নাসিরুদ্দিন চৌধুরী: ইদরিস আলম সরস্বতীর বরপুত্র ছিলেন, রাজনীতির রাস্তায় না হেঁটে সারস্বত সাধনা করলে তাঁর সিদ্ধি অনিবার্য ছিলো। তাঁর রাজনীতিতে দেশ উপকৃত হয়েছে, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করলেই বুঝি তিনি নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের স্ফূর্তি যে কলম চালনাতেই নিহিত ছিলো, তা তো নিজেই প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন শেষ জীবনে সংবাদপত্রে লেখা কলামে।

বৈঠকী ঢংয়ে প্রাঞ্জল অথচ ওজো-গুণ সম্পন্ন গদ্যে কী অমিত বিক্রমে তিনি লিখেছিলেন‘আমরা তখন যুদ্ধে’ এবং জয় করে নিলেন পাঠকচিত্ত। অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো সেই কলাম। নব্বইয়ের দশকে যখন দৈনিক পূর্বকোণে ধারাবাহিকভাবে এই লেখাগুলো প্রকাশিত হচ্ছিলো, তখন হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিলো। প্রথম দিকে সপ্তাহে একদিন শনিবার এবং পরে পাঠকের দাবিতে শনি ও বৃহস্পতিবার দু’দিন তাঁর কলাম প্রকাশিত হতো। শুধু ইদরিস আলমের কলামের জন্য এই দু’দিন পূর্বকোণের কাটতি বেড়ে গিয়েছিলো। কারো লেখার জন্য পত্রিকার সার্কুলেশন বৃদ্ধি পেতে পারে, এমন দৃষ্টান্ত তো বাংলাদেশে আর একটিই মেলে তিনি হচ্ছেন স্বনামখ্যাত লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী। নব্বইয়ের পরের কথা বলছি আমি। মৃত্যু এসে তাঁর জীবনের ওপর অকালে যবনিকা টেনে দেয়ায় ইদরিস আলমের কলামের অমিয় সুধা থেকে চট্টগ্রামের সংবাদপত্র পাঠক সমাজ চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হয়ে যান; আজো তাদের কন্ঠে অতৃপ্তির হাহাকার ধ্বনিত হয়।

চট্টগ্রামের পত্রিকায় সেই বোধ হয় প্রথম কলামের চল্ হলো। হতে পারে তার আগে কেউ কেউ কলাম লিখেছেন; কিন্তু ‘কলামিস্ট’ আখ্যা বোধ হয় চট্টগ্রামে প্রথম ইদরিস আলমই পেয়েছেন। পূর্বকোণে কলাম লেখার পর থেকে ইদরিস আলমের নামের সাথে ‘কলামিস্ট’ শব্দটা এমনভাবে জুড়ে যায় যে এরপর থেকে কলামিস্ট বলেই তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিতে হতো। তো পূর্বকোণে প্রকাশিত ইদরিস আলমের সেই কলাম অভিন্ন শিরোনামে, তাঁর মৃত্যুর সাত বছর পর, গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখার হাত ছিলো, সেজন্যে সময় পেলে কলম নিয়ে লিখতে বসে যেতেন। এমনি করে জমে উঠলো লেখার স্তপ; পত্রিকা অফিসে যান কিন্তু কষ্ট করে কেউ ছাপতে রাজি হল না। এমন সময় আমার সাথে যোগাযোগ। আমি তখন দৈনিক পূর্বকোণের বার্তা সম্পাদক; বার্তা বিভাগের পাশাপাশি সপ্তাহে দু’টি ফিচার পাতা সম্পাদনার দায়িত্ব চেপেছিলো আমার কাঁধে।

নতুন পত্রিকা, ভাবা হচ্ছিলো নতুন কিছু করে চমকে দেবার কথা। এমন সময় হাতে এলো ইদরিস আলমের লেখা; পড়ে নড়ে চড়ে বসলাম। মনে হলো পেয়ে গেছি যা চেয়েছিলাম। বিস্ফোরক মন্তব্যে ঠাসা প্রতিটি লেখা যেন এক একটি তাজা বোমা। বুঝতে পারলাম ছাপানোর সমস্যা কোথায়।

ইদরিস আলম কবিতা লেখেন জানতাম, পড়েছিও; কিন্তু তাঁর গদ্যের সাথে আমার বিশেষ পরিচয় ছিলো না। এখন পড়ে আমি অভিভূত। তাঁর গদ্যের অদ্ভুত আকর্ষণ; পড়তে পড়তে নেশা ধরে যায়, একবার পড়তে বসলে শেষ না করে ওঠা যায় না। তিনি বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখেছেন, স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ফুঁড়ে পাঠকদের জন্য আনন্দের উপকরণ আহরণ করেছেন, সেজন্যে ‘অগম্যাগমনেও’ আপত্তি নেই, অর্থাৎ অতএব তাঁকে সর্বত্রগামী বলাই সঙ্গত। কথায় কথায় কবিতা, বয়েৎ, রুবাইয়াত ভিড় করে আসে।

শাস্ত্র-পুরাণ-পুঁথি, কোরান-হাদিস, গীতা-বেদ, বাইবেল, ত্রিপিঠক ঘেঁটে হাজির করেন সাক্ষী সাবুদ; ফেরদৌসী, জামি, রুমী, সাদী, হাফিজ, খৈয়াম, গালিব, প্রেমচাঁদ, কৃষণ চন্দর, আলাওল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ-কে নেই সেই আসরে। তিনি কী নাম দিয়েছিলেন, এতদিন পর তা আমার মনে নেই, হয়তো প্রত্যেক প্রবন্ধের ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিলো। আসলে প্রবন্ধই তিনি লিখেছিলেন। তখন আমাদের সামনে আদর্শ আবদুল গাফফার চৌধুরীর তীক্ষধার কলাম আর খোন্দকার আবদুল হামিদের হুল ফুটানো কলাম। আরো পিছিয়ে গেলে পাওয়া যাবে মোসাফির-খ্যাত তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কলাম, ভিমরুল-খ্যাত আহমেদুর রহমানের ‘মিঠেকড়া’ এবং আবদুল গণি হাজারীর ‘কালো পেঁচার ডাইরি’। সেসব তো ঢাকার কথা।

চট্টগ্রামে একটি রাজনৈতিক কলাম চালু করার প্রবল ইচ্ছা চাগিয়ে উঠলো আমার অন্তরে। সম্পাদক এবং পত্রিকা কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেতে অসুবিধা হলো না। অতঃপর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখিত প্রবন্ধগুলি বাছাই করে পাঠকের পাতে পরিবেশন করলাম ইদরিস আলমের কলাম ‘আমরা তখন যুদ্ধে’। ওদিকে তখন বেধে গেছে মহা হাঙ্গামা, চট্টগ্রাম তোলপাড়। ভীষণ চাঞ্চল্য, নড়াচড়া টের পাওয়া গেল রাজনৈতিক মহলে।

তিনি তো লিখে খালাস, কিন্তু আমার হলো মুস্কিল। তাঁর যতো স্বস্তি, আমার ততো অস্বস্তি। ভিমরুলের চাকে ঢিল মারা হয়ে যাবার পর দলে দলে বেরিয়ে পড়া বোলতা যাদের কামড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেললো, তাদের শুশ্রষা আমাকেই করতে হয়েছিলো। তাঁর যেমন ফোঁড়ন-কাটা স্বভাব, সময়-অসময় নেই, স্থান-কাল-পাত্র ভেদ বুঝে সম্ঝে কথা বলতে বইয়েই গেছে তাঁর; যখন যাকে ধরেন, তাকে ব্যঙ্গ বিদ্রপের তী্ঙ্কন বাণে ফালা ফালা করে ফেলেন। এতো গদ্য নয়, গদ্যের গদা। কলম নয়, লেখক যেন গদা চালিয়েছেন । তাতে অনেকের মাথা ফেটে রক্তারক্তি কান্ড। অন্যায়, অনিয়ম, অসত্য, অসুন্দরের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম; দু’চোখে দেখতে পারেন না ভন্ড, প্রতারক, কপট, দুরাচার, দুরাত্মাকে; মাঝে মাঝে নিজের ওপরও খড়গহস্ত হয়ে ওঠেন, তখন নিজেকে নিয়েও পরিহাস করে মনের ঝাল মেটান। যেমন বিদ্যাসাগর ঠাট্টা করেছেন, নিজের জন্ম বৃত্তান্ত পরিবেশ করতে গিয়ে।

