নিজস্ব প্রতিবেদক: সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়িতে বেসরকারি বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় উদ্ধারকৃত ৪৬ জনের মরদেহের মধ্যে ১৯ জনের পরিচয় মিলেনি এখনও। এ ঘটনায় কমপক্ষে আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক। তাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদিকে বিএম ডিপোর ১১৮ ক্যামেরার ৭ ডিভিআর জব্দ করেছে সিআইডি। আজ শনিবার (১১ জুন) ডিপোতে গিয়ে দেখা যায়,ভিতরে চলছে পরিচ্ছন্নতার কাজ, বাইরে এখনো স্বজনের আহাজারি শোনা যাচ্ছে। অভিশপ্ত আগুনে পুড়ে যাওয়া কিংবা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারে শান্তি ফেরেনি। নিখোঁজদের জন্য ডিপোর ফটকে অপেক্ষার প্রহর গুনতে দেখা গেছে স্বজনদের।
জানা গেছে, বিএম কন্টেইনার ডিপোর ১১৮টি সিসিটিভি ক্যামেরার সাতটি ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডিং (ডিভিআর) মেশিন জব্দ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি)। গতকাল শনিবার সকালে সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ শরীফের নেতৃত্বে একটি তদন্ত দল কন্টেইনার ডিপোর ভেতরে ক্ষতিগ্রস্থ আইটি কক্ষে যায়। ওই কার্যালয় থেকে পুরো কন্টেইনার ডিপোর আইটি সিস্টেম এবং সিসি ক্যামেরাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হতো। সেখানে থেকে তারা বিভিন্ন ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর উদ্ধার করা ডিভিআর মেশিনের পোড়া অংশগুলো জব্দ করে।
সিআইডি পরিদর্শক মোহাম্মদ শরীফ জানান, কন্টেইনার ডিপোর ডিজিটাল আলামতগুলো জব্দ করতে এসেছি। বিস্ফোরণের কারণে আইটি কক্ষটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। সিসি ক্যামেরার ডেটা সংরক্ষণ করা ডিভিআর মেশিনগুলো জব্দ করেছি। সেগুলো এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে সেগুলো চালিয়ে দেখার মতো অবস্থায় নেই। তবুও পরীক্ষার উপযোগী করা যায় কি না, সে চেষ্টা করা হবে।
এদিকে কন্টেইনার ডিপোর ভেতরে চলছে ধ্বংস স্তুপ সরানো ও ধোয়ামোছার কাজ। ডিপো কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব লোকবল ও যন্ত্রপাতি দিয়ে এগুলো সরাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, পোড়া ধ্বংস স্তুপ সরিয়ে নিয়ে পুরোপুরি কাজের উপযোগী করতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যাবে। ডিপোর বাইরে ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) ও শিপিং কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা ভিড় করছেন। তবে
ঘটনার পর থেকে ডিপোতে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সদস্য নিয়োজিত থাকলেও গতকাল তা দেখা যায়নি। ডিপোর নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী এবং সীতাকুণ্ড থানা পুলিশের একটি দলই কেবল সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। দুর্ঘটনা পরবর্তী কয়েকদিন বিএম কনটেইনার ডিপোর ভেতরে উদ্ধারযজ্ঞ চললেও গতকাল ডিপোর পরিবেশ শান্তই ছিলো। তবে অভিশপ্ত আগুনে পুড়ে যাওয়া কিংবা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারে শান্তি ফেরেনি। নিখোঁজদের জন্য গতকালও ডিপোর ফটকে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকা স্বজনরা অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে ডিপোর আশেপাশের পরিবেশ। কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় পুলিশের দায়েরকৃত মামলায় এখনো কোন আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন কেউ কেউ।
