অনুসন্ধানী প্রতিবেদন——
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি: খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার অন্তবরতী সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নে অন্তরায়, হাসিনা পালিয়ে গেলেও জেলা শাসন করছে ফ্যাসিস্টের দোসর ও আমলারা। ছাত্র-জনতার রক্তে প্রতিষ্ঠিত অন্তবরতী সরকারের একশ দিন পার হলেও এখনো জেলা ৯টি উপজেলা শাসন করছে গোপালগঞ্জ ও ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনার আমলের কর্মকর্তারা। জেলা প্রশাসন, পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম টাস্কফোর্স ও সড়ক বিভাগে এখনো বহাল তবিয়তে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারা দোসর ও আমলারা। ফলে নানান ভাবে ব্যাহত হচ্ছে ছাত্র-জনতার সরকারের কর্মসূচী।
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান সরকারের কর্মসূচী বাস্তবায়নে খাগড়াছড়িতে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর ও আমলা তান্ত্রিকরা নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো: সহিদুজ্জামান ২০২২সালের ৪ঠা ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি জেলার জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে তিনি ছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রীর একান্ত সাধন চন্দ্র মজুমদারের সচিব। মো: সহিদুজ্জামান ২৫তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য। তিনি গোপালগঞ্জ জেলার শাপলাডাঙ্গা উপজেলার অধিবাসী। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গভর্নমেন্ট এন্ড পলিটিক্স বিষয়ে বিএসসি ও এমএসসি পাশ করার পর ২০০৬সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস কর্মকমিশনে যোগদান করেন।
সূত্র বলছে, ২০২৪সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার দলীয় প্রার্থীকে নিবিঘ্নে নির্বাচনী বৈতরী পার করানোর জন্য হাসিনা সরকারের অনুগত ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তা হিসেবে মো: সহিদুজ্জামানকে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক হিসেবে বদলী করা হয়। যদিও নানাকূট কৌশলের আশ্রয় নিলেও খাগড়াছড়ি সংসদীয় আসনে ১৯টি কেন্দ্রে শূন্য ভোট ও অন্তত: ৫০টি কেন্দ্রে ১ থেকে ২টির বেশি ভোট পড়েনি।
শেখ হাসিনার আরো এক অনুগত কর্মকর্তা হচ্ছেন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা(উপ-সচিব) সুমন চৌধুরী। তিনি ২০২৩সালের ৮ অক্টোবর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন হত্যাসহ একাধিক মামলার পলাতক আসামী সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মংসুইপ্রুু চৌধুরীর শিক্ষকসহ হস্তান্তরিত বিভাগে নিয়োগ, ভুয়া প্রকল্প গ্রহণ ও খাদ্যসশ্যসহ বিভিন্ন খাতে হাজার হাজার কোটি আত্মসাতের সহযোগী এবং পরিকল্পনাকারী।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা টিটন খীসা ২০১৭ সালের ৪ জুলাই খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। এক সময় টিটন খীসা ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বৌধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমার কম্পিউটার অপারেটর। পরবর্তীতে তিনি ২৪বিসিএস-এ প্রশাসনিক ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ পান। পতিত হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা টিটন খীসা ছিলেন অন্যতম সুবিধাভোগী। তার বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে পদোন্নতি পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৫ সালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ বালু ইজারা এক উপজেলা চেয়ারম্যানকে মারধরে অপরাধে বিভাগীয় মামলা হয়। এ ঘটনায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। তদন্তে টিটন খীসার বিরুদ্ধে অভিযোগে সত্যতা পায়। ফলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় টিটন খীসার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। টিটন খীসা আদালতে আশ্রয় নিলে তাকে বেকুসুর খালাস দেয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পাল্টা আপীল করে। যা এখনো নিস্পত্তি হয়নি।
অন্তর্বতীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দীর্ঘদিন বঞ্চিত থাকা ১১৭জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ(অতীতের কোনো সময়ে কার্যকর ধরে) উপ-সচিব পদে পদোন্নতি দেয় সরকার। এ তালিকায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নিবাহী কর্মকর্তা টিটন খীসাকেও পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতি তালিকায় তাকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দেখানো হয়। ঘটনাটি এমন তাকে উপ-সচিব থেকে উপ-সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি ২৪বিসিএস-এ প্রশাসনিক ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ পান।
বৈষম্যমূলক পার্বত্য চুক্তির ফসল পার্বত্য চট্টগ্রাম অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুু(পাহাড়ী ও বাঙ্গালী) নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্সে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে নিয়োগ পাওয়া চেয়ারম্যান সুদত্ত চাকমা, চুক্তি ভিক্তিক নিয়োগ পাওয়া কৃষ্ণ চন্দ্র চাকমা ও প্রেশনে আসা নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদুল হক বহাল তবিয়তে। কৃষ্ণ চন্দ্র চাকমা ২০১৯ সালে চুক্তি ভিক্তিক নিয়োগ পান। তার নিয়োগ আরো দুই দফা বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
অনুসন্ধান বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুু(পাহাড়ী ও বাঙ্গালী) নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্স ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় কৃষ্ণ চন্দ্র চাকমাকে। এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন। এ কৃষ্ণ চন্দ্র চাকমা মূলত. পোষ্টাল ক্যাডারের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি তৎকালীন পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার ব্যাচমেট।
মূলত: স্বজনপ্রীতির কারণে উপ-সচিব মর্যাদার এ কর্মকর্তা এ পর্যন্ত তিনবার দুই বৎসর করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ বাড়িয়ে টানা ৫ বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছে। যার ৬ বছরের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালের ২৭ এপ্রিল। প্রকৌশলী মো: মাকসুদুর রহমান ২০২২সালের ৯ নভেম্বর খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপদ বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন।
অভিযোগ রয়েছে, চুয়েট থেকে পাশ করা মো: মাকসুদুর রহমান ছিলেন, পলাতক সাবেক সড়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র ত্রিপুরার দুর্নীতি ও অনিয়মের সহযোগী। মাকসুদুর রহমান সাবেক দুই মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর ঠিকাদারী সিন্ডিকেটের সকল অপকমের নায়ক। ফলে বিগত দিনে তাদের পছন্দের বাইরে কোন ঠিকাদার সড়ক উন্নয়নে কোন টেন্ডারে অংশ নিতে পারেনি। কোন ঠিকাদার ভাগ্যক্রমে লটারিতে কাজ পেলেও কাজ করতে পারেনি।
পলাতক সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার দুর্নীতি ও অনিয়মের অন্যতম সহযোগি ছিলেন, খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন ডা: মোহাম্মদ ছাবের। স্বাস্থ্য বিভাগের ঔষধ সরবরাহ থেকে যাবতীয় সকল টেন্ডার হয়েছে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ইচ্ছায় ও সিভিল সার্জন ডা: মোহাম্মদ ছাবের সিদ্ধান্তে। ফলে খাগড়াছড়ির স্বাস্থ্য সেবা ভেঙ্গে পরার উপক্রম হয়েছে।
সচেতন মহলের দাবি, অন্তর্বতীকালীন সরকারের কর্মসূচী সফল বাস্তবায়ন করতে গোপালগঞ্জ ও ফ্যাসিবাদের দোসর ও আমলাতান্ত্রিক সহযোগীদের অন্যত্র বদলী করা নিতান্ত জরুরী বলে অনেকে মনে করেন।