২৯ এপ্রিল বিশ্ব নৃত্য দিবস আজ
খন রঞ্জন রায় : মানুষের অতীন্দ্রিয় চেতনার বিভিন্ন কু-প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করার কুশলি প্রয়োগ নৃত্য বা নৃত্যকলা। এই কলাকৌশলের মর্মগত অবস্থান সুদূর বিস্তৃত। মানুষের চিন্তা ও যুক্তিচেতনার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে এই নৃত্য। নৃত্যের লোকায়ত জীবনদর্শন প্রাগৈতিহাসিককালের।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০০ সালে মিশরীয় দেয়াল চিত্র এবং ৯০০০ বছরের প্রাচীনতম ভারতীয় গুহাচিত্রে নৃত্যকলার নানাভঙ্গী উৎকীর্ণ রয়েছে। এই শিল্পের সংহত রূপ হিসাবে মোদিত এইসব দেয়ালচিত্র মানুষের জীবন সংগ্রামের সাথে প্রগতির সংগ্রামকে নির্দেশ করে। এর মর্মান্বেষণে জানা যায় লিখিত বর্ণমালা প্রচলনের আগে থেকেই নৃত্যকলা পদ্ধতির মননগত উৎকর্ষ শুরু হয়েছিল। তৎসময়ের জীবনদর্শনকে মূর্ত করে রাখার প্রয়োজনে হৃদয়ের গভীরতাস্পর্শী নানা পদ্ধতির নৃত্য ব্যবহার করতো। সেই সময়ের সৃষ্টিভাণ্ডারে ঈর্ষণীয় কিছু প্রত্নত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়। অসামান্য বৈপ্লবিক এই নৃত্য মানুষের চিন্তার পুনর্গঠনে প্রগতিশীল অবদান রেখেছে।
প্রকৃতি ও সমাজের দ্বান্দ্বিকতা মোকাবিলা করে ইতিহাসের বিচিত্রবিধ গতি নিয়ে চলমান থাকে এই নৃত্যকলা। অবজ্ঞার দৃষ্টিতে নয়, বুদ্ধি ও চিন্তার সমন্বয়ে। মৌলিক চিন্তাসম্পন্ন সংহতরূপে। সৃষ্টিকর্মের সার্থকতার সাহসী প্রয়াস নিয়ে ইতালী-ফ্রান্স নৃত্যের জারকরসে সমৃদ্ধ হয়। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটাতে থাকে। ভোগবাদের রমরমা যুগ শুরু হয়। নৃত্যকে রাজ্যসভায় প্রবেশ ঘটানো হয়। রাজা চতুর্দশ লুই এর রাজত্বকালে নৃত্য বিধিবদ্ধ নিয়মে আসতে শুরু করে। নৃত্যরচনাশৈলীর আনুষ্ঠানিকতা লাভ করে।
১৬৬১ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে নৃত্যকলা শিক্ষার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়। নাচের সাথে সঙ্গীত কাব্য, নাট্য, গান, পোশাক সমন্বয় করে লৌকিক সংস্কৃতির নতুন এক ধারার প্রবর্তন করা হয়। নতুন এই ধারার সম্ভাবনা ও বিকাশ চিন্তা করে নাম দেওয়া হয় “ব্যালে”।
কর্মের বহুমাত্রিক দ্বন্ধ মোকাবিলা করে প্রথম দিকে নৃত্যশিল্পী হিসাবে সকল পুরুষদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিদ্বৎসমাজের আকাক্সক্ষা-প্রত্যাশা রক্ষায় পুরুষদের নিয়েই নাচের দল গঠন করা হয়। নাট্যদলের মর্মগত অংশ হয়ে অকাট্য যুক্তিকে প্রমাণ করে ১৬৮১ সালে নারীরা অন্তর্ভুক্ত হয়।
