মো. মীর হোসেন মোল্লাঃ এবারের আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়নি। প্রচলিত ছাত্রসংগঠনও সেভাবে রাস্তায় নামেনি। নেতৃত্ব দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরা সেই অর্থে ছাত্রনেতা ছিলেন না। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যাদের কেউ কেউ ছাত্রসংগঠন করলেও বেশির ভাগ ছিলেন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী।

বর্তমান সরকারের আমলে এ প্রজন্ম তাদের শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করে তারুণ্যের জানালায় পদার্পণ করেছে। তারা বই এবং পত্রিকা পড়ার প্রয়োজন মনে করেনি। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠেনি। খেলার মাঠে খেলার সুযোগ হয়নি। মূলত সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তারা বেড়ে ওঠেনি। রূপকথাময় শৈশব তাদের কাছে কল্পলোকের ধারণা হলেও এ প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে ভার্চুয়াল জগতের অপ্রতিরোধ্য আলো-আঁধারের রাজত্বে। সেখানে তারা প্রযুক্তিগত দক্ষতা যেমন আয়ত্ত করেছে, ঠিক সেভাবে অবাধ তথ্যপ্রবাহ থেকে ইতিবাচক কিছু বোধ, ধারণা এবং জ্ঞানার্জন করেছে। যেটা আমি আমার ২২ বছরের ছেলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের সুবাধে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে অনুধাবন করেছি। এ প্রজন্মের বোঝাবুঝি আমাদের থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যের প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যে পেয়েছি।

আমাদের তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে বহু প্রত্যাশিত একটি বিজয় এসেছে। তাদের নেতৃত্বে কর্তৃত্ববাদী সরকারপ্রধান পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে নিজেদের ক্ষমতার অবস্থান শক্তিশালী এবং স্থায়ী করতে একের পর এক তুরুপের তাস সাজিয়েছেন। এত ইস্পাত কঠিন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে সেটি আওয়ামী লীগ নেতাদের কল্পলোকের ধারণার ভেতরেও ছিল না। আসলে তারা সাজিয়েছিলেন তাসের ঘর যেখানে ঠিক জায়গামতো একটা টোকা পড়ার প্রয়োজন ছিল। আর সেই টোকা পড়ার বীজটি তারাই বুনেছেন। আবার বোপিত বীজকে রক্ষা করতে গিয়ে করতে হয়েছে মারাত্মক অপরাধ।

৫ আগস্ট আন্দোলনকারীরা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এদিন সকাল থেকেই কারফিউ অমান্য করে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা শহীদমিনার অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। সেনাবাহিনী প্রধান জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বিষয়টি জনগণকে অবহিত করেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়টিও তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে উত্থাপিত হয়।

সেনাপ্রধান বলেন, সব হত্যাকাণ্ড এবং অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করা হবে। জনমনে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ সঞ্চিত ছিল। সাধারণ জনগণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সেই ক্ষোভ প্রকাশের এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। ফলে ঘটেছে গণ-অভ্যুত্থান।

সাধারণ ছাত্রদের দ্বারা সংগঠিত এমন একটি আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। জল, ঝড়, রোদ ও বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তোমরা এ আন্দোলন করেছ। অপহরণ, অত্যাচার, কটুকথা শাসকদের চোখ রাঙানি, ডিবি হেফাজত এবং বন্দুকের গুলি-কোনো কিছুই তোমাদের একবিন্দু বিচলিত করতে পারেনি। তোমরা এগিয়ে গেছ দৃপ্ত পদক্ষেপে তোমাদের অভীষ্ঠ লক্ষ্যের দিকে। কোটা সংস্কার আন্দোলন নানা দোলাচলের ভেতর দিয়ে রূপ নিয়েছে দেশ সংস্কার আন্দোলনে। তোমাদের বলিষ্ঠ মনোবল, অপরিসীম সাহস, একতাবোধ এবং দূরদর্শিতার কারণেই দেশবাসীর সমর্থন পেয়েছ। ভবিষ্যতে সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা গোষ্ঠী তোমাদের এ একনিষ্ঠ পরিশ্রমের ফসল নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে। তোমাদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হতে চলেছে। এখন থেকে তোমরাই অতন্ত্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করবে। তোমাদের মতো সন্তান জন্ম দিতে পেরে আমরা গর্বিত।

আন্তর্জাতিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল সূচকগুলো আরও চাপের সম্মুখীন হওয়ার পূর্বেই দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমূহের সমাধানে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। দেশবাসীর প্রত্যাশা জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সরকার যেন তা-ই করে। সবকিছু স্বাভাবিক হলে সামগ্রিক অর্থনীতির গতিধারাও স্বাভাবিক হবে। কতিপয় অর্থনৈতিক সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগের প্রয়োজন হতে পারে।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সততা, সদিচ্ছা ও দেশপ্রেম। দেশের সকল মানুষ, সরকারি কর্মচারী, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দল ও সরকারের কাছ থেকে এসবই কাম্য। ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে প্রবাসীরা যদি বৈধ পদে রেমিট্যান্স প্রেরণ না করেন, কিংবা রপ্তানি কারকরা সময় মতো রপ্তানি মূল্য দেশে না আনেন এবং এর ফলে অর্থনীতি যদি বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়, তা হবে আত্মঘাতী।

আশা করি দেশের এই সমস্যা সংকুল পরিস্থিতিতে দেশ-বিদেশে বসবাসকারী সব বাংলাদেশিদের শুভবুদ্ধি কাজ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে যেন নতুন করে এগুলোর অবনতি না হয়।

