নিজস্ব প্রতিনিধি, নুরুল ইসলাম: সীরত একটি পবিত্র শব্দ। প্রিয় নবী (স.) এর জীবন-কর্ম এতে নিহিত। সীরতের পবিত্রতাকে মহাসমারোহে বিশ^ব্যাপী মুুমিন মুসলমানদের সামনে তুলে ধরতে আজ হতে ৫৪ বছর পূর্বে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার অন্তর্গত চুনতি গ্রামে আল্লাহর মহান ওলি হযরত শাহ্ধসঢ়; মাওলানা হাফেজ আহমদ (র.) শুভ সূচনা করেন। বাংলাদেশের মুমিন মুসলমানদের কাছে এ খবর নতুন নয়।
চুনতির হযরত শাহ্ মাওলানা হাফেজ আহমদ (র.) এ মাহফিল শুরু করলেও আজ বিশ্বব্যাপী এর প্রচার রয়েছে। লাখ লাখ মুমিন মুসলমানদের ও নবী করিম (স.) প্রেমির আল্লাহু আকবর ধ্বনীতে চট্টগ্রামের আকাশ কম্পিত হয়। এই ইমানী চেতনা নিঃসন্দেহে আনন্দের ও গর্বের। মহান আল্লাহ তায়ালার প্রিয় নবী যাঁকে আখেরী নবী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। যাঁকে রহমাতুল্লিল আলামীন বলা হয়। সেই নবীর সীরতকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা সকল মুসলিমদের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য।
হযরত শাহ্সাহেব (র.) ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম আলামে-ওলামা, পীর মাশায়েখ, ইসলামী চিন্তাবিদ ও দ্বীন-দরদি মানুষদের একই প্লাটফর্মে জড়ো করেন। ১৯৭২ সনের রবিউল আওয়াল মাসে রাতব্যাপী একদিনের মাহফিল প্রবর্তন করেন। এই সীরত মাহফিল ময়দানে শাহ্ মঞ্জিলের সামনে পর্যায়ক্রমে ১৯৭৩ সালে ৩দিন, ১৯৭৪ সালে ৫দিন, ১৯৭৬ সালের ১০দিন, ১৯৭৭ সালে ১২দিন, ১৯৭৮ সালে ১২দিন, ১৯৭৯ সালে ১৫ দিনব্যাপী উদযাপন হয়ে এসেছে। কিন্তু হযরত শাহ্ সাহেব (র.) মনোসন্তুষ্টি না হওয়ায় ২দিন ২দিন ৪ দিন বাড়িয়ে ১৯ দিনের মাহফিল ১৯৭৯ সাল থেকে শুরু করেন। হযরত শাহ্ সাহেব (র.) ইন্তেকালের বছর পর্যন্ত ১৯ দিন চালু রেখেছিলেন। বলা বাহুল্য, ১৯৮৩ সনে সীরত মাহফিলের মাত্র ১৯ দিন পূর্বে হযরত শাহ্ সাহেব (র.) ইন্তেকাল করেছিলেন।
সূচনালগ্নে দু’টি খাসি জবেহ করে শাহ্ মঞ্জিলে খাওয়ানোর ব্যবস্থা শুরু হলেও বর্তমানে শত শত গরু-মহিষ-ছাগল জবেহ করে লাখ লাখ মানুষকে খাওয়ানো হয়। এর পর কয়েক বছর মাদ্রাসার মাঠে খাওয়ানো হয়। পরবর্তীতে একদিকে মাহফিল তথা অলোচনার মঞ্চ, মসজিদে বায়তুল্লাহর সামনে; অন্যদিকে সীরত ময়দানের পূর্ব-উত্তর কোণে রন্ধন বিভাগসহ খাওয়ার ঘর, যা একবোরে টিনের ছাউনি দিয়ে স্থায়ী ঘর বেঁধে রাখা হয়েছে। সেই ঘরে একসঙ্গে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষের খাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে এ সীরতুন্নবী মাহফিলে স্বেচ্ছায় পালাক্রমে পাঁচ সহস্রাদিক এলাকাবাসী মাহফিলে আগত দেশি-বিদেশি অতিথিদের খেদমতে নিয়োজিত থাকেন।
