রানা চক্রবর্তী: এখন থেকে প্রায় একশো বছর আগে ‘হুতোম’, অর্থাৎ ‘কালীপ্রসন্ন সিংহ’ তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ গ্রন্থে সেকালের কলকাতার চড়ক-পার্বনের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, “কলিকাতা শহরের চার দিকেই ঢাকের বাজনা শোনা যাচ্চে, চড়কীর পিঠ সড় সড় কচ্চে; কামারেরা বাণ, দশলকি, কাঁটা ও বঁটি প্রস্তুত কচ্চে; সর্বাঙ্গে গয়না, পায়ে নূপুর, মাতায় জরির টুপি, কোমোরে চন্দ্রহার, সিপাই পেড়ে ঢাকাই শাড়ি মালকোচা করে পরা, তারকেশ্বরে ছোবানো গামছা হাতে, বিল্বপত্র বাদা সুতা গলায় যত ছুতোর, গয়লা, গন্ধবেণে ও কাঁসারীর আনন্দের সীমা নাই – ‘আমাদের বাবুদের বাড়ির গাজোেন!’ … এদিকে দুলে, বেয়ারা হাড়ি ও কাওরারা নূপুর পায়ে উত্তরি সুতা গলায় দিয়ে নিজ নিজ বীরব্রতের ও মহত্ত্বের শুভস্বরূপ বাণ ও দশলকি হাতে করে ঢাকের সঙ্গতে নেচে বেড়াচ্ছে, … ঢাকীরা ঢাকের টোয়েতে চামর, পাখির পালক, ঘন্টা ও ঘুঙুর বেঁধে পাড়ায় ঢাক বাজিয়ে সন্ন্যাসী সংগ্রহ কচ্চে; গুরুমশায়ের পাঠশালা বন্দ হয়ে গিয়েচে – ছেলেরা গাজনতলাই বাড়ি করে তুলেচে; আহার নাই, নিদ্রা নাই; ঢাকের পেছোনে পেচোনে রপ্টে রপ্টে বাড়াচ্চে; কখন ‘বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো মহাদেব’ চীৎকারের সঙ্গে যোগ দিচ্চে, কখন ঢাকের টোয়ের চামর ছিঁড়ছে, কখন ঢাকের পেছনটা দুম্দুম্ করে বাজাচ্চে – বাপ মা শশব্যস্ত, একটা না ব্যয়রাম কল্লে হয়।” কিন্তু এখন বাংলায় চড়ক পূজার চেয়ে শনিপুজোর ধূমই অনেক বেশি, অন্যান্য পুজোর তো কোন কথাই নেই। অতি আধুনিক যন্ত্রযুগকে সহ্য করতে না পেরে একান্তই গ্রাম্য বাংলার এই চড়ক পার্বণ এখন মহানগরীর সীমা থেকে প্রায় নির্বাসিতই হয়ে গিয়েছে। তবে হুতোমের যুগে চড়ক পূজা কিন্তু কেবলমাত্র আনন্দের ব্যাপারই ছিল না; চড়কের সঙ্গে তখন অনেক বীভৎস এবং ঘৃণ্য প্রথাও জড়িত ছিল, যা সেই যুগের অন্ততঃ একদল সমাজ সংস্কারককে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল; এবং যে বিদেশী সরকার হিন্দুদের সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সেযুগে খুব একটা হস্তক্ষেপ করতে চাইতেন না, তাঁরাও সেই ব্যাপারে তখন একেবারে নিরপেক্ষ হয়ে থাকতে পারেন নি। প্রধানতঃ সেই সব কাহিনী আলোচনা করবার জন্যই এই প্রবন্ধের অবতারণা।

ঐতিহাসিক ‘নীহাররঞ্জন রায়’ তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ গ্রন্থের ‘আদিপর্ব’ অংশে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, ধর্মপূজার মতই চড়কপূজা “মূলতঃ অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক ও অব্রাহ্মণ্য”; কিন্তু তাঁর এই অভিমত বহুলাংশে সত্যি হলেও সম্ভবতঃ সম্পূর্ণ সত্যি নয়। চড়ক পূজা যে অবৈদিক, সেবিষয়ে গবেষকদের কোনো সন্দেহ নেই, বর্তমান যুগে হিন্দুদের অধিকাংশ পূজা-পার্বণই অবৈদিক। কিন্তু চড়ক আদৌ সম্পূর্ণ অপৌরাণিক কিনা – সেবিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, মহাভারতে বর্ণিত বাণরাজার কাহিনী থেকে জানা যায় যে, মহাদেবের দর্শনলাভের জন্য বাণ রাজা তাঁর নিজের শরীরের উপরে নানা রকমের অত্যাচার করেছিলেন; মহাদেবের কৃপালাভের জন্য আজও চড়কের সন্ন্যাসীরাও তাঁদের নিজেদের শরীরের উপরে সেই একই ধরনের অত্যাচার করে থাকেন। তবে চড়ক পূজার ধারাটি যে মূলতঃ অনার্য, এবং বর্ণহিন্দু সমাজে সেটি যে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে স্বীকৃতি লাভ করেছে, সেবিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। বঙ্গদেশে প্রচলিত নীল বা চড়কপূজার কেন্দ্র যে শিবলিঙ্গ রয়েছে, সেটির প্রচলিত নাম হচ্ছে ‘বুড়ো শিব’; এবং এই বুড়ো শিবের যাঁরা পূজারী, সেই আচার্য ব্রাহ্মণ বা গ্রহবিপ্রেরা যে স্মার্ত মত অনুসারে পতিত – একথা এখন প্রায় কারোরই আর অজানা নয়। কুমিরের পুজা, জ্বলন্ত আগুনের উপরে দোলা, কাঁটাঝাঁপ, ছুরিঝাঁপ, বাণফোঁড়া, আগুন নিয়ে নাচা, চড়ক গাছে দোলা, শিবের বিয়ে, ‘দানো বারাণো’ – এসব হল চড়কপূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ। এগুলোর মধ্যে ‘দানো বারাণো’ সাধারণতঃ শ্মশানে অনুষ্ঠিত হয়, এবং এই অনুষ্ঠানটির সঙ্গেই ‘চড়কের সঙ’ জড়িত। চড়কের সন্ন্যাসীরা সাধারণতঃ দুলে, বাঙ্গী, হাড়ি, কাওরা ইত্যাদি জাতের হয়ে থাকেন; যাঁদের হাতের জল আজও বর্ণহিন্দু সমাজে অচল। সামাজিক জনতত্ত্বের পণ্ডিতেরা বলেন যে, ধর্মপূজা এবং চড়কপূজা – দুটিই নাকি আদিম সমাজের প্রেততত্ত্ব ও পুনর্জন্মে বিশ্বাস থেকে এসেছে, এবং অতীতে প্রত্যেক গোষ্ঠীর মৃতব্যক্তিদের পুনর্জন্ম কামনা করেই নাকি এই দুই পূজার অনুষ্ঠান করা হত। তাছাড়া চড়কের সময়ে বাণফোঁড়া, কাঁটাঝাপ, ছুরিঝাঁপ প্রভৃতি দৈহিক যন্ত্ৰণা গ্ৰহণ বা রক্তপাতের যেসব অনুষ্ঠান করা হয়, সেগুলোর পিছনেও সম্ভবতঃ আদিম সমাজের নরবলি প্রথার স্মৃতি রয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ঊনিশ শতকের শেষের দিকে যখন চড়কের বীভৎস অনুষ্ঠানগুলিকে সরকারি প্রচেষ্টায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন বীরভূম জেলার কোনো কোনো অঞ্চলের নিম্নবর্ণের চাষীরা সেখানকার প্রশাসক কর্তৃপক্ষের কাছে এই বলে অভিযোগ জানিয়েছিলেন যে, এর ফলে তাঁদের চাষের কাজে খুব ক্ষতি হবে; কারণ, মাটিতে কিছুটা নররক্ত না পড়লে আশানুরূপ ফসল পাওয়া নাকি অসম্ভব! এখনকার মত একশো’-দেড়শো’ বছর আগেও বাংলার বর্ণহিন্দুরা চড়কপূজায় প্রত্যক্ষভাবে কোনো অংশ গ্রহণ করতেন না। ‘রেভারেণ্ড আলেকজাণ্ডার ডাফ’, তাঁর ‘India And India Missions’ (Edinburgh, 1839) গ্রন্থে লিখেছিলেন, “It is proper to state that Brahmins, Kshatriyas and Vaishyas do not take any active part in the actual celebration of the rites peculiar to this festival. Most of them, however, contribute largely towards the expense of it, and countenance the whole of the proceedings as applauding spectators.” (P: 246-265) ১৮১৯ খৃষ্টাব্দের ২৩শে মে তারিখের ‘Calcutta Journal’ পত্রিকাতেও ডাফের এই উক্তির সমর্থন পাওয়া যায় – “No Hindoo of respectability ever degrades himself by swinging, no Brahman, no one of the medical tribe, and none among the Kaistha or writer caste, except the most abandoned …” (P- 626 ) বাংলার চড়কপূজার কৌলীন্যহীনতা সম্পর্কে এরপরে আর কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না।

