সৈয়দ নুরুন নবী :প্রাচীন বর্ষপঞ্জি গুলোর মধ্যে রোমান বর্ষপঞ্জি বা রোমান ক্যালেন্ডার বেশ উন্নত ছিল। সেই সময়ের,রোমের সেনাপতিও এক নায়ক “জুলিয়াস সিজার”, ৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেটি ব্যাপক সংশোধন করে এর নামকরণ করেন জুলীয় বর্ষপঞ্জি। এই জুলীয় বর্ষপঞ্জিকে পরিমার্জিত করে, তৈরি হয় গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি। আর গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির সাথে আরবি বর্ষপঞ্জির সমন্বয় করেই তৈরি হয়েছে আমাদের হাল আমলের বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ। তবে ঠিক কখন থেকে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ চালু হয় এ সম্পর্কে বিস্তর মতপার্থক্য আছে। অনেকে মনে করেন, প্রাচীন বঙ্গদেশের গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক তাঁর রাজত্ব কালে আনুমানিক ৫৯০ হতে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। এই মতবাদ অনুসারে ধারণা করা হয় ১৪এপ্রিল ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।

দ্বিতীয় টি হল: সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর রাজত্বকালে অর্থাৎ ১৪৯৪ হতে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় প্রচলিত সৌর পঞ্জিকার সাথে ইসলামী বর্ষপঞ্জিকার (হিজিরি সাল )সমন্বয় করে বাংলা সাল প্রবর্তন করা হয়েছে। তৃতীয়টি হল বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রবর্তন হয়েছিল মোগল সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের সময়ে। এই মতের সমর্থনে

যে প্রেক্ষাপট বর্ণনা হয়েছে তা ছিল নিম্নরূপ:

মোগল আমলে জমির খাজনা, ব্যবসায়ীর শুল্ক সবকিছুই আদায় হতো হিজরিসাল বা আরবিবছর,অনুসারে কিন্তু এই এলাকার ফসল উৎপাদনের সময়ের সাথে এই সাল ভালো ভাবে মিলতো না। তাই খাজনা আদায়ে বেজায় অসুবিধা হতো। এই অসুবিধা দূর করার জন্য সম্রাট দায়িত্ব দিলেন, সেই সময়ের,জ্যোতিষ বিজ্ঞানী ফাতেউল্লাহ/ ফতুল্লাহ সিরাজীকে । তিনি আরবি হিজরীসন ও গ্যাগেরীয় ক্যালেন্ডারের ইংরেজি সনের সাথে সমন্বয় করে একটি বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করলেন। তখন এটাকে তারিখ-ই- এলাহী বা ফসলি সন নামে ডাকা হতো। পরবর্তীতে এটি বাংলা সন বা বঙ্গাব্দে রূপান্তরিত হয়েছে। এটি ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রচলিত হয়। তবে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যে ১২ মাসের নাম আছে, সেই নামগুলো কবে থেকে এবং কেমন করে এলো এ সম্পর্কেও প্রচুর মতো ভেদ রয়েছে। অধিকাংশ পন্ডিতের অভিমত,বাংলা মাস গুলোর নাম অতি প্রাচীনকালে, সূর্যসিদ্ধান্ত নামক গ্রন্থ হতে নেওয়া হয়েছে। আমরা বিদুষী খনার বচনগুলো, পুরুষানিক ক্রমে শুনে এসেছি, এগুলোতে বাংলা মাস গুলোর নামসমূহ সুন্দরভাবে উল্লেখ হয়েছে।

যেমন:
“চৈত্রেতে থরথর
বৈশাখেতে ঝড় পাথর
জ্যৈষ্ঠতে তারা ফুটে
তবে জানবে বর্ষা বটে”

সুতরাং বাংলা মাসের নাম গুলো যে মোগল আমলের অনেক আগে থেকেই ছিল এতে কোন সন্দেহ নেই।

এবার আসা যাক পহেলা বৈশাখ প্রসঙ্গে:

বঙ্গাব্দের শেষ মাস হল চৈত্র। ঐ সময়ে রেওয়াজ প্রচলিত হল যে ৩০ চৈত্রের মধ্যে, কৃষকে জমির খাজনা পরিশোধ করতে হবে,তারপরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ জমিদার তালুকদার বা অন্যান্য ভুস্বামীরা কৃষককে বা তাদের প্রজাদেরকে মিষ্টিমুখ করাবেন। এই নিয়মই প্রচলিত হলো ব্যবসা ক্ষেত্রেও, ব্যবসায়ী বা দোকানিরা তাদের পাওনা বা বকেয়া লেনদেনের হিসাব একটি মোটা খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখতেন, বছর শেষে সেই পাওনা পরিশোধ করার জন্য জন্য বিনীতভাবে তাদের খরিদ্দার তথা পাওনাদারদের নিকট চিঠি লিখতেন বা দাওয়াত কার্ড পাঠাতেন। বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে খরিদ্দারেরা তাদের সারা বছরের পাওনা মহাজনকে পরিশোধ করতেন। মহাজন তুষ্ট হয়ে,ঐদিন খরিদ্দারদের মিষ্টিমুখ করাতেন। বাঙালি ব্যবসায়ীদের এই অনুষ্ঠানটি হালখাতা নামে পরিচিতি পেয়েছে।

