মো. কামাল উদ্দিনঃ তানহার জীবন যেন এক মর্মস্পর্শী কাব্য, যেখানে প্রতিটি পঙক্তির মাঝে লুকিয়ে আছে ভুল, অভিমান, আর অতল ভালোবাসার গভীর আর্তনাদ। ছোট্ট একটি মেয়েবেলার স্বপ্ন আর ভালোবাসার গল্প থেকে তার জীবনের পথচলা শুরু। কখনো ভেবে দেখেনি যে তার এই স্বপ্ন একদিন এভাবে বেদনায় রূপ নেবে।

তানহার প্রেম শুরু হয়েছিল এক অনামি আকর্ষণ থেকে। প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি এই মানুষের প্রতি কেন এমন আকর্ষণ। ধীরে ধীরে সেই আকর্ষণ এক অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসায় রূপ নেয়, আর তানহার মন জুড়ে তখন কেবল সেই মানুষটির মুখ আর তার কোমল কথাগুলো। সে স্বপ্ন দেখত, একদিন এই মানুষটিই তার সকল সুখ-দুঃখের সঙ্গী হবে। মনের গভীরতার আস্থা আর ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে তানহা তার সমস্ত কিছু উজাড় করে দিল। কিন্তু তানহা বুঝতে পারেনি, তার প্রিয় মানুষটি যে স্নেহের কথা বলেছে, তা যেন প্রতারণার আরেক রূপ। বিয়ের দিন আসল, তবে তানহার চোখে তখন ছিল শুধু অগাধ বিশ্বাস। মনে মনে ভাবল, জীবনভর ভালবাসার মানুষটির পাশে থাকবে।

ইসলামি শরীয়তের বিধান মেনে তাদের সম্পর্ক শুরু হলেও, সেই মানুষটি একটিবারও কাগজপত্রের কথা বলল না। তানহার মনে কোনো সন্দেহ আসেনি; সে ভেবেছিল, ভালোবাসার মানুষের কাছে কাগজপত্রের কি দরকার? কিন্তু ধীরে ধীরে তানহার জীবন জটিল হয়ে উঠল। যে মানুষটি প্রেমের কথা বলত, তার মুখে এখন দেখা গেল অন্যরূপ। ভালোবাসার মানুষটি যেন কেবল তার দেহের জন্যই আকৃষ্ট ছিল, ভালোবাসার গভীরতায় নয়। তানহার হৃদয়ে প্রতিনিয়ত একটি প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে-প্রেমে প্রতারণা কি সত্যিই এরকম? সে কেবল বিশ্বাসে ভর করেছিল, কিন্তু সেই বিশ্বাস আজ ভেঙে চুরমার। এই ভাঙা স্বপ্নের মাঝে নতুন এক জীবনও চলে এলো তানহার মধ্যে। গর্ভে সন্তান ধারণের সংবাদ তাকে কিছুটা আনন্দ দিলেও, সাথে সাথে আসল চিন্তার মুখোমুখি হল সে। এই সন্তানের পরিচয় কি হবে? কার পরিচয়ে সে দুনিয়ায় আসবে? কোনো আইনগত নথি ছাড়াই তানহাকে বিয়ে করেছিল তার প্রেমিক স্বামী।

ধর্মীয় বিধান মেনে সম্পর্কের পাশাপাশি কাবিননামা ও ছিল , যা তানহা তখন বুঝতেও পারেনি সেই যে স্বামীর ঘর থেকে বিতারিত হবে।তার ভালোবাসা ছিল অন্ধ, যার মধ্যে কাগজের প্রয়োজন ছিল না; ছিল কেবল স্বামীর প্রতি নির্ভেজাল আস্থা। কিন্তু এই আস্থার বিনিময়ে সে পেয়েছিল প্রতারণা আর দুঃসহ যন্ত্রণা। আজ তানহা আর সেই আগের তানহা নেই। জীবনের প্রতারণায় ক্লান্ত, অভিমানী এক নারী এখন সে। যে হাত ধরে একদিন সংসার ত্যাগ করেছিল, আজ সেই হাত তাকে অবহেলা করে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তার সামনে একমাত্র বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য তার পুত্র সন্তান, যার মধ্যে সে নিজের ভাঙা স্বপ্নের ছায়া খুঁজে পায়। তানহা এখন তার পরিবারকাছেই রয়েছে। সেই মানুষটির কাছে ফিরে যাওয়ার পথও নেই। জীবনের প্রতিটি দিনের আঘাত তার মনে নতুন ক্ষত সৃষ্টি করে, কিন্তু সন্তানকে সামনে রেখে তানহা আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। এই তানহা আর কোনো মায়াবী ভালোবাসার আশায় বাঁচে না, বরং নিজের সন্তানের জন্য বাঁচে। জীবনের কাঁটাময় পথে যে বেদনাগুলো তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, সেই বেদনাগুলোই যেন তার সাহস হয়ে উঠেছে। তার জীবনের গল্প এক অবিস্মরণীয় প্রেমের গল্প হলেও, এই প্রেম তার জন্য শুধু বেদনা আর আঘাতের নামান্তর। তবুও তানহা সেই কঠিন জীবনের পথে একা দাঁড়িয়ে আছে, এক নিঃসঙ্গ যোদ্ধার মতো, যার মন আজও আশা করে একদিন এই বেদনার শেষ হবে।

