বিশেষ প্রতিবেদক: সাতকানিয়ায় কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি (টপসয়েল) কাটায় জড়িতদের খুঁজে বের করতে এবং কেটে নেওয়া মাটি ৩০ দিনের মধ্যে ভরাটের জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনার ৯ মাস অতিক্রম করলেও আদালতের নির্দেশনা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
অভিযোগ উঠেছে, কৃষিজমি ভরাট ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তো দূরের কথা, মাটিখেকো সিন্ডিকেট অস্ত্রের মহড়া দিয়ে দিবারাত্রি অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ শক্তি সঞ্চয় ও প্রদর্শন করে উপজেলার প্রায় ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় এক্সক্যাভেটর দিয়ে দিনরাত নির্ভয়ে কৃষিজমির মাটি কাটার মহোৎসবে মেতে উঠেছে।
উপজেলা প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে দিন-রাত অভিযান চালানোর কথা বললেও মাটি কাটা থেমে নেই। গণমাধ্যমে প্রেসবিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রশাসন বেশ কয়েকটি অভিযানে জরিমানা ও এক্সক্যাভেটর জব্দের কথা জানালেও মাটি কাটা বন্ধ না হওয়ায় প্রশাসনের আন্তরিকতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠছে।
‘প্রশাসন মাটি কাটা বন্ধ না করলে আমার কর্মীদের দিয়ে মাটি কাটা বন্ধ করা হবে’-সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী
সাধারণ মানুষ ও ভুক্তভোগীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, মাটিখেকোরা প্রশাসনকে কেন পাত্তা দিচ্ছে না-তা রহস্যজনক। সাতকানিয়ায় প্রশাসন কর্তৃক আদালতের নির্দেশনা প্রতিপালন না করা ও পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক মাটিকাটা বন্ধে মূল হোতাদের গ্রেপ্তার ও মামলা রুজু না করায় প্রশাসনের কথিত ‘অভিযান’কে অনেকেই আইওয়াস বলে মন্তব্য করছেন।
এ ছাড়াও মাটি কাটা বন্ধ না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় রাজনীতিক, বিভিন্ন দলের সাবেক মন্ত্রী ও সাংসদরা।
জানা যায়, ২০২৪ সালের মার্চ মাসে সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া ইউনিয়নের মনেয়াবাদ এলাকার বাসিন্দা আবদুল মুনাফ নামে এক ব্যক্তি সাতকানিয়ায় কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি (টপসয়েল) কাটার বিষয়ে ‘ইটভাটা মালিকদের জোরপূর্বক মাটি উত্তোলন, হুমকিতে কক্সবাজার রেললাইন ও গ্রামীন অবকাঠামো’ শিরোনামে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ১৯ মার্চ হাইকোর্ট রুল দিয়ে একটি ইটভাটার মাটিকাটার কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেন। আদেশের পরও সংশ্লিষ্ট কৃষিজমির টপসয়েল কাটা অব্যাহত থাকার বিষয়টি একই বছরের ২২ এপ্রিল বিচারপতি মোস্তাফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহ’র আদালতের নজরে আনেন রিট আবেদনকারীর আইনজীবী। শুনানি নিয়ে আদালত অবস্থান ব্যাখ্যা করতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার এবং সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সাতকানিয়া থানার ওসিকে ২৩ এপ্রিল দুপুরে ভার্চুয়ালি আদালতে যুক্ত হতে তলব করেন। এ অনুসারে একই বছরের (২৩ এপ্রিল) চার কর্মকর্তা ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়, সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সেলিম আযাদ।
পরে কৃষিজমি নষ্টকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না জানিয়ে টপসয়েল কেটে কৃষিজমি চাষাবাদের অনুপযোগী করার ঘটনায় যারা দায়ী তাদেরকে খুঁজে বের করতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজকে এক মাসের মধ্যে তদন্ত করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। এ ছাড়া কৃষিজমির উপরিভাগের কাটা মাটি (টপসয়েল) ৩০ দিনের মধ্যে বাইরে থেকে পলিমাটি এনে ভরাট ও ঢাকা- কক্সবাজার রেললাইন থেকে কত দূরে সাতকানিয়ায় মাটি কাটা হচ্ছে এবং এতে করে রেললাইন হুমকির মুখে পড়ে কি না, তা-ও অনুসন্ধান করে রিপোর্টে উল্লেখ করতে হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়।