ইদরিস আলমের ইচ্ছা ছিলো লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশ করবেন। কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছা যেমন পূর্ণ হয় না, ইদরিস আলমের এই ইচ্ছাটিও অপূর্ণ থেকে গিয়েছিলো। সেটি পূর্ণ হলো তিনি গত হওয়ার পর, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের উদযোগ-আয়োজনে। বিশেষত কনিষ্ঠ পুত্র ইফতেখার আলম জাহেদ এই গ্রন্থ প্রকাশের জন্য যে যত্ন ও শ্রম দিয়েছেন, তা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। পিতার লেখাই যে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একমাত্র ধন, যার স্থায়ী মূল্য আছে, তা এই পুত্রটি ভালোই বুঝে। বস্তুগত সম্পদ যেমন টাকা, জমিজমা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা, বিলাসবহুল গাড়ি বা প্রাসাদ-এসবের যা মূল্য তা বর্তমানের। বর্তমান মানেই তো ক্ষণস্থায়ী। যা এ মুহূর্তে বর্তমান, পর মুহূর্তে তা অতীত। আর লেখা এমন সম্পদ, যার আবেদন চিরকালীন, কখনো ফুরোয় না। পিতার এই সম্পদ যক্ষের ধনের মতো সে এতদিন আঁকড়ে ধরে ছিলো। কখন বই বের করতে পারবে সে অপেক্ষায় কাল গুনছিলো। খুঁজে খুঁজে বের করলো সেই আমাকেই।

ইদরিস আলমের কলাম বই আকারে পড়তে গিয়ে পাঠক কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন, কারণ সব লেখা পাওয়া যায় নি। ফলে সময়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয় নি। তবুও আমরা চেষ্টা করেছি ১ মার্চ ‘৭১ থেকে যুদ্ধ করতে করতে তাঁর ভারত গমন এবং সেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের পর ১৭ ডিসেম্বর তাঁর চর চাক্তাইয়ের বাড়িতে ফিরে আসা পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত ঘটনা নিয়ে লেখা প্রবন্ধসমূহ সাজিয়ে একটি কালানুক্রমিক ইতিহাস তুলে ধরতে। তাতে যে সব সময় সফল হয়েছি সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধটি সঙ্গত কারণে গ্রন্থের প্রথমে স্থান দেয়া হয়েছে। যুদ্ধের কথা বলতে যেয়ে যুদ্ধ-পূর্ব এবং যুদ্ধোত্তর নানা ঘটনা ও ব্যক্তির কথাও ইদরিস আলম তুলে এনেছেন। আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, পঁয়ষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচন, ৬ দফা আন্দোলন এবং আগরতলা মামলা বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণ ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য জমি প্রস্তুত করেছে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এসব ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম; আর মুক্তিযুদ্ধ তো স্বাধীনতা সংগ্রামেরই সশস্ত্র অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের স্থায়িত্ব নয় মাস, স্বাধীনতা সংগ্রাম বহু বিস্তৃত, বেশ দীর্ঘ। চট্টগ্রামে সেসব আন্দোলন-সংগ্রাম এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতা ও ব্যক্তিবর্গকে (সবাই নন) নিয়ে কিছু প্রবন্ধ গ্রন্থভুক্ত করা হয়েছে।

ইদরিস আলমের রাজনীতির তীর্থ অধুনালুপ্ত রেস্ট হাউস বা ডাক বাংলা নিয়ে একটি দীর্ঘ রচনা; সর্বোপরি গ্রন্থের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাঁর উপস্থিতি পাঠকের চোখে পড়বে, তিনি হচ্ছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রনায়ক, সিটি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরী এবং আলাওলকে উদ্বৃত করে যাঁকে তিনি বলেছেন, তার ‘অন্নদাতা ভয়ত্রাতা দুই মতে বাপ’।

ইদরিস আলমের কলাম ধারাবাহিকভাবে পূর্বকোণে প্রকাশের সময় অসংকোচে, অকপটে, নির্ভয়ে সত্যভাষণের জন্য সমগ্র চট্টগ্রাম এমনকি সুদূর রাঙামাটি, কক্সবাজার থেকেও অসংখ্য পাঠক, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তথা তরুণ সমাজ কেউ লেখকের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করে, কেউ দেখা করে তাঁকে সাধুবাদ জানালেও বিরূপ সমালোচনাও তাঁকে কম শুনতে হয়নি। এমন কি তাঁকে দৈহিক নির্যাতন ও প্রাণে মেরে ফেলারও হুমকি দেয়া হয়। এ কারণে তাঁকে সময়ে সময়ে লেখার ব্যাখ্যা ও কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল। এমনি একটি কৈফিয়ত ও ব্যাখ্যা পড়ে পাঠককে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হবে। তাতে পরের কথা আগে চলে এসেছে। যে কথা তিনি পত্রিকায় কলাম প্রকাশের মাঝামাঝি সময়ে কিংবা শেষে লিখেছেন, অনিবার্য কারণে তাকে গ্রন্থের প্রথমে স্থান দিতে হয়েছে। এতে পাঠকের গ্রন্থপাঠে কোনো অসুবিধা হবে না। বরং ভূমিকা বা ভণিতা হিসেবে এই লেখাটি আগে পড়ে নিলে পরে কোন বিষয়ে পাঠককে আর ধন্ধে পড়তে হবে না। ইদরিস আলমের মানস জগতে প্রবেশের চাবিকাঠি ‘আমার কৈফিয়ত’ পড়লেই খুঁজে পাওয়া যাবে।

১৬ ডিসেম্বর ’৭১ বিজয় আসে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধও কী শেষ হয়? তখন এ প্রশ্ন উঠেনি; কিন্তু পঁচাত্তরের পনের আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে পরাজিত শক্তির পুনরুত্থানের পর এ প্রশ্ন না করে উপায় ছিলো না? অতঃপর একাত্তরের ঘাতক দালাল অপশক্তির বিরুদ্ধে নতুন করে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, সেই যুদ্ধ এখনো চলছে।

প্রতিভার অপমৃত্যু ইদরিস আলমের প্রতিভা ছিলো; কিন্তু বুদ্ধদেব বসু যাকে বলেছেন ‘প্রতিভার গৃহিণীপনা’ সেটা ছিলো না। ফলে তিনি কী হতে পারতেন, তা নিয়ে আমাদের কৌতূহলে শেষ হয় না, হতে চায় না। তাঁর প্রিয় শিক্ষক অধ্যক্ষ রেজাউল করিম চৌধুরী ছাত্রটির মধ্যে বুদ্ধির দীপ্তি ও প্রতিভার ঝলক দেখতে পেয়ে প্রশ্রয় দিতেন। আগুন উস্কে দিতেন এই আশায় যে, ছেলেটি সিএসপি না হলেও জজ-ব্যারিস্টার, নিদেনপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তো হবে। চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা জহুর আহমদ চৌধুরীর ভাবশিষ্য ছিলেন ইদরিস আলম, নিজেই লিখে গেছেন “আমি জহুর আহমদ চৌধুরীর মানস সন্তান” জহুর আহমদ চৌধুরীও তাঁকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন ইদরিস আলম একদিন পার্লামেন্টের মেম্বার হয়ে বক্তৃতায় পার্লামেন্ট কাঁপাবে। কিন্তু ইদরিস আলম সেসব কিছুই হননি, তিনি মজেছিলেন রাজনীতিতে। কারণ তাঁর রক্তে ছিলো রাজনীতির টান।

