নাসিরুদ্দিন চৌধুরী: নুরুল আলম চৌধুরী ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে ফটিকছড়ি থানার চাড়ালিয়া হাট ইউনিয়নের গোপালঘাটা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত চৌধুরী বংশে জন্মগ্রহণ করেন। নুরুল আলম চৌধুরীর পিতার নাম আলহাজ মতিউর রহমান চৌধুরী, মাতার নাম ওয়াজুন্নেসা খাতুন। তাঁরা চার ভাই, সকলেই উচ্চ শিক্ষিত। ভ্রাতাদের মধ্যে প্রথম আহমদ কবির চৌধুরী ছিলেন প্রসিদ্ধ বীমাবিদ, দ্বিতীয় আহমদ দবীর চৌধুরী ছিলেন নামকরা ডাক্তার, তৃতীয় মাহবুবুল আলম চৌধুরী ছিলেন বিদেশি ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত, চতুর্থ নুরুল আলম চৌধুরী। ডা. দবির আহমদের পুত্র ডা. মহসিন চৌধুরী পলাশও চিকিৎসক, তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (পিজি হাসপাতাল) কর্মরত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সাবেক সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের পুত্রের সঙ্গে তাঁর কন্যার বিয়ে হয়েছে।

নুরুল আলম চৌধুরীর নানার বাড়ি ফটিকছড়ি থানার শাহনগর, নানার নাম সুলতান আহমদ চৌধুরী। তিনি জমিদার ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কাঠের দোতলা বাড়ি ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আহমদ চৌধুরীর পিতা নুর আলী চৌধুরী তৈরি করেন। তাঁর বড় ভাই মোখলেছুর রহমান চৌধুরী বার্মায় অগাধ অর্থ রোজগার করেন। তাঁর বড় ছেলে আদালত খান চট্টগ্রামের প্রবাদ পুরুষ। তিনি সম্পর্কে নুরুল আলম চৌধুরীর মামা।

নুরুল আলম চৌধুরীর নানা সুলতান আহমদ চৌধুরীর দুই পুত্র ও সাত কন্যা। পুত্রদ্বয় মোহাম্মদ ইসলাম চৌধুরী ও জাকিরুল হক চৌধুরী। তাঁর সাতকন্যার প্রথম নুরুল আলম চৌধুরীর মাতা ওয়াজুন্নেসা খাতুন। সুলতান আহমদ চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা ও নুরুল আলম চৌধুরীর খালা জোলায়খা বেগম চৌধুরীর তিনপুত্র যথাক্রমে এবিএম এজহার মিঞা, অ্যাডভোকেট একেএম এমদাদুল ইসলাম ও এএমএম শহীদুল্লা। অ্যাডভোকেট এমদাদুল ইসলাম প্রথম জীবনে শিক্ষকতা ও পরে চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশায় নিযুক্ত হয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি একাধারে রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, লেখক ও সুশীল সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। এএমএম শহীদুল্লাহ ষাটের দশকের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা। সাপ্তাহিক ‘প্রতিরোধ’ নামে একটি পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতেন। নুরুল আলম চৌধুরীর পঞ্চম খালা সায়রা খাতুন-তাঁর একমাত্র পুত্র মোহাম্মদ মুসা চৌধুরী পশ্চিম ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

ষাটের দশকে চট্টগ্রামের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যেন নক্ষত্রের মেলা বসে গিয়েছিলো। সেই দশককে দু’ভাগ করে বিচার করাই সমীচীন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল একভাগ এবং ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের ছাত্র রাজনীতিকে দ্বিতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত করে আমি বিচার করতে চাই। ৬০-৬৪-এই চার বছরের মধ্যে প্রথম দেড় বছর মোটামুটি সামরিক শাসনের বৃত্তে আবদ্ধ ছিলো। উক্ত সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের ছাত্র রাজনীতিতে যাঁদের হাত ধরে ছাত্রলীগের নবজন্ম হয়েছিলো, তাঁরা পিতৃত্বের আসন দাবি করতেই পারেন। তাঁদের কথা একবার এখানে বলে নেয়া যাক, এম এ মান্নান, শহীদ মুরিদুল আলম, ফেরদৌস কোরেশী, আবু ছালেহ, আবদুর রউফ খালেদ-এই পঞ্চপাÐবকে যদি পথিকৃতের মর্যাদা দিতে হয়, তাহলে তাঁদের পেছনে পেছনে ধুলি উড়িয়ে অশ্ব ছুটিয়ে আসেন যে সপ্ত ঘোড়সওয়ারÑকফিলউদ্দিন, অধ্যক্ষ শায়েস্তা খান, বখতেয়ার কামাল, অধ্যক্ষ হারুনুর রশিদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, লোকমানুল মাহমুদ, আবুল কালাম আজাদ (অ্যাডভোকেট), তাঁদের কথাও ভুলে যাই কি করে?

৬৪ থেকে অনেক নাম ভিড় করে আসে- চাকসুর প্রথম ভিপি ইব্রাহিম ও প্রথম জিএস শহীদ আবদুর রব, আশরাফ খান, নুরুন্নবী চৌধুরী, মির্জা আবু মনসুর, নুরুল আলম চৌধুরী, ইদরিস আলম, এসএম ইউসুফ, গোলাম রব্বান, কাজী আবু জাফর, সুলতান উল কবির চৌধুরী, হাজি কামাল, এমনি অনিঃশেষ কত নাম। এই নক্ষত্রমন্ডলীর মধ্যে অবস্থান করে যে নক্ষত্রটি স্বকীয় দীপ্তিতে স্বতন্ত্র প্রভায় সমুজ্জল হয়ে বিরাজ করতো সেই নক্ষত্রের নাম নুরুল আলম চৌধুরী।

ষাট দশকের এই ছাত্র নেতাদের মধ্য থেকেই উদ্ভব হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির, পরিণামে যা স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাবকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলো। নুরুল আলম চৌধুরীকে আমি প্রথমত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রাজপথের একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবে শনাক্ত করি। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য তিনি এত আকুল হয়ে উঠেছিলেন যে, ’৭১-এর ছাব্বিশ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর কোত্থেকে নুরুল আলম চৌধুরী সেই ঘোষণা প্রচারের জন্য একটি ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কাকডাকা ভোরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডে মাইক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করতে করতে তাঁকে কালুরঘাট সেতু অতিক্রম করতে দেখেন তাঁরই এক সহকর্মী।