তানহার এই গল্প যেন প্রেম আর প্রতারণার এক করুণ কাহিনী। সত্যিকারের ভালোবাসা তাকে জীবনে কখনো সুখ দিতে পারেনি, বরং প্রতারণা তাকে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তানহা হয়তো জানে না তার জীবনের শেষ কোথায়, তবে সে জানে-তার সন্তানের জন্য, তার জীবনের বাকি যাত্রা একান্ত সংগ্রামের। তানহার জীবনের প্রতিটি দিন যেন নতুন একটি পরীক্ষা। যে বিশ্বাস আর ভালোবাসার আশ্রয়ে সে একদিন ঘর ছেড়েছিল, সেই আশ্রয় ভেঙে পড়েছে অনেক আগেই। কিন্তু, এখনো তার বুকের ভেতরে একধরনের মায়া বেঁধে রেখেছে। তানহা নিজের ছেলের দিকে তাকায়, সেই অবুঝ মুখে এক নতুন প্রশ্ন, এক নতুন অনুরোধ-“মা, তুমি নতুন বাবাকে ঘরে নিয়ে আসো না কেন?” ছেলেটির ছোট্ট মনেও একধরনের অভিমান জমে আছে। যে মানুষটি তার জন্ম দিয়েছে, তাকে স্বীকৃতি না দিয়েই চলে গেছে নতুন সংসারে। বাবার এই নিষ্ঠুরতার প্রতি এক ধরনের ঘৃণা এসে গেছে তার মনের ভেতর।

তানহা চুপচাপ নিজের ভাঙা হৃদয়ের ভার নিয়ে বেঁচে থাকে। ছেলের স্কুলে ভর্তি করানোর কথা যখন ভাবে, তার মন কেঁদে ওঠে। জন্ম সনদ নেই, কোন সামাজিক স্বীকৃতি নেই, কোন আইনি প্রমাণ নেই যে সে একজন মা। এই সমাজের সব কিছু যেন তাকেই ভুল বুঝতে শিখেছে। তবু সে হাল ছাড়েনি, অনেক আশা নিয়ে প্রতিদিন লড়ছে। তানহার মন মাঝে মাঝে ভাবে, যদি নতুন কিছু শুরু করত তবে হয়তো তার জীবনটা সহজ হতো। তার সৌন্দর্য এখনো অটুট; অনেকেই চায় তাকে আবার নতুন জীবন দিতে। কিন্তু তানহার মন আর সেখানে নেই। সে জানে, একজন মা হিসেবে তার প্রথম এবং শেষ দায়িত্ব তার সন্তানের প্রতি। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সে নতুন কিছু ভাবতে পারে না। তার মনে একটাই বাসনা-তার এই কষ্ট, এই একাকিত্ব, আর এই প্রতারণার গল্প যেন আর কারো জীবনে না আসে।