আদালতের নির্দেশের দীর্ঘ ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত মাটিখেকো সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহন এবং ভরাট করা হয়নি খননকৃত কৃষি জমিগুলোও। ফলে এসব সিন্ডিকেট আরও দ্বিগুণ শক্তিতে কৃষিজমির টপসয়েল কাটছে। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষিজমির মালিক ও সাধারন কৃষকদের হাইকোর্টের এসব নির্দেশনা প্রশাসন যথাযথভাবে অবহিত করেনি।
সম্প্রতি সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অফিস থেকে সরবরাহকৃত এক তথ্যে দেখা গেছে, ৬ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত এক মাসের অধিক সময়ের মধ্যে বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ অনুযায়ী ১০ বার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ইউএনও মিল্টন বিশ্বাস ১০টি এ্যাক্সক্যাভেটর জব্দ এবং এসিল্যাণ্ড ফারিস্তা করিম সাড়ে ৮ লাখ টাকা জরিমানা আদায় এবং এক ব্যক্তিকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন ।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস বলেন, আদালতের নির্দেশনার পরপর যারা মাটি কেটেছিল সে সময় তাৎক্ষণিক তাদের দিয়ে অধিকাংশ জলাশয় ভরাট করে দেওয়া হয়েছিল। হঠাৎ বর্ষা চলে আসায় পুরো বিল পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, যার ফলে বড় বড় জলাশয়গুলো ভরাট করা সম্ভব হয়নি। তবুও বিষয়টি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে আলাপ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে মাটিকাটা বন্ধে দিনরাত অভিযান চলমান রয়েছে। মাটি খেকোদের কোনমতেই ছাড় দেওয়া হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার কেঁওচিয়া, কালিয়াইশ, পশ্চিম ঢেমশা, এওচিয়া, ছদাহা, কাঞ্চনা, নলুয়া, মাদার্শা ও ধর্মপুর ইউনিয়নে নির্বিচারে টপসয়েল কাটার ফলে দিন দিন কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। কম-বেশি মাটি কাটা থেকে বাদ যাচ্ছে না উপজেলার প্রায় ইউনিয়ন ও পৌরসভার অনেক এলাকাও।
পক্ষান্তরে, কেঁওচিয়া ইউনিয়নের তেমুহানী ও পাঠানিপুল এলাকা সংলগ্ন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী এক সময়ের তিন ফসলী জমি বিশালাকৃতির জলাশয়ে পরিনত হয়েছে। এসব কৃষিজমি থেকে ৩০ থেকে ৪০ ফুট গভীর করে মাটি খনন করা হয়েছে বলে জমির মালিকরা জানান। যে কারণে কৃষিজমির উর্বরতা শক্তি ধ্বংস হচ্ছে। জমিতে বাড়ছে লবণ ও সালফারের আধিক্য। একই সাথে ফসল উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে বলে অভিযোগ কৃষকদের। মাটিখেকোরা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক দিয়ে ডাম্পার ট্রাকযোগে কৃষিজমির মাটি পরিবহন করায় মহাসড়ক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। অনেক সময় ঘটছে ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-কক্সবাজার রেললাইনের প্রায় কাছাকাছি দু’পাশে গভীর করে কৃষিজমির মাটি খননের ফলে অদূর ভবিষ্যতে রেললাইন ধসে পড়ার আশঙ্কা করছেন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রাম (পূর্ব) এর প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মো.মাহবুবুল করিম বলেন, রেল লাইন এলাকা পরিদর্শন করে দেখা হবে, রেললাইনের কতদূর থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। সে অনুযায়ী জেলা প্রশাসকসহ রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিগত সরকারের আমলে স্থানীয় দলীয় পদবী ও নামধারী অনেকেই কৃষিজমির টপসয়েল কাটার কাজে জড়িত ছিল। তাদের সাথে যুক্ত ছিল অন্যান্য দলের অনেক নেতাকর্মী ও সমর্থক। বিগত সরকারের লোকেরা মাঠে না থাকলেও সে সময় তাদের সাথে যুক্ত থাকা মাটিখেকো চক্র এখন মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকদের তাদের পুরনো সিন্ডিকেটের সাথে ভিড়িয়ে কৃষিজমির টপসয়েল কাটা অব্যাহত রেখেছে । কৃষিজমি হতে গভীর করে মাটি খননের কারণে জমিগুলো বিশাল জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। যা এখনও পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।