নুরুল আলম চৌধুরী একজন সুস্থ ধারার পরিশীলিত রাজনীতিক ছিলেন। তিনি কড়া ইস্ত্রি করা পাজামা পাঞ্জাবি পড়তেন। সেটা তাঁর দেহের শুভ্রতা প্রকাশ করতো, কিন্তু তিনি যে মনেও রাজহংসের মতো শুভ্র সুন্দর ছিলেন, সেটাই মনে পড়ে বেশি। সমসাময়িক ছাত্রনেতা, যাঁদের সঙ্গে তিনি চব্বিশ ঘণ্টা চলাফেরা, ওঠাবসা করতেন, যেমন ইদরিস আলম (তাঁরা পরস্পরকে খালাতো ভাই বলে সম্বোধন করতেন), এস এম ইউসুফ, বদি-বদন-নুর মোহাম্মদ চৌধুরী, আশরাফ খানÑরাজনীতিতে সাধনা ও সিদ্ধিতে তাঁর এসব বন্ধুকে তিনি ছাড়িয়ে ছাপিয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিলেন। তিনি দু’দু’বার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁর কোন বন্ধু সেটা হতে পারেননি। শুধু সুলতান ভাই একবার বাঁশখালী থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রদূত হয়ে বিদেশে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাঁর বন্ধুদের কেউ সেটা হননি। তিনি একাই শুধু তাঁর জেলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
নুরুল আলম চৌধুরীরা রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন ষাটের দশকের প্রথমভাগে। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলেজে ভর্তি হন। কলেজের ছাত্র হওয়ার পর থেকেই তাঁর চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত হতে থাকে এবং তাঁর রাজনৈতিক বিস্তার পরিপক্ক হয়ে উঠতে থাকে। মুসলিম হাইস্কুলে অধ্যয়নের সময় থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ইদরিস আলম, জহুর আহমদ চৌধুরীর পুত্র শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীরাও একই সময়ে মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাজের মাঝে ছাত্রলীগের রাজনীতি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সিরাজ ভাই (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) আর নুরুল আলম চৌধুরী প্রথম কমিটি গঠন করে সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। ফলও পেয়েছিলেন হাতে হাতে। প্রথম নির্বাচনে ছাত্রলীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। বাকলিয়ার বিখ্যাত মৌলভী সাহেবের বংশের ইব্রাহিম ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদের (চাকসু) ভিপি বা সহ সভাপতি ও শহরের এনায়েত বাজার স্টেশন কলোনির আবদুর রব (মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে যাওয়ার পথে ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর এম্বুশে পড়ে আবদুর রব, সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী ও শেখ মোজাফফর আহমদ শাহাদাত বরণ করেন।) সাধারণ সম্পাদক বা জিএস নির্বাচিত হন। কিন্তু ২য় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ছাত্রলীগকে চাকসু নির্বাচনে জিততে হয়েছিলো। সেই ক্যাবিনেট হীরা-মান্না পরিষদ নামে প্রসিদ্ধ। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অনেক ছাত্রনেতা। মোবারক ভাই, রব্বান ভাই, ইদ্রিস ভাই, ফজলু ভাই, শফিউল বশর ভাই, ইউনুস ভাই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিনেট নির্বাচনে নুরুল আলম ভাইয়ের প্যানেল বিজয়ী হয়। তাঁদের প্যানেলের দপ্তর খোলা হয়েছিলো ইসলামাবাদ টাউন কোপারেটিভ ব্যাংক ভবনের দোতলায় অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আমিন চৌধুরীর বাসায়। আমিন সাহেব ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র। তাঁদের প্যানেলের প্রার্থীদের ক্রিডেনসিয়াল লেখার দায়িত্ব পড়েছিলো আমার ওপর। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে জমজমাট আসরে হাজির থাকতেন-নুরুল আলম ভাই, ইব্রাহিম ভাই (চাকসুর প্রথম ভিপি), শহীদুল আমিন ও মঞ্জুরুল আমিন চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়, হুমায়ুন ভাই (আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী), মঈনু ভাই- ইফতি ভাই ভ্রাতৃদ্বয়, মোছলেম ভাই, তাজুল ভাই প্রভৃতি। সেই সময় নুরুল আলম ভাই’র চরিত্রের খোলামেলা, দরবারি রূপটি প্রকটিত হয়েছিলো। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন (১৯৬৬-৬৯)। তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে ২য় শ্রেণি পেয়ে এম,এ পাস করেন। কিন্তু পাস করেও আমলার চাকরিতে যোগদানে তাঁর প্রবৃত্তি হয়নি।

মরহুম নুরুল আলম চৌধুরীর জীবন একজন আদর্শবান, ত্যাগী, পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত রাজনীতিকের ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। দল ও আদর্শের জন্য এমন অবিচলিত, আপসহীন, সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন মানুষ, নিঃস্বার্থপ্রাণ নেতা-যে কোন দলের জন্য শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিলো তাঁর অগাধ আস্থা, নিঃশর্ত ভালোবাসা ও প্রশ্নাতীত আনুগত্য; প্রয়োজন হলে চোখ বন্ধ করে যেকোন মুহূর্তে নির্দ্বিধায় নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিতে পারতেন তিনি।

নুরুল আলম চৌধুরীরা দল ও দেশের জন্য কত বড় অ্যাসেট ছিলেন, সেটা কিভাবে বুঝাবো আমি বুঝতে পারছি না। আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিনে, জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহ মাড়িয়ে যখন ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য বেঈমান খোন্দকার মুশতাক বঙ্গভবনে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলা, তখন দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিমিনাল ল’ইয়ার কসবার এমপি সিরাজুল হক (বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পিতা) ছাড়া একমাত্র চট্টগ্রামের তরুণ এমপি নুরুল আলম চৌধুরীর চোখ ও কণ্ঠ থেকে তখন ক্রোধের অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিলো। সেই বৈরী সময়ে যখন বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণ নিষিদ্ধ সংলাপে পর্যবসিত হতো, তখন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, নুরুল আলম চৌধুরী, এসএম ইউসুফ, মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর ন্যায় অঙ্গুলিমেয় ক’জন নেতাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পতাকা উড্ডীন রেখেছিলেন।

নুরুল আলম চৌধুরী প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ পাকিস্তান বিমান বাহিনী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উপর বিমান আক্রমণ করলে বেতার কেন্দ্রটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ফলে বেতার কেন্দ্রটিকে চট্টগ্রাম থেকে রামগড় হয়ে ভারতের আগরতলায় নিয়ে যেতে তার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। নুরুল আলম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে ভারতে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি আর ইদরিস আলম লেম্বুছড়ায় রাইফেল, এস এল আর, স্টেশনগান চালানো এবং গ্রেনেড ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাঁদেরকে রাইফেল খোল্না, জোড়্না, পুল ফ্র মারা ইত্যাদি শেখানো হয়। পরে তাঁদেরকে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে রাজনৈতিক ক্লাস গ্রহণ করে শরণার্থীদের যুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ ক্লাস নিতে হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে প্রথমবারের মত স্বতন্ত্র নির্বাচিত এলাকা হিসেবে ঘোষিত ফটিকছড়ি আসন থেকে তাঁকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে দেশের কনিষ্ঠ সাংসদ হিসেবে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দেও সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তাঁকে ফটিকছড়ি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এসময় তিনি বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত হন। তিন জোটের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নুরুল আলম চৌধুরী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এসময় তিনি অত্যাচার-নির্যাতনের সম্মুখিন হন।

নুরুল আলম চৌধুরী ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি সেখানে তিন বছর অত্যন্ত সুনামের সাথে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রূপালী ব্যাংকে সরকারের নিযুক্ত পরিচালক হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেন। নুরুল আলম চৌধুরী প্রথিতযশা আইনজীবী অ্যাডভোকেট বদরুল হক খানের একমাত্র কন্যা মনফুজা খাতুন রোজিকে বিয়ে করেন। তাঁদের ২ পুত্র, ১ কন্যা। জনাব নুরুল আলম চৌধুরীর পুত্র-কন্যারাও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন এবং ইতিমধ্যে ফটিকছড়ি থানা ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাঁদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন।

নুরুল আলম চৌধুরীর সন্তানদের মধ্যে কন্যা বড়, তাঁর নাম তানজিনা জামান চৌধুরী। তিনি ইউএসটিসি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স কোর্স সম্পন্ন করেছেন। চট্টগ্রামের একটি প্রধান ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও রাজনৈতিক পরিবারে তাঁর বিয়ে হয়েছে। দেশখ্যাত শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, সাবেক এমপি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সাবেক সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু তাঁর শ্বশুর। জনাব বাবুর কনিষ্ঠ পুত্র জামান গ্রæপ, আরামিট গ্রুপ ও ইউসিবিএল-এর সম্মানিত পরিচালক, দানবীর ও শিল্পপতি আসিফুজ্জামান চৌধুরী জিমি তানজিনার বর। জনাব আসিফুজ্জামান চৌধুরী জিমি পারিবারিক ঐতিহ্যের দ্বারায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর জেঠা বশরুজ্জামান চৌধুরী চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ, তাঁর পিতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। তাঁর চাচা বশরুজ্জামান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেন। তাঁর বড় ভাই সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা এবং বাংলাদেশ সরকারের ভূমিমন্ত্রী। জিমির মেজ ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রণি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক, জামান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ইউসিবিএল নির্বাহী পরিষদের চেয়ারম্যান।

মরহুম চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র সাবেকুন রাহাত জিসান- বিবিএ, এমবিএ তাসমেনিয়া ইউনিভার্সিটি অব অস্ট্রেলিয়া থেকে এমবিএ পাস করেছেন। তিনি কানাডায় বসবাস করলেও তিনি সেখানে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের নানা কাজকর্মে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তাঁর স্ত্রী ফাতেমা হাসান নাওমী, শ্বশুর চন্দনাইশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাসান, বহুদিন যাবত সপরিবারে কানাডায় থাকেন।
মরহুম চৌধুরীর দ্বিতীয় পুত্র কনিষ্ঠ পুত্র হাসিবুন সুহাদ চৌধুরী সাকিব নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ পাস করেছেন। চট্টগ্রাম মহানগরের সুবৃহৎ অ্যাপার্টমেন্ট কাম মার্কেট কমপ্লেক্স ভিআইপি টাওয়ারের স্বত্তাধিকারী জনাব আবুল হোসেনের কন্যাকে সাকিব বিয়ে করেছেন। জনাব হাসিবুন সুহাদ চৌধুরী সাকিব ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সদস্য।

নুরুল আলম চৌধুরী ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি প্রয়াত হন।

