মহিউদ্দিন সাগর,নগর প্রতিনিধি: হ্যালো আমি সরওয়ার হোসেন বাবলা বলছি। চিনতে পেরেছন,আমি শিবির ক্যাডার সাজ্জাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড। ঐ একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে একবার ধরা পড়েছিলাম। এখন সাজ্জাদ ভারতে,গ্রুপটি আমি চালায়।
চান্দগাঁও,বায়েজিদ,পাঁচলাইশ এলাকায় আমার কয়েকশ কিশোরগ্যাং রয়েছে। এলাকায় ব্যবসা করতে চাইলে আমার ছেলেদের খচ্ছাপাতি দিতে হবে। না দিলে জানটাই দিতে হবে। বুজছিস,গণা দেড় লাখ টাকা দিতে হবে দেড় লাখ।
গত ঈদুল আজহার দু’দিন আগে এভাবে এক ব্যবসায়ীর কাছে মোবাইলে ফোন করে চাঁদা চেয়েছিল চট্টগ্রাম নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সরওয়ার প্রকাশ শিবির ক্যাডার সরওয়ার। হুমকি পাওয়া মুহাম্মদ হেলাল চান্দগাঁও থানার হাজিরপুল রাজনগরের মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক। তিনি এ ঘটনার পর ২৬ জুন চান্দগাঁও থানায় সরওয়ারসহ তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। অবশেষে ২৭ জুলাই তাকে বায়েজিদ থানার বালুচড়া এলাকা থেকে চান্দগাঁও থানা পুলিশ গ্রেফতার করে।
চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির বলেন,কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নগরের বহদ্দারহাটে সহিংসতার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে সরওয়ারের নাম তদন্তে উঠে এসেছে। এর ভিত্তিতে তাকে গতকাল ২৭ জুলাই গ্রেফতার করা হয়।
শীর্ষ সন্ত্রাসী সরওয়ার হোসেনের কাছে শুধু মুহাম্মদ হেলাল নয়,পুরো চান্দগাঁও,বায়েজিদ ও পাঁচলাইশ থানা এলাকার ব্যবসায়ী ও লোকজন জিন্মি। ব্যবসা করতে হলে চাঁদা দাও। ভবন নির্মাণ করতে হলে চাঁদা দাও। চাঁদা দিলে নির্বিঘ্ন থাকো,নইলে হামলা ও মারধর। সরওয়ারের শাসন করা এলাকায় এটা যেন রীতি। তার উপর নির্ভর করছে ওই তিন এলাকার মানুষের ভালোমন্দ।
রৌফবাদ এলাকার মোহাম্মদ রুবেল নামের এক যুবকের অভিযোগ,সরওয়ার বাহিনীর ক্যাড়াররা তাকে রৌফাবাদ থেকে উঠিয়ে নিয়ে হাজীরপুলস্থ টেম্পো অফিসে নিয়ে লোহার হাতল,বড় ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে। ২০ হাজার টাকা ও মোবাইল কেড়ে নেয়। মামলা করলে জানে মেরে ফেলার হুমকি দেন।
তিনি বলেন, সরওয়ারের ভয়ে মামলা পর্যন্ত করতে পারিনি।
জানা যায়, নগরের বিভিন্ন এলাকার বেশ কিছু ব্যবসায়ী ও বড় চাকরিজীবীর কাছে ফোন করে সরওয়ারের নামে চাঁদা দাবি করা হয়েছে। চাঁদা না দিলে সন্তানদের অপহরণসহ নানা ধরনের হুমকি দেওয়া হয়। ভুক্তভোগীদের অনেকে বলছেন, সরওযার বাহিনীকে তাঁদের নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। অভিযোগ করলে উল্টো মারধর ও হামলার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
কে এই সরওয়ার ?