লেখকঃ মীর হোসেন মোল্লা/ সাংবাদিক ।

মো. মীর হোসেন মোল্লাঃ এবারের আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়নি। প্রচলিত ছাত্রসংগঠনও সেভাবে রাস্তায় নামেনি। নেতৃত্ব দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরা সেই অর্থে ছাত্রনেতা ছিলেন না। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যাদের কেউ কেউ ছাত্রসংগঠন করলেও বেশির ভাগ ছিলেন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী।

বর্তমান সরকারের আমলে এ প্রজন্ম তাদের শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করে তারুণ্যের জানালায় পদার্পণ করেছে। তারা বই এবং পত্রিকা পড়ার প্রয়োজন মনে করেনি। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠেনি। খেলার মাঠে খেলার সুযোগ হয়নি। মূলত সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তারা বেড়ে ওঠেনি। রূপকথাময় শৈশব তাদের কাছে কল্পলোকের ধারণা হলেও এ প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে ভার্চুয়াল জগতের অপ্রতিরোধ্য আলো-আঁধারের রাজত্বে। সেখানে তারা প্রযুক্তিগত দক্ষতা যেমন আয়ত্ত করেছে, ঠিক সেভাবে অবাধ তথ্যপ্রবাহ থেকে ইতিবাচক কিছু বোধ, ধারণা এবং জ্ঞানার্জন করেছে। যেটা আমি আমার ২২ বছরের ছেলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের সুবাধে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে অনুধাবন করেছি। এ প্রজন্মের বোঝাবুঝি আমাদের থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ঠ্যের প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যে পেয়েছি।

আমাদের তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে বহু প্রত্যাশিত একটি বিজয় এসেছে। তাদের নেতৃত্বে কর্তৃত্ববাদী সরকারপ্রধান পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে নিজেদের ক্ষমতার অবস্থান শক্তিশালী এবং স্থায়ী করতে একের পর এক তুরুপের তাস সাজিয়েছেন। এত ইস্পাত কঠিন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে সেটি আওয়ামী লীগ নেতাদের কল্পলোকের ধারণার ভেতরেও ছিল না। আসলে তারা সাজিয়েছিলেন তাসের ঘর যেখানে ঠিক জায়গামতো একটা টোকা পড়ার প্রয়োজন ছিল। আর সেই টোকা পড়ার বীজটি তারাই বুনেছেন। আবার বোপিত বীজকে রক্ষা করতে গিয়ে করতে হয়েছে মারাত্মক অপরাধ।

৫ আগস্ট আন্দোলনকারীরা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এদিন সকাল থেকেই কারফিউ অমান্য করে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা শহীদমিনার অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। সেনাবাহিনী প্রধান জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বিষয়টি জনগণকে অবহিত করেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়টিও তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে উত্থাপিত হয়।

সেনাপ্রধান বলেন, সব হত্যাকাণ্ড এবং অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করা হবে। জনমনে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ সঞ্চিত ছিল। সাধারণ জনগণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সেই ক্ষোভ প্রকাশের এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। ফলে ঘটেছে গণ-অভ্যুত্থান।

সাধারণ ছাত্রদের দ্বারা সংগঠিত এমন একটি আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। জল, ঝড়, রোদ ও বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তোমরা এ আন্দোলন করেছ। অপহরণ, অত্যাচার, কটুকথা শাসকদের চোখ রাঙানি, ডিবি হেফাজত এবং বন্দুকের গুলি-কোনো কিছুই তোমাদের একবিন্দু বিচলিত করতে পারেনি। তোমরা এগিয়ে গেছ দৃপ্ত পদক্ষেপে তোমাদের অভীষ্ঠ লক্ষ্যের দিকে। কোটা সংস্কার আন্দোলন নানা দোলাচলের ভেতর দিয়ে রূপ নিয়েছে দেশ সংস্কার আন্দোলনে। তোমাদের বলিষ্ঠ মনোবল, অপরিসীম সাহস, একতাবোধ এবং দূরদর্শিতার কারণেই দেশবাসীর সমর্থন পেয়েছ। ভবিষ্যতে সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা গোষ্ঠী তোমাদের এ একনিষ্ঠ পরিশ্রমের ফসল নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে। তোমাদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হতে চলেছে। এখন থেকে তোমরাই অতন্ত্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করবে। তোমাদের মতো সন্তান জন্ম দিতে পেরে আমরা গর্বিত।

আন্তর্জাতিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল সূচকগুলো আরও চাপের সম্মুখীন হওয়ার পূর্বেই দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমূহের সমাধানে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। দেশবাসীর প্রত্যাশা জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সরকার যেন তা-ই করে। সবকিছু স্বাভাবিক হলে সামগ্রিক অর্থনীতির গতিধারাও স্বাভাবিক হবে। কতিপয় অর্থনৈতিক সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগের প্রয়োজন হতে পারে।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সততা, সদিচ্ছা ও দেশপ্রেম। দেশের সকল মানুষ, সরকারি কর্মচারী, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দল ও সরকারের কাছ থেকে এসবই কাম্য। ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে প্রবাসীরা যদি বৈধ পদে রেমিট্যান্স প্রেরণ না করেন, কিংবা রপ্তানি কারকরা সময় মতো রপ্তানি মূল্য দেশে না আনেন এবং এর ফলে অর্থনীতি যদি বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়, তা হবে আত্মঘাতী।

আশা করি দেশের এই সমস্যা সংকুল পরিস্থিতিতে দেশ-বিদেশে বসবাসকারী সব বাংলাদেশিদের শুভবুদ্ধি কাজ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে যেন নতুন করে এগুলোর অবনতি না হয়।

লেখকঃ মীর হোসেন মোল্লা/ সাংবাদিক ।