হুতোমের যুগে বা তারও কিছু আগের বঙ্গদেশে চড়ক-পার্বণের বর্ণনা সেই সময়কার সংবাদপত্রগুলির মধ্যে পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে ‘ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’ সম্পাদিত ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ গ্রন্থটি থেকে সেরকম দু’-একটি বর্ণনা এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তখন চড়ক পূজার সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেসব বীভৎস ও ঘৃণ্য ব্যাপার জড়িত থাকত, সেগুলোর কিছু কিছু পরিচয়ও ওই সব প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় পাওয়া যায়। ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দের ২৭শে এপ্রিল তারিখের ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, “গত সন্ন্যাসবিষয়ক নীলোৎসব দর্শন করিয়া তদ্বিষয়ে কিঞ্চিৎ উক্তি করাতে পাঠকগণের সন্তোষ জন্মিতে পারে যেহেতুক চড়কপূজার বিষয়ে সর্ব্বসাধারণের বিশেষ মনোযোগ প্রার্থনা করা গিয়াছিল। … চিৎপুরের রাস্তায় অসংখ্যক ঢাকের মহাশব্দ এবং রাস্তার উভয়পার্শ্বের বাটীর বারান্দার উপর লোকের মহা কোলাহল হয়। সন্ন্যাসির দল সকল বাণ প্রভৃতি ফুড়িয়া বাদ্যসহিত আসিল এই সকল ব্যাপার বেলা ৯ ঘণ্টা পৰ্যন্ত দেখা যায়, পরে তামাসা যাহা দর্শনার্থে অনেক লোক জমা হয় তাহা ক্রমে কম হইয়া আসিতে লাগিল। বাঁশ, বাঁকারি ও কাগজমণ্ডিত একটা পাহাড় নির্মিত হইয়া নীল ও রক্তবর্ণের রং করা গিয়াছিল তদুপরি একটা প্রকাণ্ড মন্দির, তন্মধ্যস্থিত কাগজে নির্মিত হিন্দুর দেবতারা ইহাই দেখিয়া প্রথমে দর্শকগণেরা চমৎকার ভাবিলেন! … তৎপরে একখানা ময়ুরপঙ্খী দেখা গেল তাহা বাঁশ বাঁকারির দ্বারা নির্মাণ হয় … তাহার উপর কএকজন লোকেতে গানবাদ্য করত দাঁড় ফেলিতেছিল, তাহা একটা পাঠশালার ন্যায় কিন্তু বালকের নহে সেটা প্রকাণ্ড মনুষ্যের বিদ্যালয় ইহার গুরুমশায় ছাত্রগণের মূর্খতা দেখিয়া লজ্জিত হইয়া কহিলেন আমি ইহাদিগকে আর মারিয়া সোজা করিতে পারি না। … পরে গোদযুক্ত একটা বৃদ্ধ পুষ্প চন্দনাদি দ্বারা শরীর আবৃত করত দেবতা ভুল্য হইবায় অন্য একজন তাঁহার গোদপূজা করিতেছিল এবং সং দেখিয়া বড়ই হাসির ধূম পড়িল কিন্তু দেবপূজা করেন যে হিন্দু তিনি কিরূপে গোদপূজা করিলেন তাহা আমরা বলিতে পারি না।” ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’তেও চিৎপুরের রাস্তায় চড়কের সঙের সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। “প্রথমে দুটো মুটে একটা বড় পেতলের পেটা ঘড়ি বাঁশে বেঁদে কাঁদে করেচে – কতকগুলো ছেলে মুগুরের বাড়ি বাজাতে বাজাতে চলেচে – তার পেচোনে এলোমেলো নিশেনের শ্রেণী। মধ্যে হাড়িরা দল বেঁদে ঢোলের সঙ্গতে ভজন গাইতে গাইতে চলেচে। তার পেচোনে বাবুর অবস্থামত তকমাওয়ালা দরওয়ান, হরকরা সেপাই, মধ্যে সর্বাঙ্গে ছাই ও খড়ি মাখা, টিনের সাপের ফণার টুপি মাথায় শিব ও পার্বতী সাজা সং। তার পেচোনে কতকগুলো সন্ন্যাসী দশলকি ফুঁড়ে চলেচে। দর্শকেরা হাঁ করে গাজন দেখচেন, মধ্যে বাজনার শব্দে ঘোড়া খেপেচে – হুড়মুড় করে কেউ দোকানে কেউ খানার উপর পড়চেন, রৌদ্রে মাথা ফেটে যাচ্চে – তথাপি নড়চেন না।” ‘বিশপ হেবারের’ ভ্রমণ-কাহিনীতেও কলকাতার চৌরঙ্গীর রাস্তায় চড়কের সন্ন্যাসীদের শোভাযাত্রার একটি সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। হেবার এদেশের লোকেদের শান্তিপ্রিয় মনোভাবের প্রশংসা করে লিখেছিলেন যে, ইংল্যাণ্ডে যদি কখনো এত লোক একসঙ্গে জমায়েত হতেন, তাহলে আধঘণ্টার মধ্যে সেখানে অন্ততঃ তিনবার মুষ্টিযুদ্ধ দেখা যেত, এবং ইটালিতে সেরকম কিছু ঘটলে রাত্রি আরম্ভ হওয়ার আগেই অন্ততঃ ছয়টি খুনজখম হয়ে যেত। অতীতে চড়কের সময়ে কলকাতায় যেসব সঙরা বের হতেন, সেযুগে তাঁদের মধ্যে উত্তরে জেলে পাড়ার সঙ ও দক্ষিণে কালিঘাটের সঙরা বিখ্যাত ছিলেন। তখন অনেক ক্ষেত্রেই সেই সব সঙের সন্ন্যাসীরা যে নির্দোষ আমোদের সীমাকে লঙ্ঘন করতেন, সেকালের সংবাদপত্র থেকে সেসবের প্রমাণও পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে ১৮২৭ খৃষ্টাব্দের ২১শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, “চড়ক পূজার সময়ে সন্ন্যাসিদের মধ্যে কেহ কেহ সঙ হইয়া পথেতে এমত কদর্যরূপে নৃত্যাদি করে যে তাহা দর্শন করিতে ভদ্রলোকেরদের অতিশয় লজ্জা হয় অতএব তাহার বিবরণ হইতে কলিকাতাস্থ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব লোকেরা নিশ্চয় করিয়াছেন এবং গত চড়ক পূজার সময় এইরূপ অতি নির্লজ্জ তিন-চারিজন সন্ন্যাসীকে পুলিশে ধরিয়া লইয়া গিয়াছেন ইহার পর এমত কর্ম্ম যে তাঁহারা কিম্বা অন্য লোক শহরের মধ্যে আর না করে এই নিমিত্ত তাঁহারদের শাস্তি হইবেক।” ১৮২৭ খৃষ্টাব্দের ২৬শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণে’ও দু’জন ভণ্ড সন্ন্যাসীর কুৎসিত সঙ সাজবার অপরাধে কিছুদিনের জন্য কারাভোগ করবার সংবাদ পাওয়া যায়।

সেকালে সঙ ছাড়া চড়ক-পূজার অন্য দুটি প্রধান অঙ্গ ছিল – কাঁটাঝাঁপ ও চড়কগাছে দোলা। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় সেযুগের কাঁটাঝাঁপের একটি হাস্যকর বর্ণনা পাওয়া যায় – “সন্ন্যাসীরা নাচতে নাচতে কাছের পুকুর থেকে পরশুদিনের ফ্যালা কতকগুলি বঁইচির ডাল তুলে আনলে। গাছতলায় বিশ আঁটি বিচালি বিছানো ছিল, কাঁটার ডালগুলো তার উপর রেখে বেতের বাড়ি ঠ্যাঙ্গান হলো, ক্রমে সব কাঁটাগুলি মুখে মুখে বসে গেলে পর পুরুত তার উপর গন্ধজল ছড়িয়ে দিলেন, ছ’জন সন্ন্যাসী ডবল গামছা বেঁধে তার দু’-দিকে টানা ধল্লে, – সন্ন্যাসীরা ক্রমান্বয়ে তার উপর ঝাঁপ খেয়ে পড়তে লাগলো; ‘উঃ শিবের কি মাহাত্ম্য’ কাঁটা ফুটলে বলবার যো নাই! … ক্রমে সকলের ঝাঁপ খাওয়া ফুরুলো; একজন আপনার বিক্রম জানাবার জন্য চিৎ হয়ে উলটো ঝাঁপ খেলে, সজোরে ঢাক বেজে উঠলো।” এছাড়া আরেক রকমের ঝুল সন্ন্যাসের বর্ণনাও হুতোমের বইতে পাওয়া যায় – “ক্রমে সন্ন্যাসীরা খড়ে আগুন জ্বেলে ভারার নিচে ধল্লে – একজনকে তার ভারার নিচে ধল্লে – একজনকে তার উপর পানে পা করে ঝুলিয়ে দিয়ে তার মুখের কাছে আগুনের উপর গুড় ধুনো ফেলতে লাগলো, ক্রমে একে একে ঐরকম করে দুল্লে ঝুল সন্ন্যাস সমাপন হলো। …” তখন কাঁটা-ঝাঁপ বা ঝুল সন্ন্যাসের চেয়েও চড়ক গাছে দোল খাওয়ার ব্যবস্থা আরো মারাত্মক ছিল। এই প্রসঙ্গে ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দের ২২শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা সংবাদ দিয়েছিল, “চড়ক পূজার অতি ঘৃণ্য ব্যবহার ১২ তারিখে দৃষ্ট হইল। ঐ দিবসীয় অপরাহ্ণ সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময়ে দক্ষিণ ইন্টালির রাস্তার পশ্চিম দিগবর্ত্তি প্রথম গলির মধ্যে রাধাকান্ত মুন্সী নামক এক ব্যক্তির ভূমিতে চড়কগাছ প্রোথিত হইয়াছিল। তৎসময়ে ঐ স্থান সমূহ সৰ্ব্বজাতীয় দিদৃক্ষুলোকেতে পরিপূর্ণ হইয়া অতি যুব এক ব্যক্তিকে পাখ খাইতে দেখিতেছিল এবং তৎকালে ঐ মুন্সীর চাকর-বাকর ও অন্যান্য অত্যন্ত কলরব করিতেছিল কিন্তু যে রজ্জুতে সন্ন্যাসী ঘুরিতেছিল তাহা দৈবাৎ ছিঁড়ে যাওয়াতে ঐ ব্যক্তি বেগে গিয়া ২০ হাত দূরে পড়িল, তারে উঠাইয়া দেখা গেল শরীরটা একেবারে চূর্ণ হইয়া গিয়াছে মুখখানা পিত্তাকার প্রায় কোন অঙ্গ অবিকল ছিল না।” ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দের ১২ই মে তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় চুঁচুড়া থেকে জনৈক পত্রলেখক কয়েকজন সন্ন্যাসীর চড়কঘোরার ফলে মৃতপ্রায় হওয়ার সংবাদ দিয়েছিলেন। এছাড়া ‘জর্জ স্মিথ’ রচিত ‘উইলিয়ম কেরী’র জীবনীতে ১৮১৪ সালে শ্রীরামপুরের চড়কেও একজন সন্ন্যাসীর মৃত্যু-বরণের সংবাদ পাওয়া যায়। উন্মত্ত অবস্থা ছাড়া চড়কের সন্ন্যাসীদের পক্ষে এতটা দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করা কখনই সম্ভবপর ছিল না, এবং বলা বাহুল্য যে, তখন এসব অনুষ্ঠানের সময়ে সন্ন্যাসীরা প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করতেও কোন সঙ্কোচ করতেন না। বিশপ হেবার তাঁর ভ্রমণ-কাহিনীতে জানিয়েছিলেন যে, তখন সন্ন্যাসীরা শরীরে বাণ ফোঁড়ার আগে নিজেদের যন্ত্রণাবোধ কমানোর জন্য প্রায়ই কিছুটা আফিঙ সেবন করে নিতেন, যদিও তাতেও শেষপর্যন্ত সব সময়ে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভবপর হত না। স্বভাবতঃই উন্মত্ত অবস্থার জন্য তাঁরা কখনো শ্লীলতার মাত্রাও ছাড়িয়ে যেতেন। ১৮১৯ খৃষ্টাব্দের ২০শে এপ্রিল তারিখের ‘Calcutta Journal’ পত্রিকায় (P- 205) একজন হিন্দু সহিস, এবং একজন পর্তুগীজ খৃষ্টান মহিলার একত্রে চড়ক ঘোরার কাহিনীও পাওয়া যায়। সেই সংবাদদাতা জানিয়েছিলেন যে, সেদিন আনুমানিক ত্রিশ হাজার লোক ঐ দৃশ্য দেখবার জন্য সমবেত হয়েছিলেন। সেযুগের সাধারণ মানুষের রুচি যে ঐসব ভয়ানক দৃশ্য দেখবার বিরোধী ছিল না – সেটা বলাই বাহুল্য।