ডিপো এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ডিপো কর্তৃপক্ষের নিজস্ব উদ্যোগে কনটেইনারগুলো সরিয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছিলেন তাদের নিয়োজিত পরিচ্ছন্ন শ্রমিকরা। তবে তা ছিল খুব ধীর গতির। অল্প কয়েকজন শ্রমিক ছোট এস্কেভেটর দিয়ে ঠেলে সরিয়ে রাখছিলেন পুড়ে থাকা বিভিন্ন কনটেইনার। জানতে চাইলে নুর আলম নামে একজন শ্রমিক বলেন, আমরা এখন কনটেইনারগুলো একটি একটি করে সরিয়ে নিচ্ছি। এরপর ভেতরে থাকা কাপড় থেকে মাঝে মাঝে বের হওয়া ধোঁয়ায় পানি দেব। তবে এখন ফের বিস্ফোরণের সম্ভাবনা নেই। তাই ঝুঁকিও দেখছি না। এদিকে দায়িত্বশীল বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের আনাগোনা কমলেও এখনো ডিপোটি নিয়ে কৌতুহলী সাধারণ মানুষ। ডিপোর বাইরে অনেক এলাকাবাসীকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। ভেতরে এখন কি হচ্ছে বা আর কি কি পাওয়া যাচ্ছে তা জানতেই উৎসুক ছিল লোকজন। তাই ভিড় করছেন তারা।
ডিপোতে সংঘটিত ভয়ঙ্কর অগ্নিকান্ডে নিখোঁজ সীতাকুণ্ডের হাসেম ড্রাইভারসহ বেশ কয়েকজনের হদিস মিলেনি এখনো। তারা আদৌ বেঁচে আছেন, নাকি পুড়ে অঙ্গার- সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না স্বজনরা। ফলে উদ্ধার তৎপরতা থেমে গেলেও এসব পরিবারে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে এখনো।গতকালও হাসেম ড্রাইভারের বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের বুকফাটা আহাজারি চলে। এদিন হাসেমের মেয়ে সালমা আক্তার (১৩) কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আজ ৭ দিন হয়ে গেল। আমার বাবার কোন খবর পেলাম না। তিনি কি জীবিত আছেন নাকি মারা গেছেন কিছুই কেউ জানাতে পারছেন না কেউ।
সীতাকুণ্ড থানার ওসি মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডিপোর ভেতরে এখন আমরা (পুলিশ) ছাড়া কেউ নেই। শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি দল ডিপোটি পরিদর্শন করেছেন। যেহেতু অনেক কনটেইনারে এখনো মালামাল আছে। সেগুলো যেন লুটপাট না হয় সেজন্য পুলিশ রাখা হয়েছে।
এদিকে আহতরা বেশির ভাগই দৃষ্টিশক্তি হীনতায় ভুগতে পারেন বলে জানিয়েছেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের মহাসচিব ডা. এম এ আজিজ। অপরদিকে ১৯ মরদেহ ও নিখোঁজসহ ২৩ জনের বিপরীতে মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করতে ৪২ জনের ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য নমুনা নিয়েছে সিআইডি।
সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হিমঘরে ১৫ টি, চট্টগ্রাম এভারকেয়ার হাসপাতালে ২ টি ও চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ২টি মরদেহ রাখা হয়েছে। আপাতত শনাক্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো মরদেহ হস্তান্তর হচ্ছেনা।
মরদেহ দেখে যেহেতু চেনা যাচ্ছে না, সেক্ষেত্রে আমরাও মরদেহ হস্তান্তর করতে পারছি না বলে জানিয়েছেন কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ওমর ফারুক। তিনি জানান, পরিচয় শনাক্তে মরদেহগুলার ডিএনএ টেস্টের পরিচয় শনাক্ত হলে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। শনাক্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো মরদেহ হস্তান্তর করা হবেনা।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান জানান, এ পর্যন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে ৪৬টি। এর মধ্যে ২৭ জনের পরিচয় শনাক্ত করে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। চমেক হাসপাতালের হিম ঘরে ১৯ জনের মরদেহ রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান।