তানহার জীবন যেন শুধুই এক লড়াই। সে চায় তার গল্পটি অন্যদের জন্য একটি শিক্ষা হয়ে থাকুক, যাতে আর কোন মেয়ে প্রতারণার এই বিষময় অধ্যায়ে পা না দেয়, যাতে আর কেউ তানহার মতো প্রতিটি মুহূর্তে প্রতারণার দহন না বয়ে বেড়ায়। তানহা নিজে নিজে আক্ষেপ করে বলে-তানহার জীবন যেন এক কঠিন পরীক্ষার নাম, দুঃখ করে বলে- যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে আমার জন্য অপেক্ষা করে নতুন কোনো ব্যথা, নতুন কোনো লজ্জা। জীবনের শুরুতে আমার হৃদয় ভরা ছিল ভালোবাসা। আমিনস্বপ্ন দেখেছিলসম একজন সঙ্গীর হাত ধরে সুখী সংসারের। কিন্তু যে মানুষটিকে আমি অন্ধভাবে ভালোবেসেছিলাম সেই মানুষটি আমাকে শুধু দুঃখ আর যন্ত্রণাই দিয়েছে। বিয়ে হয়ে গেল, অথচ কোনো কাগজপত্রে কোনো নাম লেখা হলো না, কোনো কাবিননামা আমার জীবনের সাথে সংযুক্ত হলো না। তানহা জানতই না, যে ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা পড়েছিল, তা ছিল শুধু মুখের মিষ্টি মায়া। তার স্বামী তাকে শুধু ভোগের বস্তু হিসেবে দেখেছিল, তার মনের গভীর ভালোবাসা কখনোই তার কাছে মূল্যবান ছিল না। তানহার হৃদয় ভেঙে যেতে শুরু করলো, কিন্তু সে বুঝতে পারল না কীভাবে এই জটিলতা থেকে বের হবে। তার পেটে তখন তাদের সন্তান-একটি নির্দোষ প্রাণ, যার পরিচয়ের ভিত্তি নিয়ে তানহা প্রতিনিয়ত প্রশ্নের মুখোমুখি। কিন্তু তানহা অপেক্ষা করেছিল, মনে হয়েছিল, হয়তো সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে একদিন তার স্বামী ফিরে আসবে, সেই প্রেমিকের ছায়া নিয়ে। সে ভাবতে পারত না যে তার স্বামী কখনোই আর ফিরে আসবে না। সে এক নতুন সংসার পেতেছে, জীবনের পথ আবার নতুনভাবে বেছে নিয়েছে, কিন্তু তানহার কাছে কোনো খবরই পাঠায়নি। এদিকে, তানহার ছেলেও ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। তানহার সন্তান আজ বাবার পরিবর্তে আরেকটি বাবা চায়। সে তার মায়ের কাছে এসে বলে, “মা, অন্যদের তো বাবা আছে, আমারও বাবা চাই।” তার মায়ের চোখে ভীষণ দুঃখ জমে ওঠে, কিন্তু সে কিছু বলে না। সন্তানের এই অবুঝ কথাগুলো তার হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দেয়।

তানহার মনের এক কোণে কিছু প্রশ্ন প্রতিদিনই উঠে আসে। তানহা জানে, তার সৌন্দর্য এখনো অনেককে আকর্ষণ করে। তার কাছে একাধিক প্রস্তাব এসেছে নতুন করে জীবন শুরু করার, কিন্তু সে জানে, এই পথে গেলে তার ছেলের প্রতি তার দায়িত্বে কোনো ফাঁক রেখে যেতে হবে। নিজের ভালোবাসার মানুষ, নিজের মা-বাবা, এমনকি ভাই-বোনদের থেকেও সে দূরে সরে গেছে, সেই ক্ষতি আর পূরণ করা সম্ভব নয়। সে চায় না আরেকটি ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ছেলেটির জীবন আবার ধোঁকার মধ্যে পড়ুক। তানহার দিনগুলো কাটে চুপচাপ, এক নিরব সংগ্রামের মধ্যে। সে তার ছেলেকে একা মানুষ করার অঙ্গীকার নিয়েছে। ছেলের ভালো-মন্দের চিন্তা ছাড়া আর কিছু তার মনে আসে না। সেই ছোট্ট ছেলেটি হয়তো একদিন বড় হবে, হয়তো তার মায়ের এই সংগ্রামকে বুঝবে। আর তানহার এই জীবন যেন আর কোনো মেয়ের জীবনে না আসে। তানহার জীবনের গল্পটি যে কেবল তার একার নয়, তা যেন সমস্ত মায়েদের জন্য এক সতর্ক বার্তা হয়ে ওঠে। সে চায় তার জীবনের প্রতিটি দুঃখের অধ্যায় অন্য মেয়েদের জন্য শিক্ষা হোক। যেন তারা এই মায়াবী প্রেমের ফাঁদে পা না দেয়, যেন তারা এই ভুলে নিজেদের জীবনকে দুঃখের সমুদ্র না বানায়। তানহার প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি ক্ষত থেকে উঠে আসা গল্প যেন একদিকে সতর্কতা আর অন্যদিকে প্রতিশ্রুতির এক বুনন।