নুরুল আলম চৌধুরী ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে ফটিকছড়ি থানার চাড়ালিয়া হাট ইউনিয়নের গোপালঘাটা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত চৌধুরী বংশে জন্মগ্রহণ করেন। নুরুল আলম চৌধুরীর পিতার নাম আলহাজ মতিউর রহমান চৌধুরী, মাতার নাম ওয়াজুন্নেসা খাতুন। তাঁরা চার ভাই, সকলেই উচ্চ শিক্ষিত। ভ্রাতাদের মধ্যে প্রথম আহমদ কবির চৌধুরী ছিলেন প্রসিদ্ধ বীমাবিদ, দ্বিতীয় আহমদ দবীর চৌধুরী ছিলেন নামকরা ডাক্তার, তৃতীয় মাহবুবুল আলম চৌধুরী ছিলেন বিদেশি ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত, চতুর্থ নুরুল আলম চৌধুরী। ডা. দবির আহমদের পুত্র ডা. মহসিন চৌধুরী পলাশও চিকিৎসক, তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (পিজি হাসপাতাল) কর্মরত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সাবেক সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের পুত্রের সঙ্গে তাঁর কন্যার বিয়ে হয়েছে।

নুরুল আলম চৌধুরীর নানার বাড়ি ফটিকছড়ি থানার শাহনগর, নানার নাম সুলতান আহমদ চৌধুরী। তিনি জমিদার ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কাঠের দোতলা বাড়ি ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আহমদ চৌধুরীর পিতা নুর আলী চৌধুরী তৈরি করেন। তাঁর বড় ভাই মোখলেছুর রহমান চৌধুরী বার্মায় অগাধ অর্থ রোজগার করেন। তাঁর বড় ছেলে আদালত খান চট্টগ্রামের প্রবাদ পুরুষ। তিনি সম্পর্কে নুরুল আলম চৌধুরীর মামা। নুরুল আলম চৌধুরীর নানা সুলতান আহমদ চৌধুরীর দুই পুত্র ও সাত কন্যা। পুত্রদ্বয় মোহাম্মদ ইসলাম চৌধুরী ও জাকিরুল হক চৌধুরী। তাঁর সাতকন্যার প্রথম নুরুল আলম চৌধুরীর মাতা ওয়াজুন্নেসা খাতুন। সুলতান আহমদ চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা ও নুরুল আলম চৌধুরীর খালা জোলায়খা বেগম চৌধুরীর তিনপুত্র যথাক্রমে এবিএম এজহার মিঞা, অ্যাডভোকেট একেএম এমদাদুল ইসলাম ও এএমএম শহীদুল্লা। অ্যাডভোকেট এমদাদুল ইসলাম প্রথম জীবনে শিক্ষকতা ও পরে চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশায় নিযুক্ত হয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি একাধারে রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, লেখক ও সুশীল সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। এএমএম শহীদুল্লাহ ষাটের দশকের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা। সাপ্তাহিক ‘প্রতিরোধ’ নামে একটি পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতেন। নুরুল আলম চৌধুরীর পঞ্চম খালা সায়রা খাতুন-তাঁর একমাত্র পুত্র মোহাম্মদ মুসা চৌধুরী পশ্চিম ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

ষাটের দশকে চট্টগ্রামের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যেন নক্ষত্রের মেলা বসে গিয়েছিলো। সেই দশককে দু’ভাগ করে বিচার করাই সমীচীন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল একভাগ এবং ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের ছাত্র রাজনীতিকে দ্বিতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত করে আমি বিচার করতে চাই। ৬০-৬৪-এই চার বছরের মধ্যে প্রথম দেড় বছর মোটামুটি সামরিক শাসনের বৃত্তে আবদ্ধ ছিলো। উক্ত সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের ছাত্র রাজনীতিতে যাঁদের হাত ধরে ছাত্রলীগের নবজন্ম হয়েছিলো, তাঁরা পিতৃত্বের আসন দাবি করতেই পারেন। তাঁদের কথা একবার এখানে বলে নেয়া যাক, এম এ মান্নান, শহীদ মুরিদুল আলম, ফেরদৌস কোরেশী, আবু ছালেহ, আবদুর রউফ খালেদ-এই পঞ্চপাÐবকে যদি পথিকৃতের মর্যাদা দিতে হয়, তাহলে তাঁদের পেছনে পেছনে ধুলি উড়িয়ে অশ্ব ছুটিয়ে আসেন যে সপ্ত ঘোড়সওয়ারÑকফিলউদ্দিন, অধ্যক্ষ শায়েস্তা খান, বখতেয়ার কামাল, অধ্যক্ষ হারুনুর রশিদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, লোকমানুল মাহমুদ, আবুল কালাম আজাদ (অ্যাডভোকেট), তাঁদের কথাও ভুলে যাই কি করে?

৬৪ থেকে অনেক নাম ভিড় করে আসে- চাকসুর প্রথম ভিপি ইব্রাহিম ও প্রথম জিএস শহীদ আবদুর রব, আশরাফ খান, নুরুন্নবী চৌধুরী, মির্জা আবু মনসুর, নুরুল আলম চৌধুরী, ইদরিস আলম, এসএম ইউসুফ, গোলাম রব্বান, কাজী আবু জাফর, সুলতান উল কবির চৌধুরী, হাজি কামাল, এমনি অনিঃশেষ কত নাম। এই নক্ষত্রমন্ডলীর মধ্যে অবস্থান করে যে নক্ষত্রটি স্বকীয় দীপ্তিতে স্বতন্ত্র প্রভায় সমুজ্জল হয়ে বিরাজ করতো সেই নক্ষত্রের নাম নুরুল আলম চৌধুরী।

ষাট দশকের এই ছাত্র নেতাদের মধ্য থেকেই উদ্ভব হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির, পরিণামে যা স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাবকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলো। নুরুল আলম চৌধুরীকে আমি প্রথমত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রাজপথের একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবে শনাক্ত করি। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য তিনি এত আকুল হয়ে উঠেছিলেন যে, ’৭১-এর ছাব্বিশ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর কোত্থেকে নুরুল আলম চৌধুরী সেই ঘোষণা প্রচারের জন্য একটি ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কাকডাকা ভোরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডে মাইক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করতে করতে তাঁকে কালুরঘাট সেতু অতিক্রম করতে দেখেন তাঁরই এক সহকর্মী।

নুরুল আলম চৌধুরী একজন সুস্থ ধারার পরিশীলিত রাজনীতিক ছিলেন। তিনি কড়া ইস্ত্রি করা পাজামা পাঞ্জাবি পড়তেন। সেটা তাঁর দেহের শুভ্রতা প্রকাশ করতো, কিন্তু তিনি যে মনেও রাজহংসের মতো শুভ্র সুন্দর ছিলেন, সেটাই মনে পড়ে বেশি। সমসাময়িক ছাত্রনেতা, যাঁদের সঙ্গে তিনি চব্বিশ ঘণ্টা চলাফেরা, ওঠাবসা করতেন, যেমন ইদরিস আলম (তাঁরা পরস্পরকে খালাতো ভাই বলে সম্বোধন করতেন), এস এম ইউসুফ, বদি-বদন-নুর মোহাম্মদ চৌধুরী, আশরাফ খান রাজনীতিতে সাধনা ও সিদ্ধিতে তাঁর এসব বন্ধুকে তিনি ছাড়িয়ে ছাপিয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিলেন। তিনি দু’দু’বার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁর কোন বন্ধু সেটা হতে পারেননি। শুধু সুলতান ভাই একবার বাঁশখালী থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রদূত হয়ে বিদেশে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাঁর বন্ধুদের কেউ সেটা হননি। তিনি একাই শুধু তাঁর জেলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
নুরুল আলম চৌধুরীরা রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন ষাটের দশকের প্রথমভাগে। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলেজে ভর্তি হন। কলেজের ছাত্র হওয়ার পর থেকেই তাঁর চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত হতে থাকে এবং তাঁর রাজনৈতিক বিস্তার পরিপক্ক হয়ে উঠতে থাকে। মুসলিম হাইস্কুলে অধ্যয়নের সময় থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ইদরিস আলম, জহুর আহমদ চৌধুরীর পুত্র শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীরাও একই সময়ে মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাজের মাঝে ছাত্রলীগের রাজনীতি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সিরাজ ভাই (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) আর নুরুল আলম চৌধুরী প্রথম কমিটি গঠন করে সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। ফলও পেয়েছিলেন হাতে হাতে। প্রথম নির্বাচনে ছাত্রলীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। বাকলিয়ার বিখ্যাত মৌলভী সাহেবের বংশের ইব্রাহিম ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদের (চাকসু) ভিপি বা সহ সভাপতি ও শহরের এনায়েত বাজার স্টেশন কলোনির আবদুর রব (মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে যাওয়ার পথে ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর এম্বুশে পড়ে আবদুর রব, সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী ও শেখ মোজাফফর আহমদ শাহাদাত বরণ করেন।) সাধারণ সম্পাদক বা জিএস নির্বাচিত হন। কিন্তু ২য় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ছাত্রলীগকে চাকসু নির্বাচনে জিততে হয়েছিলো। সেই ক্যাবিনেট হীরা-মান্না পরিষদ নামে প্রসিদ্ধ। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অনেক ছাত্রনেতা। মোবারক ভাই, রব্বান ভাই, ইদ্রিস ভাই, ফজলু ভাই, শফিউল বশর ভাই, ইউনুস ভাই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিনেট নির্বাচনে নুরুল আলম ভাইয়ের প্যানেল বিজয়ী হয়। তাঁদের প্যানেলের দপ্তর খোলা হয়েছিলো ইসলামাবাদ টাউন কোপারেটিভ ব্যাংক ভবনের দোতলায় অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আমিন চৌধুরীর বাসায়। আমিন সাহেব ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র। তাঁদের প্যানেলের প্রার্থীদের ক্রিডেনসিয়াল লেখার দায়িত্ব পড়েছিলো আমার ওপর। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে জমজমাট আসরে হাজির থাকতেন-নুরুল আলম ভাই, ইব্রাহিম ভাই (চাকসুর প্রথম ভিপি), শহীদুল আমিন ও মঞ্জুরুল আমিন চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়, হুমায়ুন ভাই (আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী), মঈনু ভাই- ইফতি ভাই ভ্রাতৃদ্বয়, মোছলেম ভাই, তাজুল ভাই প্রভৃতি। সেই সময় নুরুল আলম ভাই’র চরিত্রের খোলামেলা, দরবারি রূপটি প্রকটিত হয়েছিলো।

তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন (১৯৬৬-৬৯)। তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে ২য় শ্রেণি পেয়ে এম,এ পাস করেন। কিন্তু পাস করেও আমলার চাকরিতে যোগদানে তাঁর প্রবৃত্তি হয়নি।

মরহুম নুরুল আলম চৌধুরীর জীবন একজন আদর্শবান, ত্যাগী, পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত রাজনীতিকের ধ্রæপদী দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। দল ও আদর্শের জন্য এমন অবিচলিত, আপসহীন, সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন মানুষ, নিঃস্বার্থপ্রাণ নেতা-যে কোন দলের জন্য শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিলো তাঁর অগাধ আস্থা, নিঃশর্ত ভালোবাসা ও প্রশ্নাতীত আনুগত্য; প্রয়োজন হলে চোখ বন্ধ করে যেকোন মুহূর্তে নির্দ্বিধায় নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিতে পারতেন তিনি।

নুরুল আলম চৌধুরীরা দল ও দেশের জন্য কত বড় অ্যাসেট ছিলেন, সেটা কিভাবে বুঝাবো আমি বুঝতে পারছি না। আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিনে, জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহ মাড়িয়ে যখন ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য বেঈমান খোন্দকার মুশতাক বঙ্গভবনে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলা, তখন দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিমিনাল ল’ইয়ার কসবার এমপি সিরাজুল হক (বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পিতা) ছাড়া একমাত্র চট্টগ্রামের তরুণ এমপি নুরুল আলম চৌধুরীর চোখ ও কণ্ঠ থেকে তখন ক্রোধের অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিলো। সেই বৈরী সময়ে যখন বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণ নিষিদ্ধ সংলাপে পর্যবসিত হতো, তখন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, নুরুল আলম চৌধুরী, এসএম ইউসুফ, মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর ন্যায় অঙ্গুলিমেয় ক’জন নেতাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পতাকা উড্ডীন রেখেছিলেন।

নুরুল আলম চৌধুরী প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মকাÐের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ পাকিস্তান বিমান বাহিনী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উপর বিমান আক্রমণ করলে বেতার কেন্দ্রটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ফলে বেতার কেন্দ্রটিকে চট্টগ্রাম থেকে রামগড় হয়ে ভারতের আগরতলায় নিয়ে যেতে তার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। নুরুল আলম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে ভারতে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি আর ইদরিস আলম লেম্বুছড়ায় রাইফেল, এস এল আর, স্টেশনগান চালানো এবং গ্রেনেড ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাঁদেরকে রাইফেল খোল্না, জোড়্না, পুল ফ্র মারা ইত্যাদি শেখানো হয়। পরে তাঁদেরকে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে রাজনৈতিক ক্লাস গ্রহণ করে শরণার্থীদের যুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ ক্লাস নিতে হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে প্রথমবারের মত স্বতন্ত্র নির্বাচিত এলাকা হিসেবে ঘোষিত ফটিকছড়ি আসন থেকে তাঁকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে দেশের কনিষ্ঠ সাংসদ হিসেবে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দেও সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তাঁকে ফটিকছড়ি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এসময় তিনি বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত হন। তিন জোটের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নুরুল আলম চৌধুরী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এসময় তিনি অত্যাচার-নির্যাতনের সম্মুখিন হন।

নুরুল আলম চৌধুরী ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি সেখানে তিন বছর অত্যন্ত সুনামের সাথে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রূপালী ব্যাংকে সরকারের নিযুক্ত পরিচালক হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেন।

নুরুল আলম চৌধুরী প্রথিতযশা আইনজীবী অ্যাডভোকেট বদরুল হক খানের একমাত্র কন্যা মনফুজা খাতুন রোজিকে বিয়ে করেন। তাঁদের ২ পুত্র, ১ কন্যা। জনাব নুরুল আলম চৌধুরীর পুত্র-কন্যারাও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন এবং ইতিমধ্যে ফটিকছড়ি থানা ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাঁদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন। নুরুল আলম চৌধুরীর সন্তানদের মধ্যে কন্যা বড়, তাঁর নাম তানজিনা জামান চৌধুরী। তিনি ইউএসটিসি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স কোর্স সম্পন্ন করেছেন। চট্টগ্রামের একটি প্রধান ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও রাজনৈতিক পরিবারে তাঁর বিয়ে হয়েছে। দেশখ্যাত শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, সাবেক এমপি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সাবেক সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু তাঁর শ্বশুর। জনাব বাবুর কনিষ্ঠ পুত্র জামান গ্রুপ, আরামিট গ্রুপ ও ইউসিবিএল-এর সম্মানিত পরিচালক, দানবীর ও শিল্পপতি আসিফুজ্জামান চৌধুরী জিমি তানজিনার বর। জনাব আসিফুজ্জামান চৌধুরী জিমি পারিবারিক ঐতিহ্যের দ্বারায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর জেঠা বশরুজ্জামান চৌধুরী চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ, তাঁর পিতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। তাঁর চাচা বশরুজ্জামান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেন। তাঁর বড় ভাই সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা এবং বাংলাদেশ সরকারের ভূমিমন্ত্রী। জিমির মেজ ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রণি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক, জামান গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ইউসিবিএল নির্বাহী পরিষদের চেয়ারম্যান।

মরহুম চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র সাবেকুন রাহাত জিসান- বিবিএ, এমবিএ তাসমেনিয়া ইউনিভার্সিটি অব অস্ট্রেলিয়া থেকে এমবিএ পাস করেছেন। তিনি কানাডায় বসবাস করলেও তিনি সেখানে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের নানা কাজকর্মে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তাঁর স্ত্রী ফাতেমা হাসান নাওমী, শ্বশুর চন্দনাইশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাসান, বহুদিন যাবত সপরিবারে কানাডায় থাকেন।
মরহুম চৌধুরীর দ্বিতীয় পুত্র কনিষ্ঠ পুত্র হাসিবুন সুহাদ চৌধুরী সাকিব নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ পাস করেছেন। চট্টগ্রাম মহানগরের সুবৃহৎ অ্যাপার্টমেন্ট কাম মার্কেট কমপ্লেক্স ভিআইপি টাওয়ারের স্বত্তাধিকারী জনাব আবুল হোসেনের কন্যাকে সাকিব বিয়ে করেছেন। জনাব হাসিবুন সুহাদ চৌধুরী সাকিব ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সদস্য। নুরুল আলম চৌধুরী ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি প্রয়াত হন।