ইদরিস আলমের জন্ম চট্টগ্রামের একটি বিখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারে। চট্টগ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পথপ্রদর্শক শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার এই পরিবারে রাজনীতি আমদানি করেন বিশ শতকের গোড়ার দিকে। কাজেম আলীর দু’পুত্র একরামুল হক ও সিরাজুল হকও ব্রিটিশ বিরোধী চেতনায় উদ্দীপ্ত ছিলেন। স্বদেশব্রতে উৎসর্গীকৃত একরামুল হকের ওপর পিতার ছায়া পড়েছিলো; তাঁকেও চট্টগ্রামের মানুষ ভালোবেসে একটা উপাধি দিয়েছিলো-‘শেরে চাটগাম’। সিরাজুল হক পিতার দুরন্ত সাহস পেয়েছিলেন।

একরামুল হকের তিন কন্যা শামসুন্নাহার, আইনুন নাহার, নুরুন্নাহার ছিলেন কবি, সম্ভবত চট্টগ্রামের প্রথম মহিলা কবি। অবশ্য হবীবুল্লাহ বাহারের বোন শামসুন্নাহার মাহমুদকে বাদ দিলে; তাঁরা নোয়াখালীর মানুষ, চট্টগ্রামে মাতাসহ আবদুল আজিজ বি.এ.-র আবাস ‘আজিজ মঞ্জিল’-এ শৈশব-কৈশোর কাটে তাঁদের। হবীবুল্লাহ বাহার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু ছিলেন; নজরুল একবার চট্টগ্রাম সফরে এসে ‘আজিজ মঞ্জিল’এ থেকেছিলেন। এবং নাহার-বাহার দুই ভাই-বোনকে নিয়ে কবিতাও লিখেছেন।

সে যা-ই হোক, একরামুল হকের পুত্র-রা রাজনীতি করেছেন কিনা সে সম্পর্কে আমার জানা নেই। তবে কাজেম আলী মাস্টারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এরপর দেখা গেল তাঁর ভাই মনুহর আলী মাস্টারের ঘরে। মনুহর আলী মাস্টারের চার পুত্রই রাজনীতিতে যোগ দেন। তাঁরা হলেন- সাহেবুর রহমান, শাহ আলম, জানে আলম ও সৈয়দুর রহমান। কাজেম আলী ও তাঁর পুত্র একরামুল হক ছিলেন কংগ্রেসী, কাজেম আলীর ভ্রাতুষ্পুত্ররা করলেন মুসলিম লীগ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাদের মোহমুক্তি ঘটে এবং তারা সকলেই যুক্তফ্রন্টের জন্য কাজ করেন। মনুহর আলী মাস্টারেরই নাতি ইদরিস আলম। তাঁর পিতা জানে আলম শেষ জীবনে আধ্যাত্মিক সাধক হয়ে যান। তাঁর দুই পুত্র ইদরিস আলম ও সিদ্দিক আলম আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হয়ে পরিবারের রাজনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন।

জানে আলমের জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে শহীদ হন। ইদরিস আলমের পুত্র ইফতেখার আলম জাহেদ এখন আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত দেখা যাচ্ছে। সিদ্দিক আলম আজীবন আওয়ামী লীগ করেছেন। তিনি বৃহত্তর বাকলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ৫ আগস্টের কথিত ‘বিপ্লবে’র ধাক্কায় কাজেম আলী মাস্টারের ভাই মনহর মাস্টারের দু’পুত্র ইদরিস আলম ও সিদ্দিকী আলমের বাড়িও লন্ড-ভন্ড হয়ে যায়। হায় বিপ্লব! যাঁরা ব্রিটিশ আমল থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে করতে একবার পাকিস্তান, আরেকবার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে এখন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছে, গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে দিয়ে একটি শক্তি তাদের উপরই চড়াও হয়ে এলোপাথাড়ি হামলা করে তাদের নবলব্ধ শক্তি প্রদর্শন করেছে।

ইদরিস আলম তো নেই, ছিলেন সিদ্দিক আলম, তাঁর একার পক্ষে কীই বা করা সম্ভব। তাঁর ভাইপো জাভেদ জন্মখোঁড়া, জাহেদ ক্ষীণদেহ-অসুরের সাথে যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ তাঁদেরকে স্বাস্থ্য শরীর কিছুই দেননি। অতএব, চট্টগ্রামের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক পরিবারের উপর আসুরিক তান্ডবের ভয়াবহ বিভীষিকা সহ্য করতে না পেরে সিদ্দিক আলম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

মহিউদ্দিন চৌধুরী নেই, সুলতান উল কবির চৌধুরীও প্রয়াত, তাঁদের বন্ধু ইদরিস আলমের বাড়ি যে তস্করেরা ভেঙ্গেচুরে লুটেপুটে নিল, তারা হয়তো পরপারে ক্রোধে মুঠি পাকিয়ে নিস্ফল আস্ফালন করছেন, কিন্তু এপারে আসার এজাজত আজরাইল তাঁদেরকে দেবেন না। নোমান ভাই, খসরু ভাই কি করছেন। এখন তাদের দলের সমর্থনপুষ্ট সরকারের শাসন চলছে। নোমান ভাইকে ইদরিস আলম মামা বলতেন। যদিও তিনি অসুস্থ, তবুও তাঁর কানে গেলে হয়তো শাহাদাত, বক্করকে ফোন করে তিনি ধমকাতেন। খসরু ভাইয়ের বড় ভাই একদা ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী আবদুর রাজ্জাক মাহমুদ চৌধুরী সম্ভবত ইদরিস আলমের সমসাময়িক। সুতরাং ইদরিস আলমের বিপদে খসরু ভাইয়েরও হয়তো কিছু করণীয় ছিলো।

সার্টিফিকেট অনুযায়ী ইদরিস আলমের জন্ম তারিখ ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৪। তবে আত্মপরিচিতি দিতে গিয়ে তিনি আরো লিখেছেন, “আমার মাতার নাম মাবিয়া খাতুন। আমরা তিন ভাই ও দুই বোন। আমার নানার নাম হাজী মিন্নত আলী। আমার পৈত্রিক ও মাতামহের বাড়ি যথাক্রমে পূর্ব ও দক্ষিণ বাকলিয়ায়”।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের সময় ইদরিস আলম দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র, বয়স পাঁচ। কিন্তু সেই বয়সেই ভাষা আন্দোলন তাঁর মনে রেখাপাত করেছিলো। চার বছর পর, অর্থাৎ ইদরিস আলমের বয়স যখন নয় এবং তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছেন মুসলিম হাই স্কুলে; ১৯৫৬ সালে কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই তিনি স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে ক্লাশ টেনের ছাত্র ফজলুল কাদের চৌধুরীকে (পরে অধ্যক্ষ) পরাজিত করে প্রথম স্থান দখল করেন। সে বছর তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও পরিচিত হন এবং আমৃত্যু এই সম্পর্ক বজায় ছিলো। ইদরিস আলম এই দু’টি ঘটনাকে তাঁর জীবনে ‘আশ্চর্য ঘটনা’ হিসেবে দেখেছেন।

ইদরিস আলম লিখেছেন, “তিনি (বঙ্গবন্ধু) আমার কাছে পত্র লিখেছেন। ১৯৬৬ সালে তিনি আমাকে প্রস্তাব দেন যে, আমি যেন তাঁর বত্রিশ নম্বরের বাসায় থেকে রাজনীতি করি এবং তিনি পকেট খরচ বাবত আমাকে মাসিক সাড়ে তিনশত টাকা দেবেন। কিন্তু জহুর আহমদ চৌধুরীর সান্নিধ্যের কারণে তা সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি আমাকে বিশ্ব সফরের আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু আমার দুই বন্ধু ছাড়া একলা সফরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করি। ……বঙ্গবন্ধু প্রথমে আমাকে পৌরসভার চেয়ারম্যান ও পরে জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর সংসদ নির্বাচন করতে বলেন”।

