আজ বিশ্ব প্রাথমিক চিকিৎসক দিবস
খন রঞ্জন রায় : অনুমোদিত চিকিৎসা ব্যবস্থার বাইরে জীবনরক্ষার যে প্রাথমিক পদ্ধতি তাই প্রাথমিক চিকিৎসা। বড় ডিগ্রিধারী কোন রকম চিকিৎসক ব্যাতিরেখে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রাথমিক চিকিৎসক বা কোন ব্যক্তির দ্বারা জীবনরক্ষার প্রয়োজনীয় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করাই প্রাথমিক চিকিৎসা।
আন্তর্জাতিক ফেডারেশন অব রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ২০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে জনগুরুত্বের এই দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালনের সূচনা ঘটায়। প্রাথমিক চিকিৎসা কীভাবে জীবন বাঁচায় এবং প্রাত্যহিক জীবনে নানা সংকট থেকে রক্ষা করে সে বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়েই এই ভাবনার উদ্ভব। আকস্মিক অসুস্থতায় নিপতিত বা দূর্ঘটনা কবলিত কোন ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিকভাবে জরুরীভিত্তিতে যে চিকিৎসা বা ব্যবস্থাপনা করা হয় তাই প্রাথমিক চিকিৎসা।
ডাক্তার আসার পূর্বে বা ব্যক্তিকে অনুমোদিত চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তরিত করার আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত নীতিমালা বিধিমালায় গ্রহণীয় ব্যবস্থাই এই চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। রোগীর জীবনরক্ষার পাশাপাশি তাৎক্ষণিকভাবে সমসাময়িক ব্যবস্থাপত্রের মাধ্যমে অবস্থার অবনতি রোধ করা, সম্ভব হলে উন্নতি করাই এর লক্ষ্য। নির্ধারিত চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক অসুস্থ্যতার চিকিৎসা বা শুশ্রুষা করে নিরাপদে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেয়াই প্রাথমিক চিকিৎসা। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাওয়া বা পৌঁছানো পর্যন্ত যাতে রোগীর মারাত্মক কোন অসুবিধা না হয়, শারীরীক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকে, সাধারণভাবে নির্ভরতার সাথে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করাই প্রাথমিক চিকিৎসার অর্ন্তভুক্ত।
একজন আহত, অসুস্থ ব্যক্তির জীবন-মরণ বহুলাংশে প্রাথমিক চিকিৎসার উপর নির্ভর করে। যথাসময়ে, যথাস্থানে, যথাযথভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করতে না পারলে, অনেকাংশে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। শারীরীক অক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যায়। আর সঠিক পদ্ধতিতে ঠিক সময়ে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করতে পারলে সুস্থ্যতার হারও বহুলাংশে ত্বরাণিত হয়। দ্রুত আরোগ্য লাভ করে। লক্ষণ দেখে রোগ বা অসুস্থ্যতার কারণ নির্ণয় করতে পারলে পরবর্তীতে চিকিৎসা ব্যবস্থা বা পদ্ধতি অনেক সহজ হয়। সাবলীল হয়, নির্ভরশীল হয়, যথাযথ হয়। সুস্থ্যতার হার অনেক বেশি হয়। অর্থহানী, হয়রানি অনেকাংশে হ্রাস পায়। আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বর্তমানে যদিও জরুরী চিকিৎসা পরিষেবা গ্রহণের মোবাইল ফোনের সুযোগ রয়েছে, তবু অবস্থার প্রেক্ষিতে স্বশরীরে উপস্থিতির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।
অত্যাধিক রক্তপাত, মাথায় আঘাত, পুড়ে যাওয়া, হঠাৎ অচেতন হওয়া, নাক কানে রক্তপাত, সাপের কামড়, কুকুরের কামড়, কাটাছেঁড়া ইত্যাদি হাজারো ঘটনার ক্ষেত্রে প্রাথমিক প্রতিবিধান হলো চিকিৎসাশাস্ত্রের অর্ন্তগত একটি নির্ভরশীল বিভাগ প্রাথমিক চিকিৎসা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় প্রাথমিক চিকিৎসার কর্মীবাহিনী প্রস্তুত করা হয়। সৃষ্টি করা হয় স্বেচ্ছাসেবী জনগোষ্ঠী। প্রাথমিক চিকিৎসায় দক্ষ অভিজ্ঞ গবেষকের সুস্পষ্ট নীতিমালা ও নির্দেশনা অনুযায়ী আগ্রহী তরুণ জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজনভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। তাদেরকে দ্রুত পরিস্থিতি মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জনের সুযোগ দেওয়া হয়। সাথে রোগীর অবস্থা ও পারিপার্শ্বিক সবকিছু অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত দেওয়ার সক্ষম হিসাবে গড়ে তোলা হয়।
সর্বপ্রথম অবস্থার শিকার রোগীর যন্ত্রণা লাঘবে, কিছু আরাম প্রদানের ব্যবস্থার উপর শিক্ষা-কৌশল প্রশিক্ষণ দিতে হয়। পরিস্থিতির শিকার রোগীকে সহানুভূতি দেখানোর, মানসিক শক্তি সামর্থ্য সৃষ্টি হয়, এমন ব্যবস্থার প্রতি নজর দিয়ে গড়া হয়। দ্রুত যেন তার প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান দক্ষতার সাথে সাধ্যমত প্রয়োগ করতে পারে সেদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিদানে সক্ষম করে তোলা হয়। সব থেকে গুরুত্ব যে কোন রোগীকে কোন অবস্থায় কোথায় স্থানান্তর করতে হবে তার শিক্ষা সঠিকভাবে প্রদান করে দক্ষকর্মীতে রূপান্তরিত করা হয়। কোন যন্ত্রপাতি বা চিকিৎসা উপকরণ ছাড়া নিজেদের এই কাজে দক্ষ করে তোলাই এই চিকিৎসা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য। বিপদাপন্ন কোন ব্যক্তিকে সমূহ বিপদ বা মৃত্যুর সম্ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে বিপন্ন জীবনের কাণ্ডারী হওয়া।
ভূক্তভোগী ব্যক্তির আঘাত বা কষ্ট যেন আর ছড়িয়ে না পড়ে বা গুরুতর পর্যায়ে অগ্রসর না হয় সেজন্য সুতীক্ষন্ন নজর দেওয়া। রক্তপাত হতে থাকলে তা বন্ধের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ভূক্তভোগীর মনে উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলে অন্তঃমনে শক্তি সাহস সঞ্চার করা মূল চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাথমিক চিকিৎসককে সেই কাজটিই করতে হয় সাবলীলভাবে, আন্তরিকে। অবশ্য এর জন্য তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসাবিষয়ক প্রশিক্ষণমালায় নিষ্ঠার সাথে অংশগ্রহণ কতে হয়। হোক সেটি সংক্ষিপ্ত।
দেখা গেছে, ঘন্টা হিসাবে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণেও ভাল ফলাফল পাওয়া গেছে। যেমন যুক্তরাজ্যে মাত্র একদিনের প্রশিক্ষণ চালু আছে। আর তাতেই প্রাথমিক চিকিৎসাকর্মীর যাবতীয় পদ্ধতির সাথে নিজের ব্যাপারেও কর্মদক্ষতা তৈরী হয়ে যায়। কাজ করতে গিয়ে আত্মরক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। নিজের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার বিষয়টিতো আছেই। আর কতটুকু চিকিৎসা প্রদান করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে সেই রকম ধাপ এই প্রশিক্ষণে অর্ন্তভূক্ত থাকে। প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতিটিই মূলত সাধারণজ্ঞানের উপর নির্ভর করে অস্থায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগীর জীবনরক্ষার কর্মকৌশল। রোগীকে তৎক্ষণাৎ অস্থায়ী ভিত্তিতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনভিত্তিক স্বাস্থ্যকর্মী, হাসপাতাল বা তাঁর জন্য নিরাপদ স্থানে প্রেরণ করার সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিকে সংকট উত্তরণের পথ বাতলে দেওয়ার অত্যান্ত ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে প্রাথমিক চিকিৎসগণ। আর একারণে তাঁদের শ্রদ্ধা জানাতে এই চিকিৎসা পদ্ধতি ও ব্যবস্থার প্রতি জনসচেতনা সৃষ্টি করতে শুরু হয় আজকের ‘বিশ্ব প্রাথমিক চিকিৎসা দিবস’। মূলত আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি শুরু করে বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে তাঁদের সোসাইটি দ্বারা শতাধিক দেশে এই দিবস পালন করলেও, এখন আর এখানে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য সংস্থা, সংগঠন ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, পরিদপ্তর, মন্ত্রণালয়েও।
প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উপযুক্ত চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বীকার ও স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধারায়। বাংলাদেশ আরো দ্রুত এগিয়েছে এব্যাপারে। এক দুই তিন সপ্তাহ মাস প্রশিক্ষণনীতির পাশাপাশি চালু করেছে প্রাথমিক চিকিৎসার নির্ভরযোগ্য সাংগঠনিক কাঠামো। প্রতিষ্ঠা করেছে কমিউনিটি ক্লিনিক, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রভাইডার।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ৬৮টি জেলা ও সিটি ইউনিটের প্রায় লক্ষাধিক সদস্যর প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণের সাথে দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা ও দুযোর্গকালীন সমযোগী হতে প্রস্তুত করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত প্রতি ৬ হাজার জনসংখ্যার জন্য প্রতিষ্ঠা হচ্ছে একটি ক্লিনিক। ইতিমধ্যে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে নাগরিকদের প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
যদিও আজকের এই দিবসের সাথে কমিউনিটি ক্লিনিক চিকিৎসাব্যবস্থা ওতপ্রোতজড়িত নয় তবে সাংঘর্ষিকও নয়। বস্তুত সর্বস্তরের মানুষের জন্য, মানুষের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসার গুরুত্ব তুলে ধরাই এই দিবসের মূল লক্ষ্য।লেখকঃ খন রঞ্জন রায়,সমাজচিন্তক, গবেষক ও সংগঠক।