লেখক: নাসিরুদ্দিন চৌধুরী,প্রবীন সাংবাদিক ও কলামিস্ট

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী: নুরুল আলম চৌধুরী ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে ফটিকছড়ি থানার চাড়ালিয়া হাট ইউনিয়নের গোপালঘাটা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত চৌধুরী বংশে জন্মগ্রহণ করেন। নুরুল আলম চৌধুরীর পিতার নাম আলহাজ মতিউর রহমান চৌধুরী, মাতার নাম ওয়াজুন্নেসা খাতুন। তাঁরা চার ভাই, সকলেই উচ্চ শিক্ষিত। ভ্রাতাদের মধ্যে প্রথম আহমদ কবির চৌধুরী ছিলেন প্রসিদ্ধ বীমাবিদ, দ্বিতীয় আহমদ দবীর চৌধুরী ছিলেন নামকরা ডাক্তার, তৃতীয় মাহবুবুল আলম চৌধুরী ছিলেন বিদেশি ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত, চতুর্থ নুরুল আলম চৌধুরী। ডা. দবির আহমদের পুত্র ডা. মহসিন চৌধুরী পলাশও চিকিৎসক, তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (পিজি হাসপাতাল) কর্মরত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সাবেক সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের পুত্রের সঙ্গে তাঁর কন্যার বিয়ে হয়েছে।

নুরুল আলম চৌধুরীর নানার বাড়ি ফটিকছড়ি থানার শাহনগর, নানার নাম সুলতান আহমদ চৌধুরী। তিনি জমিদার ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কাঠের দোতলা বাড়ি ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আহমদ চৌধুরীর পিতা নুর আলী চৌধুরী তৈরি করেন। তাঁর বড় ভাই মোখলেছুর রহমান চৌধুরী বার্মায় অগাধ অর্থ রোজগার করেন। তাঁর বড় ছেলে আদালত খান চট্টগ্রামের প্রবাদ পুরুষ। তিনি সম্পর্কে নুরুল আলম চৌধুরীর মামা।

নুরুল আলম চৌধুরীর নানা সুলতান আহমদ চৌধুরীর দুই পুত্র ও সাত কন্যা। পুত্রদ্বয় মোহাম্মদ ইসলাম চৌধুরী ও জাকিরুল হক চৌধুরী। তাঁর সাতকন্যার প্রথম নুরুল আলম চৌধুরীর মাতা ওয়াজুন্নেসা খাতুন। সুলতান আহমদ চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা ও নুরুল আলম চৌধুরীর খালা জোলায়খা বেগম চৌধুরীর তিনপুত্র যথাক্রমে এবিএম এজহার মিঞা, অ্যাডভোকেট একেএম এমদাদুল ইসলাম ও এএমএম শহীদুল্লা। অ্যাডভোকেট এমদাদুল ইসলাম প্রথম জীবনে শিক্ষকতা ও পরে চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশায় নিযুক্ত হয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি একাধারে রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, লেখক ও সুশীল সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। এএমএম শহীদুল্লাহ ষাটের দশকের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা। সাপ্তাহিক ‘প্রতিরোধ’ নামে একটি পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতেন। নুরুল আলম চৌধুরীর পঞ্চম খালা সায়রা খাতুন-তাঁর একমাত্র পুত্র মোহাম্মদ মুসা চৌধুরী পশ্চিম ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

ষাটের দশকে চট্টগ্রামের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যেন নক্ষত্রের মেলা বসে গিয়েছিলো। সেই দশককে দু’ভাগ করে বিচার করাই সমীচীন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল একভাগ এবং ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের ছাত্র রাজনীতিকে দ্বিতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত করে আমি বিচার করতে চাই। ৬০-৬৪-এই চার বছরের মধ্যে প্রথম দেড় বছর মোটামুটি সামরিক শাসনের বৃত্তে আবদ্ধ ছিলো। উক্ত সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের ছাত্র রাজনীতিতে যাঁদের হাত ধরে ছাত্রলীগের নবজন্ম হয়েছিলো, তাঁরা পিতৃত্বের আসন দাবি করতেই পারেন। তাঁদের কথা একবার এখানে বলে নেয়া যাক, এম এ মান্নান, শহীদ মুরিদুল আলম, ফেরদৌস কোরেশী, আবু ছালেহ, আবদুর রউফ খালেদ-এই পঞ্চপাÐবকে যদি পথিকৃতের মর্যাদা দিতে হয়, তাহলে তাঁদের পেছনে পেছনে ধুলি উড়িয়ে অশ্ব ছুটিয়ে আসেন যে সপ্ত ঘোড়সওয়ারÑকফিলউদ্দিন, অধ্যক্ষ শায়েস্তা খান, বখতেয়ার কামাল, অধ্যক্ষ হারুনুর রশিদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, লোকমানুল মাহমুদ, আবুল কালাম আজাদ (অ্যাডভোকেট), তাঁদের কথাও ভুলে যাই কি করে?

৬৪ থেকে অনেক নাম ভিড় করে আসে- চাকসুর প্রথম ভিপি ইব্রাহিম ও প্রথম জিএস শহীদ আবদুর রব, আশরাফ খান, নুরুন্নবী চৌধুরী, মির্জা আবু মনসুর, নুরুল আলম চৌধুরী, ইদরিস আলম, এসএম ইউসুফ, গোলাম রব্বান, কাজী আবু জাফর, সুলতান উল কবির চৌধুরী, হাজি কামাল, এমনি অনিঃশেষ কত নাম। এই নক্ষত্রমন্ডলীর মধ্যে অবস্থান করে যে নক্ষত্রটি স্বকীয় দীপ্তিতে স্বতন্ত্র প্রভায় সমুজ্জল হয়ে বিরাজ করতো সেই নক্ষত্রের নাম নুরুল আলম চৌধুরী।

ষাট দশকের এই ছাত্র নেতাদের মধ্য থেকেই উদ্ভব হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির, পরিণামে যা স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাবকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলো। নুরুল আলম চৌধুরীকে আমি প্রথমত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রাজপথের একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবে শনাক্ত করি। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য তিনি এত আকুল হয়ে উঠেছিলেন যে, ’৭১-এর ছাব্বিশ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর কোত্থেকে নুরুল আলম চৌধুরী সেই ঘোষণা প্রচারের জন্য একটি ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কাকডাকা ভোরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডে মাইক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করতে করতে তাঁকে কালুরঘাট সেতু অতিক্রম করতে দেখেন তাঁরই এক সহকর্মী।