ইদরিস আলম মুসলিম হাই স্কুলের জেনারেল ক্যাপ্টেনও নির্বাচিত হন। ইতিমধ্যে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। পরে ম্যাট্রিক পাস করে সিটি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তিনি ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে যান। সিটি কলেজে অধ্যয়নকালে তাঁর নেতৃত্ব বিকশিত হয় এবং বাগ্মিতা প্রকাশ পায়। এক সময় তিনি তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, যিনি বক্তৃতার যাদুতে শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারেন। মুসলিম হাই স্কুলের ‘বিতার্কিক’ সিটি কলেজে এসে বাগ্মী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। চট্টগ্রামের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে তিনি প্রথমে সরকারি খরচে ঢাকা ও পরবর্তীকালে সরকারের খরচে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত শিল্পমন্ত্রীর সভায় তিনিই একমাত্র বাংলাভাষী বক্তা ছিলেন।

সিটি কলেজ ছিলো ইদরিস আলমের জীবনের সুবর্ণ যুগ। তিনি সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের এজিএস ও জিএস নির্বাচিত হন। এ সময় তাঁর মধ্যে কবিত্ব শক্তিরও উন্মেষ ঘটে। পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। বাগ্মিতায় ষাটের দশকে ইদরিস আলমের সমকক্ষতা দাবি করতে পারতেন আর মাত্র দু’জন ছাত্রলীগ নেতা আশরাফ খান ও এস.এম ইউসুফ। ফেরদৌস কোরেশীর কথা বললাম না, কারণ তিনি অনেক সিনিয়র। বেসিক ডেমোক্র্যাসির ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ইদরিস আলম ও আশরাফ খান চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে একনাগাড়ে ৩৩ ঘণ্টা বক্তৃতার রেকর্ড সৃষ্টি করেন। সেবার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের প্রার্থী ছিলেন ফাতেমা জিন্নাহ। লালদিঘি ময়দানে তাঁর জনসভা ছিলো। সহস্রাধিক মানুষ তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য স্টেশনে জমায়েত হয়েছিলো। কিন্তু তাঁর আসতে বিলম্ব হচ্ছিলো, তাই উৎসুক জনতাকে ধরে রাখতে ম্যারাথন বক্তৃতা।

মেধায় তাঁকে টেক্কা দেবার মতো ছিলেন এসএম ইউসুফ। এক্ষেত্রেও শহীদ মুরিদুল আলম ও ফেরদৌস কোরেশীর নাম আসবে না সিনিয়রিটির কারণে। লেখালেখিতে ইদরিস আলমের প্রতিদ্বদ্বী হিসেবে ভাবা যেতে পারে শওকত হাফিজ খান রুশ্নি ও গোফরান গাজীকে। এ প্রসঙ্গ যে কারণে দীর্ঘায়িত করলাম, তা হলো আমি বুঝাতে চাচ্ছি ইদরিস আলম চাইলে কবি বা তার্কিক, কিংবা উপস্থাপক বা আবৃত্তিকারও হতে পারতেন। তাঁর বক্তৃতা ছিলো প্রতর্কোন্মুখ, অথচ আবেগময় বা কাব্যিক। বক্তৃতায় সাহিত্য, ইতিহাসের উদ্ধৃতি টেনে সভাস্থলে এমন রসঘন জমাট পরিবেশ সৃষ্টি করতেন যে, বাচিক শিল্পের অপূর্ব প্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করে শ্রোতারা নালেঝোলে হয়ে যেতেন। বাংলা সাহিত্যের আলাওল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, উর্দু-ফারসি সাহিত্যের ইকবাল, হাফিজ, গালিব, সাদী, রুমী, জামী, ফেরদৌসী ছিলেন ইদরিস আলমের প্রিয় কবি। অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী হওয়ার কারণে উপর্যুক্ত কবিদের বহু কবিতা বা কাব্যাংশ তাঁর স্মৃতির ভান্ডারে জমা থাকতো। বক্তৃতা বা লেখায় পরপর তারা ভিড় করে আসতো। সমসাময়িক ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের সাথে তাঁর পার্থক্য হলো তিনি ছিলেন এমন এক বহুমাত্রিক প্রতিভা, যাঁর একার জীবনে বহু গুণের সমাবেশ ঘটেছিলো।

ছাত্র রাজনীতি করতে করতে ইদরিস আলম আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েন। তিনিই একমাত্র রাজনৈতিক কর্মী যিনি একাধারে ছাত্রলীগের নেতা, ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং সিটি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক, প্রচার সম্পাদক ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে যখন তাঁকে সিটি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক করা হয়, তখন ছাত্র রাজনীতিতে তাঁর ভরা যৌবন এবং তাঁর ছাত্রত্বও লোপ পায়নি।

“১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা কর্মসূচি দেয়ার পর ইদরিস আলম প্রথম উক্ত কর্মসূচির ব্যাখ্যা পুস্তিকা লেখেন। ৬ দফাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি ডা. সৈয়দুর রহমান চৌধুরী, মানিক চৌধুরী, বিধান কৃষ্ণ সেন, কামাল, আশরাফ খান, বদন দীদারি, জয়নাল আবেদিন প্রধান, আবদুল মালেক প্রমুখের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রথম সভার আয়োজন থেকে শুরু করে রাত-দিন প্রচার কার্য চালান।

ছাত্রলীগ করার অপরাধে ইদরিস আলম প্রতিদ্ব›দ্বী ছাত্র সংগঠন সমূহের রোষানলে পতিত হন এবং তাদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এমনভাবে ছুরিকাহত হন যে তাঁর প্রাণ সংশয় উপস্থিত হয়। তিনি লিখেছেন ১৯৬৬ সালের ১৭ অক্টোবর আমাকে তৎকালীন সরকারী ছাত্র সাংগঠন এনএসএফ ও ছাত্র ইউনিয়ন যুক্তভাবে হামলা করে চাকু চালায় এবং হোটেল মিসকার দক্ষিণে রেস্ট হাউসের পেছনে কচুবনে ফেলে দেয়।”

ইদরিস আলম রাজনৈতিক কারণে তিনবার কারাবরণ করেন। ১৯৬৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর স্টেডিয়ামে আইয়ুব খানের নির্বাচনী সভা থেকে প্রথম গ্রেফতার হন। ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয়বার এবং ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বর্তমান নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ অনেকের সঙ্গে গ্রেফতার হন। ইদরিস আলম মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাকলিয়া ও চরচাক্তাই এলাকায় কোন প্রাথমিক বা উচ্চ বিদ্যালয় ছিলো না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন অনেকেই বিষয় সম্পত্তি দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন, তখন ঊনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষাব্রতী কাজেম আলী মাস্টার ও মনুহর আলী মাস্টারের নাতি ইদরিস আলম তাঁর এলাকায় শিক্ষার আলো জ্বালাবার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি চর চাক্তাই উচ্চ বিদ্যালয়, চর চাক্তাই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ইউসেপ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ইদরিস আলম লিখেছেন, “আমার মনে হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম ও এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আমার জীবনের মহত্তর অবদান”।

২০০৬ সালের ২ জানুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় ইদরিস আলমের বাম হাত ভেঙে যায়। পরে তিনি পলিও আর্থারাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়েন। ২০০৬ সালের ৬ নভেম্বর তাঁর জীবন থেমে যায়।