মো. কামাল উদ্দিনঃ তানহার জীবন যেন এক মর্মস্পর্শী কাব্য, যেখানে প্রতিটি পঙক্তির মাঝে লুকিয়ে আছে ভুল, অভিমান, আর অতল ভালোবাসার গভীর আর্তনাদ। ছোট্ট একটি মেয়েবেলার স্বপ্ন আর ভালোবাসার গল্প থেকে তার জীবনের পথচলা শুরু। কখনো ভেবে দেখেনি যে তার এই স্বপ্ন একদিন এভাবে বেদনায় রূপ নেবে।

তানহার প্রেম শুরু হয়েছিল এক অনামি আকর্ষণ থেকে। প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি এই মানুষের প্রতি কেন এমন আকর্ষণ। ধীরে ধীরে সেই আকর্ষণ এক অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসায় রূপ নেয়, আর তানহার মন জুড়ে তখন কেবল সেই মানুষটির মুখ আর তার কোমল কথাগুলো। সে স্বপ্ন দেখত, একদিন এই মানুষটিই তার সকল সুখ-দুঃখের সঙ্গী হবে। মনের গভীরতার আস্থা আর ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে তানহা তার সমস্ত কিছু উজাড় করে দিল। কিন্তু তানহা বুঝতে পারেনি, তার প্রিয় মানুষটি যে স্নেহের কথা বলেছে, তা যেন প্রতারণার আরেক রূপ। বিয়ের দিন আসল, তবে তানহার চোখে তখন ছিল শুধু অগাধ বিশ্বাস। মনে মনে ভাবল, জীবনভর ভালবাসার মানুষটির পাশে থাকবে।

ইসলামি শরীয়তের বিধান মেনে তাদের সম্পর্ক শুরু হলেও, সেই মানুষটি একটিবারও কাগজপত্রের কথা বলল না। তানহার মনে কোনো সন্দেহ আসেনি; সে ভেবেছিল, ভালোবাসার মানুষের কাছে কাগজপত্রের কি দরকার? কিন্তু ধীরে ধীরে তানহার জীবন জটিল হয়ে উঠল। যে মানুষটি প্রেমের কথা বলত, তার মুখে এখন দেখা গেল অন্যরূপ। ভালোবাসার মানুষটি যেন কেবল তার দেহের জন্যই আকৃষ্ট ছিল, ভালোবাসার গভীরতায় নয়। তানহার হৃদয়ে প্রতিনিয়ত একটি প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে-প্রেমে প্রতারণা কি সত্যিই এরকম? সে কেবল বিশ্বাসে ভর করেছিল, কিন্তু সেই বিশ্বাস আজ ভেঙে চুরমার। এই ভাঙা স্বপ্নের মাঝে নতুন এক জীবনও চলে এলো তানহার মধ্যে। গর্ভে সন্তান ধারণের সংবাদ তাকে কিছুটা আনন্দ দিলেও, সাথে সাথে আসল চিন্তার মুখোমুখি হল সে। এই সন্তানের পরিচয় কি হবে? কার পরিচয়ে সে দুনিয়ায় আসবে? কোনো আইনগত নথি ছাড়াই তানহাকে বিয়ে করেছিল তার প্রেমিক স্বামী।

ধর্মীয় বিধান মেনে সম্পর্কের পাশাপাশি কাবিননামা ও ছিল , যা তানহা তখন বুঝতেও পারেনি সেই যে স্বামীর ঘর থেকে বিতারিত হবে।তার ভালোবাসা ছিল অন্ধ, যার মধ্যে কাগজের প্রয়োজন ছিল না; ছিল কেবল স্বামীর প্রতি নির্ভেজাল আস্থা। কিন্তু এই আস্থার বিনিময়ে সে পেয়েছিল প্রতারণা আর দুঃসহ যন্ত্রণা। আজ তানহা আর সেই আগের তানহা নেই। জীবনের প্রতারণায় ক্লান্ত, অভিমানী এক নারী এখন সে। যে হাত ধরে একদিন সংসার ত্যাগ করেছিল, আজ সেই হাত তাকে অবহেলা করে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তার সামনে একমাত্র বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য তার পুত্র সন্তান, যার মধ্যে সে নিজের ভাঙা স্বপ্নের ছায়া খুঁজে পায়। তানহা এখন তার পরিবারকাছেই রয়েছে। সেই মানুষটির কাছে ফিরে যাওয়ার পথও নেই। জীবনের প্রতিটি দিনের আঘাত তার মনে নতুন ক্ষত সৃষ্টি করে, কিন্তু সন্তানকে সামনে রেখে তানহা আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। এই তানহা আর কোনো মায়াবী ভালোবাসার আশায় বাঁচে না, বরং নিজের সন্তানের জন্য বাঁচে। জীবনের কাঁটাময় পথে যে বেদনাগুলো তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, সেই বেদনাগুলোই যেন তার সাহস হয়ে উঠেছে। তার জীবনের গল্প এক অবিস্মরণীয় প্রেমের গল্প হলেও, এই প্রেম তার জন্য শুধু বেদনা আর আঘাতের নামান্তর। তবুও তানহা সেই কঠিন জীবনের পথে একা দাঁড়িয়ে আছে, এক নিঃসঙ্গ যোদ্ধার মতো, যার মন আজও আশা করে একদিন এই বেদনার শেষ হবে।