আগেই বলা হয়েছে যে, তৎকালীন হিন্দু সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরা – দুলে, বাগদী, হাড়ি, কাওরা ইত্যাদিরা তখন সাধারণতঃ চড়কের পূজারী হতেন। কিন্তু এই তথ্য থেকে যদি এটা মনে করা হয় যে, তখনকার উচ্চ শ্রেণীর বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে চড়ক পূজার কোনো ধরণের সংশ্রব ছিল না, তাহলে সেটা বিরাট ভুল করা হবে। হুতোম প্যাঁচার নকশা পড়ে মনে হয় যে, সে যুগের কলকাতার বাবুরা, বিশেষতঃ ভূঁইফোড় বাবুদের দল নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করবার জন্য এক-একটি করে নিজস্ব চড়কের দল রাখতেন। এই প্রসঙ্গে ১৮৩১ খৃষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় কালীঘাট মন্দিরের জনৈক পূজারী লিখেছিলেন, “সন্ন্যাস ছোটলোক করে যথার্থ কিন্তু এই ছোটলোকের মধ্যে শিবালয় কাহার আছে গাজন কতক জনা উঠাইয়া থাকে সমস্ত ভাগ্যবান ভদ্রলোক গাজন করেন খরচপত্র নিজে দেন তথায় ছোটলোক গিয়ে কেহ বা মানত করে কেহ বা আহ্লাদ কারণ চড়ক ইত্যাদি সন্ন্যাস করে অতএব যদ্যপি ঐ গাজনওয়ালা মহাশয়েরা গাজন না উঠান চড়ক গাছ না পুতেন তবে ছোটলোক কোথায় চড়কগাছ পায় যে চড়ক করে।” ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দের ৫ই মে তারিখের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় (পৃ- ৪), সুখচরনিবাসী জনৈক ‘রামকমল মজুমদারের’ পত্রেও তখনকার চড়কের ব্যাপারে ধনী ব্যক্তিদের আনুকূল্যের কথা বলা হয়েছিল। পত্রলেখক সেই পত্রে অবিলম্বে চড়ক বন্ধ করবার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেছিলেন। ১৮১৯ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসের (মাসিক) ‘Friends of India’ পত্রিকায় (পৃ: ১৩৯-১৪৩) এই বিষয়ে একটি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছিল। তাতে সেই প্রবন্ধের লেখক অভিযোগ করেছিলেন যে, সেই সময়ের ধনী লোকেরা, বিশেষতঃ জমিদারেরা তাঁদের নিম্নশ্রেণীর প্রজাদের উপরে চড়কের সময়ে জোর-জুলুম করতেন, এমনকি অনেক সময়ে তাঁদের বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁদের চড়কের সন্ন্যাস নিতে বাধ্য পর্যন্ত করতেন। তখন কোনো জমিদারের এলাকায় ক’টি চড়কের বাড়ি বাঁধা হয়েছিল, এবং ক’জন লোক সন্ন্যাস নিয়েছিলেন, সেসব থেকে জমিদারের সামাজিক মর্যাদার পরিমাপ করা হত। সন্ন্যাসের কয়দিন (অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির আগের দশ-পনেরো দিন) জমিদারই চড়কের সন্ন্যাসীদের সমস্ত খরচ দিতেন; কারণ, সেই কাজ নাকি বিশেষ পুণ্যের ছিল। সন্ন্যাসীদের কষ্টের মাত্রা কমাবার জন্য ও তাঁদের লোভ দেখাবার জন্য তখন মদিরা ও বারবনিতার সাহায্যও গ্রহণ করা হত। অবশ্য ‘Friends of India’ সেযুগের বাংলার খৃষ্টান পাদ্রীদের কাগজ ছিল, তাই সেখানে প্রকাশিত ঐসব অভিযোগের সবটুকু সত্যি ছিল কিনা, সেটা এখন বলা কঠিন। তবে ১৮১৯ খৃষ্টাব্দের ২৩শে মে তারিখের ‘Calcutta Journal’ পত্রিকাতেও (P- 627) তখনকার বাংলার গ্রামের জমিদারদের বিরুদ্ধেও ঠিক একই অভিযোগ করা হয়েছিল, এবং খুব সম্ভবতঃ এর মধ্যে কিছুটা হলেও সত্যি নিহিত রয়েছে। ১৮১৪ খৃষ্টাব্দে শ্রীরামপুরের পাদ্রীরা বিলেতে যে কার্যবিবরণী পাঠিয়েছিলেন, তাতেও তাঁরা জানিয়েছিলেন যে, তখন চড়কের সময়ে বাংলার নিম্ন শ্রেণীর দরিদ্র মানুষেরা জমিদারদের অত্যাচারের ভয়ে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে কিছুদিন কোন অজ্ঞাত জায়গায় লুকিয়ে থাকবার চেষ্টা করতেন, এবং সেই লুকিয়ে থাকতে গিয়ে কোনোক্রমে ধরা পড়ে গেলে তাঁদের ভাগ্যে প্রচুর প্রহার ও লাঞ্ছনা জুটত। সেই বছরই (১৮১৪) শ্রীরামপুরের ছাপাখানার কয়েকজন কর্মী তাঁদের অঞ্চলের জমিদারদের জুলুমের ভয়ে পাদ্রী ওয়ার্ডের কাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ‘Friends of India’-র মতে তখন সারা বঙ্গদেশে অন্ততঃ পঞ্চাশ হাজার মানুষ প্রত্যেক বছর চড়কের সন্ন্যাস গ্রহণ করতেন। সেই সময়ে কলকাতার বাইরে তারকেশ্বরে চড়ক ও গাজনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র ছিল, তবে বাংলার প্রায় সর্বত্রই তখন এই দুই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হত। গবেষক ‘বিনয় কুমার সরকার’ তাঁর ‘The Folk Element In Hindu Culture’ গ্রন্থে (Chap. IV) লিখেছিলেন যে, তখন নীলপূজার দিন সকালে যে সব অনুষ্ঠান হত, তাতে শুধু হিন্দুরা নন, মুসলমানেরাও যোগদান করতেন। সন্ন্যাসীদের সঙ্গে দু’-চারজন সন্ন্যাসিনীও যে এসব অনুষ্ঠানে তখন যোগ দিতেন, সেটার সাক্ষ্যও সে যুগের সংবাদপত্রে, এবং পাদ্রীদের লেখায় পাওয়া যায়।