লেখকঃ নাসিরুদ্দিন চৌধুরী,প্রবীন সাংবাদিক ও কলামিস্ট

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী: ইদরিস আলম সরস্বতীর বরপুত্র ছিলেন, রাজনীতির রাস্তায় না হেঁটে সারস্বত সাধনা করলে তাঁর সিদ্ধি অনিবার্য ছিলো। তাঁর রাজনীতিতে দেশ উপকৃত হয়েছে, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করলেই বুঝি তিনি নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের স্ফূর্তি যে কলম চালনাতেই নিহিত ছিলো, তা তো নিজেই প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন শেষ জীবনে সংবাদপত্রে লেখা কলামে।

বৈঠকী ঢংয়ে প্রাঞ্জল অথচ ওজো-গুণ সম্পন্ন গদ্যে কী অমিত বিক্রমে তিনি লিখেছিলেন‘আমরা তখন যুদ্ধে’ এবং জয় করে নিলেন পাঠকচিত্ত। অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো সেই কলাম। নব্বইয়ের দশকে যখন দৈনিক পূর্বকোণে ধারাবাহিকভাবে এই লেখাগুলো প্রকাশিত হচ্ছিলো, তখন হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিলো। প্রথম দিকে সপ্তাহে একদিন শনিবার এবং পরে পাঠকের দাবিতে শনি ও বৃহস্পতিবার দু’দিন তাঁর কলাম প্রকাশিত হতো। শুধু ইদরিস আলমের কলামের জন্য এই দু’দিন পূর্বকোণের কাটতি বেড়ে গিয়েছিলো। কারো লেখার জন্য পত্রিকার সার্কুলেশন বৃদ্ধি পেতে পারে, এমন দৃষ্টান্ত তো বাংলাদেশে আর একটিই মেলে তিনি হচ্ছেন স্বনামখ্যাত লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী। নব্বইয়ের পরের কথা বলছি আমি। মৃত্যু এসে তাঁর জীবনের ওপর অকালে যবনিকা টেনে দেয়ায় ইদরিস আলমের কলামের অমিয় সুধা থেকে চট্টগ্রামের সংবাদপত্র পাঠক সমাজ চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হয়ে যান; আজো তাদের কন্ঠে অতৃপ্তির হাহাকার ধ্বনিত হয়।

চট্টগ্রামের পত্রিকায় সেই বোধ হয় প্রথম কলামের চল্ হলো। হতে পারে তার আগে কেউ কেউ কলাম লিখেছেন; কিন্তু ‘কলামিস্ট’ আখ্যা বোধ হয় চট্টগ্রামে প্রথম ইদরিস আলমই পেয়েছেন। পূর্বকোণে কলাম লেখার পর থেকে ইদরিস আলমের নামের সাথে ‘কলামিস্ট’ শব্দটা এমনভাবে জুড়ে যায় যে এরপর থেকে কলামিস্ট বলেই তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিতে হতো। তো পূর্বকোণে প্রকাশিত ইদরিস আলমের সেই কলাম অভিন্ন শিরোনামে, তাঁর মৃত্যুর সাত বছর পর, গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখার হাত ছিলো, সেজন্যে সময় পেলে কলম নিয়ে লিখতে বসে যেতেন। এমনি করে জমে উঠলো লেখার স্তপ; পত্রিকা অফিসে যান কিন্তু কষ্ট করে কেউ ছাপতে রাজি হল না। এমন সময় আমার সাথে যোগাযোগ। আমি তখন দৈনিক পূর্বকোণের বার্তা সম্পাদক; বার্তা বিভাগের পাশাপাশি সপ্তাহে দু’টি ফিচার পাতা সম্পাদনার দায়িত্ব চেপেছিলো আমার কাঁধে।

নতুন পত্রিকা, ভাবা হচ্ছিলো নতুন কিছু করে চমকে দেবার কথা। এমন সময় হাতে এলো ইদরিস আলমের লেখা; পড়ে নড়ে চড়ে বসলাম। মনে হলো পেয়ে গেছি যা চেয়েছিলাম। বিস্ফোরক মন্তব্যে ঠাসা প্রতিটি লেখা যেন এক একটি তাজা বোমা। বুঝতে পারলাম ছাপানোর সমস্যা কোথায়।

ইদরিস আলম কবিতা লেখেন জানতাম, পড়েছিও; কিন্তু তাঁর গদ্যের সাথে আমার বিশেষ পরিচয় ছিলো না। এখন পড়ে আমি অভিভূত। তাঁর গদ্যের অদ্ভুত আকর্ষণ; পড়তে পড়তে নেশা ধরে যায়, একবার পড়তে বসলে শেষ না করে ওঠা যায় না। তিনি বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখেছেন, স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ফুঁড়ে পাঠকদের জন্য আনন্দের উপকরণ আহরণ করেছেন, সেজন্যে ‘অগম্যাগমনেও’ আপত্তি নেই, অর্থাৎ অতএব তাঁকে সর্বত্রগামী বলাই সঙ্গত। কথায় কথায় কবিতা, বয়েৎ, রুবাইয়াত ভিড় করে আসে।

শাস্ত্র-পুরাণ-পুঁথি, কোরান-হাদিস, গীতা-বেদ, বাইবেল, ত্রিপিঠক ঘেঁটে হাজির করেন সাক্ষী সাবুদ; ফেরদৌসী, জামি, রুমী, সাদী, হাফিজ, খৈয়াম, গালিব, প্রেমচাঁদ, কৃষণ চন্দর, আলাওল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ-কে নেই সেই আসরে। তিনি কী নাম দিয়েছিলেন, এতদিন পর তা আমার মনে নেই, হয়তো প্রত্যেক প্রবন্ধের ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিলো। আসলে প্রবন্ধই তিনি লিখেছিলেন। তখন আমাদের সামনে আদর্শ আবদুল গাফফার চৌধুরীর তীক্ষধার কলাম আর খোন্দকার আবদুল হামিদের হুল ফুটানো কলাম। আরো পিছিয়ে গেলে পাওয়া যাবে মোসাফির-খ্যাত তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কলাম, ভিমরুল-খ্যাত আহমেদুর রহমানের ‘মিঠেকড়া’ এবং আবদুল গণি হাজারীর ‘কালো পেঁচার ডাইরি’। সেসব তো ঢাকার কথা।

চট্টগ্রামে একটি রাজনৈতিক কলাম চালু করার প্রবল ইচ্ছা চাগিয়ে উঠলো আমার অন্তরে। সম্পাদক এবং পত্রিকা কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেতে অসুবিধা হলো না। অতঃপর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখিত প্রবন্ধগুলি বাছাই করে পাঠকের পাতে পরিবেশন করলাম ইদরিস আলমের কলাম ‘আমরা তখন যুদ্ধে’। ওদিকে তখন বেধে গেছে মহা হাঙ্গামা, চট্টগ্রাম তোলপাড়। ভীষণ চাঞ্চল্য, নড়াচড়া টের পাওয়া গেল রাজনৈতিক মহলে।

তিনি তো লিখে খালাস, কিন্তু আমার হলো মুস্কিল। তাঁর যতো স্বস্তি, আমার ততো অস্বস্তি। ভিমরুলের চাকে ঢিল মারা হয়ে যাবার পর দলে দলে বেরিয়ে পড়া বোলতা যাদের কামড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেললো, তাদের শুশ্রষা আমাকেই করতে হয়েছিলো। তাঁর যেমন ফোঁড়ন-কাটা স্বভাব, সময়-অসময় নেই, স্থান-কাল-পাত্র ভেদ বুঝে সম্ঝে কথা বলতে বইয়েই গেছে তাঁর; যখন যাকে ধরেন, তাকে ব্যঙ্গ বিদ্রপের তী্ঙ্কন বাণে ফালা ফালা করে ফেলেন। এতো গদ্য নয়, গদ্যের গদা। কলম নয়, লেখক যেন গদা চালিয়েছেন । তাতে অনেকের মাথা ফেটে রক্তারক্তি কান্ড। অন্যায়, অনিয়ম, অসত্য, অসুন্দরের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম; দু’চোখে দেখতে পারেন না ভন্ড, প্রতারক, কপট, দুরাচার, দুরাত্মাকে; মাঝে মাঝে নিজের ওপরও খড়গহস্ত হয়ে ওঠেন, তখন নিজেকে নিয়েও পরিহাস করে মনের ঝাল মেটান। যেমন বিদ্যাসাগর ঠাট্টা করেছেন, নিজের জন্ম বৃত্তান্ত পরিবেশ করতে গিয়ে।