সরওয়ার হোসেন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। সে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার কালা মুন্সির বাড়ির খোন্দকারপাড়ার আব্দুল কাদেরের ছেলে। তার বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় হত্যা, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ প্রায় ১৯টি মামলা রয়েছে। সে চট্টগ্রাম নগর জুড়ে মূতির্মান আতঙ্ক। ২০১১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নগরের প্রবর্তক মোড়ে একটি রোগ নির্ণয়কেন্দ্র থেকে ১১ লাখ টাকা লুটের ঘটনায় আলোচনায় আসেন সরওয়ার। একই বছরের ৬ জুলাই বায়েজিদ এলাকা থেকে তাকেকে দুটি একে-৪৭ রাইফেল ও গুলিসহ আটক পুলিশ। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন,বায়েজিদ ও পাঁচলাইশ এলাকায় নতুন বাড়ি নির্মাণ করার আগে সরওয়ারকে চাঁদা দিতে হয়। তার বাহিনীর সদস্যরা ডাকাতি ও নাছিরাবাদ এবং বায়েজিদ শিল্পকারখানায় চাঁদাবাজি করে । তার বিরুদ্ধে একাধিক গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে।
পুলিশের তথ্য মতে,২০১৭ সালে জামিনে বেরিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী ম্যাক্সন (নিহত) ও সরওয়ার কাতারে আত্মগোপনে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। পরে তাদের বিরুদ্ধে পুনরায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে এক গাড়ির যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ফোনে চাঁদা দাবি করে সরওয়ার, ম্যাক্সন ও একরাম। তাদের হয়ে চাঁদাবাজির কাজ করত অনুসারীরা। তাদের কথামতো চাঁদা না দেওয়ায় একই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর বায়েজিদের নয়াহাটে ওই ব্যবসায়ীর বাড়িতে পেট্রোল বোমা ছোড়া হয়। এরপর কাতারে বসে বাংলাদেশে চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশ। ২০২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কাতার থেকে বাংলাদেশে পৌঁছালে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
চাঁদাবাজিতে অঢেল টাকার মালিক
সরওয়ার হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে বিশাল কিশোর গ্যাং। তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে খুন, জমি দখল, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ইয়াবা ব্যবসা, টেম্পো ও সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে চাঁদাবাজিসহ হেন অপরাধ নেই করছে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে,হাজীপাড়া, চান্দগাঁও, হাজীরপুল এলাকায় কোন বিল্ডিংয়ের কাজ করলেই তাদেরকে চাঁদা দিতে হয়। তারা এলাকার গার্মেন্টস, টেম্পো ও সিএনজি স্ট্যান্ড এবং বিভিন্ন কারখানা থেকে চাঁদা নেয়। হাজীর পুলের টেম্পো স্ট্যান্ডের অফিসে রাতে বসে তাঁর নেতৃত্বে মদের আসর। এ অফিস থেকে প্রতিদিন ইয়াবা বিক্রি হয় লক্ষ লক্ষ টাকার। প্রায় সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে নিরীহ লোকজনকে ধরে টেম্পো অফিসে টর্চার করে। তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে সবকিছু দেখাশোনা করে তার ছোট ভাই আজিজ। হাজীর পুলের পশ্চিম পাশে ইলিয়াছ কলোনিতে আজিজের অফিসে চলে নানা উড়তি বয়সী কিশোরীদের দিয়ে দেহ ব্যাবসা। অবাধে চলে জুয়া খেলা। ছোট ছোট মেয়েদের জিম্মি করে ধরে এনে ধর্ষণ করে তাঁরা। নানা অপরাধের আয়ের টাকা দিয়ে সরওয়ার গড়ে তুলেছেন বাড়ি। তার রয়েছে একাধিক ব্যাংক ব্যালেন্স, নামে বেনামে জায়গা জমি, প্ল্যাট ও দোকানপাট। দেশে চাঁদাবাজির টাকায় কাতারে রয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
চান্দগাঁওয়ে সজন মার্কেটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন ব্যবসায়ী বলেছেন, চাঁদা না দেওয়ায় অতীতে একাধিক ব্যবসায়ী খুন হয়েছেন। এ কারণে চাঁদাবাজির ঘটনায় এখন কেউ থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করতে চান না। কেউ জিডি করলে সন্ত্রাসীরা দ্রুত খবর পেয়ে যায়। তাই ব্যবসায়ীরা নীরবে চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
তার বাহিনীতে যারা
সরওয়ার বাহিনীর সদস্যরা হচ্ছে হাজিরপুলের রহমান, কসাই পাড়ার দিদার, রং মিস্ত্রি আরিফ,আফতাব উদ্দিন তাহসিন, লাল হাসান, ফুফাতো ভাই সোহেল,পুলিশ সোর্স নিজাম,ভুইল্লে পাড়ার ইকবাল,আমির, নাদিম,কুয়াইশের ভাগিনা জাবেদ,ঢাকাইয়া আকবর,মোহাম্মদ ফিরোজ,আতুরার ডিপুর সাল্লো,সোর্স নবী।
গ্রেফতার ও প্রশাসনের বক্তব্য
চান্দগাঁও থানার ওসি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন,১৮ জুলাই বহদ্দারহাটে পুলিশের উপর হামলা ও তিনজন মৃত্যুর ঘটনায় মামলার প্রধান সন্দেহভাজন সরওয়ার। তাকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে।
এলাকায় মিষ্টি বিতরণ
এদিকে শিবির ক্যাডার সরওয়ারকে গ্রেফতারের খবরে মিষ্টি বিতরণ করে এলাকাবাসী। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন তারা।