অনুসন্ধানী প্রতিবেদন——–
নজরুল ইসলাম: কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্যারটেক এলাকায় পুলিশের হাতে আটক চোরাই স্বর্ণের পরিমান নিয়ে দুই ধরণের তথ্য বেরিয়ে আসছে। প্রকৃত স্বর্ণ উদ্ধারের পরিমান সাড়ে ১৪ কেজি না সাড়ে ৯ কেজি এ নিয়ে দেখা দিয়েছে রহস্য।
উদ্ধারকৃত স্বর্ণ থেকে ৫ কেজি স্বর্ণ গায়েব করে স্বর্ণ চোরাকাবারিদের আড়ালে রাখার চেষ্টা শুরু থেকে চলছিল বলে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ উঠেছে। তবে ইতোমধ্যে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে উদ্ধারকৃত স্বর্ণগুলো আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাকাবারি কক্সবাজারের পরিমল ধরের। স্বর্ণ বিভিন্ন সময় ধরা পড়লেও পুলিশের সাথে সখ্যতা থাকায় বার বার ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে পরিমল।
পুলিশের তদন্তে পরিমল ধরের নাম পর্দার আড়ালে থাকে। পরিমল ধর ও তার ভাই এবং আত্বীয় স্বজন মিলে কক্সবাজারে মাদক ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে ইয়াবার মামলা এবং দুদকের মামলাও রয়েছে। চট্টগ্রামে গত বছর কর্ণফুলী থানার মইজ্যারটেক এলাকা থেকে সাড়ে ৯ কেজি স্বর্ণ জব্দ করার পর তিন মাসের মধ্যে কোনো দাবিদার হাজির হননি থানা কিংবা ডিবি কার্যালয়ে।
আলোচিত সাড়ে ৯ কেজি স্বর্ণের এক মাত্র মালিক পরিমল ধর। পরিমল ধর একজন আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাকারবারি। চোরাই পথে বার্মা হয়ে কক্সবাজার,নগরের হাজারীগল্লি, ঢাকা থেকে ভারতে স্বর্ণগুলো নিয়মিত পাচার করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরিমল ধরের চোরাই স্বর্ণের ব্যবসার তথ্য হাজারীগলির অধিকাংশ স্বর্ণের দোকানদার এবং কর্মচারীদের কাছে ওপেন সিক্রেট। হাজারীগলির বিভিন্ন দোকানের কর্মচারীকে চুক্তির ভিত্তিতে চোরাই স্বর্ণ পাচারের কাজে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছে। পরিমল ধরের স্বর্ণ বহন করতে গিয়ে অনেকে কর্মচারী এখনো কারাগারে বন্দিদশায় আছে। স্বর্নের দোকানের কিছু কর্মচারীর ব্যাংক হিসাবে কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হওয়ায় বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসলে কৌশল পাল্টিয়ে বিশেষ টোকেনের মাধ্যমে ব্যাংকের লেনদেন করে আসছে চক্রটি।
পরিমল ধরের রয়েছে ২০/২৫ জনের একটি সিন্ডিকেট। পরিমল ধর আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাকারবারি এবং ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার বিষয় স্বর্ণ ব্যবসায়ী পলাশ ধর নামের এক ব্যক্তি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, ডিআইজি চট্টগ্রাম রেঞ্জ, সিএমপি কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে তার বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দাবি জানিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরিমল ধরের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা বাজার এলাকার ফকির চন্দ্র ধরের পুত্র। নগরীর আন্দরকিল্লাস্থ আর্কিট প্লাজার ১০ম তলায় ফ্ল্যাট বাসা। পরিমল ধরের ভাই নির্মল ধর, বিমল ধরসহ তারা এক সময়ে নৌকার মাঝি ছিল, টাকার লোভে জড়িয়ে মাদক, ইয়াবা স্বর্ণ চোরাকারবরির সাথে বর্তমানে তারা প্রায় ৪/৫ হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক। পরিমল ধরের প্রধান সহযোগী রাউজানের বিজয় সিংহ, এক সময়ে হাজারী গলিতে তিন হাজার টাকা বেতনে স্বর্ণের দোকানের কর্মচারী গত ১০/১২ বছরে বনে যান রাতারাতি কয়েকশ’ কোটি টাকার মালিক। পরিমল ধরের আত্বীয়