ইদরিস আলমের ইচ্ছা ছিলো লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশ করবেন। কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছা যেমন পূর্ণ হয় না, ইদরিস আলমের এই ইচ্ছাটিও অপূর্ণ থেকে গিয়েছিলো। সেটি পূর্ণ হলো তিনি গত হওয়ার পর, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের উদযোগ-আয়োজনে। বিশেষত কনিষ্ঠ পুত্র ইফতেখার আলম জাহেদ এই গ্রন্থ প্রকাশের জন্য যে যত্ন ও শ্রম দিয়েছেন, তা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। পিতার লেখাই যে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একমাত্র ধন, যার স্থায়ী মূল্য আছে, তা এই পুত্রটি ভালোই বুঝে। বস্তুগত সম্পদ যেমন টাকা, জমিজমা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা, বিলাসবহুল গাড়ি বা প্রাসাদ-এসবের যা মূল্য তা বর্তমানের। বর্তমান মানেই তো ক্ষণস্থায়ী। যা এ মুহূর্তে বর্তমান, পর মুহূর্তে তা অতীত। আর লেখা এমন সম্পদ, যার আবেদন চিরকালীন, কখনো ফুরোয় না। পিতার এই সম্পদ যক্ষের ধনের মতো সে এতদিন আঁকড়ে ধরে ছিলো। কখন বই বের করতে পারবে সে অপেক্ষায় কাল গুনছিলো। খুঁজে খুঁজে বের করলো সেই আমাকেই।

ইদরিস আলমের কলাম বই আকারে পড়তে গিয়ে পাঠক কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন, কারণ সব লেখা পাওয়া যায় নি। ফলে সময়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয় নি। তবুও আমরা চেষ্টা করেছি ১ মার্চ ‘৭১ থেকে যুদ্ধ করতে করতে তাঁর ভারত গমন এবং সেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের পর ১৭ ডিসেম্বর তাঁর চর চাক্তাইয়ের বাড়িতে ফিরে আসা পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত ঘটনা নিয়ে লেখা প্রবন্ধসমূহ সাজিয়ে একটি কালানুক্রমিক ইতিহাস তুলে ধরতে। তাতে যে সব সময় সফল হয়েছি সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধটি সঙ্গত কারণে গ্রন্থের প্রথমে স্থান দেয়া হয়েছে। যুদ্ধের কথা বলতে যেয়ে যুদ্ধ-পূর্ব এবং যুদ্ধোত্তর নানা ঘটনা ও ব্যক্তির কথাও ইদরিস আলম তুলে এনেছেন। আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, পঁয়ষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচন, ৬ দফা আন্দোলন এবং আগরতলা মামলা বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণ ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য জমি প্রস্তুত করেছে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এসব ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম; আর মুক্তিযুদ্ধ তো স্বাধীনতা সংগ্রামেরই সশস্ত্র অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের স্থায়িত্ব নয় মাস, স্বাধীনতা সংগ্রাম বহু বিস্তৃত, বেশ দীর্ঘ। চট্টগ্রামে সেসব আন্দোলন-সংগ্রাম এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতা ও ব্যক্তিবর্গকে (সবাই নন) নিয়ে কিছু প্রবন্ধ গ্রন্থভুক্ত করা হয়েছে।

ইদরিস আলমের রাজনীতির তীর্থ অধুনালুপ্ত রেস্ট হাউস বা ডাক বাংলা নিয়ে একটি দীর্ঘ রচনা; সর্বোপরি গ্রন্থের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাঁর উপস্থিতি পাঠকের চোখে পড়বে, তিনি হচ্ছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রনায়ক, সিটি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরী এবং আলাওলকে উদ্বৃত করে যাঁকে তিনি বলেছেন, তার ‘অন্নদাতা ভয়ত্রাতা দুই মতে বাপ’।

ইদরিস আলমের কলাম ধারাবাহিকভাবে পূর্বকোণে প্রকাশের সময় অসংকোচে, অকপটে, নির্ভয়ে সত্যভাষণের জন্য সমগ্র চট্টগ্রাম এমনকি সুদূর রাঙামাটি, কক্সবাজার থেকেও অসংখ্য পাঠক, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তথা তরুণ সমাজ কেউ লেখকের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করে, কেউ দেখা করে তাঁকে সাধুবাদ জানালেও বিরূপ সমালোচনাও তাঁকে কম শুনতে হয়নি। এমন কি তাঁকে দৈহিক নির্যাতন ও প্রাণে মেরে ফেলারও হুমকি দেয়া হয়। এ কারণে তাঁকে সময়ে সময়ে লেখার ব্যাখ্যা ও কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল। এমনি একটি কৈফিয়ত ও ব্যাখ্যা পড়ে পাঠককে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হবে। তাতে পরের কথা আগে চলে এসেছে। যে কথা তিনি পত্রিকায় কলাম প্রকাশের মাঝামাঝি সময়ে কিংবা শেষে লিখেছেন, অনিবার্য কারণে তাকে গ্রন্থের প্রথমে স্থান দিতে হয়েছে। এতে পাঠকের গ্রন্থপাঠে কোনো অসুবিধা হবে না। বরং ভূমিকা বা ভণিতা হিসেবে এই লেখাটি আগে পড়ে নিলে পরে কোন বিষয়ে পাঠককে আর ধন্ধে পড়তে হবে না। ইদরিস আলমের মানস জগতে প্রবেশের চাবিকাঠি ‘আমার কৈফিয়ত’ পড়লেই খুঁজে পাওয়া যাবে।

১৬ ডিসেম্বর ’৭১ বিজয় আসে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধও কী শেষ হয়? তখন এ প্রশ্ন উঠেনি; কিন্তু পঁচাত্তরের পনের আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে পরাজিত শক্তির পুনরুত্থানের পর এ প্রশ্ন না করে উপায় ছিলো না? অতঃপর একাত্তরের ঘাতক দালাল অপশক্তির বিরুদ্ধে নতুন করে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, সেই যুদ্ধ এখনো চলছে।

প্রতিভার অপমৃত্যু ইদরিস আলমের প্রতিভা ছিলো; কিন্তু বুদ্ধদেব বসু যাকে বলেছেন ‘প্রতিভার গৃহিণীপনা’ সেটা ছিলো না। ফলে তিনি কী হতে পারতেন, তা নিয়ে আমাদের কৌতূহলে শেষ হয় না, হতে চায় না। তাঁর প্রিয় শিক্ষক অধ্যক্ষ রেজাউল করিম চৌধুরী ছাত্রটির মধ্যে বুদ্ধির দীপ্তি ও প্রতিভার ঝলক দেখতে পেয়ে প্রশ্রয় দিতেন। আগুন উস্কে দিতেন এই আশায় যে, ছেলেটি সিএসপি না হলেও জজ-ব্যারিস্টার, নিদেনপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তো হবে। চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা জহুর আহমদ চৌধুরীর ভাবশিষ্য ছিলেন ইদরিস আলম, নিজেই লিখে গেছেন “আমি জহুর আহমদ চৌধুরীর মানস সন্তান” জহুর আহমদ চৌধুরীও তাঁকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন ইদরিস আলম একদিন পার্লামেন্টের মেম্বার হয়ে বক্তৃতায় পার্লামেন্ট কাঁপাবে। কিন্তু ইদরিস আলম সেসব কিছুই হননি, তিনি মজেছিলেন রাজনীতিতে। কারণ তাঁর রক্তে ছিলো রাজনীতির টান।