নুরুল আলম চৌধুরী একজন সুস্থ ধারার পরিশীলিত রাজনীতিক ছিলেন। তিনি কড়া ইস্ত্রি করা পাজামা পাঞ্জাবি পড়তেন। সেটা তাঁর দেহের শুভ্রতা প্রকাশ করতো, কিন্তু তিনি যে মনেও রাজহংসের মতো শুভ্র সুন্দর ছিলেন, সেটাই মনে পড়ে বেশি। সমসাময়িক ছাত্রনেতা, যাঁদের সঙ্গে তিনি চব্বিশ ঘণ্টা চলাফেরা, ওঠাবসা করতেন, যেমন ইদরিস আলম (তাঁরা পরস্পরকে খালাতো ভাই বলে সম্বোধন করতেন), এস এম ইউসুফ, বদি-বদন-নুর মোহাম্মদ চৌধুরী, আশরাফ খানÑরাজনীতিতে সাধনা ও সিদ্ধিতে তাঁর এসব বন্ধুকে তিনি ছাড়িয়ে ছাপিয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিলেন। তিনি দু’দু’বার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁর কোন বন্ধু সেটা হতে পারেননি। শুধু সুলতান ভাই একবার বাঁশখালী থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রদূত হয়ে বিদেশে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাঁর বন্ধুদের কেউ সেটা হননি। তিনি একাই শুধু তাঁর জেলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
নুরুল আলম চৌধুরীরা রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন ষাটের দশকের প্রথমভাগে। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলেজে ভর্তি হন। কলেজের ছাত্র হওয়ার পর থেকেই তাঁর চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত হতে থাকে এবং তাঁর রাজনৈতিক বিস্তার পরিপক্ক হয়ে উঠতে থাকে। মুসলিম হাইস্কুলে অধ্যয়নের সময় থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ইদরিস আলম, জহুর আহমদ চৌধুরীর পুত্র শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীরাও একই সময়ে মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাজের মাঝে ছাত্রলীগের রাজনীতি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সিরাজ ভাই (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) আর নুরুল আলম চৌধুরী প্রথম কমিটি গঠন করে সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। ফলও পেয়েছিলেন হাতে হাতে। প্রথম নির্বাচনে ছাত্রলীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। বাকলিয়ার বিখ্যাত মৌলভী সাহেবের বংশের ইব্রাহিম ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদের (চাকসু) ভিপি বা সহ সভাপতি ও শহরের এনায়েত বাজার স্টেশন কলোনির আবদুর রব (মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে যাওয়ার পথে ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর এম্বুশে পড়ে আবদুর রব, সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী ও শেখ মোজাফফর আহমদ শাহাদাত বরণ করেন।) সাধারণ সম্পাদক বা জিএস নির্বাচিত হন। কিন্তু ২য় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ছাত্রলীগকে চাকসু নির্বাচনে জিততে হয়েছিলো। সেই ক্যাবিনেট হীরা-মান্না পরিষদ নামে প্রসিদ্ধ। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অনেক ছাত্রনেতা। মোবারক ভাই, রব্বান ভাই, ইদ্রিস ভাই, ফজলু ভাই, শফিউল বশর ভাই, ইউনুস ভাই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিনেট নির্বাচনে নুরুল আলম ভাইয়ের প্যানেল বিজয়ী হয়। তাঁদের প্যানেলের দপ্তর খোলা হয়েছিলো ইসলামাবাদ টাউন কোপারেটিভ ব্যাংক ভবনের দোতলায় অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আমিন চৌধুরীর বাসায়। আমিন সাহেব ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র। তাঁদের প্যানেলের প্রার্থীদের ক্রিডেনসিয়াল লেখার দায়িত্ব পড়েছিলো আমার ওপর। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে জমজমাট আসরে হাজির থাকতেন-নুরুল আলম ভাই, ইব্রাহিম ভাই (চাকসুর প্রথম ভিপি), শহীদুল আমিন ও মঞ্জুরুল আমিন চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়, হুমায়ুন ভাই (আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী), মঈনু ভাই- ইফতি ভাই ভ্রাতৃদ্বয়, মোছলেম ভাই, তাজুল ভাই প্রভৃতি। সেই সময় নুরুল আলম ভাই’র চরিত্রের খোলামেলা, দরবারি রূপটি প্রকটিত হয়েছিলো। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন (১৯৬৬-৬৯)। তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে ২য় শ্রেণি পেয়ে এম,এ পাস করেন। কিন্তু পাস করেও আমলার চাকরিতে যোগদানে তাঁর প্রবৃত্তি হয়নি।

মরহুম নুরুল আলম চৌধুরীর জীবন একজন আদর্শবান, ত্যাগী, পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত রাজনীতিকের ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। দল ও আদর্শের জন্য এমন অবিচলিত, আপসহীন, সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন মানুষ, নিঃস্বার্থপ্রাণ নেতা-যে কোন দলের জন্য শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিলো তাঁর অগাধ আস্থা, নিঃশর্ত ভালোবাসা ও প্রশ্নাতীত আনুগত্য; প্রয়োজন হলে চোখ বন্ধ করে যেকোন মুহূর্তে নির্দ্বিধায় নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিতে পারতেন তিনি।

নুরুল আলম চৌধুরীরা দল ও দেশের জন্য কত বড় অ্যাসেট ছিলেন, সেটা কিভাবে বুঝাবো আমি বুঝতে পারছি না। আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিনে, জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহ মাড়িয়ে যখন ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য বেঈমান খোন্দকার মুশতাক বঙ্গভবনে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলা, তখন দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিমিনাল ল’ইয়ার কসবার এমপি সিরাজুল হক (বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পিতা) ছাড়া একমাত্র চট্টগ্রামের তরুণ এমপি নুরুল আলম চৌধুরীর চোখ ও কণ্ঠ থেকে তখন ক্রোধের অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিলো। সেই বৈরী সময়ে যখন বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণ নিষিদ্ধ সংলাপে পর্যবসিত হতো, তখন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, নুরুল আলম চৌধুরী, এসএম ইউসুফ, মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর ন্যায় অঙ্গুলিমেয় ক’জন নেতাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পতাকা উড্ডীন রেখেছিলেন।

নুরুল আলম চৌধুরী প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ পাকিস্তান বিমান বাহিনী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উপর বিমান আক্রমণ করলে বেতার কেন্দ্রটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ফলে বেতার কেন্দ্রটিকে চট্টগ্রাম থেকে রামগড় হয়ে ভারতের আগরতলায় নিয়ে যেতে তার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। নুরুল আলম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে ভারতে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি আর ইদরিস আলম লেম্বুছড়ায় রাইফেল, এস এল আর, স্টেশনগান চালানো এবং গ্রেনেড ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাঁদেরকে রাইফেল খোল্না, জোড়্না, পুল ফ্র মারা ইত্যাদি শেখানো হয়। পরে তাঁদেরকে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে রাজনৈতিক ক্লাস গ্রহণ করে শরণার্থীদের যুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ ক্লাস নিতে হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে প্রথমবারের মত স্বতন্ত্র নির্বাচিত এলাকা হিসেবে ঘোষিত ফটিকছড়ি আসন থেকে তাঁকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে দেশের কনিষ্ঠ সাংসদ হিসেবে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দেও সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তাঁকে ফটিকছড়ি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এসময় তিনি বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত হন। তিন জোটের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নুরুল আলম চৌধুরী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এসময় তিনি অত্যাচার-নির্যাতনের সম্মুখিন হন।

নুরুল আলম চৌধুরী ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি সেখানে তিন বছর অত্যন্ত সুনামের সাথে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রূপালী ব্যাংকে সরকারের নিযুক্ত পরিচালক হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেন। নুরুল আলম চৌধুরী প্রথিতযশা আইনজীবী অ্যাডভোকেট বদরুল হক খানের একমাত্র কন্যা মনফুজা খাতুন রোজিকে বিয়ে করেন। তাঁদের ২ পুত্র, ১ কন্যা। জনাব নুরুল আলম চৌধুরীর পুত্র-কন্যারাও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন এবং ইতিমধ্যে ফটিকছড়ি থানা ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাঁদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন।

নুরুল আলম চৌধুরীর সন্তানদের মধ্যে কন্যা বড়, তাঁর নাম তানজিনা জামান চৌধুরী। তিনি ইউএসটিসি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স কোর্স সম্পন্ন করেছেন। চট্টগ্রামের একটি প্রধান ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও রাজনৈতিক পরিবারে তাঁর বিয়ে হয়েছে। দেশখ্যাত শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, সাবেক এমপি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সাবেক সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু তাঁর শ্বশুর। জনাব বাবুর কনিষ্ঠ পুত্র জামান গ্রæপ, আরামিট গ্রুপ ও ইউসিবিএল-এর সম্মানিত পরিচালক, দানবীর ও শিল্পপতি আসিফুজ্জামান চৌধুরী জিমি তানজিনার বর। জনাব আসিফুজ্জামান চৌধুরী জিমি পারিবারিক ঐতিহ্যের দ্বারায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর জেঠা বশরুজ্জামান চৌধুরী চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ, তাঁর পিতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। তাঁর চাচা বশরুজ্জামান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেন। তাঁর বড় ভাই সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা এবং বাংলাদেশ সরকারের ভূমিমন্ত্রী। জিমির মেজ ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রণি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক, জামান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ইউসিবিএল নির্বাহী পরিষদের চেয়ারম্যান।

মরহুম চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র সাবেকুন রাহাত জিসান- বিবিএ, এমবিএ তাসমেনিয়া ইউনিভার্সিটি অব অস্ট্রেলিয়া থেকে এমবিএ পাস করেছেন। তিনি কানাডায় বসবাস করলেও তিনি সেখানে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের নানা কাজকর্মে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তাঁর স্ত্রী ফাতেমা হাসান নাওমী, শ্বশুর চন্দনাইশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাসান, বহুদিন যাবত সপরিবারে কানাডায় থাকেন।
মরহুম চৌধুরীর দ্বিতীয় পুত্র কনিষ্ঠ পুত্র হাসিবুন সুহাদ চৌধুরী সাকিব নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ পাস করেছেন। চট্টগ্রাম মহানগরের সুবৃহৎ অ্যাপার্টমেন্ট কাম মার্কেট কমপ্লেক্স ভিআইপি টাওয়ারের স্বত্তাধিকারী জনাব আবুল হোসেনের কন্যাকে সাকিব বিয়ে করেছেন। জনাব হাসিবুন সুহাদ চৌধুরী সাকিব ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সদস্য।

নুরুল আলম চৌধুরী ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি প্রয়াত হন।