সাতকানিয়া বাড়ি রুপন ধর এবং বাপ্পা ধর তারা পরিমল ধরের হয়ে কক্সবাজার স্বর্ণের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। সিন্ডিকেটটির আচার আচরণ চলা ফেরা কখনো কেউ বিশ্বাস করবে না তারা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে মূলত তাদের দোকান হচ্ছে শো। উক্ত দোকানে ৫০ হাজার টাকার স্বর্ণ রাখে না। দোকানকে শো করে বাইরে মূল ব্যবসা। গত বছরের ১৬ জুন নগরীর কর্ণফুলী থানার মইজ্জারটেক এলাকায় সাড়ে সাত কোটি টাকা মূল্যের এ স্বর্ণবার ধরা পড়ে। যাত্রীবাহী বাসে তল্লাশি করে স্বর্ণসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে সিএমপির কর্ণফুলী থানা পুলিশ।
এ মামলার আসামি করা হয় বাঁশখালীর সাধন পুরের নয়ন ধর, তার স্ত্রী বসুন্ধরা জুলি ধর, কৃষ্ণ ধর এবং চন্দনাইশের বণিক পাড়ার টিপু ধর অলক। অবৈধ স্বর্ণ গলিয়ে ছোট ছোট দণ্ড ও পাতলা পাত বা বিস্কুট আকৃতির করা হয়। কর্ণফুলী থানাধীন মইজ্যারটেক এলাকায় গত বছরের ১৬ জুন সাড়ে ৯ কেজি স্বর্ণসহ কয়েকজনকেআটক করেন পুলিশ। পরিমল ধরের স্বর্ণ চোরাচালান ও অবৈধভাবে দেশে স্বর্ণ এনে বিক্রির প্রসঙ্গে স্বর্ণের দোকানদার পলাশ ধর দুদকের এক অফিসারকে পরিমল সর্ম্পকৈ তথ্য দেয়ার অপরাধে পরিমাল পাঁচলাইশ থানায় মিথ্যা একটি মামলা করে উক্ত স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করায়। পরিমল ধর ও তার আত্বীয় স্বজন আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাকারারির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে পরিমল ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছে গত ৪ মে সিএমপি কমিশনার এবং ডিআইজি চট্টগ্রাম রেঞ্জের নিকট।
গত ৫ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্ররালয়ে লিখিত অভিযোগ করে সাড়ে ৯ কেজি স্বর্ণের মালিক পরিমল বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।
মামলার শুরুতে ডিবির তদন্ত চলাকালে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামি নয়ন ধর ওরফে নারায়ণ বলেন, ‘কক্সবাজারের বাপ্পু নামের এক ব্যবসায়ী সাড়ে ৯ কেজি স্বর্ণ নিয়ে এসে নগরের হাজারিগলিতে বিশ্বকর্মা বুলিয়ান জুয়েলারির মালিক বিধান ধর ও কৃষ্ণ ধরকে দিতে বলেন। অপর আসামি টিপু ধরের জবানবন্দিতেও বিধান ও কৃষ্ণের নাম উঠে আসে। নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে কক্সবাজারের পরিমল ধর। পরিমল ধরের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ যাওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান। ঘটনার বিষয়ে জানার জন্য পরিমল ধরের মোবাইলে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করা হলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