চড়কপূজার সঙ্গে তখন যেসব বীভৎস ও ঘৃণ্য অনুষ্ঠানগুলি জড়িত ছিল, সেগুলিকে দূর করবার জন্য ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বঙ্গদেশে একটা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, এবং বৃটিশ সরকারও সেই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে এগিয়ে এসেছিল। সেযুগের সংবাদপত্রগুলিতে এবং ‘Buckland’ সাহেবের লেখা ‘Bengal Under the Lieutenant Governors’ গ্রন্থে সেই আন্দোলনের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়। ১৮৩১ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে ইয়ং বেঙ্গলদের মুখপত্র ‘Reformer’ কাগজে জনৈক এক লেখক, বঙ্গদেশে চড়কপূজা বন্ধ করবার জন্য সরকারী আদেশ প্রচারিত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ঐ বছরেরই ৩০শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় কালীঘাট মন্দিরের কোনো এক পূজারীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছিলেন যে, চড়কের মত পালাপার্বণের জন্যই তাঁর মত অনেক পূজারীর অন্নসংস্থান ঘটে, সুতরাং রাতারাতি এই সব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিলে তাঁরা খুবই অসুবিধায় পড়বেন। তাছাড়া তাঁর মত ছিল যে, কোনো দেশাচার বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে হলে আগে সেবিষয়ে দেশবাসীর একমত হওয়া উচিত, আর দেশবাসীর মতৈক্য না থাকলে সেবিষয়ে সরকারী সাহায্য প্রার্থনা করা সঙ্গত নয়। ঊনিশ শতকের বাংলার চড়কপূজায় প্রধানতঃ নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা অংশগ্রহণ করলেও, সেই ব্যাপারে তখনকার ভদ্রলোকেরাও যে যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন, সেকথাও ওই বিবৃতি থেকে জানতে পারা যায়। ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দের ২০শে এপ্রিল তারিখে হিন্দু রক্ষণশীল দলের মুখপত্র ‘সমাচার চন্দ্রিকা’য় বাংলার চড়কের বিরোধী দলকে ‘ধর্মদ্বেষী’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল, এবং সরকার সেই দলের অনুরোধে কর্ণপাত না করবার জন্য রক্ষণশীল হিন্দুদের পক্ষ থেকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দের ১২ই মে তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি পত্রে চুঁচুড়াবাসী জনৈক ভদ্রলোক লিখেছিলেন, “অস্মদাদির মানস ঐ প্রব্রজা এককালীন প্রশমন না করিয়া তাহার আর ২ তামাসা ও পূজা প্রভৃতি বজায় রাখিয়া কেবল বাণফোঁড়া ও চড়কমাত্র রহিত আজ্ঞা করেন।” ১৮৩৯ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতার পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট চৌরঙ্গীর রাস্তায় চড়কের সন্ন্যাসীদের শোভাযাত্রা বন্ধ করবার জন্য যে আদেশটি প্রচার করেছিলেন, সেটার এক অনুলিপি ওই বছরের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার ৬ই এপ্রিল সংখ্যায় পাওয়া যায়। সেই বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হওয়ার আগেই চড়ক নিয়ে সরকারের অভিপ্রায় জানতে পেরে ‘Commercial Advertiser’ পত্রিকা আনন্দ প্রকাশ করেছিল।

১৮৫৬-৫৭ সালে ভারত সরকার ও বিলাতের কর্তৃপক্ষের মধ্যে চড়কপূজা সম্পর্কে কিছু মতামত বিনিময় হয়েছিল। সেই সময়ে লণ্ডনের ‘কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স’ ভারত সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল যে, চড়কপূজার মধ্যে যেসব যন্ত্রণাদায়ক অনুষ্ঠানগুলি রয়েছে, সেগুলিকে সন্ন্যাসীরা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেন না বলে সরকার যদি মনে করে, তাহলে অবিলম্বে সেগুলোর প্রতিকারের ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত। ওই নির্দেশ পাওয়ার পরে তৎকালীন বাংলার বড়লাট ‘হ্যালিডে’ সাহেব চড়কপূজা সম্পর্কে একটি সরকারী তদন্তের আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই তদন্তের ফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই, কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স আবার লিখিত নির্দেশ পাঠিয়েছিল যে, সেই ব্যাপারে কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হলে আইনের সাহায্য না নিয়ে সরকারের পরোক্ষ প্রভাবের সাহায্যেই সেটা করা উচিত হবে। ঠিক সেই সময়ে ‘Calcutta Missionary Conference’-এর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে চড়কের বীভৎস, এবং যন্ত্রণাদায়ক অনুষ্ঠানগুলিকে আইনের সাহায্যে বন্ধ করবার জন্য একটি আবেদন পেশ করা হয়েছিল। হ্যালিডে সাহেব শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, চড়কের অনুষ্ঠানগুলি যেহেতু বাধ্যতামূলক নয়, অতএব শিক্ষার বিস্তার, এবং মিশনারীদের প্রচারের সাহায্যেই সেগুলি বন্ধ করতে হবে; তার জন্য আলাদাভাবে কোন আইন প্রণয়ন করা সঙ্গত হবে না। হ্যালিডের পরে ১৮৫৯ খৃষ্টাব্দে ‘স্যার জন গ্রান্ট’ বাংলার শাসনকর্তা হয়ে এসেছিলেন। তখন ‘Calcutta Missionary Conference’-এর পক্ষ থেকে দ্বিতীয়বারের জন্য লাট-সাহেবের আইনসভার কাছে চড়কঘোরা বন্ধ করবার জন্য অনুরোধ জানিয়ে একটি আবেদনপত্র পেশ করা হয়েছিল। লাটসাহেব সেই আবেদনপত্রটি বিলাতের কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষ তখন নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, পরোক্ষভাবে জনমত গঠন করে, এবং সরকারের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে বিরূপ মনোভাবের পরিচয় দিয়ে চড়কের নৃশংস অনুষ্ঠানগুলিকে একে একে বন্ধ করতে হবে। এরপরে লাটসাহেব বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারদের এক সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন। সেই সম্মেলনে ঠিক করা হয়েছিল যে, তখন বাংলার যেসব অঞ্চলে বহুদিন ধরে চড়ক-পার্বণ চলছিল, সেই সব জায়গায় সরকারী কর্মচারীদের ব্যক্তিগত প্রভাবের দ্বারা, এবং স্থানীয় জমিদারদের সমর্থনের সাহায্যে চড়কের নৃশংস অনুষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে হবে; এবং যেসব জায়গায় চড়কের অনুষ্ঠানগুলি দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ছিল না, সেসব ক্ষেত্রে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে সেখানে অনুষ্ঠানগুলিকে বন্ধ করবার জন্য আদেশ দেবেন। তবে তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনারদের বিবরণী থেকে জানা যায় যে, বাংলার চড়ক-পার্বণের বীভৎস অনুষ্ঠানগুলির প্রচলন ইতিমধ্যেই অনেকটা কমে গিয়েছিল। ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে ‘স্যার সিসিল বীডন’ বাংলার লাট হয়ে এসেছিলেন, এবং এর দু’ বছর পরেই বৃটিশ সরকার বাংলার চড়কপূজার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। আইন সভার একজন হিন্দু সদস্য চড়কের নৃশংস অনুষ্ঠানগুলি বন্ধ করবার জন্য একটি প্রস্তাব উপস্থাপিত করেছিলেন, এবং সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দের ১৫ই মার্চ তারিখে বীডন সাহেব চড়ক বিষয়ে একটি সরকারী বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছিলেন। সেই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল যে – চড়কঘোরা, বাণফোঁড়া প্রভৃতি নৃশংস অনুষ্ঠান ভারতের অন্য সব প্রদেশে বন্ধ হয়ে গেলেও বঙ্গদেশের বহু জেলায় সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী প্রচেষ্টাকে অগ্রাহ্য করে তখনও পর্যন্ত টিকে রয়েছে। তাই ভবিষ্যতে সেগুলি যাতে পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যায়, সেজন্য ওই বিজ্ঞপ্তিতে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও কমিশনারদের প্রতি তাঁদের সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, এবং জমিদার ও স্থানীয় অন্যান্য প্রভাবশালী লোকেদেরও সেই ব্যাপারে সরকারকে সমর্থন করবার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। একই সাথে ওই বিজ্ঞপ্তিতে, যাঁরা এর পরেও স্বেচ্ছায় সেই সরকারী আদেশ উলঙ্ঘন করবেন, তাঁদের আইন অনুসারে শাস্তি দেওয়া হবে বলে ভয় দেখানো হয়েছিল। তবে নৃশংস অনুষ্ঠানগুলি বাদ দিয়ে চড়কপূজার আয়োজন করলে সরকার তাতে কোনো রকমের বাধা দেবেন না বলে প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। ‘British Indian Association’ সেই ব্যাপারে সরকারকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছিল। ওই সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হওয়ার পরে কলকাতা শহরে ও শহরতলীতে চড়কঘোরা, বাণফোঁড়া ইত্যাদি নৃশংস অনুষ্ঠান একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে কলকাতা শহরের মধ্যে এই ধরনের অনুষ্ঠানের সংবাদ আর পাওয়া যায় নি; তবে শহরতলী থেকে অবশ্য কয়েকবার সরকারি নির্দেশ অগ্রাহ্য করা হয়েছিল বলে জানা যায়। বীডন সাহেবের পরে ‘স্যার উইলিয়ম গ্রে’ ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে বাংলার শাসনকর্তা হয়ে এসেছিলেন। তাঁর আমলে মেদিনীপুর ও ঢাকা অঞ্চলে আবার চড়কের নিষিদ্ধ অনুষ্ঠানগুলি প্রচলিত হওয়ার কাহিনী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। তখন স্থানীয় সরকারি কর্মচারীরা অবিলম্বে সেই ঘটনাগুলির তদন্ত করেছিলেন, এবং আইন-লঙ্ঘনকারীদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি দিয়েছিলেন। এরপরে ধীরে ধীরে বঙ্গদেশের সর্বত্রই চড়কের নৃশংস অনুষ্ঠানগুলি একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

(তথ্যসূত্র:
১- হুতোম প্যাঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ, সাহিত্য পরিষদ সংস্করণ, ১৯৫৭।
২- বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদিপর্ব, নীহাররঞ্জন রায়।
৩- সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ২য় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৪- Narrative of A Journey Through The Upper Provinces of India, Vol. I, R. Heber.
৫- India And India Missions, Alexander Duff.
৬- Life Of William Carey, G. Smith.
৭- History Of Hindu Civilisation During British Rule In India, Vol. I, P. N. Bose.
৮- Bengal Under The Lieutenant Governors, Vol. I & II, C. E. Buckland.
৯- The Folk Element In Hindu Culture, B. K. Sarkar.
১০- The Friends of India (Monthly), March, 1819.
১১- The Calcutta Journal, 20th April 1819 and 23rd May 1819.)