তানহার এই গল্প যেন প্রেম আর প্রতারণার এক করুণ কাহিনী। সত্যিকারের ভালোবাসা তাকে জীবনে কখনো সুখ দিতে পারেনি, বরং প্রতারণা তাকে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তানহা হয়তো জানে না তার জীবনের শেষ কোথায়, তবে সে জানে-তার সন্তানের জন্য, তার জীবনের বাকি যাত্রা একান্ত সংগ্রামের। তানহার জীবনের প্রতিটি দিন যেন নতুন একটি পরীক্ষা। যে বিশ্বাস আর ভালোবাসার আশ্রয়ে সে একদিন ঘর ছেড়েছিল, সেই আশ্রয় ভেঙে পড়েছে অনেক আগেই। কিন্তু, এখনো তার বুকের ভেতরে একধরনের মায়া বেঁধে রেখেছে। তানহা নিজের ছেলের দিকে তাকায়, সেই অবুঝ মুখে এক নতুন প্রশ্ন, এক নতুন অনুরোধ-“মা, তুমি নতুন বাবাকে ঘরে নিয়ে আসো না কেন?” ছেলেটির ছোট্ট মনেও একধরনের অভিমান জমে আছে। যে মানুষটি তার জন্ম দিয়েছে, তাকে স্বীকৃতি না দিয়েই চলে গেছে নতুন সংসারে। বাবার এই নিষ্ঠুরতার প্রতি এক ধরনের ঘৃণা এসে গেছে তার মনের ভেতর।

তানহা চুপচাপ নিজের ভাঙা হৃদয়ের ভার নিয়ে বেঁচে থাকে। ছেলের স্কুলে ভর্তি করানোর কথা যখন ভাবে, তার মন কেঁদে ওঠে। জন্ম সনদ নেই, কোন সামাজিক স্বীকৃতি নেই, কোন আইনি প্রমাণ নেই যে সে একজন মা। এই সমাজের সব কিছু যেন তাকেই ভুল বুঝতে শিখেছে। তবু সে হাল ছাড়েনি, অনেক আশা নিয়ে প্রতিদিন লড়ছে। তানহার মন মাঝে মাঝে ভাবে, যদি নতুন কিছু শুরু করত তবে হয়তো তার জীবনটা সহজ হতো। তার সৌন্দর্য এখনো অটুট; অনেকেই চায় তাকে আবার নতুন জীবন দিতে। কিন্তু তানহার মন আর সেখানে নেই। সে জানে, একজন মা হিসেবে তার প্রথম এবং শেষ দায়িত্ব তার সন্তানের প্রতি। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সে নতুন কিছু ভাবতে পারে না। তার মনে একটাই বাসনা-তার এই কষ্ট, এই একাকিত্ব, আর এই প্রতারণার গল্প যেন আর কারো জীবনে না আসে।