নৃত্যের সম্ভাবনা ও বিকাশকে ভারসাম্যপূর্ণ করে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। নৃত্যকলার বিষয়বস্তু গুণের সাথে তুলনামূলক ব্যাকরণযুক্ত নৃত্য পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য উদ্ভাবন হতে থাকে। নৃত্য তার নিজের গরজেই মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করে। সংস্কৃতির অন্যান্য শাখা-প্রশাখার তুলনায় অধিক অগ্রসর হতে থাকে। প্রতিক্রিয়াশীলতা উদ্ধার করে আনার গরজবোধ জাগ্রত হতে থাকে। সংজ্ঞায়িত হয় এর সুবিশাল পরিসর। নৃত্যকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বিভিন্নভাবে শ্রেণিবিন্যাস করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক সময়কাল, উৎপত্তি স্থল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নন্দনতাত্তি¡ক, শৈল্পিক এবং নৈতিক বিষয়ের নির্মোহ-বিশ্লেষণে নাম নির্বাচন করা হয়।
পশ্চিমা ব্যালে, আধুনিক নৃত্য ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে ভরতনাট্যমের অনুশীলনজাত ভাগ বিভাগে ধ্রুপদী অন্যতম লোকজ সংস্কৃতি। ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে উদ্ভত ঐতিহ্য, মহাকাব্য, পুরাণ থেকে মননদীপ্ত আনন্দময় এই নৃত্যের উদ্ভব হয়েছে। প্রতিটি অঞ্চলের তত্ত¡ ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব বিবেচনা করে মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়।
তীব্র ইতিহাসবোধের পরিচয় দিয়ে ভারতীয় অভিনয়শিল্প ব্যাখ্যা করে ৮টি অঞ্চলের নাচকে ধ্রুপদী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। তামিলনাড়ু ভরতনাট্যম, উত্তর, পশ্চিম ও মধ্য ভারতের কত্থক, কেরালার মোহিনী অট্টম, কথাকলি, অন্ধ প্রদেশের কুচিপুডি, ওড়িশা অঞ্চলের ওড়িশি, মণিপুরের মণিপুরি, আসামীয় এলাকার সত্রীয়া নৃত্য নাট্যশাস্ত্রের বিধিবদ্ধ নীতিতে সুসঙ্গত প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। নিষ্ঠা ও সর্বজন বিদিত এই সমস্ত লোকনৃত্যের তাৎপর্যপূর্ণ কারণ গ্রাম সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন অভিব্যক্তি। লোকসংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে নয়, মননগত উৎকর্ষ ও মূল্যবোধের আলোকে। মহৎ মানবিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে ধর্মীয় ভাব প্রকাশ করার একান্ত মূর্ত ও স্পষ্ট প্রকাশ উদ্দেশ্যে।
ভারতের কিছু রাজ্যসমূহের আলাদা নিজস্বলোকনৃত্যের উজ্জল ব্যতিক্রম কিছু ধারা রয়েছে। যেমন কর্ণাটকের বেদারা, জম্মু-কাশ্মীরের নেইয়োপা, পাঞ্জাবের ভাংরা, আসামের বিহু, উত্তরাখণ্ডের ছুলিয়া নাচ, গুজরাটের গাগারী, রাজস্থানের কালবেলিয়া, মহারাষ্ট্রের লভানি ও কলিচ নাচ আঞ্চলিক জীবনদর্শন ঐকান্তিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। এই সমস্ত নৃত্যকলার উদ্ভব ও আকুলতার সুনিপুণ উদ্ঘাটন নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির অতীত বর্তমান বাস্তবকে সত্য ভাষণে চর্চা অব্যহত রেখেছে। পাকিস্তান-বাংলাদেশ, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর নাচশৈলীতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করছে। সংকীর্ণ কৌশল পরিহার করে এইসব এলাকার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অংশিদার হয়ে গণমানুষকে আলোকিত করছে।