রানা চক্রবর্তী: এখন থেকে প্রায় একশো বছর আগে ‘হুতোম’, অর্থাৎ ‘কালীপ্রসন্ন সিংহ’ তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ গ্রন্থে সেকালের কলকাতার চড়ক-পার্বনের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, “কলিকাতা শহরের চার দিকেই ঢাকের বাজনা শোনা যাচ্চে, চড়কীর পিঠ সড় সড় কচ্চে; কামারেরা বাণ, দশলকি, কাঁটা ও বঁটি প্রস্তুত কচ্চে; সর্বাঙ্গে গয়না, পায়ে নূপুর, মাতায় জরির টুপি, কোমোরে চন্দ্রহার, সিপাই পেড়ে ঢাকাই শাড়ি মালকোচা করে পরা, তারকেশ্বরে ছোবানো গামছা হাতে, বিল্বপত্র বাদা সুতা গলায় যত ছুতোর, গয়লা, গন্ধবেণে ও কাঁসারীর আনন্দের সীমা নাই – ‘আমাদের বাবুদের বাড়ির গাজোেন!’ … এদিকে দুলে, বেয়ারা হাড়ি ও কাওরারা নূপুর পায়ে উত্তরি সুতা গলায় দিয়ে নিজ নিজ বীরব্রতের ও মহত্ত্বের শুভস্বরূপ বাণ ও দশলকি হাতে করে ঢাকের সঙ্গতে নেচে বেড়াচ্ছে, … ঢাকীরা ঢাকের টোয়েতে চামর, পাখির পালক, ঘন্টা ও ঘুঙুর বেঁধে পাড়ায় ঢাক বাজিয়ে সন্ন্যাসী সংগ্রহ কচ্চে; গুরুমশায়ের পাঠশালা বন্দ হয়ে গিয়েচে – ছেলেরা গাজনতলাই বাড়ি করে তুলেচে; আহার নাই, নিদ্রা নাই; ঢাকের পেছোনে পেচোনে রপ্টে রপ্টে বাড়াচ্চে; কখন ‘বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো মহাদেব’ চীৎকারের সঙ্গে যোগ দিচ্চে, কখন ঢাকের টোয়ের চামর ছিঁড়ছে, কখন ঢাকের পেছনটা দুম্দুম্ করে বাজাচ্চে – বাপ মা শশব্যস্ত, একটা না ব্যয়রাম কল্লে হয়।” কিন্তু এখন বাংলায় চড়ক পূজার চেয়ে শনিপুজোর ধূমই অনেক বেশি, অন্যান্য পুজোর তো কোন কথাই নেই। অতি আধুনিক যন্ত্রযুগকে সহ্য করতে না পেরে একান্তই গ্রাম্য বাংলার এই চড়ক পার্বণ এখন মহানগরীর সীমা থেকে প্রায় নির্বাসিতই হয়ে গিয়েছে। তবে হুতোমের যুগে চড়ক পূজা কিন্তু কেবলমাত্র আনন্দের ব্যাপারই ছিল না; চড়কের সঙ্গে তখন অনেক বীভৎস এবং ঘৃণ্য প্রথাও জড়িত ছিল, যা সেই যুগের অন্ততঃ একদল সমাজ সংস্কারককে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল; এবং যে বিদেশী সরকার হিন্দুদের সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সেযুগে খুব একটা হস্তক্ষেপ করতে চাইতেন না, তাঁরাও সেই ব্যাপারে তখন একেবারে নিরপেক্ষ হয়ে থাকতে পারেন নি। প্রধানতঃ সেই সব কাহিনী আলোচনা করবার জন্যই এই প্রবন্ধের অবতারণা।

ঐতিহাসিক ‘নীহাররঞ্জন রায়’ তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ গ্রন্থের ‘আদিপর্ব’ অংশে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, ধর্মপূজার মতই চড়কপূজা “মূলতঃ অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক ও অব্রাহ্মণ্য”; কিন্তু তাঁর এই অভিমত বহুলাংশে সত্যি হলেও সম্ভবতঃ সম্পূর্ণ সত্যি নয়। চড়ক পূজা যে অবৈদিক, সেবিষয়ে গবেষকদের কোনো সন্দেহ নেই, বর্তমান যুগে হিন্দুদের অধিকাংশ পূজা-পার্বণই অবৈদিক। কিন্তু চড়ক আদৌ সম্পূর্ণ অপৌরাণিক কিনা – সেবিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, মহাভারতে বর্ণিত বাণরাজার কাহিনী থেকে জানা যায় যে, মহাদেবের দর্শনলাভের জন্য বাণ রাজা তাঁর নিজের শরীরের উপরে নানা রকমের অত্যাচার করেছিলেন; মহাদেবের কৃপালাভের জন্য আজও চড়কের সন্ন্যাসীরাও তাঁদের নিজেদের শরীরের উপরে সেই একই ধরনের অত্যাচার করে থাকেন। তবে চড়ক পূজার ধারাটি যে মূলতঃ অনার্য, এবং বর্ণহিন্দু সমাজে সেটি যে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে স্বীকৃতি লাভ করেছে, সেবিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। বঙ্গদেশে প্রচলিত নীল বা চড়কপূজার কেন্দ্র যে শিবলিঙ্গ রয়েছে, সেটির প্রচলিত নাম হচ্ছে ‘বুড়ো শিব’; এবং এই বুড়ো শিবের যাঁরা পূজারী, সেই আচার্য ব্রাহ্মণ বা গ্রহবিপ্রেরা যে স্মার্ত মত অনুসারে পতিত – একথা এখন প্রায় কারোরই আর অজানা নয়। কুমিরের পুজা, জ্বলন্ত আগুনের উপরে দোলা, কাঁটাঝাঁপ, ছুরিঝাঁপ, বাণফোঁড়া, আগুন নিয়ে নাচা, চড়ক গাছে দোলা, শিবের বিয়ে, ‘দানো বারাণো’ – এসব হল চড়কপূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ। এগুলোর মধ্যে ‘দানো বারাণো’ সাধারণতঃ শ্মশানে অনুষ্ঠিত হয়, এবং এই অনুষ্ঠানটির সঙ্গেই ‘চড়কের সঙ’ জড়িত। চড়কের সন্ন্যাসীরা সাধারণতঃ দুলে, বাঙ্গী, হাড়ি, কাওরা ইত্যাদি জাতের হয়ে থাকেন; যাঁদের হাতের জল আজও বর্ণহিন্দু সমাজে অচল। সামাজিক জনতত্ত্বের পণ্ডিতেরা বলেন যে, ধর্মপূজা এবং চড়কপূজা – দুটিই নাকি আদিম সমাজের প্রেততত্ত্ব ও পুনর্জন্মে বিশ্বাস থেকে এসেছে, এবং অতীতে প্রত্যেক গোষ্ঠীর মৃতব্যক্তিদের পুনর্জন্ম কামনা করেই নাকি এই দুই পূজার অনুষ্ঠান করা হত। তাছাড়া চড়কের সময়ে বাণফোঁড়া, কাঁটাঝাপ, ছুরিঝাঁপ প্রভৃতি দৈহিক যন্ত্ৰণা গ্ৰহণ বা রক্তপাতের যেসব অনুষ্ঠান করা হয়, সেগুলোর পিছনেও সম্ভবতঃ আদিম সমাজের নরবলি প্রথার স্মৃতি রয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ঊনিশ শতকের শেষের দিকে যখন চড়কের বীভৎস অনুষ্ঠানগুলিকে সরকারি প্রচেষ্টায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন বীরভূম জেলার কোনো কোনো অঞ্চলের নিম্নবর্ণের চাষীরা সেখানকার প্রশাসক কর্তৃপক্ষের কাছে এই বলে অভিযোগ জানিয়েছিলেন যে, এর ফলে তাঁদের চাষের কাজে খুব ক্ষতি হবে; কারণ, মাটিতে কিছুটা নররক্ত না পড়লে আশানুরূপ ফসল পাওয়া নাকি অসম্ভব! এখনকার মত একশো’-দেড়শো’ বছর আগেও বাংলার বর্ণহিন্দুরা চড়কপূজায় প্রত্যক্ষভাবে কোনো অংশ গ্রহণ করতেন না। ‘রেভারেণ্ড আলেকজাণ্ডার ডাফ’, তাঁর ‘India And India Missions’ (Edinburgh, 1839) গ্রন্থে লিখেছিলেন, “It is proper to state that Brahmins, Kshatriyas and Vaishyas do not take any active part in the actual celebration of the rites peculiar to this festival. Most of them, however, contribute largely towards the expense of it, and countenance the whole of the proceedings as applauding spectators.” (P: 246-265) ১৮১৯ খৃষ্টাব্দের ২৩শে মে তারিখের ‘Calcutta Journal’ পত্রিকাতেও ডাফের এই উক্তির সমর্থন পাওয়া যায় – “No Hindoo of respectability ever degrades himself by swinging, no Brahman, no one of the medical tribe, and none among the Kaistha or writer caste, except the most abandoned …” (P- 626 ) বাংলার চড়কপূজার কৌলীন্যহীনতা সম্পর্কে এরপরে আর কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না।