এই মাহফিলকে কেন্দ্র করে সারাদেশের উপ-কমিটিগুলোকে নিয়ে ২ মাসের অধিক সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রস্তুতি সভা শুরু করা হয়। মাহফিলে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এখানে সকল সিলসিলার আলেম-ওলামা ও অনুসারীরা সমবেত হন। অন্যান্য মাহফিলের মতো এটা শুধু আলোচনা সভায় সীমাবদ্ধ নয়। বরং এখানে অংশগ্রহণকারী সমস্ত শ্রোতাদের জন্য বিশেষ আয়োজনের সাথে ব্যবস্থা হয় দু’বেলা খাবারেরও। শাহ্ সাহেব কেবলা (র.) প্রবর্তিত এ সীরতুন্নবী (স.) মাহফিল সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় দষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত ভূমিকা রাখে। প্রত্যেক বছর ১১ রবিউল আওয়াল শুরু হয়ে ১৯দিনব্যাপী দীর্ঘ এই সীরত মাহফিল শাহ্ সাহেব কেবলা (র.) এর সকল মতবাদের অনুসারীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
এই ধারাবাহিকতায় চলতি সনের ১৫ সেপ্টেম্বর এবারের ৫৪তম সীরতুন্নবী মাহফিলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে এবং আগামী ৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দিবাগত ভোর রাতে আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে সমাপ্ত হবে। ৫৪ তম এ সীরত মাহফিলের জন্য ৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা বাজেট ঘোষনা করা হয়েছে।
আলহাজ্ব শাহ্ মাওলানা হাফেজ আহমদ (র.) দক্ষিণ চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসিদ্ধ বুজুর্গানে দ্বীনের আবাসভূমি চুনতি গ্রামে ১৯০৭ সনে এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলহাজ্ব সৈয়দ আহমদ (র.)। শাহ সাহেব কেবলা (র.) পিতামহ মুফতি মাওলানা কাজী ইউসুফ (র.) এর পারিবারিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, প্রসিদ্ধ দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা এবং উপমহাদেশের বিখ্যাত কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। শিক্ষা জীবনের পর একবার আকিয়াবে তাঁদের জমিদারি দেখার জন্য গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বর্তমান মায়ানমারের বাম্মু শহরে বেড়াতে যান। ওখানকার জনগণ তাঁর এলেম ও আমলে মুগ্ধ হয়ে তাকে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিবের দায়িত্ব অর্পন করেন। কর্মজীবনে শরীয়তের ইলম, নামাজ, রোজা ইত্যাদির সঙ্গে বাতেনী ইবাদতও আবশ্যক মনে করে কাজ করতে করতে এক সময়ে সত্যের সন্ধানে লোকালয় ত্যাগ করে ৩৭ বৎসর আল্লাহর যিকির ও রসূল (স.) এর প্রশংসা করে ঘুরে বেড়াতেন, পাহাড়ে অরণ্যে, গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে এবং গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
আশেকে রসূল (স.) মুজাদ্দেদে মিল্লাত বাণীয়ে সীরত আলহাজ্ব হযরত শাহ্ মাওলানা হাফেজ আহমদ (র.) এ প্রবর্তিত সীরতুন্নবী (স.) মাহফিলের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার জন্য গড়ে গেছেন ১৩ একর আয়তনের এক বিশাল সীরত ময়দান। যার পশ্চিম প্রান্তে ওনার অভিপ্রায় অনুযায়ী নির্মিত হয়েছে একটি সুরম্য জামে মসজিদ ‘মসজিদের বায়তুল্লাহ’। এ মসজিদের দক্ষিণ পাশের্ তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত থেকে যেন প্রত্যক্ষ করছেন ওনার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহ।