেজরা এ অঞ্চলের দখল নিয়ে এর নাম দেন চিটাগাং ’। আরবীয় বণিকরা বাণিজ্য করতে এসে এ অঞ্চলকে আখ্যায়িত করেন ‘মদিনাতুল আখজার’- যার অর্থ চির সবুজের শহর পতুর্গীজরা চট্টগ্রামের নাম দেন পোর্টো গ্রান্ডে । ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁও এর সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ এ অঞ্চল দখল করেন এবং নাম দেন চাটিগাঁও বা চাটগাঁও।

চট্টগ্রাম এখন- চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এই ১১টি জেলার সমন্বয়ে বিভাগীয় শহরের মর্যাাদায় সমাসীন। এখানের প্রকৃত আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ- ২৫৯৬১৪৪, আউস ধান- ৪২৫০৯৫, আমন ধান- ৬৩৫২৪৬, বোরো ধান – ২৬৪১৫৮, গম – ১৭৩২৭, পাট- ১৯৬২০ একরের। কর্ণফুলী, সাঙ্গু, ফেনী, মুহুরী, সোনাদিয়া, তিতাস, মেঘনা, সালদা, ডাকাতিয়া, নাফ, শঙ্খ, কাশালঙ, রানখিয়াং ইত্যাদি নদ-নদীবেষ্টিত। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, কাপ্তাই লেক, রাঙ্গামাটি ঝুলন্ত ব্রীজ, ফয়’জ লেক, শালবন বিহার, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, আদিনাথ মন্দির, আলুটিলা, চন্দ্রনাথ মন্দির, মুহুরী প্রজেক্ট, কমলা রাণীর দীঘি, পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাধি, ময়নামতি পাহাড়, বৌদ্ধ সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ, নদী গবেষণা ইনষ্টিটিউট চাঁদপুর, তিতাস গ্যাসক্ষেত্র, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, চন্দ্রঘোনা কাগজ কল, হিমছড়ি, শুভলং, নিঝুম দ্বীপ ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান।

আয়েত আলী খাঁ, কবি ও সাহিত্যিক কবির চৌধুরী, চারুশিল্পী হাসেম খান অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, মহাকবি আলাওল, সাহিত্যিক আবদুল করিম, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, মাষ্টারদা সূর্যসেন, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ, সাহিত্যিক মোতাহার হোসেন চৌধুরী, কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা, ইঞ্জি. সাঈদ মাহবুবুল হক, ইঞ্জি. মিয়া মো. কাইয়ুম, ড: ইঞ্জি: মো. তারেক উদ্দীন প্রমূখ বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর জন্ম ধণ্য চট্টগ্রাম।

প্রাকৃতিক সম্পদ, জলজ সম্পদ, উদ্ভিদ সম্পদ, মৎস্য সম্পদ, খনিজ সম্পদে ভরপুর চট্টগ্রাম বিভাগ। সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম ছিল ভারতবর্ষের একটি শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চল। সময়ের বিবর্তনে চাহিদা অনুযায়ী এই অঞ্চলের জনগণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে জীবিকা নির্ধারণ করে আসছে। বর্ণিল বিশেষণে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। প্রায় হাজার বছর নানা জাতিগোষ্ঠীর আগমন-আক্রমণে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ছিল নিয়তির খেলা আর মানুসের স্বাভাবিক প্রবণতারও বাইরে মানিয়ে নেয়ার এক অসম্ভব শক্তি। মধ্যযুগের প্রাচীন হরিকেল রাজ্য কিংবা দেয়াঙ পরগনার সমৃদ্ধ ইতিহাসে মগ, পর্তুগিজ কিংবা ওলন্দাজদের আগমনের শেষার্ধে ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলেই প্রতিরোধ সংগ্রামের ঝলক দেখায় এ অঞ্চলের ভূমিপুত্ররা।

জেমস ফিনলে, ডানকান ব্রাদার্স কিংবা লিভার ব্রাদার্সের মতো বিশ্বখ্যাত বাণিজ্য গ্রুপ চট্টগ্রামেই তাদের পণ্য উৎপাদনের স্থানীয় কারখানা তৈরি করে। পরবর্তীতে তা পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রোথিত হয়। আর পাকিস্তান সরকারই চট্টগ্রামের এ অপারসম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগোলিকভাবে সমৃদ্ধ এ অঞ্চলে একের পর এক শিল্প স্থাপনে মনোযোগী হয়, যা ঐতিহ্য আর পরম্পরায় বাংলাদেশের ভারী শিল্প কিংবা যেকোনো নতুন শিল্প সম্ভাবনার সূতিগাকার হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম। পর্তুগিজ কিংবা তারও আগের চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শিল্পের যে সূত্রপাত, তারই ধারাবাহিকতা চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে। জাহাজ ভাঙা শিল্প, কাগজ, কেমিক্যাল, প্রসাধনী, ইস্পাত, পাট ও পাটজাত পণ্যের চট্টগ্রামের গর্ব করার মতো আছে নানা অনুষঙ্গ। শৌর্য-বীর্যেও চাটগাঁ আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লবেও কখনো পিছিয়ে ছিল না।

নান্দনিক দৃষ্টিনন্দন অপ্সরীস্থানও হাতেগোনা নয়। তবে ভৌগোলিক ও প্রকৃতিগত কারণে উপমহাদেশের অনেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, শিল্পগোষ্ঠীর দৃষ্টি ছিল এই চট্টগ্রাম। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি শিল্পবান্ধব করে তুলেছে চট্টগ্রামকে। অথচ তৎকালীন স্থাপিত বেশকিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, কিছু কিছু এখন মৃতপ্রায় হলেও চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের প্রধান শিল্প-কারখানা এখানেই। নানা পথ পরিক্রমা, নানামাত্রিক পরিবর্তিত, পরিস্থিতি, যোগাযোগ ব্যবস্থার ছন্দপতন, ব্যবসায়ীদের চিন্তাচেতনার পরিবর্তন, কিছু ব্যবসায়ীর ঢাকাকেন্দ্রিক মানসিকতা ও দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক অবয়বে।

পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক ইস্পাতের চাহিদা ছিল ব্যাপক। এ চাহিদা বিবেচনা করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৬০ সালের দিকে চট্টগ্রামে ‘চিটাগং স্টিল মিলস’ নামে একটি ইস্পাত কারখানা কর্ণফুলী নদীর পাড়ে স্থাপন করে। প্রায় ২২২ দশমিক ৪২ একর জমির উপর স্থাপিত এই কারখানা বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায় ১৯৬৭ সালের আগস্টে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে এটিকে একটি পৃথক কোম্পানিতে পরিণত করা হয়। ১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে সরকার কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করে। এ কারখানাই পূর্ব পাকিস্তানসহ ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ও প্রসিদ্ধ ভারী ইস্পাত শিল্প হিসেবে পরিচিত ছিল। চট্টগ্রামের ইস্পাত শিল্পের বিকাশে তৎকালীন চিটাগং স্টিল মিলসের অবদান এখনো অনস্বীকার্য।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নে প্রায় ৯২ একর জমির ওপর ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘চিটাগাং কেমিক্যাল কমপ্লেক্স’ বার্ষিক প্রায় ২২ হাজার টন রাসায়নিক পণ্য উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানটিতে সাত হাজার টন কস্টিক সোডা, ৪ হাজার ৬০০ টন তরল ক্লোরিন পাউডার ও ২ হাজার ৪০০ টন ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্লোরাইড উৎপাদনক্ষমতা ছিল। দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠানটি লাভজনকভাবে চালু ছিল। কিন্তু সরকার, বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে ২০০২ সালে কারখানাটির উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।

চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় ১৯৫৩ সালে কর্ণফুলী পেপার মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন ‘পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা’ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পেপার মিলটি ১৯৫৩ সালের ১৬ অক্টোবর বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্যমাত্রা ছিল বার্ষিক ৩০ হাজার টন কাগজ উৎপাদনের। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ কাগজ উৎপাদন কারখানা স্থাপন করলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের বৃহৎ দাউদ গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়। দৈনিক ১৫০ টনেরও বেশি কাগজ উৎপাদনের মাধ্যমে কারখানাটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় কাগজ কারখানায় রূপান্তর হয়। পরে স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের আওতায় নিয়ে এসে পরিচালনা শুরু করে সরকার।

বর্তমানে প্রযুক্তি প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে কর্ণফুলী পেপার মিল। বেসরকারি গোল্ডেন বেঙ্গল টোব্যাকোসহ অনেক প্রসিদ্ধ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি মালিকানাধীন এসকেএম জুট মিল, আর আর টেক্সটাইল, হাফিজ টেক্সটাইল, অ্যারোমা টি কোম্পানি, লিপটন চা কোম্পানিও বন্ধ। পাহাড়তলী শিল্পাঞ্চলে ইস্পাহানির ভিক্টোরি জুট প্রডাক্টস বন্ধ ১৯৯৫ সাল থেকে। একই সময় বন্ধ হয় এ কে খান জুট, আমীন জুট মিল ইত্যাদি। রাঙ্গুনিয়ার কর্ণফুলী জুট মিল ও ফোরাত-কর্ণফুলী কার্পেট মিলস বন্ধ ঘোষণার পর শিল্পাঞ্চলটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।

সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডে ১৯৬৬ সালে গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রিজ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গাড়ি সংযোজন কারখানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তান। স্বাধীনতাপরবর্তী ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের আওতায় প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ নামে যাত্রা করে রাষ্ট্রীয় মলিকানায়, যা দেশের গাড়ি সংযোজনের ক্ষেত্রে এখনো শীর্ষস্থানীয়। বছরে প্রায় এক হাজার নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি সংযোজন ও বিপণনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি দেশে ভারী শিল্প হিসেবে অগ্রগণ্য। ইংল্যান্ডের জেনারেল মোটরসের কারিগরি সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত প্রগতি দীর্ঘদিন ধরে জাপানের মিৎসুবিশি কর্পোরেশন ছাড়াও বর্তমানে ভারতের মাহিন্দ্রা, টাটাসহ বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কারিগরি সহযোগিতায় দেশে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান তৈরির স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছে।

খাদ্যের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড । সমুদ্রের পানি কাজে লাগিয়ে অথবা খনি থেকে লবণ আহরণ করা হয়। খ্রিস্টের জন্মের ছয় হাজার বছর আগেও মানুষ খনি থেকে লবণ উত্তোলন করতো বলে ইতিহাস থেকে ধারণা পাওয়া যায়। লবণের ইতিহাস শুধু খাওয়ার লবণের ব্যবহার বা লবণ নিয়ে বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রাচীন রোমের সৈন্যদের বেতন দেয়া হতো লবণ দিয়ে। ইংরেজিতে শব্দের মানে হলো সৈন্য। আর মানে বেতন। এ শব্দ দুটি থেকে সল্ট শব্দের উৎপত্তি। মিসরীয়রা লবণ মাখিয়ে প্রথম খাবার সংরক্ষণের পদ্ধতি আবিষ্কার করে। লবণ নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে আন্দোলন হয়েছিল, যাকে ‘সল্ট মার্চ’ নামে অভিহিত করা হয়। এ আন্দোলনের আহ্বয়ক ছিলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। লবণের ওপর ব্রিটিশ সরকার করারোপ করে। তারই প্রতিবাদে এ যাত্রার আয়োজন করা হয়। মুলঞ্চী নামে খ্যাত চট্টগ্রামের একশ্রেণীর লোক অতীতকাল থেকে সমুদ্রের পানি সিদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করত।

পরবর্তীতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি কাজে লাগিয়ে লবণ উৎপাদন শুরু হয় মাঠপর্যায়ে। এক্ষেত্রে জোয়ারের সময় জমিতে পানি জমা করে রেখে তা সূর্যের আলো ও বাতাসের উপস্থিতিতে বাষ্প হয়ে গেলে তা জমিতে লবণের আস্তরণ পড়ে, তা-ই লবণ। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় সুদীর্ঘকাল থেকে অপরিকল্পিতভাবে সৌরপদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন হয়ে আসছে। বিসিকের হিসাবমতে ৭৪ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হয়। এ শিল্পে নিয়োজিত রয়েছেন ৫৫ হাজার চাষী। এছাড়া লবণ উৎপাদনের ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বড়ঘোনা, পটুয়াখালী উপকূলীয় এলাকায়ও পরীক্ষামূলকভাবে লবণ চাষ হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হয় চীনে, ৫৮ মিলিয়ন টন, যুক্তরাষ্ট্রে হয় ৪২ মিলিয়ন ও ভারতে ১৯ মিলিয়ন টন। দেশে গুরুত্বপূর্ণ যে কয়টি শিল্প রয়েছে, তার মধ্যে লবণ শিল্প অন্যতম। বাংলাদেশে জাতীয় অর্থনীতিতে লবণ শিল্পের অবদান ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা। চাহিদা আর যোগানের গড়পড়তা হিসাবের মারপ্যাঁচে এই শিল্পও নানা চড়াই উৎরাই কাটিয়ে কোনোমতে টিকে আছে।

বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মহাসাগর হচ্ছে শক্তির সবচেয়ে ভাল উৎস। বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সমুদ্রের সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। অর্থনীতি এখন সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে এবং সমুদ্রের রং যেহেতু নীল তাই এই নীলকান্ত ভিত্তিক অর্থনীতিকে ‘ব্লু ইকোনমি’ বা সুনীল অর্থনীতি বলে। সমুদ্র বাণিজ্যের মাধ্যমে জিডিপিতে ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবদান নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিশ্বের ৪৪তম অবস্থানে। আনুমানিক ৩০ লক্ষ বাংলাদেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামুদ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের উপর নির্ভরশীল। এই বিপুল জনগোষ্ঠী মৎস্য ও সামুদ্রিক পরিবহনের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে।

উপকূলীয় এবং দ্বীপ, উন্নয়নশীল দেশগুলি এই ব্লু ইকোনোমি’র দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মানবতার ভবিষ্যৎ উন্নয়নে সমুদ্র একটি বড় ভূমিকা পালন করে। উন্নত দেশের অর্থনীতির সিংহভাগ অর্জন হয় তাদের ব্লু ইকোনোমির সুনীল সাগরের সম্পদ থেকে। বাংলাদেশের ব্লু ইকোনোমির সম্পদের মধ্যে রয়েছে- সামুদ্রিক খাবার, সামুদ্রিক মৎস্য, সামুদ্রিক পরিবহন, সামুদ্রিক একোয়া কালচার, সামুদ্রিক পর্যটন, সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তি, সামুদ্রিক জৈব প্রযুক্তি ইত্যাদি, এই সবের সুষম আহরণ বাজারজাতকরণ ও পরিচালনায় চট্টগ্রাম বিভাগ হয়ে উঠুক অনন্য ভূমিকা পালনকারী। এজন্য দরকার প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত চৌকষ দক্ষ জনবল।

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশের অন্যতম দ্বার হিসেবে চট্টগ্রাম প্রাচীনকাল থেকেই পরিচিত হয়ে আসছিল। ফাহিয়ান, ডিওন, ক্লিমেন্স, জোহানস, টলেমি, স্ট্রাবো, প্লিনির ভ্রমণবৃত্তান্তে জানা যায়, আদিতে চট্টগ্রামের সাথে আরব, চীন, গ্রিকের সাথে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। ইবনে বতুতা, ইরান বুধ, ইদ্রিসীর ভ্রমণকাহিনীতেও চাটগাঁর সুবিস্তৃত বাণিজ্যের কথা উল্লেখ আছে। চাটগাঁর নৌযান নিয়ে চট্টগ্রামের নাবিকরা নক্ষত্রের সাহায্যে ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপ, পারস্য, সিংহল, সুমাত্রা, জাবা, মিসর দেশ পর্যন্ত গমন করত। এর মধ্যে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। বর্তমানেও দেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড চট্টগ্রাম বন্দর। সাথে যুক্ত হচ্ছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। ব্যবসা বাণিজ্যের সূতিকাগার চট্টগ্রাম দেশের জন্য আরো অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করবে।