হুতোমের যুগে বা তারও কিছু আগের বঙ্গদেশে চড়ক-পার্বণের বর্ণনা সেই সময়কার সংবাদপত্রগুলির মধ্যে পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে ‘ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’ সম্পাদিত ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ গ্রন্থটি থেকে সেরকম দু’-একটি বর্ণনা এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তখন চড়ক পূজার সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেসব বীভৎস ও ঘৃণ্য ব্যাপার জড়িত থাকত, সেগুলোর কিছু কিছু পরিচয়ও ওই সব প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় পাওয়া যায়। ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দের ২৭শে এপ্রিল তারিখের ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, “গত সন্ন্যাসবিষয়ক নীলোৎসব দর্শন করিয়া তদ্বিষয়ে কিঞ্চিৎ উক্তি করাতে পাঠকগণের সন্তোষ জন্মিতে পারে যেহেতুক চড়কপূজার বিষয়ে সর্ব্বসাধারণের বিশেষ মনোযোগ প্রার্থনা করা গিয়াছিল। … চিৎপুরের রাস্তায় অসংখ্যক ঢাকের মহাশব্দ এবং রাস্তার উভয়পার্শ্বের বাটীর বারান্দার উপর লোকের মহা কোলাহল হয়। সন্ন্যাসির দল সকল বাণ প্রভৃতি ফুড়িয়া বাদ্যসহিত আসিল এই সকল ব্যাপার বেলা ৯ ঘণ্টা পৰ্যন্ত দেখা যায়, পরে তামাসা যাহা দর্শনার্থে অনেক লোক জমা হয় তাহা ক্রমে কম হইয়া আসিতে লাগিল। বাঁশ, বাঁকারি ও কাগজমণ্ডিত একটা পাহাড় নির্মিত হইয়া নীল ও রক্তবর্ণের রং করা গিয়াছিল তদুপরি একটা প্রকাণ্ড মন্দির, তন্মধ্যস্থিত কাগজে নির্মিত হিন্দুর দেবতারা ইহাই দেখিয়া প্রথমে দর্শকগণেরা চমৎকার ভাবিলেন! … তৎপরে একখানা ময়ুরপঙ্খী দেখা গেল তাহা বাঁশ বাঁকারির দ্বারা নির্মাণ হয় … তাহার উপর কএকজন লোকেতে গানবাদ্য করত দাঁড় ফেলিতেছিল, তাহা একটা পাঠশালার ন্যায় কিন্তু বালকের নহে সেটা প্রকাণ্ড মনুষ্যের বিদ্যালয় ইহার গুরুমশায় ছাত্রগণের মূর্খতা দেখিয়া লজ্জিত হইয়া কহিলেন আমি ইহাদিগকে আর মারিয়া সোজা করিতে পারি না। … পরে গোদযুক্ত একটা বৃদ্ধ পুষ্প চন্দনাদি দ্বারা শরীর আবৃত করত দেবতা ভুল্য হইবায় অন্য একজন তাঁহার গোদপূজা করিতেছিল এবং সং দেখিয়া বড়ই হাসির ধূম পড়িল কিন্তু দেবপূজা করেন যে হিন্দু তিনি কিরূপে গোদপূজা করিলেন তাহা আমরা বলিতে পারি না।” ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’তেও চিৎপুরের রাস্তায় চড়কের সঙের সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। “প্রথমে দুটো মুটে একটা বড় পেতলের পেটা ঘড়ি বাঁশে বেঁদে কাঁদে করেচে – কতকগুলো ছেলে মুগুরের বাড়ি বাজাতে বাজাতে চলেচে – তার পেচোনে এলোমেলো নিশেনের শ্রেণী। মধ্যে হাড়িরা দল বেঁদে ঢোলের সঙ্গতে ভজন গাইতে গাইতে চলেচে। তার পেচোনে বাবুর অবস্থামত তকমাওয়ালা দরওয়ান, হরকরা সেপাই, মধ্যে সর্বাঙ্গে ছাই ও খড়ি মাখা, টিনের সাপের ফণার টুপি মাথায় শিব ও পার্বতী সাজা সং। তার পেচোনে কতকগুলো সন্ন্যাসী দশলকি ফুঁড়ে চলেচে। দর্শকেরা হাঁ করে গাজন দেখচেন, মধ্যে বাজনার শব্দে ঘোড়া খেপেচে – হুড়মুড় করে কেউ দোকানে কেউ খানার উপর পড়চেন, রৌদ্রে মাথা ফেটে যাচ্চে – তথাপি নড়চেন না।” ‘বিশপ হেবারের’ ভ্রমণ-কাহিনীতেও কলকাতার চৌরঙ্গীর রাস্তায় চড়কের সন্ন্যাসীদের শোভাযাত্রার একটি সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। হেবার এদেশের লোকেদের শান্তিপ্রিয় মনোভাবের প্রশংসা করে লিখেছিলেন যে, ইংল্যাণ্ডে যদি কখনো এত লোক একসঙ্গে জমায়েত হতেন, তাহলে আধঘণ্টার মধ্যে সেখানে অন্ততঃ তিনবার মুষ্টিযুদ্ধ দেখা যেত, এবং ইটালিতে সেরকম কিছু ঘটলে রাত্রি আরম্ভ হওয়ার আগেই অন্ততঃ ছয়টি খুনজখম হয়ে যেত। অতীতে চড়কের সময়ে কলকাতায় যেসব সঙরা বের হতেন, সেযুগে তাঁদের মধ্যে উত্তরে জেলে পাড়ার সঙ ও দক্ষিণে কালিঘাটের সঙরা বিখ্যাত ছিলেন। তখন অনেক ক্ষেত্রেই সেই সব সঙের সন্ন্যাসীরা যে নির্দোষ আমোদের সীমাকে লঙ্ঘন করতেন, সেকালের সংবাদপত্র থেকে সেসবের প্রমাণও পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে ১৮২৭ খৃষ্টাব্দের ২১শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, “চড়ক পূজার সময়ে সন্ন্যাসিদের মধ্যে কেহ কেহ সঙ হইয়া পথেতে এমত কদর্যরূপে নৃত্যাদি করে যে তাহা দর্শন করিতে ভদ্রলোকেরদের অতিশয় লজ্জা হয় অতএব তাহার বিবরণ হইতে কলিকাতাস্থ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব লোকেরা নিশ্চয় করিয়াছেন এবং গত চড়ক পূজার সময় এইরূপ অতি নির্লজ্জ তিন-চারিজন সন্ন্যাসীকে পুলিশে ধরিয়া লইয়া গিয়াছেন ইহার পর এমত কর্ম্ম যে তাঁহারা কিম্বা অন্য লোক শহরের মধ্যে আর না করে এই নিমিত্ত তাঁহারদের শাস্তি হইবেক।” ১৮২৭ খৃষ্টাব্দের ২৬শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণে’ও দু’জন ভণ্ড সন্ন্যাসীর কুৎসিত সঙ সাজবার অপরাধে কিছুদিনের জন্য কারাভোগ করবার সংবাদ পাওয়া যায়।

সেকালে সঙ ছাড়া চড়ক-পূজার অন্য দুটি প্রধান অঙ্গ ছিল – কাঁটাঝাঁপ ও চড়কগাছে দোলা। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় সেযুগের কাঁটাঝাঁপের একটি হাস্যকর বর্ণনা পাওয়া যায় – “সন্ন্যাসীরা নাচতে নাচতে কাছের পুকুর থেকে পরশুদিনের ফ্যালা কতকগুলি বঁইচির ডাল তুলে আনলে। গাছতলায় বিশ আঁটি বিচালি বিছানো ছিল, কাঁটার ডালগুলো তার উপর রেখে বেতের বাড়ি ঠ্যাঙ্গান হলো, ক্রমে সব কাঁটাগুলি মুখে মুখে বসে গেলে পর পুরুত তার উপর গন্ধজল ছড়িয়ে দিলেন, ছ’জন সন্ন্যাসী ডবল গামছা বেঁধে তার দু’-দিকে টানা ধল্লে, – সন্ন্যাসীরা ক্রমান্বয়ে তার উপর ঝাঁপ খেয়ে পড়তে লাগলো; ‘উঃ শিবের কি মাহাত্ম্য’ কাঁটা ফুটলে বলবার যো নাই! … ক্রমে সকলের ঝাঁপ খাওয়া ফুরুলো; একজন আপনার বিক্রম জানাবার জন্য চিৎ হয়ে উলটো ঝাঁপ খেলে, সজোরে ঢাক বেজে উঠলো।” এছাড়া আরেক রকমের ঝুল সন্ন্যাসের বর্ণনাও হুতোমের বইতে পাওয়া যায় – “ক্রমে সন্ন্যাসীরা খড়ে আগুন জ্বেলে ভারার নিচে ধল্লে – একজনকে তার ভারার নিচে ধল্লে – একজনকে তার উপর পানে পা করে ঝুলিয়ে দিয়ে তার মুখের কাছে আগুনের উপর গুড় ধুনো ফেলতে লাগলো, ক্রমে একে একে ঐরকম করে দুল্লে ঝুল সন্ন্যাস সমাপন হলো। …” তখন কাঁটা-ঝাঁপ বা ঝুল সন্ন্যাসের চেয়েও চড়ক গাছে দোল খাওয়ার ব্যবস্থা আরো মারাত্মক ছিল। এই প্রসঙ্গে ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দের ২২শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা সংবাদ দিয়েছিল, “চড়ক পূজার অতি ঘৃণ্য ব্যবহার ১২ তারিখে দৃষ্ট হইল। ঐ দিবসীয় অপরাহ্ণ সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময়ে দক্ষিণ ইন্টালির রাস্তার পশ্চিম দিগবর্ত্তি প্রথম গলির মধ্যে রাধাকান্ত মুন্সী নামক এক ব্যক্তির ভূমিতে চড়কগাছ প্রোথিত হইয়াছিল। তৎসময়ে ঐ স্থান সমূহ সৰ্ব্বজাতীয় দিদৃক্ষুলোকেতে পরিপূর্ণ হইয়া অতি যুব এক ব্যক্তিকে পাখ খাইতে দেখিতেছিল এবং তৎকালে ঐ মুন্সীর চাকর-বাকর ও অন্যান্য অত্যন্ত কলরব করিতেছিল কিন্তু যে রজ্জুতে সন্ন্যাসী ঘুরিতেছিল তাহা দৈবাৎ ছিঁড়ে যাওয়াতে ঐ ব্যক্তি বেগে গিয়া ২০ হাত দূরে পড়িল, তারে উঠাইয়া দেখা গেল শরীরটা একেবারে চূর্ণ হইয়া গিয়াছে মুখখানা পিত্তাকার প্রায় কোন অঙ্গ অবিকল ছিল না।” ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দের ১২ই মে তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় চুঁচুড়া থেকে জনৈক পত্রলেখক কয়েকজন সন্ন্যাসীর চড়কঘোরার ফলে মৃতপ্রায় হওয়ার সংবাদ দিয়েছিলেন। এছাড়া ‘জর্জ স্মিথ’ রচিত ‘উইলিয়ম কেরী’র জীবনীতে ১৮১৪ সালে শ্রীরামপুরের চড়কেও একজন সন্ন্যাসীর মৃত্যু-বরণের সংবাদ পাওয়া যায়। উন্মত্ত অবস্থা ছাড়া চড়কের সন্ন্যাসীদের পক্ষে এতটা দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করা কখনই সম্ভবপর ছিল না, এবং বলা বাহুল্য যে, তখন এসব অনুষ্ঠানের সময়ে সন্ন্যাসীরা প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করতেও কোন সঙ্কোচ করতেন না। বিশপ হেবার তাঁর ভ্রমণ-কাহিনীতে জানিয়েছিলেন যে, তখন সন্ন্যাসীরা শরীরে বাণ ফোঁড়ার আগে নিজেদের যন্ত্রণাবোধ কমানোর জন্য প্রায়ই কিছুটা আফিঙ সেবন করে নিতেন, যদিও তাতেও শেষপর্যন্ত সব সময়ে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভবপর হত না। স্বভাবতঃই উন্মত্ত অবস্থার জন্য তাঁরা কখনো শ্লীলতার মাত্রাও ছাড়িয়ে যেতেন। ১৮১৯ খৃষ্টাব্দের ২০শে এপ্রিল তারিখের ‘Calcutta Journal’ পত্রিকায় (P- 205) একজন হিন্দু সহিস, এবং একজন পর্তুগীজ খৃষ্টান মহিলার একত্রে চড়ক ঘোরার কাহিনীও পাওয়া যায়। সেই সংবাদদাতা জানিয়েছিলেন যে, সেদিন আনুমানিক ত্রিশ হাজার লোক ঐ দৃশ্য দেখবার জন্য সমবেত হয়েছিলেন। সেযুগের সাধারণ মানুষের রুচি যে ঐসব ভয়ানক দৃশ্য দেখবার বিরোধী ছিল না – সেটা বলাই বাহুল্য।