হাল শব্দটি মূলত ফারসি শব্দ এর শাব্দিক অর্থ নতুন। ঐদিন ব্যবসায়ীরা তাঁদের হিসেবের খাতা হালনগাদ করতেন অর্থাৎ এটি হিসাবের খাতা,নতুন করার দিন ও বটে। এই হাল নাগাদ হতে হালখাতা শব্দের উৎপত্তি। আমাদের অনেকের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে অতীত দিনের সেই হালখাতার আমন্ত্রণ পত্র বা কার্ড। যে গুলোর উপরে লেখা থাকতো,”বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বা “এলাহী ভরসা”। অনেক ব্যবসায়ী বা মহাজন হালখাতার দিনে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন ও করতেন। হিন্দু ব্যবসায়ীরাও ঐদিন,তাঁদের দোকানে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ক্রেতাদের পাওনা পরিশোধের জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানাতেন। দোকানে সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করতেন। অবশ্য অনেক ব্যবসায়ী বৈশাখ মাসেই অক্ষয় তৃতীয়ায়, শুভ মহরৎ পূজা করতেন। তাই দেখা যায় পহেলা বৈশাখ, আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি সঙ্গে সেই অতি পুরাতন কাল হতে জড়িয়ে আছে। সুতরাং এটাকে সম্প্রদায়ের বা ধর্মীয় রঙে রঙ দেওয়া নিতান্তই অমূলক।

এটি আমাদের সকল বাঙ্গালীর একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতি। তাই একজন বাঙালি হিসাবে উচ্ছ্বাসের সাথে পহেলা বৈশাখ কে আহবান করছি-এসো হে বৈশাখ! জীর্ণতা, সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প উড়ানোর তোমার অমিত শক্তি ও তেজ নিয়ে, ধৈর্য ও সহনশীলতার শান্ত স্নিগ্ধ তারা ভরা আকাশ নিয়ে,মায়া ও মমতার বৃষ্টির অপরূপ ছোঁয়া নিয়ে। তুমি এসো তোমার কিরণ মাখা পাখা মেলে নতুনের কেতন উড়াতে।

সৈয়দ নুরুন নবী :প্রাচীন বর্ষপঞ্জি গুলোর মধ্যে রোমান বর্ষপঞ্জি বা রোমান ক্যালেন্ডার বেশ উন্নত ছিল। সেই সময়ের,রোমের সেনাপতিও এক নায়ক “জুলিয়াস সিজার”, ৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেটি ব্যাপক সংশোধন করে এর নামকরণ করেন জুলীয় বর্ষপঞ্জি। এই জুলীয় বর্ষপঞ্জিকে পরিমার্জিত করে, তৈরি হয় গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি। আর গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির সাথে আরবি বর্ষপঞ্জির সমন্বয় করেই তৈরি হয়েছে আমাদের হাল আমলের বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ। তবে ঠিক কখন থেকে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ চালু হয় এ সম্পর্কে বিস্তর মতপার্থক্য আছে। অনেকে মনে করেন, প্রাচীন বঙ্গদেশের গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক তাঁর রাজত্ব কালে আনুমানিক ৫৯০ হতে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। এই মতবাদ অনুসারে ধারণা করা হয় ১৪এপ্রিল ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।

দ্বিতীয় টি হল: সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর রাজত্বকালে অর্থাৎ ১৪৯৪ হতে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় প্রচলিত সৌর পঞ্জিকার সাথে ইসলামী বর্ষপঞ্জিকার (হিজিরি সাল )সমন্বয় করে বাংলা সাল প্রবর্তন করা হয়েছে। তৃতীয়টি হল বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রবর্তন হয়েছিল মোগল সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের সময়ে। এই মতের সমর্থনে

যে প্রেক্ষাপট বর্ণনা হয়েছে তা ছিল নিম্নরূপ:

