সুব্রত দে : শিশুদের প্রথম পীঠস্থান পরিবার। সামাজিক পরিবেশের মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠলেও পরিবার হলো শিশুদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মূল ভিত্তি। কেননা প্রত্যেক শিশু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতে হাটতে হাঁটা আর আবোল তাবোল শব্দ উচ্চারণ করতে করতে মাতৃভাষা আয়ত্ত করে, সে পরিবেশে থেকে এবং পরিবারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। পরিবারের সদস্যের আচার-আচরণ, রুচিশীলতা ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ শিশুর সামগ্রীক বিকাশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা পাওয়া শিশুদের মৌলিক অধিকার। পরিবারের কাছ থেকে তারা আদর যত্ন, শিক্ষা, শাসন সর্বোপরি ভবিষ্যৎ গঠনে সময়োপযোগী দিকনির্দেশনা জন্মগতভাবেই প্রত্যাশা করে। এছাড়াও শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে উপযুক্ত নিরাপদ পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশে তাদের অন্তর্নিহিত চাহিদাগুলো উপলব্ধি করার পাশাপাশি চাহিদাগুলোর ন্যূনতম হলেও পূরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সুস্থ শিশু বলতে শুধু শারীরিকভাবে সুস্থ শিশুকেই বোঝায় না; শারীরিক ও মানসিক উভয়দিকে শিশুকে সুস্থ রাখতে হবে। সাধারণত আমরা শিশুর শারীরিক বিকাশে যতটা মনোযোগ দিই, মানসিক বিকাশে ততটা মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না। কিন্তু মানসিকভাবে সুস্থ না হলে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। সুতরাং শিশুর মানসিক বিকাশে বিশেষ করে সুস্থ পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, সৃজনশীল খেলধুলার যোগান, ছবি আঁকতে উৎসাহ পাশাপাশি সংগীতচর্চাসহ ভালো বই পড়তে আগ্রহী করে তোলা খুবই জরুরি।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন রয়ে যায়, একজন বাবা কিংবা মায়ের পক্ষে শিশুদের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা সত্ত্বেও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সবকিছু পূরণ করা সম্ভব? মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও আর্থিক সংকট নিত্য সঙ্গি। যেখানে তাদের নগণ্য আয়ে বৃদ্ধ মা-বাবা ও সন্তান-সন্ততি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা কাটিয়ে উঠতেই বেশিরভাগ পরিবারের লাগাম ছিড়ে যায়, সেখানে কীভাবে তার নিষ্পাপ শিশুদের শিক্ষিত করার আদ্যপান্ত কিংবা বৃদ্ধ মা- বাবার প্রয়োজনীয়তার আধিক্য ঠিক করবে।
এ পরিবারের সন্তানদের চাওয়া-পাওয়াগুলোও জীবনের গতির সঙ্গে মিলিয়ে নিতে বাধ্য থাকতে হয়। তাদের নগণ্য আয় দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ শেষে সন্তানদের লেখা পড়ার খরচ সামলানো খুব কঠিন। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে এসব পরিবারের সন্তানরা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে। অনেক সময় পড়াশোনা বাদ দিয়ে তারা শিশুশ্রম বিক্রির সাথে জড়িয়ে পরে। অর্থকষ্ট, লোকলজ্জা আর আত্মসম্মান হারানোর ভয়ে অভিভাবকরা কিশোরীদের বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হয়। বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরীরা নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভোগে। পরে তারা পরিবারের কাছে আবারও বোঝা হয়ে ফিরে আসে। এদের জীবনাচরণগুলো সিনেমার দৃশ্যকে হার মানিয়ে আসছে যুগের পর যুগ এবং তা এখনো অব্যহত আছে।
এছাড়া শিশু, কিশোর-কিশোরীরা এখন স্কুলে এমনকি নিজ বসতবাড়িতে সহিংসতার শিকার হওয়ার খবর প্রতিনিয়ত পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি মাগুরায় শিশু আছিয়া ধর্ষণের ঘটনা আরো একবার চোখে অঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, একটা শিশু বড় করতে কতটা সচেতন ও সাবধান হতে হবে প্রত্যেক বাবা-মা এবং সমাজকে। এ সমস্য দিনের পর দিন প্রকট আকার ধারণ করছে, যা অভিভাবকদের মারাত্মকভাবে ভাবিয়ে তুলছে । এসব সমস্যা প্রতিকারে শিশুদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণের পাশাপাশি তাদের জন্য সন্তানদের সৃজনশীল মানস গঠনে সহায়ক ও নিরাপদ পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। শুধুমাত্র মত প্রকাশের স্বাধীনতার অভাবে শত শত আছিয়া তার উপর হয়ে যাওয়া অন্যায় অবিচার নিরবে মেনে নিচ্ছে। এসব প্রতিবন্ধকতা শিশুরা মানসিকভাবে বেড়ে উঠতে বড় বাধা। ফলে তারা পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার গতি অনেকটা কমে যায়।
প্রত্যেক অভিভাবকই সন্তানদের উন্নত ভবিষ্যৎ কামনা করে। সে লক্ষ্যেই তারা অভিজ্ঞতার শ্রেষ্ঠ জীবনাদর্শন কখনো বই পড়িয়ে, কখনো নিজ জীবনাচরণ দিয়ে কখনো বা সাংস্কৃতিক উপস্থাপনায় অংশগ্রহণ করিয়ে সন্তানের মনোজগতকে সমৃদ্ধ করতে চায়।
বর্তমান যুগের সাথে তাল মেলাতে মোবাইল, ল্যাপটপসহ অসংখ্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস সন্তানদের জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে । এসব ডিভাইস বা মাধ্যম নতুন প্রজন্মের কাছে আধুনিক জীবন ব্যবস্থাকে যেমন সহজ করছে, ঠিক তেমনি এর অপব্যবহার বা আসক্তি অভিভাবকদের ভাবিয়ে তুলেছে মারাত্মকভাবে। শিশুরা কিশোর গ্যাং এর মতন ভয়ংকর অপরাধ চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। দেশকে অস্থিতিশীল করতে কিংবা দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে কোমলমতি শিশুদের ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। ফলে বুঝে না বুঝে নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পরছে অসংখ্য শিশু ও কিশোর-কিশোরী।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং গতানুগতিক জ্ঞানের পাশাপাশি কারিগরি জ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি শিশুর মনোবিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলেই বৈষম্যহীন ও জবাবদিহিতামূলক, সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বির্নিমাণ সম্ভব। এতে দেশের মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিতে সরকারের দায়বদ্ধতা কমবে অন্যদিকে সন্তানদের অধিকার নিশ্চিতে অভিভাবকদের যে দায়বদ্ধতা সেখান থেকে তারা অনেকাংশেই মুক্তি পাবে। –পিআইডি ফিচার