ইদরিস আলমের জন্ম চট্টগ্রামের একটি বিখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারে। চট্টগ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পথপ্রদর্শক শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার এই পরিবারে রাজনীতি আমদানি করেন বিশ শতকের গোড়ার দিকে। কাজেম আলীর দু’পুত্র একরামুল হক ও সিরাজুল হকও ব্রিটিশ বিরোধী চেতনায় উদ্দীপ্ত ছিলেন। স্বদেশব্রতে উৎসর্গীকৃত একরামুল হকের ওপর পিতার ছায়া পড়েছিলো; তাঁকেও চট্টগ্রামের মানুষ ভালোবেসে একটা উপাধি দিয়েছিলো-‘শেরে চাটগাম’। সিরাজুল হক পিতার দুরন্ত সাহস পেয়েছিলেন।

একরামুল হকের তিন কন্যা শামসুন্নাহার, আইনুন নাহার, নুরুন্নাহার ছিলেন কবি, সম্ভবত চট্টগ্রামের প্রথম মহিলা কবি। অবশ্য হবীবুল্লাহ বাহারের বোন শামসুন্নাহার মাহমুদকে বাদ দিলে; তাঁরা নোয়াখালীর মানুষ, চট্টগ্রামে মাতাসহ আবদুল আজিজ বি.এ.-র আবাস ‘আজিজ মঞ্জিল’-এ শৈশব-কৈশোর কাটে তাঁদের। হবীবুল্লাহ বাহার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু ছিলেন; নজরুল একবার চট্টগ্রাম সফরে এসে ‘আজিজ মঞ্জিল’এ থেকেছিলেন। এবং নাহার-বাহার দুই ভাই-বোনকে নিয়ে কবিতাও লিখেছেন।

সে যা-ই হোক, একরামুল হকের পুত্র-রা রাজনীতি করেছেন কিনা সে সম্পর্কে আমার জানা নেই। তবে কাজেম আলী মাস্টারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এরপর দেখা গেল তাঁর ভাই মনুহর আলী মাস্টারের ঘরে। মনুহর আলী মাস্টারের চার পুত্রই রাজনীতিতে যোগ দেন। তাঁরা হলেন- সাহেবুর রহমান, শাহ আলম, জানে আলম ও সৈয়দুর রহমান। কাজেম আলী ও তাঁর পুত্র একরামুল হক ছিলেন কংগ্রেসী, কাজেম আলীর ভ্রাতুষ্পুত্ররা করলেন মুসলিম লীগ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাদের মোহমুক্তি ঘটে এবং তারা সকলেই যুক্তফ্রন্টের জন্য কাজ করেন। মনুহর আলী মাস্টারেরই নাতি ইদরিস আলম। তাঁর পিতা জানে আলম শেষ জীবনে আধ্যাত্মিক সাধক হয়ে যান। তাঁর দুই পুত্র ইদরিস আলম ও সিদ্দিক আলম আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হয়ে পরিবারের রাজনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন।

জানে আলমের জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে শহীদ হন। ইদরিস আলমের পুত্র ইফতেখার আলম জাহেদ এখন আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত দেখা যাচ্ছে। সিদ্দিক আলম আজীবন আওয়ামী লীগ করেছেন। তিনি বৃহত্তর বাকলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ৫ আগস্টের কথিত ‘বিপ্লবে’র ধাক্কায় কাজেম আলী মাস্টারের ভাই মনহর মাস্টারের দু’পুত্র ইদরিস আলম ও সিদ্দিকী আলমের বাড়িও লন্ড-ভন্ড হয়ে যায়। হায় বিপ্লব! যাঁরা ব্রিটিশ আমল থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে করতে একবার পাকিস্তান, আরেকবার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে এখন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছে, গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে দিয়ে একটি শক্তি তাদের উপরই চড়াও হয়ে এলোপাথাড়ি হামলা করে তাদের নবলব্ধ শক্তি প্রদর্শন করেছে।

ইদরিস আলম তো নেই, ছিলেন সিদ্দিক আলম, তাঁর একার পক্ষে কীই বা করা সম্ভব। তাঁর ভাইপো জাভেদ জন্মখোঁড়া, জাহেদ ক্ষীণদেহ-অসুরের সাথে যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ তাঁদেরকে স্বাস্থ্য শরীর কিছুই দেননি। অতএব, চট্টগ্রামের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক পরিবারের উপর আসুরিক তান্ডবের ভয়াবহ বিভীষিকা সহ্য করতে না পেরে সিদ্দিক আলম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

মহিউদ্দিন চৌধুরী নেই, সুলতান উল কবির চৌধুরীও প্রয়াত, তাঁদের বন্ধু ইদরিস আলমের বাড়ি যে তস্করেরা ভেঙ্গেচুরে লুটেপুটে নিল, তারা হয়তো পরপারে ক্রোধে মুঠি পাকিয়ে নিস্ফল আস্ফালন করছেন, কিন্তু এপারে আসার এজাজত আজরাইল তাঁদেরকে দেবেন না। নোমান ভাই, খসরু ভাই কি করছেন। এখন তাদের দলের সমর্থনপুষ্ট সরকারের শাসন চলছে। নোমান ভাইকে ইদরিস আলম মামা বলতেন। যদিও তিনি অসুস্থ, তবুও তাঁর কানে গেলে হয়তো শাহাদাত, বক্করকে ফোন করে তিনি ধমকাতেন। খসরু ভাইয়ের বড় ভাই একদা ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী আবদুর রাজ্জাক মাহমুদ চৌধুরী সম্ভবত ইদরিস আলমের সমসাময়িক। সুতরাং ইদরিস আলমের বিপদে খসরু ভাইয়েরও হয়তো কিছু করণীয় ছিলো।

সার্টিফিকেট অনুযায়ী ইদরিস আলমের জন্ম তারিখ ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৪। তবে আত্মপরিচিতি দিতে গিয়ে তিনি আরো লিখেছেন, “আমার মাতার নাম মাবিয়া খাতুন। আমরা তিন ভাই ও দুই বোন। আমার নানার নাম হাজী মিন্নত আলী। আমার পৈত্রিক ও মাতামহের বাড়ি যথাক্রমে পূর্ব ও দক্ষিণ বাকলিয়ায়”।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের সময় ইদরিস আলম দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র, বয়স পাঁচ। কিন্তু সেই বয়সেই ভাষা আন্দোলন তাঁর মনে রেখাপাত করেছিলো। চার বছর পর, অর্থাৎ ইদরিস আলমের বয়স যখন নয় এবং তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছেন মুসলিম হাই স্কুলে; ১৯৫৬ সালে কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই তিনি স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে ক্লাশ টেনের ছাত্র ফজলুল কাদের চৌধুরীকে (পরে অধ্যক্ষ) পরাজিত করে প্রথম স্থান দখল করেন। সে বছর তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও পরিচিত হন এবং আমৃত্যু এই সম্পর্ক বজায় ছিলো। ইদরিস আলম এই দু’টি ঘটনাকে তাঁর জীবনে ‘আশ্চর্য ঘটনা’ হিসেবে দেখেছেন।

ইদরিস আলম লিখেছেন, “তিনি (বঙ্গবন্ধু) আমার কাছে পত্র লিখেছেন। ১৯৬৬ সালে তিনি আমাকে প্রস্তাব দেন যে, আমি যেন তাঁর বত্রিশ নম্বরের বাসায় থেকে রাজনীতি করি এবং তিনি পকেট খরচ বাবত আমাকে মাসিক সাড়ে তিনশত টাকা দেবেন। কিন্তু জহুর আহমদ চৌধুরীর সান্নিধ্যের কারণে তা সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি আমাকে বিশ্ব সফরের আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু আমার দুই বন্ধু ছাড়া একলা সফরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করি। ……বঙ্গবন্ধু প্রথমে আমাকে পৌরসভার চেয়ারম্যান ও পরে জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর সংসদ নির্বাচন করতে বলেন”।