সরেজমিন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মৌলভীর দোকান থেকে কেঁওচিয়া ইউনিয়নের আধার মানিক দরগাহ এর সাথে লাগোয়া কেরানিহাট রেলক্রসিং এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এক সময়ের তিন ফসলি কৃষিজমির মাঠ এখন বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। মনে হয় কৃষি জমি নয়, এ যেন বিশাল আকৃতির জলাশয়।
এছাড়া কেঁওচিয়া ইউনিয়নের নয়াখাল, পাঠানিপুল ও আঁধার মানিক দরগাহ এর পশ্চিমে ঢেমশা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে , মাটি খননের ফলে সৃষ্ট জলাশয় থেকে পুনরায় মাটি কাটার জন্য পানির পাম্প বসিয়ে জলাশয় সেচ দেওয়া হচ্ছে। এলাকার হাজার হাজার গ্রাহকের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ না করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে মিটারবিহীন পানির পাম্প বসিয়ে বিশাল জলাশয় সেচ দিয়ে মাটিখোকোদের পুনরায় মাটি কাটার উপযোগী করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে দোহাজারি বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে।
এ ব্যাপারে দোহাজারী বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের আবাসিক প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, জলাশয়গুলো থেকে মাছ ধরার জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে, শুকিয়ে মাটি কাটার জন্য নয়। তবে, মোটা অংকের লেনদেনের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
উপজেলার ঢেমশা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর ঢেমশা বারি সিকদার পাড়ার কৃষক আবু জাহের সিকদার বলেন, বৃটিশ আমলের আগে থেকে আমাদের বাপ-দাদারা রেলওয়ের অধিগ্রহণকৃত ও পাশ্ববর্তী জায়গাগুলোতে চাষাবাদ করে পরিবারের ভরনপোষণ মেটাতো। ২০১৪ সালে রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে এক টাকাও না দিয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আমার পাঁচ কানি জমির মাটি কেটে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা । তখন অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হুমকির কারণে জায়গায় যেতে পারিনি। সরকার পরিবর্তনের পরও পূর্বের ন্যায় একই কায়দায় পুনরায় প্রতিদিন রাত ৯ টা থেকে শুরু হয়ে ফজর পর্যন্ত চলে মাটি কাটা। এখনও নিজের জমি বলে দাবি করতে পারছি না। কোন জায়গায় বিচার পাচ্ছি না। তাই জীবন বাঁচাতে চাষাবাদ না করে চুপ করে বসে আছি।
একই সুরে কেঁওচিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবু সৈয়দ বলেন, রেললাইন সংলগ্ন আমার মালিকানাধীন কৃষিজমির মাটি রাতের অন্ধকারে কেটে নিয়ে যাওয়ায় পরবর্তীতে মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হই। প্রশাসনকে পাত্তা না দিয়ে অবিক্রিত জমির মাটি জোর করে কেটে নিয়ে গেছে। প্রথম দিকে মহাসড়কের দক্ষিণ পাশের জমির মাটি কেটে জলাশয়ে পরিণত করেছে। বর্তমানে উত্তর পাশের কৃষি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় নিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে অভিযোগ করেছেন কালিয়াইশ ইউনিয়নের রসুলাবাদ এলাকার মো. ওসমানসহ আরও অনেকে।
সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.জাহেদুল ইসলাম বলেন, মাটি কাটা বন্ধে থানা পুলিশ উপজেলা প্রশাসনের সাথে কাজ করছে।
অস্ত্রের মহড়ায় মাটিকাটা প্রসঙ্গে ওসি বলেন, এ ধরনের অভিযোগ কেউ এখনও করেনি, অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে ওসি বলেন, বিষয়টি ইউএনও স্যারের সাথে আলাপ করলে ভালো জানতে পারবেন।
অপরদিকে, উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবু ছালেহ মুন্সি বলেন, যে স্থান সমূহ থেকে মাটি কাটা হচ্ছে রেল লাইন থেকে তার দূরত্ব প্রায় ১৫০ ফুটের মত হবে। রেল লাইনের কাছাকাছি এলাকা থেকে মাটি কাটায় ২০২৩ সালে নতুন নির্মিত রেল লাইন ধ্বসে পড়েছিল। যার কারণে সাতকানিয়ার সিংহভাগ এলাকা কয়েকদিন ধরে পানির নীচে নিমজ্জিত ছিল, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্যার পানির তোড়ে ভেঙে গিয়েছিল গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট, পানিতে তলিয়ে ও ভেঙে গিয়েছিল অসংখ্য পাকা ও কাঁচা ঘর-বাড়ি। এ মাটি কাটা বন্ধ না হলে আগামীতে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যেতে পারে কৃষি উৎপাদন। হাজার হাজার কৃষক বেকার হয়ে দেখা দিতে পারে খাদ্য ঘাটতি।
সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ফসল উৎপাদনের জন্য টপসয়েল খুবই উপযোগী। মাটি কাটায় প্রতি বছর আবাদি জমির পরিমাণ কমতে থাকায় ভালো ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। তাই কৃষিজমির মাটি কাটা বন্ধে সংশ্লিষ্টদের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন জরুরি ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মো.ইকবাল সরোয়ার বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে মাটি সবচেয়ে মূল্যবান।
টপসয়েল এর ৬ থেকে ১৮ ইঞ্চির মধ্যেই জৈব পদার্থ ও অনুজীবের ঘনত্ব সর্বাধিক এবং পৃথিবীর জৈবিক মাটির কার্যকলাপ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ অংশে ঘটে থাকে। জমির জৈব উপাদান হ্রাস পেলে তা ফিরিয়ে আনতে ১৮ থেকে ২০ বছর সময় লাগে। অনাবাদি জমি বৃদ্ধির ফলে দেখা দিতে পারে বেকারত্ব ও খাদ্য ঘাটতি।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার উপপরিচালক মো. মোজাহিদুর রহমানের নিকট জানতে চাইলে দায়সারা বক্তব্যে তিনি বলেন , কৃষিজমি থেকে মাটি কাটার বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন দেখে থাকে। মাটি কাটার ফলে জীব বৈচিত্র্য ধ্বংসের বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কাজ করছে বলে জানান।
কার্যত জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরের দৃশ্যৃমান কোন অভিযান এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফরিদা খানম বলেন, মাটি কাটা বন্ধে ইউএনও এবং এসিল্যাণ্ড দিন-রাত অভিযান চলমান রেখেছেন। ইতোমধ্যে অনেককে শাস্তির আওতায়ও আনা হয়েছে।
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী কাটা মাটি ভরাট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। ইউএনও’র সাথে আলাপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. সাইফুল ইসলাম সানতু্ কৃষি জমি থেকে কাটা মাটি ভরাট প্রসঙ্গে অবগত নয় বলে তিনি জানান, আমি সম্প্রতি যোগদান করেছি। আপনার কাছে কাগজ থাকলে দেন, দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সাতকানিয়ার বাসিন্দা ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শেখ মো. মহিউদ্দিন বলেন, মাটি কেটে কৃষি জমি ধ্বংসের পাশাপাশি যে বা যারা পরিবেশ বিপর্যয়ে ভূমিকা রাখছে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে নিবৃত্ত করার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আর যারা মাটি কাটতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে লাভের জন্য কৃষিজমি ধ্বংসের নেশায় মেতে উঠেছেন, তাদের ওই টাকাগুলো বৈধ ব্যবসায় বিনিয়োগ করে কৃষক ও দেশের মানুষকে প্রাণে বাঁচার সুযোগ দিন, না হয় এক সময় কৃষি জমি ধ্বংসের কারণে কৃষক-জনতা আপনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে।
জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরীর আমীর ও চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃষিজমির মাটি কাটার সম্পূর্ণ বিরোধী। পরিবেশ উপদেষ্টার উপস্থিতিতে চট্টগ্রামের একটি সভায় জলাবদ্ধতার একমাত্র কারণ হিসেবে আমি মাটি কাটাকে চিহ্নিত করেছিলাম। আমি ডিসি সাহেবকে বলেছি, অবৈধ ইট ভাটা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। আমি এজন্য পুলিশ প্রশাসনকে দায়ী করছি। প্রশাসন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আমার কর্মীদের দিয়ে হলেও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর মাটি কাটা বন্ধ করা হবে।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি, চট্টগ্রাম-১৪ ও চট্টগ্রাম১৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী কর্ণেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেন, কৃষিজমির টপসয়েল কেটে যারা জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের পাশাপাশি এ্যাক্সক্যাভেটর জব্দ করার জন্য আমি ডিসি ও ইউএনওকে বলে দিব। কোন অবস্থাতেই কৃষকের ক্ষতি করা যাবে না।