নগর প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম বন্দর পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালের চুক্তি বাতিল ও এন.সি.টি সি.সি.টি সহ বন্দরের যে কোন অংশকে প্রাইভেট দেওয়ার প্রতিবাদে আজ শনিবার (০৭ ডিসেম্বর)সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের হলরুমে চট্টগ্রাম বন্দর সংযুক্ত শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বন্দর সংযুক্ত শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি মো. হারুন।
সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত আলোচনায় অংশ নেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কাজী শেখ নুরুল্লাহ বাহার।
লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন তসলিম উদ্দীন সেলিম।
এসময় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় শ্রমিক সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রমিক দলের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব এ এম নাজিম উদ্দিন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি বলেন, যে কোন উদ্ভুত পরিস্থিতির জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার দায় থাকবে। সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত দাবি সমূহ হল- বন্দরের ৪৫০০ শূন্য পদে স্বল্প সময়ে লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আউট সোচিং পদ্বতিতে নিয়োগ বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছি। চট্টগ্রাম বন্দর প্রাইভেটাইজেশন বাতিল সহ বিভিন্ন দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগামী ২২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবরে মিছিল সহকারে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। শ্রম শাখার অন্তর্ভূক্ত সকল শ্রমিক কর্মচারীদের দুইমাসের সম পরিমান ৬০ ডিউটি গ্র্যাচুয়েটি দিতে হবে এবং প্রতি মাসে ১০০০ এক হাজার টাকা প্রভিডেন্ড কান্ড কতর্ন করতে হবে। এমইউ চুক্তি মোতাবেক সকল শ্রমিক কর্মচারীদের বন্দরের নিজস্ব পরিচয়পত্র দিতে হবে।
বক্তারা বলেন, উইন্সম্যানদের/ক্রেন অপারেটরদের পদ মর্যাদা অনুযায়ী গ্র্যাচুয়েটি নির্ধারণ করতে হবে। সকল ষ্টিভিডোর ষ্টাফদের শ্রম শাখায় অর্ন্তভূক্ত করতে হবে। এন.সি.টি সি.সি.টি তে তিন শিফট ভিত্তিতে ল্যাসিং শ্রমিক বুকিং করতে হবে ও উৎপাদনশীলতার ভিত্তিতে মজুরী নির্ধারণ করতে হবে। আমরা মনে করি অর্ন্তবর্তী কালীন সরকার বন্দরকে বেসরকারী করণের জন্য যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এটি তাহাদের কাজ নয়। অর্ন্তবর্তী সরকার রুটিন কাজ করবে। বন্দর কিভাবে পরিচালিত হবে সেই সিদ্ধান্ত নিবে নির্বাচিত সরকার। এর ব্যতিরেকে বন্দরকে বেসরকারী করনের যেকোন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান সুস্পষ্ট। এক তরফা কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে আমরা শ্রমিক কর্মচারীরা কোন ভাবেই মেনে নিবো না। এটিই সংবাদ সম্মেলনের মূল লক্ষ্য।
এসব সার্বিক বিষয় নিয়ে ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে কাজী শেখ নুরুল্লাহ বাহার সকল সাংবাদিকদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্বাধীনতা দিবসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, জাতীয় অর্থনীতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব অপরিসীম। ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় বন্দর গুরুত্ব আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বহি:বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানী রপ্তানী বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ খোলা পণ্য এবং কন্টেইনারের পণ্য পরিবহণে ৯৮ শতাংশ এই বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। শ্রমিক কর্মচারীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর একটি আধুনিক বিশ্ব মানের বন্দরের সুখ্যাতি লাভ করেছে। ২০২০ সালে বৈশ্বিক মহামারী কোভিড ১৯ এর সময় মানুষ যখন জীবনের ভয়ে ঘর থেকে বের হতে ভয় পেতো। সে সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের সেবায় নিয়োজিত থেকে শ্রমিক কর্মচারীরা নিরলস ভাবে বন্দরকে স্বচল রেখে ছিল। বৈশ্বিক মহামারীর কারণে জাতীয় অর্থনিতীতে সকল মহল বিরুপ প্রভাবের যে আশংকা করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর স্বচল থাকায় সেটি বাহুলাংশে লাঘব হয়েছে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী কোভিড ১৯ পরিস্থিতি যখন মহামারী আকার ধারন করে, সেই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দর ২৮ লাখের বেশী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করে বিশ্বের শত শত বন্দরের স্থলে ৫৮তম স্থানে উন্নীত হয়েছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের এ অর্জন শ্রমিক কর্মচারীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর প্রতি বছর দেশের রাজস্ব খাতে শুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রতি বছর চট্টগ্রাম বন্দরের মুনাফা বেড়েই চলেছে। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের নীট আয় হয়েছে ৪ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা সদ্য সমাপ্ত ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে বন্দরের নীট আয় হয়েছে ৪ হাজার ৪৭৩ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকা। চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরের ৪ মাসে চট্টগ্রাম বন্দর ১৬৪৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা আয় করেছে। যাহা বিগত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১.৮৫% বেশী। আমরা আপনাদের মাধ্যমে বলতে চাই বাংলাদেশে অনেক লোকসানী প্রতিষ্ঠান ও রুগ্নশিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে যে গুলোকে লাভ জনক শিল্পে পরিণত করার জন্য কোন মাথা ব্যথা কারোর নেই।
চট্টগ্রাম বন্দর একটি লাভ জনক প্রতিষ্ঠান আজকে দেশী বিদেশী মাফিয়ারা চক্রান্তের মাধ্যমে দেশের অর্থনিতীর প্রানকেন্দ চট্টগ্রাম বন্দরকে লুটেপুটে খাওয়ার জন্য নানাবিধ ষড়যন্ত্র করে চলেছে। এ ষড়যন্ত্রের সাথে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং বন্দরের নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা আশংকা প্রকাশ করছি। তাই দেশের অর্থনীতি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের গুরুত্ব অনুধাবন করে বন্দরকে ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আপনাদের মাধ্যমে সমস্ত দেশ বাসীকে সোচ্চার থাকার এবং ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের আশাকাংখার প্রতীক। এই বন্দরকে দেশী-বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়ার জন্য বিগত পতিত স্বৈরাচার খুনী হাসিনা ও তার বেসরকারী করন উপদেষ্টা কুখ্যাত দরবেশ বাবা সালমান এফ রহমান নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রাম বন্দরকেও কুক্ষিগত করার জন্য যে পরিকল্পনা এটেছিল। বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা শাখাওয়াত হোসেনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পরিবর্তন করে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের আশায় তিনিও একই পথের পথিক হয়ে হাঁটছে।
লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনে তসলিম উদ্দীন সেলিম বলেন, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পতিত স্বৈরাচারের দোসরেরা তাদের নিয়োগকৃত দোসরেরা বন্দরকে প্রাইভেটাইজেশনে ছেড়ে দেয়ার জন্য অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। যাহা বন্দর ও দেশের অর্থনীতিকে এবং আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিবে। বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনা ইতি মধ্যে বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আমরা বলতে চাই বেসরকারী কোম্পানীগুলি তৈরিকৃত স্থাপনা ব্যবহার করে মুনাফা অর্জন করতে পারছে। তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা থাকা সত্বেও কেনো বন্দর নিজস্ব জনবল ব্যবহার করে বন্দরের রাজস্বকে আরো গতিশীল করতে অনীহা, তাহা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। তাই আমরা আজকের সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের নিকট উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি যেন বন্দরকে বেসরকারী করন প্রক্রিয়া, থেকে সরে আসে।
