খন রঞ্জন রায়: ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা আয়ু-মৃত্যু সবকিছুই নির্ভর করে সৃষ্টিকর্তার ইশারায়। ইহাই সর্বকালের সত্য। এরপরও নানা রকম কঠিন পরীক্ষণের ভেতর দিয়ে চলমান থাকে মানুষের জীবনধারা। “যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ বিশ্বাস” এই মূলনীতিই মানুষের জীবনের গতি। এই গতি আমরা যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ‘ট্রাকে, ট্রেনে, ভ্যানে, প্লেনে’ চালানোর চেষ্টা করি। জীবনের কোনো কিছুই বাধ্যতামূলক না হলেও জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবাই আমরা উদ্বিগ্ন। এই উদ্বিগ্নতা পরিহারে সম্ভাব্য বিপদ মোকাবিলা করার হাতিয়ার হিসাবে আর্ভিভূত বীমা।
অর্থের বিনিময়ে নিজেদের ছকবাঁধা ভোগের জীবন আর সম্পদের নিশ্চয়তা ও ঝুঁকি অপর পক্ষের হাতে তুলে দেই। বীমা প্রদান কর্তৃপক্ষও উক্ত ঝুঁকি গ্রহণ করে সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ প্রদানের অঙ্গীকার করে। এই ব্যবস্থা অতীত গৌরবের। প্রায় ৪ হাজার বছরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার নির্যাস। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার যুগে। তৎসময়ের ব্যবসা বাণিজ্যের দুর্বল কাঠামো আর ডাকাতি, লুন্ঠন ঠেকাতে বীমা ব্যবস্থা প্রচলন করেছিল। সম্ভাব্য বিপদ ভাগাভাগি করে একে অপরের দুঃখ-কষ্টে-ক্ষতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার চুক্তিবদ্ধ প্রথম উদাহরণ এটি। পরবর্তীতে রোমান, গ্রীকদের দ্বারা এর প্রসার ঘটে। অবিশ্বাস-হিংসা-বিদ্বেষ, মুনাফেকি বন্ধ হওয়ার ভিত্তি তৈরি হয়।
১৪২৪ খ্রিষ্টাব্দে ইতালির জেনোয়াতে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়। ১৪৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বার্সেলোনায় বীমা সংক্রান্ত প্রথম আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের আইল ধরে বীমা ব্যবস্থায় সাহেবিয়ান ছাপ পড়তে থাকে। ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে বীমার ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগ শুরু হয়। বীমা ব্যবস্থার ভাগ-বিভাগ সৃষ্টি হয়।
খ্যাতিমান চিকিৎসক ও অর্থনীতিবিদ নিকোলাস বারবন নিজের জীবন থেকে শেখার চেষ্টা করে প্রথম অগ্নিবীমা চালু করেছিলেন। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বীমার গুরুত্ব নিয়ে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। বীমা বিকাশে পরিচালিত এটিই ছিল সংসদ কর্তৃক প্রথম আইন। বলা হয়ে থাকে ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বীমা ক্রমবিকাশে থাকলেও এর পরিধি বেড়েছে মূলত আইনকানুন প্রণয়নের পর থেকে। আশাব্যঞ্জক পরিণতি নিয়ে শুরু হয় নৌ-বীমা। বীমা প্রসারের আলাদা আবেদন নিয়ে সর্বশেষ বিস্তৃত হয় জীবন বীমার।
বীমা ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা স্বস্তি থাকায় পরবর্তীতে ইউরোপীয় বণিকরা ধীরে ধীরে প্রচলন করে সমবায় সংস্থার মাধ্যমে বীমা। চঞ্চল ডানপিটে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম বীমা আইন প্রণয়ন করে। পরে অবশ্য যুগের চাহিদা আর স্বার্থবাদীতার হিসাব কষে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বীমা আইন সংশোধিত ও পরিমার্জিত করে। বীমা উৎপত্তির আবেদন আমলে নিলে দেখা যায় একে তোয়াজ করে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাজ্যে বেকার ও স্বাস্থ্যবীমা, ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে রপ্তানিবীমা তাও যুক্তরাজ্যে, ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানিতে শস্যবীমা, ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রে গোষ্ঠীবীমা, আর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় উপ মহাদেশে ডাক জীবন বীমার গোড়াপত্তন করা হয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ প্রণীত ব্রিটিশ বীমা আইন দ্বারা নানা রকম নৈতিক সংকটে চলছিল বীমা ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ এই বীমা ব্যবস্থা অপাঙ্কক্তেয় হয়ে পড়েছিল। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে নতুন করে উল্লেখিত হওয়ার মতো বীমা আইন করা হয়। বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল ২০০৮, খ্রিষ্টাব্দে। ‘বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন ২০০৯’ জাতীয় সংসদে পাশ হওয়ায় তা আইনে পরিণত হয়। একরৈখিক এই আইনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রচণ্ড ক্লান্তিতে চলা বীমা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা হয়।