সংস্কৃতি ও বিনোদনের পার্থক্য অনুভব করে নৃত্যকলার পথরেখা অনুসরণ করলে দেখা যায় ৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে নৃত্যকলার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সামগ্রিক ও সমন্বয়ী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসাবে তখন প্রাচীন বৈদিক গ্রন্থসমূহের অনন্য সাধারণ কাহিনীকে উপজীব্য করে মননরাজ্যে নৃত্যকলাকে সমৃদ্ধ করেছে। অদম্য ক্রিয়াশীল দৃঢ়প্রত্যয়ী বিবেকী ঐসব মানুষের মস্তিষ্ককোষে শাস্ত্রীয় এই ধারা প্রবর্তীত হয়।
নাট্য শাস্ত্রের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সংকলন ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রচনা করেছিলেন “ঋষি ভাড়ত”। অতিমাত্রায় পরিশীতিলতা ভাবনা নিয়ে তিনি ‘ঋগ্বে¦দ’ থেকে শব্দ, ‘সামবেদ’ থেকে সুর, ‘যজুর্বেদ’ থেকে মূকাভিনয়, এবং ‘অথর্ববেদ’ থেকে আবেগ নিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন ‘নাট্যবেদন’ সৃষ্টি হয় নৃত্যের ধারণা। বিভিন্ন কৌশল ও অনুশীলনের ফলে এর অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটতে থাকে। পূর্ণাঙ্গ অবয়ব নিয়ে স্পষ্ট পদরেখা সৃষ্টি করেছিল মিশরীয়রা। মিশর এবং গ্রিসে তাদের সামাজিক, পারিবারিক এবং ধর্মীয়ভাবের যে কোন অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে একান্তভাবে নৃত্যকে যুক্ত করে।
মনের অন্দরমহলে প্রচলিত নৃত্য লালন-পালন হতে থাকে। শিবের তাণ্ডবনৃত্য থেকে শুরু হয়ে শিল্পসৌকর্যের ব্যবহার মাধ্যমে কালক্রমে নানা বৈশিষ্ট্য তৈরি করে বর্তমানে এসে স্থিতু হয়েছে। হিন্দু পৌরাণিক দর্শন অনুযায়ী দেবাদিদেব শিব তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী সতী’র মৃত্যু সংবাদে ক্রদ্ধ হন। নিজের জটা ছিন্ন করেন। তাঁর চোখ থেকে বিপুল পরিমাণ জলরাশি নির্গত হতে থাকে। তিনি ব্যাক্যহীন জ্ঞানশূন্য বিহ্বল হন। স্ত্রীর মৃতদেহ আলগোছে তুলে কাঁধে নিয়ে শব্দহীন আর্তনাদে চাঁপা চিৎকারে শুরু করেন তাণ্ডবনৃত্য। শূন্য নীল আকাশে দূরাগত মেঘে ঢেকে যাওয়া দিগন্তের কৃষ্ণসীমায় চলে এই শোক নৃত্য। ‘তাণ্ডব’ ধ্বংসাত্মক ও পুরষালী নৃত্য। মুক্ত নীলাকাশের বাতাসে সুগন্ধ ভাসিয়ে পরবর্তীতে শুরু হয় ‘লাস্য’। লাস্য তাণ্ডবের নারীসুলভ বিকল্প নৃত্য। কলাকৈবল্যবাদী জীবনদর্শনের চিন্তাউদ্দীপক ইতিহাসে ‘লাস্য’ সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যুগপরিক্রমায় বোধের জমিন তছতছ করে স্বমহিমায় উজ্জল হয় পুরুষের সাথে নারীর নৃত্যচর্চা।