আগেই বলা হয়েছে যে, তৎকালীন হিন্দু সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরা – দুলে, বাগদী, হাড়ি, কাওরা ইত্যাদিরা তখন সাধারণতঃ চড়কের পূজারী হতেন। কিন্তু এই তথ্য থেকে যদি এটা মনে করা হয় যে, তখনকার উচ্চ শ্রেণীর বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে চড়ক পূজার কোনো ধরণের সংশ্রব ছিল না, তাহলে সেটা বিরাট ভুল করা হবে। হুতোম প্যাঁচার নকশা পড়ে মনে হয় যে, সে যুগের কলকাতার বাবুরা, বিশেষতঃ ভূঁইফোড় বাবুদের দল নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করবার জন্য এক-একটি করে নিজস্ব চড়কের দল রাখতেন। এই প্রসঙ্গে ১৮৩১ খৃষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় কালীঘাট মন্দিরের জনৈক পূজারী লিখেছিলেন, “সন্ন্যাস ছোটলোক করে যথার্থ কিন্তু এই ছোটলোকের মধ্যে শিবালয় কাহার আছে গাজন কতক জনা উঠাইয়া থাকে সমস্ত ভাগ্যবান ভদ্রলোক গাজন করেন খরচপত্র নিজে দেন তথায় ছোটলোক গিয়ে কেহ বা মানত করে কেহ বা আহ্লাদ কারণ চড়ক ইত্যাদি সন্ন্যাস করে অতএব যদ্যপি ঐ গাজনওয়ালা মহাশয়েরা গাজন না উঠান চড়ক গাছ না পুতেন তবে ছোটলোক কোথায় চড়কগাছ পায় যে চড়ক করে।” ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দের ৫ই মে তারিখের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় (পৃ- ৪), সুখচরনিবাসী জনৈক ‘রামকমল মজুমদারের’ পত্রেও তখনকার চড়কের ব্যাপারে ধনী ব্যক্তিদের আনুকূল্যের কথা বলা হয়েছিল। পত্রলেখক সেই পত্রে অবিলম্বে চড়ক বন্ধ করবার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেছিলেন। ১৮১৯ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসের (মাসিক) ‘Friends of India’ পত্রিকায় (পৃ: ১৩৯-১৪৩) এই বিষয়ে একটি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছিল। তাতে সেই প্রবন্ধের লেখক অভিযোগ করেছিলেন যে, সেই সময়ের ধনী লোকেরা, বিশেষতঃ জমিদারেরা তাঁদের নিম্নশ্রেণীর প্রজাদের উপরে চড়কের সময়ে জোর-জুলুম করতেন, এমনকি অনেক সময়ে তাঁদের বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁদের চড়কের সন্ন্যাস নিতে বাধ্য পর্যন্ত করতেন। তখন কোনো জমিদারের এলাকায় ক’টি চড়কের বাড়ি বাঁধা হয়েছিল, এবং ক’জন লোক সন্ন্যাস নিয়েছিলেন, সেসব থেকে জমিদারের সামাজিক মর্যাদার পরিমাপ করা হত। সন্ন্যাসের কয়দিন (অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির আগের দশ-পনেরো দিন) জমিদারই চড়কের সন্ন্যাসীদের সমস্ত খরচ দিতেন; কারণ, সেই কাজ নাকি বিশেষ পুণ্যের ছিল। সন্ন্যাসীদের কষ্টের মাত্রা কমাবার জন্য ও তাঁদের লোভ দেখাবার জন্য তখন মদিরা ও বারবনিতার সাহায্যও গ্রহণ করা হত। অবশ্য ‘Friends of India’ সেযুগের বাংলার খৃষ্টান পাদ্রীদের কাগজ ছিল, তাই সেখানে প্রকাশিত ঐসব অভিযোগের সবটুকু সত্যি ছিল কিনা, সেটা এখন বলা কঠিন। তবে ১৮১৯ খৃষ্টাব্দের ২৩শে মে তারিখের ‘Calcutta Journal’ পত্রিকাতেও (P- 627) তখনকার বাংলার গ্রামের জমিদারদের বিরুদ্ধেও ঠিক একই অভিযোগ করা হয়েছিল, এবং খুব সম্ভবতঃ এর মধ্যে কিছুটা হলেও সত্যি নিহিত রয়েছে। ১৮১৪ খৃষ্টাব্দে শ্রীরামপুরের পাদ্রীরা বিলেতে যে কার্যবিবরণী পাঠিয়েছিলেন, তাতেও তাঁরা জানিয়েছিলেন যে, তখন চড়কের সময়ে বাংলার নিম্ন শ্রেণীর দরিদ্র মানুষেরা জমিদারদের অত্যাচারের ভয়ে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে কিছুদিন কোন অজ্ঞাত জায়গায় লুকিয়ে থাকবার চেষ্টা করতেন, এবং সেই লুকিয়ে থাকতে গিয়ে কোনোক্রমে ধরা পড়ে গেলে তাঁদের ভাগ্যে প্রচুর প্রহার ও লাঞ্ছনা জুটত। সেই বছরই (১৮১৪) শ্রীরামপুরের ছাপাখানার কয়েকজন কর্মী তাঁদের অঞ্চলের জমিদারদের জুলুমের ভয়ে পাদ্রী ওয়ার্ডের কাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ‘Friends of India’-র মতে তখন সারা বঙ্গদেশে অন্ততঃ পঞ্চাশ হাজার মানুষ প্রত্যেক বছর চড়কের সন্ন্যাস গ্রহণ করতেন। সেই সময়ে কলকাতার বাইরে তারকেশ্বরে চড়ক ও গাজনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র ছিল, তবে বাংলার প্রায় সর্বত্রই তখন এই দুই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হত। গবেষক ‘বিনয় কুমার সরকার’ তাঁর ‘The Folk Element In Hindu Culture’ গ্রন্থে (Chap. IV) লিখেছিলেন যে, তখন নীলপূজার দিন সকালে যে সব অনুষ্ঠান হত, তাতে শুধু হিন্দুরা নন, মুসলমানেরাও যোগদান করতেন। সন্ন্যাসীদের সঙ্গে দু’-চারজন সন্ন্যাসিনীও যে এসব অনুষ্ঠানে তখন যোগ দিতেন, সেটার সাক্ষ্যও সে যুগের সংবাদপত্রে, এবং পাদ্রীদের লেখায় পাওয়া যায়।