তানহার জীবন যেন শুধুই এক লড়াই। সে চায় তার গল্পটি অন্যদের জন্য একটি শিক্ষা হয়ে থাকুক, যাতে আর কোন মেয়ে প্রতারণার এই বিষময় অধ্যায়ে পা না দেয়, যাতে আর কেউ তানহার মতো প্রতিটি মুহূর্তে প্রতারণার দহন না বয়ে বেড়ায়। তানহা নিজে নিজে আক্ষেপ করে বলে-তানহার জীবন যেন এক কঠিন পরীক্ষার নাম, দুঃখ করে বলে- যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে আমার জন্য অপেক্ষা করে নতুন কোনো ব্যথা, নতুন কোনো লজ্জা। জীবনের শুরুতে আমার হৃদয় ভরা ছিল ভালোবাসা। আমিনস্বপ্ন দেখেছিলসম একজন সঙ্গীর হাত ধরে সুখী সংসারের। কিন্তু যে মানুষটিকে আমি অন্ধভাবে ভালোবেসেছিলাম সেই মানুষটি আমাকে শুধু দুঃখ আর যন্ত্রণাই দিয়েছে। বিয়ে হয়ে গেল, অথচ কোনো কাগজপত্রে কোনো নাম লেখা হলো না, কোনো কাবিননামা আমার জীবনের সাথে সংযুক্ত হলো না। তানহা জানতই না, যে ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা পড়েছিল, তা ছিল শুধু মুখের মিষ্টি মায়া। তার স্বামী তাকে শুধু ভোগের বস্তু হিসেবে দেখেছিল, তার মনের গভীর ভালোবাসা কখনোই তার কাছে মূল্যবান ছিল না। তানহার হৃদয় ভেঙে যেতে শুরু করলো, কিন্তু সে বুঝতে পারল না কীভাবে এই জটিলতা থেকে বের হবে। তার পেটে তখন তাদের সন্তান-একটি নির্দোষ প্রাণ, যার পরিচয়ের ভিত্তি নিয়ে তানহা প্রতিনিয়ত প্রশ্নের মুখোমুখি। কিন্তু তানহা অপেক্ষা করেছিল, মনে হয়েছিল, হয়তো সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে একদিন তার স্বামী ফিরে আসবে, সেই প্রেমিকের ছায়া নিয়ে। সে ভাবতে পারত না যে তার স্বামী কখনোই আর ফিরে আসবে না। সে এক নতুন সংসার পেতেছে, জীবনের পথ আবার নতুনভাবে বেছে নিয়েছে, কিন্তু তানহার কাছে কোনো খবরই পাঠায়নি। এদিকে, তানহার ছেলেও ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। তানহার সন্তান আজ বাবার পরিবর্তে আরেকটি বাবা চায়। সে তার মায়ের কাছে এসে বলে, “মা, অন্যদের তো বাবা আছে, আমারও বাবা চাই।” তার মায়ের চোখে ভীষণ দুঃখ জমে ওঠে, কিন্তু সে কিছু বলে না। সন্তানের এই অবুঝ কথাগুলো তার হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দেয়।

তানহার মনের এক কোণে কিছু প্রশ্ন প্রতিদিনই উঠে আসে। তানহা জানে, তার সৌন্দর্য এখনো অনেককে আকর্ষণ করে। তার কাছে একাধিক প্রস্তাব এসেছে নতুন করে জীবন শুরু করার, কিন্তু সে জানে, এই পথে গেলে তার ছেলের প্রতি তার দায়িত্বে কোনো ফাঁক রেখে যেতে হবে। নিজের ভালোবাসার মানুষ, নিজের মা-বাবা, এমনকি ভাই-বোনদের থেকেও সে দূরে সরে গেছে, সেই ক্ষতি আর পূরণ করা সম্ভব নয়। সে চায় না আরেকটি ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ছেলেটির জীবন আবার ধোঁকার মধ্যে পড়ুক। তানহার দিনগুলো কাটে চুপচাপ, এক নিরব সংগ্রামের মধ্যে। সে তার ছেলেকে একা মানুষ করার অঙ্গীকার নিয়েছে। ছেলের ভালো-মন্দের চিন্তা ছাড়া আর কিছু তার মনে আসে না। সেই ছোট্ট ছেলেটি হয়তো একদিন বড় হবে, হয়তো তার মায়ের এই সংগ্রামকে বুঝবে। আর তানহার এই জীবন যেন আর কোনো মেয়ের জীবনে না আসে। তানহার জীবনের গল্পটি যে কেবল তার একার নয়, তা যেন সমস্ত মায়েদের জন্য এক সতর্ক বার্তা হয়ে ওঠে। সে চায় তার জীবনের প্রতিটি দুঃখের অধ্যায় অন্য মেয়েদের জন্য শিক্ষা হোক। যেন তারা এই মায়াবী প্রেমের ফাঁদে পা না দেয়, যেন তারা এই ভুলে নিজেদের জীবনকে দুঃখের সমুদ্র না বানায়। তানহার প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি ক্ষত থেকে উঠে আসা গল্প যেন একদিকে সতর্কতা আর অন্যদিকে প্রতিশ্রুতির এক বুনন।