তিনি আরো বলেন, আমরা বন্দরকে সর্বপ্রকার বেসরকারী করন প্রক্রিয়ার তীব্র বিরুধীতা করছি। ইতি মধ্যে যে সকল প্রাইভেট কোম্পানীর সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে তাদের সাথে নতুন করে কোন চুক্তি না করার জন্য অনুরোধ করছি। চুক্তিকৃত পতেঙ্গাঁ কন্টেইনার টার্মিনালের চুক্তি বাতিল করে বন্দরের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করার দাবী জানাচ্ছি। এন.সি.টি সি.সি.টি টার্মিনালকে দুবাই ভিত্তিক একটি বেসরকারী কোম্পানীর হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার দোসর কুখ্যাত সালমান এফ রহমান যে রূপরেখা প্রনয়ন করে ছিল, সেটি বাস্তবায়নের জন্য বর্তমানে তাদের দোসরেরা তোড় জোড় চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা কিছুতেই এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন হতে দেব না। আমরা মনে করি আমলা তান্ত্রিক মনো ভিত্তি নিয়ে স্বার্থ সিদ্ধির জন্য দেশ বিরুধী আত্মঘাতী এ সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য একটি গোষ্ঠী অপ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের স্বার্থে বন্দরকে রক্ষা করার জন্য এ ধরণের সিদ্ধান্ত চিরতরে পরিহার করা একান্ত প্রয়োজন এবং আগামী এক বছরের মধ্যে বেসরকারী করণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মহোদয় সংবাদ সম্মেলনে যে ঘোষনা দিয়েছেন আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
সম্প্রতি একটি টিভি চ্যানেলে শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশন নেতৃবৃন্দ একটি সাক্ষাৎ কারে শ্রমিক কর্মচারীদের কল্যাণমূলক সুযোগ সুবিধা প্রদানের জন্য যে লেভী কর্তন করা হয়, এবিষয়ে ভূল ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। যার কারণে শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। আমরা ঐ বক্তব্য প্রত্যাহার কারার দাবী করছি এবং এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
মো. হারুন বলেন, শ্রমিক কর্মচারীদের র্গ্যাচুয়িটি, প্রভিডেন্ড ফান্ড সহ যাবতীয় অন্যান্য কল্যান মূলক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য দীর্ঘ বহু বছর যাবত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ লেভী কর্তন করে আসছে। আমরা মনে করি দীর্ঘদিন যাবত চলমান একটি বিষয়ে অপব্যাখ্যা দিয়ে স্বৈরাচার আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসরেরা চট্টগ্রাম বন্দরকে অস্থিতিশীল করার চক্রন্ত করছে। যাতে করে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। পতিত স্বৈরাচারের দোসরেরা বন্দর নিয়ে ষড়যন্ত্র করেই চলেছে। শ্রমিক কর্মচারীদের উস্কে দিয়ে বন্দরকে অস্থিতিশীল করার জন্য সুদুর প্রসারী এক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা মনে করি যেকোন সময় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বন্দরের কাজে বড় ধরণের আঘাত হানতে পারে। লেভী সংক্রান্ত বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের ১৪১৫৬নং বোর্ড সভার একটি চিত্র উপস্থাপন করা হল। বন্দরকে সকল ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা সচেতন আছি এবং আপনারা সহ সকল মহল ও দেশবাসীকে সতর্ক ও সজাগ থাকার আহবান জানাচ্ছি।
উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় শ্রমিক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুর রহমান মজুমদার, দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বন্দর সংযুক্ত শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ-এর মধ্যে ইব্রাহিম খোকন, আবুল কাসেম, মো. ইকবাল, মো. স্বপন, মোস্তাফিজুর রহমান মজু, ইমাম হোসেন খোকন, মো. হাসান, ইব্রাহিম ফরাজি, মো. হোসেন, মো. হাসান, হুমায়ুন কবির, নাজিম উদ্দীন, রাসেল খান রানা, হুমায়ন কবির ফারুক, আবদুর রব, মো. ইউসুফ, মো. পারভেজ, খন্দকার রাজু আহমেদ, মো. জহির, আল ফারুক প্রমুখ।