কল্পিত উপাখ্যানের সাথে জ্ঞানানুসন্ধান করে বাস্তবজীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, আনন্দ-বেদনা, জন্ম-মৃত্যু, স্বপ্ন-প্রত্যাশা নিয়ে দীর্ঘ এক সমগ্রসন্ধানী হয় নৃত্য। সমসাময়িককালে শক্তিমান কিছু অনুসন্ধানী প্রয়াসী কলাকৌশল সংযুক্ত হয়। সঙ্গীতশাস্ত্রের প্রধান তিনটি অঙ্গের অন্যতম একটি অঙ্গতে পরিণত হয় ‘নৃত্য’। গতি-ছন্দ-প্রকাশভঙ্গীর দেহভঙ্গিমায় ব্যক্তি মানুষের আকুল আর্তি প্রকাশ পায়।
প্রাগৈতিহাসিককালের যৌক্তিকভাবে প্রযুক্ত এই কলা মানুষের নান্দনিকতা ও অনুভ‚তি প্রকাশের স্বচ্ছ ছবি হয়ে দাঁড়ায় ‘নৃত্য’। আদিমকাল থেকে পৃথিবীর প্রতিটি জনগোষ্ঠীর পৃথক ও স্বতন্ত্র পূর্ণ এক অখণ্ড সত্তা হয়ে আত্মপ্রকাশ করে নৃত্যকলা। লোকায়িত জীবনোপলব্ধির প্রবল ভাবোম্মাদ নিয়ে নাট্যকলার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বর্তমান নাট্যধারাকে প্রধানত ৪টি ভাগে বিভক্ত করা যায়। ধ্রুপদী, আদিবাসী, লোক এবং আধুনিক।
নৃত্যশিল্পের আঁধার কক্ষ থেকে দর্শক শ্রোতার মানসভুবনকে আলোকিত করে সৃষ্টি হয় আধুনিক নৃত্য। উনিশ ও বিশ শতকের শুরুতে জার্মানি ও মার্কিনিরা মিলে অসামান্য নিষ্ঠায় নৃত্যধারার ঐতিহ্য পুনরাবর্তন ঘটান। সৃজনশীল এই নৃত্যধারাটি পরবর্তীতে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর তৎপরে বহু বর্ণবিভঙ্গে নতুন রূপ দান করেন উদয়ন শংকর। বিভিন্ন অঙ্গিকের নৃত্যরীতিকে ভেঙ্গে সংগীত, নৃত্য চারু ও কারুশিল্পের সমন্বয় ঘটান। বিলাস ও প্রমোদ এবং উপকরণসামগ্রী থেকে গণমানুষের জীবনধারায় সাঁকো বাঁধেন।
১৯৩১-৩২ সালে নৃত্যকে দ্বন্ধ সংকটের বৃত্ত থেকে বের করে ইউরোপ-আমেরিকায় সৃজিত আধুনিক নৃত্যকলা প্রদর্শন শুরু করেন। নেপথ্যে সহযোগীতায় এগিয়ে আসেন শচীন দেববর্মণ, আলাউদ্দিন খাঁ, আলি আকবর খাঁ প্রমুখ খ্যাতিমান শিল্পবোদ্ধারা। কল্পনাজগতের স্রষ্টা নতুন এই নৃত্যধারা পশ্চাদপদতার মূল উপড়ে ফেলতে সক্ষম হয়। ১৯৬১-৭০ সালে সিনেমাতে সংযোজন ঘটান নতুন এই “শঙ্করস্কোপ”। উদয় শঙ্করের দূরদর্শিতা আর বিশ্বব্যাপী নতুন এই রীতির প্রদর্শন কারণে নৃত্যের এই আধুনিক ধারা ভারতীয় শাখা হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৮০ এর পরে নৃত্যের এই ধারা বিশাল ব্যাপক প্রবলভাবে জনপ্রিয় হয়ে, অনেকের জীবন ও জীবিকার সন্ধান দেয়। নৃত্য অভিভাবকসুলভ দায়িত্ব পালন করতে থাকে। ভ্রান্তিবহুল শিল্পমাধ্যমের খোলনলচে থেকে বেড়িয়ে অনবদ্য উদ্ভব ঘটায়।
বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী এ দেশের নৃত্যশিল্পকে অন্ধকার থেকে আলোর সীমানায় পৌঁছে দেন। রক্ষণশীল সামাজিক মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করে নাচকে জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যমে উন্নীত করেছিলেন। ছবি ও রঙের মতো অত্যন্ত জটিল নৃত্যরূপকে সহজ-সরল অভিব্যাক্তির প্রকাশভঙ্গিতে দর্শকের আকর্ষণবোধের স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। দেহের ছন্দকে সৃজনশীল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গতিশীল আলোড়ন ফুটিয়ে তোলার দেহ-আত্মা-ভাষা একসূত্রে গাথা বলে আবিস্কার করেন।
নৃত্য যে মানুষের মনোজাগতিক প্রকাশভঙ্গি তা প্রমাণ করতে সামর্থ্য হন । দুর্মর কুসংস্কারাচ্ছন্ন আমাদের সমাজব্যবস্থায় নৃত্য এখন অন্যতম প্রধান একটি শিল্পমাধ্যম। মানস প্রতিবন্ধের বিপরীতে মানুষের শিল্পরুচিতে সৃষ্টিশীল প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এখন সংস্কৃতির প্রতিটি অধ্যায়ে নৃত্যের মানবিক উপস্থাপন অবশ্য-অবধারিত হয়ে লক্ষ্যবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
নৃত্য নিয়ে ব্যাক্তিমানুষের চিন্তা তত্ত্ব ও বোধের সামষ্ঠিক ফলাফল “বিশ্ব নৃত্য দিবস”। অবশ্য দিবটি উদযাপন করা হয় আধুনিক ব্যালে নৃত্যের স্রষ্টা ফরাসি নাগরিক জ্যাঁ জর্জ নোভেরে’র জন্মদিনকে স্মরণ করে। ১৭২৭ সালে প্যারিসে জন্ম নেওয়া এই স্রষ্টা ১৭৫৪ সালে নতুন নৃত্যধারা ‘ব্যালে’ আবিস্কার করেছিলেন। নৃত্য অরিবাম পড়াশোনা নিরীক্ষা আর কর্মতৎপরতার ফসল বলে প্রথম তিনিই শিল্প সমালোচকদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর এই ভাবনা থেকেই ১৭৬০ সালে রচনা করেন “লেটারস অন দ্য ড্যান্স” নামক প্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণভিত্তিক নৃত্যগ্রন্থ।
ব্যালের শেক্সপিয়ার হিসাবে আলোড়িত এই গ্রন্থের জনক ক্ষণজমা শিল্পী জর্জ নোভের ১৮১০ সালের ১৮ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দিতে ইউনেস্কো ১৯৮০ সালে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। যথারীতি তারিখ হিসাবে বেছে নেয় জর্জ নোভের জন্ম দিন ২৯ এপ্রিলকে। শুরু থেকেই পৃথিবীব্যাপী এই দিবস আন্তর্জাতিক মর্যাদা পায়।
১৯৯১ সাল থেকে রাজনৈতিক আদর্শ, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, পেশাগত পরিচয় বাদ দিয়ে বিশেষভাবে পালন শুরু হয়। ইউনেস্কোর প্রধান সহযোগী সংস্থ্যা পারফর্মিং আর্টস-এর নিয়ন্ত্রণে আইআইটি, ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কমিটি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থাসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক কিছু সংগঠন যথাযজ্ঞ মর্যাদায় ১৯৯৫ সাল থেকে এই দিবস পালন করে আসছে বাংলাদেশে।
আজকের দিনে প্রাকবৈদিক যুগে আবির্ভাব ঘটে বৈদিককোত্তর যুগ হয়ে বর্তমান আধুনিক যুগের জনপ্রিয় নৃত্যধারা সাধনায় জড়িত সকল কলাকৌশলী, নৃত্যশিল্পীপ্রজন্মকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।