চট্টগ্রাম শিল্পের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ চালানো চট্টগ্রামবাসীর আদি পেশা। চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক জাহাজ দূরদূরান্তে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করত। হালিশহরে অনেক ‘মালুম’ বংশের পরিচয় পাওয়া যায়। বার্মাটিক কাঠ দিয়ে চট্টগ্রামের কারিগরদের তৈরি জাহাজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ছিল। সুদূর ইউরোপ ও এশিয়া মাইনর থেকে এসে বণিকেরা চট্টগ্রামের জাহাজ কিনে নিয়ে যেত। কর্ণফুলীর তীরবর্তী গোসাইলডাঙ্গা, হালিশহর ও পতেঙ্গা জাহাজ নির্মাণের অনেক ডক ছিল। হালিশহরের ইশান চন্দ্র মিস্ত্রি, আগ্রাবাদ মিস্ত্রিপাড়ার ইমাম মিস্ত্রির নাম জাহাজ নির্মাণের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছে। জাহাজ নির্মাণের কারখানা ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত নিজ মাহাত্ম্য অক্ষুণ্ন রেখেছিল।

বিশ্বের মোট আয়তনের ৩ ভাগ জল এবং ১ ভাগ স্থল। এই ৩ ভাগ পানির পরিমাণ ১৩৮৬ মিলিয়ন ঘনমিটার। বিশাল এই জলরাশির ৯৭ শতাংশই লবণাক্ত এবং ৩ ভাগ মিঠা পানি। এই মিঠা পানির অধিকাংশই অর্থাৎ দুই মেরু অঞ্চলে জমাটবদ্ধ বরফ হিসেবে সংরক্ষিত। অবশিষ্ট ১ শতাংশ ব্যবহার-উপযোগী পানি। এই ১ শতাংশ মিষ্টি পানি ভূ-উপরিস্থ, ভূগর্ভস্থ ও বৃষ্টির পানি এ রকম একটি পানি চক্রের মাধ্যমে প্রাকৃতিক পানির স্তর পুনর্ভরণ করে চলেছে।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তিনটি প্রধান নদী অববাহিকা যথার্থ গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও মেঘনা উৎসের সঙ্গে প্রায় ২৩০টি বিভিন্ন আকার-আয়তনের নদনদী এবং অসংখ্য হাওড়-বাঁওড়-বিল-খাল-ঝরনা-ছড়া প্রভৃতিকে নিয়ে বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থা গঠিত। এই ২৩০টি নদীর মধ্যে ৫৭টি নদীর প্রবাহ বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত, চীন, নেপাল, মিয়ানমার ও ভুটানকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। অন্য আরেক হিসাবে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবাহিত নদনদীর সংখ্যা ২৩০ নয়, সাত শতাধিক। এক সুন্দরবন অঞ্চলেই রয়েছে ১৭০টি খাল ও নদী। এর মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের কর্ণফুলী। দেশের প্রাণশক্তি। অর্থনীতি সমৃদ্ধির অনন্ত সোপান চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাকৃতিক মূলধন।

চট্টগ্রাম বিভাগের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পর্যটন কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি। পাহাড়, অরণ্য, নদী, সাগর আর বিস্তীর্ণ বেলাভূমি কক্সবাজারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখানে রয়েছে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১১২কিঃমিঃ পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। সাগরের বুক চিরে ছোট বড় দ্বীপ। রয়েছে বিরল পাহাড়ী দ্বীপ মহেশখালী, মূল ভূখণ্ড থেকে ১৬ কিঃমিঃ দক্ষিণে নীল সাগরবেষ্টিত স্বপ্নের প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। হিমছড়ির পাহাড়ী ঝর্না, কক্সবাজার ও রামুর ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দির, কেয়াং, প্যাগোডা, অতিথি পাখির প্রিয়স্থান ও দেশের প্রধান শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্র সোনাদিয়া, আদিনাথ মন্দির, সৌন্দর্যের আদুরে কন্য ইনানী।