চড়কপূজার সঙ্গে তখন যেসব বীভৎস ও ঘৃণ্য অনুষ্ঠানগুলি জড়িত ছিল, সেগুলিকে দূর করবার জন্য ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বঙ্গদেশে একটা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, এবং বৃটিশ সরকারও সেই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে এগিয়ে এসেছিল। সেযুগের সংবাদপত্রগুলিতে এবং ‘Buckland’ সাহেবের লেখা ‘Bengal Under the Lieutenant Governors’ গ্রন্থে সেই আন্দোলনের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়। ১৮৩১ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে ইয়ং বেঙ্গলদের মুখপত্র ‘Reformer’ কাগজে জনৈক এক লেখক, বঙ্গদেশে চড়কপূজা বন্ধ করবার জন্য সরকারী আদেশ প্রচারিত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ঐ বছরেরই ৩০শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় কালীঘাট মন্দিরের কোনো এক পূজারীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছিলেন যে, চড়কের মত পালাপার্বণের জন্যই তাঁর মত অনেক পূজারীর অন্নসংস্থান ঘটে, সুতরাং রাতারাতি এই সব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিলে তাঁরা খুবই অসুবিধায় পড়বেন। তাছাড়া তাঁর মত ছিল যে, কোনো দেশাচার বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে হলে আগে সেবিষয়ে দেশবাসীর একমত হওয়া উচিত, আর দেশবাসীর মতৈক্য না থাকলে সেবিষয়ে সরকারী সাহায্য প্রার্থনা করা সঙ্গত নয়। ঊনিশ শতকের বাংলার চড়কপূজায় প্রধানতঃ নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা অংশগ্রহণ করলেও, সেই ব্যাপারে তখনকার ভদ্রলোকেরাও যে যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন, সেকথাও ওই বিবৃতি থেকে জানতে পারা যায়। ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দের ২০শে এপ্রিল তারিখে হিন্দু রক্ষণশীল দলের মুখপত্র ‘সমাচার চন্দ্রিকা’য় বাংলার চড়কের বিরোধী দলকে ‘ধর্মদ্বেষী’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল, এবং সরকার সেই দলের অনুরোধে কর্ণপাত না করবার জন্য রক্ষণশীল হিন্দুদের পক্ষ থেকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দের ১২ই মে তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি পত্রে চুঁচুড়াবাসী জনৈক ভদ্রলোক লিখেছিলেন, “অস্মদাদির মানস ঐ প্রব্রজা এককালীন প্রশমন না করিয়া তাহার আর ২ তামাসা ও পূজা প্রভৃতি বজায় রাখিয়া কেবল বাণফোঁড়া ও চড়কমাত্র রহিত আজ্ঞা করেন।” ১৮৩৯ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতার পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট চৌরঙ্গীর রাস্তায় চড়কের সন্ন্যাসীদের শোভাযাত্রা বন্ধ করবার জন্য যে আদেশটি প্রচার করেছিলেন, সেটার এক অনুলিপি ওই বছরের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার ৬ই এপ্রিল সংখ্যায় পাওয়া যায়। সেই বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হওয়ার আগেই চড়ক নিয়ে সরকারের অভিপ্রায় জানতে পেরে ‘Commercial Advertiser’ পত্রিকা আনন্দ প্রকাশ করেছিল।

১৮৫৬-৫৭ সালে ভারত সরকার ও বিলাতের কর্তৃপক্ষের মধ্যে চড়কপূজা সম্পর্কে কিছু মতামত বিনিময় হয়েছিল। সেই সময়ে লণ্ডনের ‘কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স’ ভারত সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল যে, চড়কপূজার মধ্যে যেসব যন্ত্রণাদায়ক অনুষ্ঠানগুলি রয়েছে, সেগুলিকে সন্ন্যাসীরা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেন না বলে সরকার যদি মনে করে, তাহলে অবিলম্বে সেগুলোর প্রতিকারের ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত। ওই নির্দেশ পাওয়ার পরে তৎকালীন বাংলার বড়লাট ‘হ্যালিডে’ সাহেব চড়কপূজা সম্পর্কে একটি সরকারী তদন্তের আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই তদন্তের ফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই, কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স আবার লিখিত নির্দেশ পাঠিয়েছিল যে, সেই ব্যাপারে কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হলে আইনের সাহায্য না নিয়ে সরকারের পরোক্ষ প্রভাবের সাহায্যেই সেটা করা উচিত হবে। ঠিক সেই সময়ে ‘Calcutta Missionary Conference’-এর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে চড়কের বীভৎস, এবং যন্ত্রণাদায়ক অনুষ্ঠানগুলিকে আইনের সাহায্যে বন্ধ করবার জন্য একটি আবেদন পেশ করা হয়েছিল। হ্যালিডে সাহেব শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, চড়কের অনুষ্ঠানগুলি যেহেতু বাধ্যতামূলক নয়, অতএব শিক্ষার বিস্তার, এবং মিশনারীদের প্রচারের সাহায্যেই সেগুলি বন্ধ করতে হবে; তার জন্য আলাদাভাবে কোন আইন প্রণয়ন করা সঙ্গত হবে না। হ্যালিডের পরে ১৮৫৯ খৃষ্টাব্দে ‘স্যার জন গ্রান্ট’ বাংলার শাসনকর্তা হয়ে এসেছিলেন। তখন ‘Calcutta Missionary Conference’-এর পক্ষ থেকে দ্বিতীয়বারের জন্য লাট-সাহেবের আইনসভার কাছে চড়কঘোরা বন্ধ করবার জন্য অনুরোধ জানিয়ে একটি আবেদনপত্র পেশ করা হয়েছিল। লাটসাহেব সেই আবেদনপত্রটি বিলাতের কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষ তখন নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, পরোক্ষভাবে জনমত গঠন করে, এবং সরকারের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে বিরূপ মনোভাবের পরিচয় দিয়ে চড়কের নৃশংস অনুষ্ঠানগুলিকে একে একে বন্ধ করতে হবে। এরপরে লাটসাহেব বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারদের এক সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন। সেই সম্মেলনে ঠিক করা হয়েছিল যে, তখন বাংলার যেসব অঞ্চলে বহুদিন ধরে চড়ক-পার্বণ চলছিল, সেই সব জায়গায় সরকারী কর্মচারীদের ব্যক্তিগত প্রভাবের দ্বারা, এবং স্থানীয় জমিদারদের সমর্থনের সাহায্যে চড়কের নৃশংস অনুষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে হবে; এবং যেসব জায়গায় চড়কের অনুষ্ঠানগুলি দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ছিল না, সেসব ক্ষেত্রে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে সেখানে অনুষ্ঠানগুলিকে বন্ধ করবার জন্য আদেশ দেবেন। তবে তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনারদের বিবরণী থেকে জানা যায় যে, বাংলার চড়ক-পার্বণের বীভৎস অনুষ্ঠানগুলির প্রচলন ইতিমধ্যেই অনেকটা কমে গিয়েছিল। ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে ‘স্যার সিসিল বীডন’ বাংলার লাট হয়ে এসেছিলেন, এবং এর দু’ বছর পরেই বৃটিশ সরকার বাংলার চড়কপূজার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। আইন সভার একজন হিন্দু সদস্য চড়কের নৃশংস অনুষ্ঠানগুলি বন্ধ করবার জন্য একটি প্রস্তাব উপস্থাপিত করেছিলেন, এবং সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দের ১৫ই মার্চ তারিখে বীডন সাহেব চড়ক বিষয়ে একটি সরকারী বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছিলেন। সেই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল যে – চড়কঘোরা, বাণফোঁড়া প্রভৃতি নৃশংস অনুষ্ঠান ভারতের অন্য সব প্রদেশে বন্ধ হয়ে গেলেও বঙ্গদেশের বহু জেলায় সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী প্রচেষ্টাকে অগ্রাহ্য করে তখনও পর্যন্ত টিকে রয়েছে। তাই ভবিষ্যতে সেগুলি যাতে পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যায়, সেজন্য ওই বিজ্ঞপ্তিতে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও কমিশনারদের প্রতি তাঁদের সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, এবং জমিদার ও স্থানীয় অন্যান্য প্রভাবশালী লোকেদেরও সেই ব্যাপারে সরকারকে সমর্থন করবার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। একই সাথে ওই বিজ্ঞপ্তিতে, যাঁরা এর পরেও স্বেচ্ছায় সেই সরকারী আদেশ উলঙ্ঘন করবেন, তাঁদের আইন অনুসারে শাস্তি দেওয়া হবে বলে ভয় দেখানো হয়েছিল। তবে নৃশংস অনুষ্ঠানগুলি বাদ দিয়ে চড়কপূজার আয়োজন করলে সরকার তাতে কোনো রকমের বাধা দেবেন না বলে প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। ‘British Indian Association’ সেই ব্যাপারে সরকারকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছিল। ওই সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হওয়ার পরে কলকাতা শহরে ও শহরতলীতে চড়কঘোরা, বাণফোঁড়া ইত্যাদি নৃশংস অনুষ্ঠান একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে কলকাতা শহরের মধ্যে এই ধরনের অনুষ্ঠানের সংবাদ আর পাওয়া যায় নি; তবে শহরতলী থেকে অবশ্য কয়েকবার সরকারি নির্দেশ অগ্রাহ্য করা হয়েছিল বলে জানা যায়। বীডন সাহেবের পরে ‘স্যার উইলিয়ম গ্রে’ ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে বাংলার শাসনকর্তা হয়ে এসেছিলেন। তাঁর আমলে মেদিনীপুর ও ঢাকা অঞ্চলে আবার চড়কের নিষিদ্ধ অনুষ্ঠানগুলি প্রচলিত হওয়ার কাহিনী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। তখন স্থানীয় সরকারি কর্মচারীরা অবিলম্বে সেই ঘটনাগুলির তদন্ত করেছিলেন, এবং আইন-লঙ্ঘনকারীদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি দিয়েছিলেন। এরপরে ধীরে ধীরে বঙ্গদেশের সর্বত্রই চড়কের নৃশংস অনুষ্ঠানগুলি একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

(তথ্যসূত্র:
১- হুতোম প্যাঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ, সাহিত্য পরিষদ সংস্করণ, ১৯৫৭।
২- বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদিপর্ব, নীহাররঞ্জন রায়।
৩- সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ২য় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত।
৪- Narrative of A Journey Through The Upper Provinces of India, Vol. I, R. Heber.
৫- India And India Missions, Alexander Duff.
৬- Life Of William Carey, G. Smith.
৭- History Of Hindu Civilisation During British Rule In India, Vol. I, P. N. Bose.
৮- Bengal Under The Lieutenant Governors, Vol. I & II, C. E. Buckland.
৯- The Folk Element In Hindu Culture, B. K. Sarkar.
১০- The Friends of India (Monthly), March, 1819.
১১- The Calcutta Journal, 20th April 1819 and 23rd May 1819.)