ইদরিস আলম মুসলিম হাই স্কুলের জেনারেল ক্যাপ্টেনও নির্বাচিত হন। ইতিমধ্যে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। পরে ম্যাট্রিক পাস করে সিটি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তিনি ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে যান। সিটি কলেজে অধ্যয়নকালে তাঁর নেতৃত্ব বিকশিত হয় এবং বাগ্মিতা প্রকাশ পায়। এক সময় তিনি তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, যিনি বক্তৃতার যাদুতে শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারেন। মুসলিম হাই স্কুলের ‘বিতার্কিক’ সিটি কলেজে এসে বাগ্মী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। চট্টগ্রামের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে তিনি প্রথমে সরকারি খরচে ঢাকা ও পরবর্তীকালে সরকারের খরচে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত শিল্পমন্ত্রীর সভায় তিনিই একমাত্র বাংলাভাষী বক্তা ছিলেন।

সিটি কলেজ ছিলো ইদরিস আলমের জীবনের সুবর্ণ যুগ। তিনি সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের এজিএস ও জিএস নির্বাচিত হন। এ সময় তাঁর মধ্যে কবিত্ব শক্তিরও উন্মেষ ঘটে। পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। বাগ্মিতায় ষাটের দশকে ইদরিস আলমের সমকক্ষতা দাবি করতে পারতেন আর মাত্র দু’জন ছাত্রলীগ নেতা আশরাফ খান ও এস.এম ইউসুফ। ফেরদৌস কোরেশীর কথা বললাম না, কারণ তিনি অনেক সিনিয়র। বেসিক ডেমোক্র্যাসির ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ইদরিস আলম ও আশরাফ খান চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে একনাগাড়ে ৩৩ ঘণ্টা বক্তৃতার রেকর্ড সৃষ্টি করেন। সেবার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের প্রার্থী ছিলেন ফাতেমা জিন্নাহ। লালদিঘি ময়দানে তাঁর জনসভা ছিলো। সহস্রাধিক মানুষ তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য স্টেশনে জমায়েত হয়েছিলো। কিন্তু তাঁর আসতে বিলম্ব হচ্ছিলো, তাই উৎসুক জনতাকে ধরে রাখতে ম্যারাথন বক্তৃতা।

মেধায় তাঁকে টেক্কা দেবার মতো ছিলেন এসএম ইউসুফ। এক্ষেত্রেও শহীদ মুরিদুল আলম ও ফেরদৌস কোরেশীর নাম আসবে না সিনিয়রিটির কারণে। লেখালেখিতে ইদরিস আলমের প্রতিদ্বদ্বী হিসেবে ভাবা যেতে পারে শওকত হাফিজ খান রুশ্নি ও গোফরান গাজীকে। এ প্রসঙ্গ যে কারণে দীর্ঘায়িত করলাম, তা হলো আমি বুঝাতে চাচ্ছি ইদরিস আলম চাইলে কবি বা তার্কিক, কিংবা উপস্থাপক বা আবৃত্তিকারও হতে পারতেন। তাঁর বক্তৃতা ছিলো প্রতর্কোন্মুখ, অথচ আবেগময় বা কাব্যিক। বক্তৃতায় সাহিত্য, ইতিহাসের উদ্ধৃতি টেনে সভাস্থলে এমন রসঘন জমাট পরিবেশ সৃষ্টি করতেন যে, বাচিক শিল্পের অপূর্ব প্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করে শ্রোতারা নালেঝোলে হয়ে যেতেন। বাংলা সাহিত্যের আলাওল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, উর্দু-ফারসি সাহিত্যের ইকবাল, হাফিজ, গালিব, সাদী, রুমী, জামী, ফেরদৌসী ছিলেন ইদরিস আলমের প্রিয় কবি। অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী হওয়ার কারণে উপর্যুক্ত কবিদের বহু কবিতা বা কাব্যাংশ তাঁর স্মৃতির ভান্ডারে জমা থাকতো। বক্তৃতা বা লেখায় পরপর তারা ভিড় করে আসতো। সমসাময়িক ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের সাথে তাঁর পার্থক্য হলো তিনি ছিলেন এমন এক বহুমাত্রিক প্রতিভা, যাঁর একার জীবনে বহু গুণের সমাবেশ ঘটেছিলো।

ছাত্র রাজনীতি করতে করতে ইদরিস আলম আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েন। তিনিই একমাত্র রাজনৈতিক কর্মী যিনি একাধারে ছাত্রলীগের নেতা, ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং সিটি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক, প্রচার সম্পাদক ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে যখন তাঁকে সিটি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক করা হয়, তখন ছাত্র রাজনীতিতে তাঁর ভরা যৌবন এবং তাঁর ছাত্রত্বও লোপ পায়নি।

“১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা কর্মসূচি দেয়ার পর ইদরিস আলম প্রথম উক্ত কর্মসূচির ব্যাখ্যা পুস্তিকা লেখেন। ৬ দফাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি ডা. সৈয়দুর রহমান চৌধুরী, মানিক চৌধুরী, বিধান কৃষ্ণ সেন, কামাল, আশরাফ খান, বদন দীদারি, জয়নাল আবেদিন প্রধান, আবদুল মালেক প্রমুখের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রথম সভার আয়োজন থেকে শুরু করে রাত-দিন প্রচার কার্য চালান।

ছাত্রলীগ করার অপরাধে ইদরিস আলম প্রতিদ্ব›দ্বী ছাত্র সংগঠন সমূহের রোষানলে পতিত হন এবং তাদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এমনভাবে ছুরিকাহত হন যে তাঁর প্রাণ সংশয় উপস্থিত হয়। তিনি লিখেছেন ১৯৬৬ সালের ১৭ অক্টোবর আমাকে তৎকালীন সরকারী ছাত্র সাংগঠন এনএসএফ ও ছাত্র ইউনিয়ন যুক্তভাবে হামলা করে চাকু চালায় এবং হোটেল মিসকার দক্ষিণে রেস্ট হাউসের পেছনে কচুবনে ফেলে দেয়।”

ইদরিস আলম রাজনৈতিক কারণে তিনবার কারাবরণ করেন। ১৯৬৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর স্টেডিয়ামে আইয়ুব খানের নির্বাচনী সভা থেকে প্রথম গ্রেফতার হন। ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয়বার এবং ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বর্তমান নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ অনেকের সঙ্গে গ্রেফতার হন। ইদরিস আলম মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাকলিয়া ও চরচাক্তাই এলাকায় কোন প্রাথমিক বা উচ্চ বিদ্যালয় ছিলো না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন অনেকেই বিষয় সম্পত্তি দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন, তখন ঊনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষাব্রতী কাজেম আলী মাস্টার ও মনুহর আলী মাস্টারের নাতি ইদরিস আলম তাঁর এলাকায় শিক্ষার আলো জ্বালাবার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি চর চাক্তাই উচ্চ বিদ্যালয়, চর চাক্তাই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ইউসেপ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ইদরিস আলম লিখেছেন, “আমার মনে হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম ও এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আমার জীবনের মহত্তর অবদান”।

২০০৬ সালের ২ জানুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় ইদরিস আলমের বাম হাত ভেঙে যায়। পরে তিনি পলিও আর্থারাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়েন। ২০০৬ সালের ৬ নভেম্বর তাঁর জীবন থেমে যায়।

লেখকঃ নাসিরুদ্দিন চৌধুরী,প্রবীন সাংবাদিক ও কলামিস্ট