দেশের সর্ব দক্ষিণপ্রান্তে মায়ানমার সীমান্তের নাফ নদী ও সাগর বিধৌত টেকনাফ, ডুলাহাজরায় প্রতিষ্ঠিত সাফারি পার্ক, টেকনাফের মাথিনের কূপ, রাখাইন সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় জীবনাচার, বার্মিজ মার্কেট, ঝিনুক মার্কেটসহ আবহাওয়াকেন্দ্র। সম্পদ, মেধা, সাহস, ঐতিহ্য যে দিকেই চিন্তা করি না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই চট্টগ্রামের আছে উপচে পড়া সম্ভার। এর বাইরেও আছে অনবদ্য ভৌগোলিক অবস্থান। নিতান্তই অনবদ্য ভৌগোলিক অবস্থান। এত কিছু সত্তে্বও ‘গ্লোবাল সিটি’র মর্যাদার প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রামের অবস্থান নিতান্তই করুণ।

অর্থনীতি, অবকাঠামো ও শিক্ষা এ তিন উপাদান ছাড়াও আরো দুটি উপাদান চট্টগ্রামের গেøাবাল সিটি স্বপ্নের জন্য জরুরি ঐতিহ্য ও প্রকৃতি। পাহাড় ও সমুদ্রের লীলাভূমিতে পৃথিবীর খুব কম শহরই সমৃদ্ধ। ভৌগোলিক অবস্থানের এ অপার ভাগ্যকে শুভ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় নাই। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐতিহ্যের বিশাল ইতিহাস চট্টগ্রামের। এ ইতিহাসকে চট্টগ্রামের জন্য বিশ্বমানের সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করা হয়নি।
গ্লোবাল বাল সিটি’র স্বপ্ন অলীক নয়। কিন্তু অর্জনের দায়িত্ব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাঁধে তুলে নেয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করত হবে।

চট্টগ্রাম শহর ঢাকার সমকক্ষ শহর ছিল প্রায় স্বাধীনতার সময়, সেটাও এখন অনেক পিছিয়ে পড়েছে। ঐতিহাসিক সমৃদ্ধ পুরনো শহর এখনও সেই মফস্বল চেহারাই রয়ে গেছে। এক ধরনের তথাকথিত অবকাঠামোর বিকাশ ঘটেছে। সার্বিক অর্থে ঢাকার সঙ্গে তুলনা করলে আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টা স্পষ্ট হয়। বৈষম্য দূর করতে প্রাকৃতিক সম্পদকে প্রযুক্তিশক্তির সাহায্যে নান্দনিকরূপে ফুটিয়ে তুলতে হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘকাল এ চট্টগ্রাম বিভাগের ভাগ্যাহত মানুষের কল্যাণে বিশেষ কোন উদ্যোগ বা কোন উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯০ (নব্বই) দশকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলে দেশের ভাগ্যাহত মানুষের কল্যাণে নবদিগন্তের সূচনা হয়। চট্টগ্রামের জন্যও বড় বড় কিছু প্রকল্প বৃহত্তর পরিসরে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।কল্যাণমূলক কিছু বৃহৎ প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর পাশাপাশি বর্ণনাকৃত ভূ-প্রাকৃতিক সম্পদগুলিকে জনকল্যাণে ব্যবহার করার বড় ধরণের পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। তবেই অধিকারহারা চট্টগ্রাম ফিরে পাবে তার হারানো গৌরব। আমাদের প্রত্যাশা ও অপেক্ষা তাই দেখার।লেখকঃ খন রঞ্জন রায়,সমাজচিন্তক, গবেষক ও সংগঠক