মোগল আমলে জমির খাজনা, ব্যবসায়ীর শুল্ক সবকিছুই আদায় হতো হিজরিসাল বা আরবিবছর,অনুসারে কিন্তু এই এলাকার ফসল উৎপাদনের সময়ের সাথে এই সাল ভালো ভাবে মিলতো না। তাই খাজনা আদায়ে বেজায় অসুবিধা হতো। এই অসুবিধা দূর করার জন্য সম্রাট দায়িত্ব দিলেন, সেই সময়ের,জ্যোতিষ বিজ্ঞানী ফাতেউল্লাহ/ ফতুল্লাহ সিরাজীকে । তিনি আরবি হিজরীসন ও গ্যাগেরীয় ক্যালেন্ডারের ইংরেজি সনের সাথে সমন্বয় করে একটি বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করলেন। তখন এটাকে তারিখ-ই- এলাহী বা ফসলি সন নামে ডাকা হতো। পরবর্তীতে এটি বাংলা সন বা বঙ্গাব্দে রূপান্তরিত হয়েছে। এটি ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রচলিত হয়। তবে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যে ১২ মাসের নাম আছে, সেই নামগুলো কবে থেকে এবং কেমন করে এলো এ সম্পর্কেও প্রচুর মতো ভেদ রয়েছে। অধিকাংশ পন্ডিতের অভিমত,বাংলা মাস গুলোর নাম অতি প্রাচীনকালে, সূর্যসিদ্ধান্ত নামক গ্রন্থ হতে নেওয়া হয়েছে। আমরা বিদুষী খনার বচনগুলো, পুরুষানিক ক্রমে শুনে এসেছি, এগুলোতে বাংলা মাস গুলোর নামসমূহ সুন্দরভাবে উল্লেখ হয়েছে।

যেমন:
“চৈত্রেতে থরথর
বৈশাখেতে ঝড় পাথর
জ্যৈষ্ঠতে তারা ফুটে
তবে জানবে বর্ষা বটে”

সুতরাং বাংলা মাসের নাম গুলো যে মোগল আমলের অনেক আগে থেকেই ছিল এতে কোন সন্দেহ নেই।

এবার আসা যাক পহেলা বৈশাখ প্রসঙ্গে:

বঙ্গাব্দের শেষ মাস হল চৈত্র। ঐ সময়ে রেওয়াজ প্রচলিত হল যে ৩০ চৈত্রের মধ্যে, কৃষকে জমির খাজনা পরিশোধ করতে হবে,তারপরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ জমিদার তালুকদার বা অন্যান্য ভুস্বামীরা কৃষককে বা তাদের প্রজাদেরকে মিষ্টিমুখ করাবেন। এই নিয়মই প্রচলিত হলো ব্যবসা ক্ষেত্রেও, ব্যবসায়ী বা দোকানিরা তাদের পাওনা বা বকেয়া লেনদেনের হিসাব একটি মোটা খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখতেন, বছর শেষে সেই পাওনা পরিশোধ করার জন্য জন্য বিনীতভাবে তাদের খরিদ্দার তথা পাওনাদারদের নিকট চিঠি লিখতেন বা দাওয়াত কার্ড পাঠাতেন। বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে খরিদ্দারেরা তাদের সারা বছরের পাওনা মহাজনকে পরিশোধ করতেন। মহাজন তুষ্ট হয়ে,ঐদিন খরিদ্দারদের মিষ্টিমুখ করাতেন। বাঙালি ব্যবসায়ীদের এই অনুষ্ঠানটি হালখাতা নামে পরিচিতি পেয়েছে।

হাল শব্দটি মূলত ফারসি শব্দ এর শাব্দিক অর্থ নতুন। ঐদিন ব্যবসায়ীরা তাঁদের হিসেবের খাতা হালনগাদ করতেন অর্থাৎ এটি হিসাবের খাতা,নতুন করার দিন ও বটে। এই হাল নাগাদ হতে হালখাতা শব্দের উৎপত্তি। আমাদের অনেকের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে অতীত দিনের সেই হালখাতার আমন্ত্রণ পত্র বা কার্ড। যে গুলোর উপরে লেখা থাকতো,”বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বা “এলাহী ভরসা”। অনেক ব্যবসায়ী বা মহাজন হালখাতার দিনে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন ও করতেন। হিন্দু ব্যবসায়ীরাও ঐদিন,তাঁদের দোকানে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ক্রেতাদের পাওনা পরিশোধের জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানাতেন। দোকানে সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করতেন। অবশ্য অনেক ব্যবসায়ী বৈশাখ মাসেই অক্ষয় তৃতীয়ায়, শুভ মহরৎ পূজা করতেন। তাই দেখা যায় পহেলা বৈশাখ, আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি সঙ্গে সেই অতি পুরাতন কাল হতে জড়িয়ে আছে। সুতরাং এটাকে সম্প্রদায়ের বা ধর্মীয় রঙে রঙ দেওয়া নিতান্তই অমূলক।

এটি আমাদের সকল বাঙ্গালীর একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতি। তাই একজন বাঙালি হিসাবে উচ্ছ্বাসের সাথে পহেলা বৈশাখ কে আহবান করছি-এসো হে বৈশাখ! জীর্ণতা, সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প উড়ানোর তোমার অমিত শক্তি ও তেজ নিয়ে, ধৈর্য ও সহনশীলতার শান্ত স্নিগ্ধ তারা ভরা আকাশ নিয়ে,মায়া ও মমতার বৃষ্টির অপরূপ ছোঁয়া নিয়ে। তুমি এসো তোমার কিরণ মাখা পাখা মেলে নতুনের কেতন উড়াতে।