বীমা অধিদপ্তর নামের সাবেকী নাম পরিবর্তন হয়ে “বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ” গঠিত হয়। শান্ত ও অন্তমুখী বীমাব্যবস্থা ঘূর্ণিঝড়ের গতি পায়। ব্যবসায়িরা এই আইনকে গোগ্রাসে লুফে নেয়। যাঁরা দীর্ঘ সময়-এর ধারে কাছে ঘেঁষে নাই তাঁরাই নতুন নতুন বীমা প্রতিষ্ঠান গড়তে থাকে।
বাংলাদেশে বীমা বিবর্তনের ইতিহাসে বর্তমানে ৬২টি বীমা কোম্পানি নিজেদের প্রতিপত্তি জাহির করছে। এর মধ্যে অবশ্য জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা নামে ২টি সরকারিভাবে পরিচালিত হয়। আকস্মিক কোন দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়-ক্ষতি বা আর্থিক ক্ষতিগর বিরুদ্ধে বীমা, ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বীমা, সম্পত্তি দুর্ঘটনা বীমা, দায় বীমার দায়িত্ব নিয়ে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বেসরকারিখাতে বীমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। বীমা ব্যবস্থার একচ্ছত্র আধিপত্য আর সামাজিক অঙ্গীকার নিয়ে জীবনের অপরিহার্য অনুসঙ্গ হয়েছে বীমা।
জীবন বীমা এখন মানুষের সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে কাছাকাছি থাকে। কাল্পনিক বিস্তার ঘটিয়েছে আজীবন বীমা, মেয়াদি বীমা, যৌথ বীমা, বার্ষিক বীমা, পারিবারিক বীমা, স্বাস্থ্য বীমা, ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বীমা, শিক্ষাবৃত্তি বীমা ইত্যাদির শাখা-প্রশাখায় বীমা এখন পরিবারের হাঁড়ির খবর পর্যন্ত রাখে। সাধারণ বীমা ও পুনঃসজ্ঞায়ন, পুর্নমূল্যায়ন ও নবীনকরণ করে নৌবীমা, অগ্নিবীমা, শস্যবীমা, গবাদিপশু বীমা, মোটরযান বীমা, দুর্ঘটনা বীমা, চৌর্য বীমায় পরিবর্তিত করেছে। এক পর্যায় থেকে অন্য একটি পর্যায়ভুক্ত করতে কোম্পানিগুলিই দায়িত্ব পালন করছে।
জীবনের যেকোন অশুভ সংকেতে পাশে থাকে বীমা। বীমায় পারিপার্শ্বিক বর্ণনা দিলে বিশ্বস্ততা বীমা, বেকারত্ব বীমা, দ্বৈত বীমা, পুনঃবীমা উর্ব্বতার সাথে কাজ করছে। বীমাব্যবস্থার গুরুত্ব বিবেচনা করে বর্তমান সরকার দেশের আপামর নাগরিককে স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনার আইন করেছে। বিশেষ করে বয়স্ক লোকের অবসর জীবন, নিরুদ্বেগ, স্বচ্ছল ও শান্তিময় করতে ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে। ৫৫ বছর থেকে ৬৫ বছরের যে কোন নাগরিক এই সুবিধা গ্রহণ শুরু করতে পারবেন। এখানে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, বস্তিবাসী, ফুটপাতবাসী, প্রান্তিক মানুষের নিস্করুণ জীবনের মানবিক দিক তুলে আনা হয়েছে।
২০ বছর থেকে ৬০ বছর বয়সী যে কোন নাগরিক সুনির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম দিয়ে ১০/১৫/২০ বছর পর্যন্ত পেনসন লাভের নিশ্চয়তা গ্রহণ করতে পারবেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন সামনে রেখে সরকার জনকল্যাণমুখী এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। সরকার যেমন দরিদ্র ও বস্তিবাসী মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রশংসনীয় কাজ করছে। সরকারের জীবন বীমা করপোরেশনও দারিদ্র বিমোচন, সাধারণ নাগরিকের জীবনমান উন্নয়নেও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিচক্ষণ কাজ করছে। এই সর্বজনবিদিত সুনামী এই কাজকে আরো জনমানুষের নিকট পৌঁছে দিতে ‘বঙ্গবন্ধু সার্বজনীন পেনশন বীমা পলিসি’ নামে একটি বিশেষ পলিসি চালু করেছে।
অর্থমন্ত্রণালয় থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে ৫ অক্টোবর ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে ‘তা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে’র অনুমোদন লাভ করে। আকর্ষণীয় সুযোগ আর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নীতির কারণে দেশের ১১ কোটি বয়স্ক মানুষই কোন না কোনভাবে উপকার ভোগ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মহত্তম এই প্রত্যয়ী সিদ্ধান্তের আড়ালে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর বীমা দর্শন। সমাজ ব্যবস্থার তলে চাপা পড়া এক হিরন্ময় ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ পাকিস্তানের আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকুরির জন্য যোগদান করেছিলেন। পরিচয়হীনতার বীমাকে জনগণকল্যাণের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের নানা কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। এই দিনটিকে জাতীয় পর্যায়ে স্মরণীয় করে রাখতে ‘জাতীয় বীমা দিবস’ প্রবর্তন করা হয়।
বীমার প্রতি সাধারণ মানুষের আরো অধিক সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সুপারিশক্রমে প্রতিবছর ১লা মার্চকে ‘জাতীয় বীমা দিবস’ ঘোষণা করে। সেই থেকে প্রতি বছর সুনির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে নানা আয়োজনে পালিত হয় আসছে এই দিবস।লেখকঃ খন রঞ্জন রায়,সমাজচিন্তক, গবেষক ও সংগঠক।