নুরুল আলম চৌধুরী ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে ফটিকছড়ি থানার চাড়ালিয়া হাট ইউনিয়নের গোপালঘাটা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত চৌধুরী বংশে জন্মগ্রহণ করেন। নুরুল আলম চৌধুরীর পিতার নাম আলহাজ মতিউর রহমান চৌধুরী, মাতার নাম ওয়াজুন্নেসা খাতুন। তাঁরা চার ভাই, সকলেই উচ্চ শিক্ষিত। ভ্রাতাদের মধ্যে প্রথম আহমদ কবির চৌধুরী ছিলেন প্রসিদ্ধ বীমাবিদ, দ্বিতীয় আহমদ দবীর চৌধুরী ছিলেন নামকরা ডাক্তার, তৃতীয় মাহবুবুল আলম চৌধুরী ছিলেন বিদেশি ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত, চতুর্থ নুরুল আলম চৌধুরী। ডা. দবির আহমদের পুত্র ডা. মহসিন চৌধুরী পলাশও চিকিৎসক, তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (পিজি হাসপাতাল) কর্মরত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সাবেক সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের পুত্রের সঙ্গে তাঁর কন্যার বিয়ে হয়েছে।

নুরুল আলম চৌধুরীর নানার বাড়ি ফটিকছড়ি থানার শাহনগর, নানার নাম সুলতান আহমদ চৌধুরী। তিনি জমিদার ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কাঠের দোতলা বাড়ি ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আহমদ চৌধুরীর পিতা নুর আলী চৌধুরী তৈরি করেন। তাঁর বড় ভাই মোখলেছুর রহমান চৌধুরী বার্মায় অগাধ অর্থ রোজগার করেন। তাঁর বড় ছেলে আদালত খান চট্টগ্রামের প্রবাদ পুরুষ। তিনি সম্পর্কে নুরুল আলম চৌধুরীর মামা। নুরুল আলম চৌধুরীর নানা সুলতান আহমদ চৌধুরীর দুই পুত্র ও সাত কন্যা। পুত্রদ্বয় মোহাম্মদ ইসলাম চৌধুরী ও জাকিরুল হক চৌধুরী। তাঁর সাতকন্যার প্রথম নুরুল আলম চৌধুরীর মাতা ওয়াজুন্নেসা খাতুন। সুলতান আহমদ চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা ও নুরুল আলম চৌধুরীর খালা জোলায়খা বেগম চৌধুরীর তিনপুত্র যথাক্রমে এবিএম এজহার মিঞা, অ্যাডভোকেট একেএম এমদাদুল ইসলাম ও এএমএম শহীদুল্লা। অ্যাডভোকেট এমদাদুল ইসলাম প্রথম জীবনে শিক্ষকতা ও পরে চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশায় নিযুক্ত হয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি একাধারে রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, লেখক ও সুশীল সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। এএমএম শহীদুল্লাহ ষাটের দশকের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা। সাপ্তাহিক ‘প্রতিরোধ’ নামে একটি পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতেন। নুরুল আলম চৌধুরীর পঞ্চম খালা সায়রা খাতুন-তাঁর একমাত্র পুত্র মোহাম্মদ মুসা চৌধুরী পশ্চিম ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

ষাটের দশকে চট্টগ্রামের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যেন নক্ষত্রের মেলা বসে গিয়েছিলো। সেই দশককে দু’ভাগ করে বিচার করাই সমীচীন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল একভাগ এবং ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের ছাত্র রাজনীতিকে দ্বিতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত করে আমি বিচার করতে চাই। ৬০-৬৪-এই চার বছরের মধ্যে প্রথম দেড় বছর মোটামুটি সামরিক শাসনের বৃত্তে আবদ্ধ ছিলো। উক্ত সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের ছাত্র রাজনীতিতে যাঁদের হাত ধরে ছাত্রলীগের নবজন্ম হয়েছিলো, তাঁরা পিতৃত্বের আসন দাবি করতেই পারেন। তাঁদের কথা একবার এখানে বলে নেয়া যাক, এম এ মান্নান, শহীদ মুরিদুল আলম, ফেরদৌস কোরেশী, আবু ছালেহ, আবদুর রউফ খালেদ-এই পঞ্চপাÐবকে যদি পথিকৃতের মর্যাদা দিতে হয়, তাহলে তাঁদের পেছনে পেছনে ধুলি উড়িয়ে অশ্ব ছুটিয়ে আসেন যে সপ্ত ঘোড়সওয়ারÑকফিলউদ্দিন, অধ্যক্ষ শায়েস্তা খান, বখতেয়ার কামাল, অধ্যক্ষ হারুনুর রশিদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, লোকমানুল মাহমুদ, আবুল কালাম আজাদ (অ্যাডভোকেট), তাঁদের কথাও ভুলে যাই কি করে?

৬৪ থেকে অনেক নাম ভিড় করে আসে- চাকসুর প্রথম ভিপি ইব্রাহিম ও প্রথম জিএস শহীদ আবদুর রব, আশরাফ খান, নুরুন্নবী চৌধুরী, মির্জা আবু মনসুর, নুরুল আলম চৌধুরী, ইদরিস আলম, এসএম ইউসুফ, গোলাম রব্বান, কাজী আবু জাফর, সুলতান উল কবির চৌধুরী, হাজি কামাল, এমনি অনিঃশেষ কত নাম। এই নক্ষত্রমন্ডলীর মধ্যে অবস্থান করে যে নক্ষত্রটি স্বকীয় দীপ্তিতে স্বতন্ত্র প্রভায় সমুজ্জল হয়ে বিরাজ করতো সেই নক্ষত্রের নাম নুরুল আলম চৌধুরী।

ষাট দশকের এই ছাত্র নেতাদের মধ্য থেকেই উদ্ভব হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির, পরিণামে যা স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাবকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলো। নুরুল আলম চৌধুরীকে আমি প্রথমত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রাজপথের একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবে শনাক্ত করি। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য তিনি এত আকুল হয়ে উঠেছিলেন যে, ’৭১-এর ছাব্বিশ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর কোত্থেকে নুরুল আলম চৌধুরী সেই ঘোষণা প্রচারের জন্য একটি ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কাকডাকা ভোরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডে মাইক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করতে করতে তাঁকে কালুরঘাট সেতু অতিক্রম করতে দেখেন তাঁরই এক সহকর্মী।

নুরুল আলম চৌধুরী একজন সুস্থ ধারার পরিশীলিত রাজনীতিক ছিলেন। তিনি কড়া ইস্ত্রি করা পাজামা পাঞ্জাবি পড়তেন। সেটা তাঁর দেহের শুভ্রতা প্রকাশ করতো, কিন্তু তিনি যে মনেও রাজহংসের মতো শুভ্র সুন্দর ছিলেন, সেটাই মনে পড়ে বেশি। সমসাময়িক ছাত্রনেতা, যাঁদের সঙ্গে তিনি চব্বিশ ঘণ্টা চলাফেরা, ওঠাবসা করতেন, যেমন ইদরিস আলম (তাঁরা পরস্পরকে খালাতো ভাই বলে সম্বোধন করতেন), এস এম ইউসুফ, বদি-বদন-নুর মোহাম্মদ চৌধুরী, আশরাফ খান রাজনীতিতে সাধনা ও সিদ্ধিতে তাঁর এসব বন্ধুকে তিনি ছাড়িয়ে ছাপিয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিলেন। তিনি দু’দু’বার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁর কোন বন্ধু সেটা হতে পারেননি। শুধু সুলতান ভাই একবার বাঁশখালী থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রদূত হয়ে বিদেশে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাঁর বন্ধুদের কেউ সেটা হননি। তিনি একাই শুধু তাঁর জেলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
নুরুল আলম চৌধুরীরা রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন ষাটের দশকের প্রথমভাগে। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলেজে ভর্তি হন। কলেজের ছাত্র হওয়ার পর থেকেই তাঁর চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত হতে থাকে এবং তাঁর রাজনৈতিক বিস্তার পরিপক্ক হয়ে উঠতে থাকে। মুসলিম হাইস্কুলে অধ্যয়নের সময় থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ইদরিস আলম, জহুর আহমদ চৌধুরীর পুত্র শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীরাও একই সময়ে মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাজের মাঝে ছাত্রলীগের রাজনীতি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সিরাজ ভাই (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) আর নুরুল আলম চৌধুরী প্রথম কমিটি গঠন করে সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। ফলও পেয়েছিলেন হাতে হাতে। প্রথম নির্বাচনে ছাত্রলীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। বাকলিয়ার বিখ্যাত মৌলভী সাহেবের বংশের ইব্রাহিম ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদের (চাকসু) ভিপি বা সহ সভাপতি ও শহরের এনায়েত বাজার স্টেশন কলোনির আবদুর রব (মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে যাওয়ার পথে ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর এম্বুশে পড়ে আবদুর রব, সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী ও শেখ মোজাফফর আহমদ শাহাদাত বরণ করেন।) সাধারণ সম্পাদক বা জিএস নির্বাচিত হন। কিন্তু ২য় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ছাত্রলীগকে চাকসু নির্বাচনে জিততে হয়েছিলো। সেই ক্যাবিনেট হীরা-মান্না পরিষদ নামে প্রসিদ্ধ। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অনেক ছাত্রনেতা। মোবারক ভাই, রব্বান ভাই, ইদ্রিস ভাই, ফজলু ভাই, শফিউল বশর ভাই, ইউনুস ভাই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিনেট নির্বাচনে নুরুল আলম ভাইয়ের প্যানেল বিজয়ী হয়। তাঁদের প্যানেলের দপ্তর খোলা হয়েছিলো ইসলামাবাদ টাউন কোপারেটিভ ব্যাংক ভবনের দোতলায় অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আমিন চৌধুরীর বাসায়। আমিন সাহেব ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র। তাঁদের প্যানেলের প্রার্থীদের ক্রিডেনসিয়াল লেখার দায়িত্ব পড়েছিলো আমার ওপর। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে জমজমাট আসরে হাজির থাকতেন-নুরুল আলম ভাই, ইব্রাহিম ভাই (চাকসুর প্রথম ভিপি), শহীদুল আমিন ও মঞ্জুরুল আমিন চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়, হুমায়ুন ভাই (আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী), মঈনু ভাই- ইফতি ভাই ভ্রাতৃদ্বয়, মোছলেম ভাই, তাজুল ভাই প্রভৃতি। সেই সময় নুরুল আলম ভাই’র চরিত্রের খোলামেলা, দরবারি রূপটি প্রকটিত হয়েছিলো।

তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন (১৯৬৬-৬৯)। তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে ২য় শ্রেণি পেয়ে এম,এ পাস করেন। কিন্তু পাস করেও আমলার চাকরিতে যোগদানে তাঁর প্রবৃত্তি হয়নি।

মরহুম নুরুল আলম চৌধুরীর জীবন একজন আদর্শবান, ত্যাগী, পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত রাজনীতিকের ধ্রæপদী দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। দল ও আদর্শের জন্য এমন অবিচলিত, আপসহীন, সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন মানুষ, নিঃস্বার্থপ্রাণ নেতা-যে কোন দলের জন্য শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিলো তাঁর অগাধ আস্থা, নিঃশর্ত ভালোবাসা ও প্রশ্নাতীত আনুগত্য; প্রয়োজন হলে চোখ বন্ধ করে যেকোন মুহূর্তে নির্দ্বিধায় নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিতে পারতেন তিনি।

নুরুল আলম চৌধুরীরা দল ও দেশের জন্য কত বড় অ্যাসেট ছিলেন, সেটা কিভাবে বুঝাবো আমি বুঝতে পারছি না। আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিনে, জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহ মাড়িয়ে যখন ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য বেঈমান খোন্দকার মুশতাক বঙ্গভবনে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলা, তখন দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিমিনাল ল’ইয়ার কসবার এমপি সিরাজুল হক (বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পিতা) ছাড়া একমাত্র চট্টগ্রামের তরুণ এমপি নুরুল আলম চৌধুরীর চোখ ও কণ্ঠ থেকে তখন ক্রোধের অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিলো। সেই বৈরী সময়ে যখন বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণ নিষিদ্ধ সংলাপে পর্যবসিত হতো, তখন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, নুরুল আলম চৌধুরী, এসএম ইউসুফ, মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর ন্যায় অঙ্গুলিমেয় ক’জন নেতাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পতাকা উড্ডীন রেখেছিলেন।

নুরুল আলম চৌধুরী প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মকাÐের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ পাকিস্তান বিমান বাহিনী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উপর বিমান আক্রমণ করলে বেতার কেন্দ্রটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ফলে বেতার কেন্দ্রটিকে চট্টগ্রাম থেকে রামগড় হয়ে ভারতের আগরতলায় নিয়ে যেতে তার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। নুরুল আলম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে ভারতে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি আর ইদরিস আলম লেম্বুছড়ায় রাইফেল, এস এল আর, স্টেশনগান চালানো এবং গ্রেনেড ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাঁদেরকে রাইফেল খোল্না, জোড়্না, পুল ফ্র মারা ইত্যাদি শেখানো হয়। পরে তাঁদেরকে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে রাজনৈতিক ক্লাস গ্রহণ করে শরণার্থীদের যুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ ক্লাস নিতে হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে প্রথমবারের মত স্বতন্ত্র নির্বাচিত এলাকা হিসেবে ঘোষিত ফটিকছড়ি আসন থেকে তাঁকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে দেশের কনিষ্ঠ সাংসদ হিসেবে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দেও সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তাঁকে ফটিকছড়ি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এসময় তিনি বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত হন। তিন জোটের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নুরুল আলম চৌধুরী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এসময় তিনি অত্যাচার-নির্যাতনের সম্মুখিন হন।

নুরুল আলম চৌধুরী ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি সেখানে তিন বছর অত্যন্ত সুনামের সাথে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রূপালী ব্যাংকে সরকারের নিযুক্ত পরিচালক হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেন।

নুরুল আলম চৌধুরী প্রথিতযশা আইনজীবী অ্যাডভোকেট বদরুল হক খানের একমাত্র কন্যা মনফুজা খাতুন রোজিকে বিয়ে করেন। তাঁদের ২ পুত্র, ১ কন্যা। জনাব নুরুল আলম চৌধুরীর পুত্র-কন্যারাও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন এবং ইতিমধ্যে ফটিকছড়ি থানা ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাঁদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন। নুরুল আলম চৌধুরীর সন্তানদের মধ্যে কন্যা বড়, তাঁর নাম তানজিনা জামান চৌধুরী। তিনি ইউএসটিসি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স কোর্স সম্পন্ন করেছেন। চট্টগ্রামের একটি প্রধান ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও রাজনৈতিক পরিবারে তাঁর বিয়ে হয়েছে। দেশখ্যাত শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, সাবেক এমপি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সাবেক সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু তাঁর শ্বশুর। জনাব বাবুর কনিষ্ঠ পুত্র জামান গ্রুপ, আরামিট গ্রুপ ও ইউসিবিএল-এর সম্মানিত পরিচালক, দানবীর ও শিল্পপতি আসিফুজ্জামান চৌধুরী জিমি তানজিনার বর। জনাব আসিফুজ্জামান চৌধুরী জিমি পারিবারিক ঐতিহ্যের দ্বারায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর জেঠা বশরুজ্জামান চৌধুরী চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ, তাঁর পিতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। তাঁর চাচা বশরুজ্জামান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেন। তাঁর বড় ভাই সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা এবং বাংলাদেশ সরকারের ভূমিমন্ত্রী। জিমির মেজ ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রণি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক, জামান গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ইউসিবিএল নির্বাহী পরিষদের চেয়ারম্যান।

মরহুম চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র সাবেকুন রাহাত জিসান- বিবিএ, এমবিএ তাসমেনিয়া ইউনিভার্সিটি অব অস্ট্রেলিয়া থেকে এমবিএ পাস করেছেন। তিনি কানাডায় বসবাস করলেও তিনি সেখানে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের নানা কাজকর্মে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তাঁর স্ত্রী ফাতেমা হাসান নাওমী, শ্বশুর চন্দনাইশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাসান, বহুদিন যাবত সপরিবারে কানাডায় থাকেন।
মরহুম চৌধুরীর দ্বিতীয় পুত্র কনিষ্ঠ পুত্র হাসিবুন সুহাদ চৌধুরী সাকিব নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ পাস করেছেন। চট্টগ্রাম মহানগরের সুবৃহৎ অ্যাপার্টমেন্ট কাম মার্কেট কমপ্লেক্স ভিআইপি টাওয়ারের স্বত্তাধিকারী জনাব আবুল হোসেনের কন্যাকে সাকিব বিয়ে করেছেন। জনাব হাসিবুন সুহাদ চৌধুরী সাকিব ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সদস্য। নুরুল আলম চৌধুরী ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি প্রয়াত হন।

লেখক: নাসিরুদ্দিন চৌধুরী,প্রবীন সাংবাদিক ও কলামিস্ট