হাজারীগলির একাধিক স্বর্ণের দোকানদার ও কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পরিমল ধর হচ্ছে আর্ন্তজাতিক মাফিয়া, বার্মা থেকে চোরাই পথে স্বর্ণ এনে কক্সবাজার, হাজারীগলি, ঢাকা হয়ে ভারতে চোরাইপথে অবৈধভাবে স্বর্ণের ব্যবসা করে আসছে। কক্সাবাজারের মানুষ সবাই জানে উনি কি করে কি ছিল, হাজারীগলিতে যারা অবৈধ স্বর্ণের ব্যবসা করে এবং যারা স্বর্ণ বহন করে এরকম পরিমল ধরের কাছে কয়েকশ মানুষ আছে। তার সিন্ডিকেটে ২৫/৩০ জন দোকানদারও আছে। তার সিন্ডিকেটের “বাইন্যগ্রুপটি” স্বর্ণ চোরাচালানীর টাকা বৈধ করতে নগরে ফ্লাট ব্যবসাও করছে।তাদের পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে পুলিশের একজন উদ্ধত্বন কর্মকর্তা। তিনি রাজধানীতে বসে কলকাঠি নাড়ছে। যা তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসবে।
তার হাতে কোন টাকা থাকে না। মইজ্যারটেকের স্বর্ণগুলো পরিমল বাবুর। তার নির্দেশনা হচ্ছে মাল ধরা পড়লে প্রয়োজনে কোটি টাকা দিয়ে হলেও সেখান থেকে চলে পরে কাকে কিভাবে ম্যানেজ করতে হয় সেটা উনার ঠিক করা আছে। তবে উনার সাথে পুলিশের সাথে সর্ম্পক থাকায় উনার মাল কেউ ধরে না।
এ বিষয় বাংলাদেশ জুয়েলারী সমিতি চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি মৃনাল কান্তি ধর বলেন, আমরা চাই পরিমল ধরের মত স্বর্ণ চোরাকারবারি অবৈধ স্বর্ণ ব্যবসায়ী এ ব্যবসায় না থাকুক, তারা দেশ জাতির জন্য ক্ষতিকর, অনেকে স্বর্ণ ব্যবসায়ী আছে তারা দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করে আসছে। বার্মা থেকে কারা অবৈধভাবে স্বর্ণ আনতেছে, এয়ারপার্টে ধরা পরার পর তারা কৌশল পাল্টে ইয়াবা সিন্ডিকেটদের দিয়ে ইয়াবা যেভাবে যে পথে সরবরাহ হচ্ছে সে পথে অবৈধ স্বর্ণগুলো বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুরোধ করব।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী পিবিআই অফিসার চট্টগ্রাম (মেট্টো) মোজাম্মেল হক বলেন, মামলাটি আমি যেভাবে তথ্য প্রমাণ পেয়েছি সেভাবে প্রতিবেদন দিয়েছি, স্বর্ণের মালিকানা দাবি না করার বিষয়টি ঠিক না, তারা আদালতে পুর্ণাঙ্গ নাম ঠিকানা দিয়ে স্বর্ণগুলো দাবি করছিল। তবে পরিমল ধরের বিষয়ে তদন্তকালিন সময়ে তার নাম কেউ বলেনি। স্বর্ণগুলো যদি পরিমলের হয়ে থাকে আদালত চাইলে উনাকে ডাকতে পারে। পরিমল ধরকে আদালত জ্ঞিসাবাদ করবে যারা মালিকানা দাবি করতেছে সবাইকে পৃথক পৃথক জবানবন্ধি নিতে পারে আদালত।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পিপি এডভোকেট আব্দুর রশীদ বলেন, স্বর্ণগুলোর উদ্ধারের পর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যতটুকু সম্ভব স্বর্ণগুলো চোরাকারবারির চক্রের কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে, যদি চোরাকারবারির স্বর্ণ হয়ে থাকে সেখানে পরিমল ধরের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় সে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। স্বর্ণগুলো নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে পুর্ণ তদন্তের জন্য আবেদন করা হয়েছে বলে শুনেছি।