খন রঞ্জন রায়: মাতৃভাষা জীবনের অস্তিত্বের অন্যতম শর্ত। প্রাণপ্রাচুর্য ও প্রাণশক্তিকে উদ্দীপ্ত করে। মনস্তাত্তি¡ক গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে মানজীবনের সৃজনশীলতার সাথে জীবনবোধের অনবদ্য অবদান ‘ভাষা’। জীবনদর্শনের আলোকিত মানুষ হওয়ার তুলনাহীন শক্তি। প্রাপ্তির লক্ষ্যে সহস্র বাধা পেরোনোর প্রেরণা। মাতৃভাষায় শত আনন্দের অধিকারী হওয়া যায়। বহু ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকে, অন্য কিছুতে তা মোটেও সম্ভব নয়। শিশু বয়স থেকে চার পাশের জগৎ সম্পর্কে অনায়াসে সামগ্রিক ধারণা লাভ করে মাতৃভাষার মাধ্যমেই।

মায়ের আবেগ অনুভূতি মুখের প্রকাশভঙ্গি দেখে শিশু বয়সেই ঠোঁটের কোণে একটা উচ্চাঙ্গের হাসি ফুটে। চেতনা সুতীক্ষ্ণ তরবারির মতো ক্ষুরধার হয়। এই নির্ভেজাল হাসি ফোটার ভাষা নিয়ে আন্তর্জাতিভাবে কোনো দিবস ছিল না। অসীম ত্যাগ ও বিপুল বীরত্বের বিনিময়ে সংগ্রামী বিজয়ী হয়েছিল ‘বাংলা’।

সংবেদনশীল মনের উজ্জ্বলতা প্রকাশ হচ্ছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারি জাতীয়ভাবে। তাও নানাভাবে নানা সময়ের অযাচিতভাবে অবহেলার অভিঘাত সহ্য করে চলছিল এই দিবস। একে স্রোতময় করে আন্তর্জাতিকীকরণে প্রথম প্রস্তাব তোলে ‘গফরগাঁও থিয়েটার’। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে একুশের এক অনুষ্ঠানে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবী উত্থাপন করে। অনেকে আবোল তাবোল মনে করলেও তারা চুপচাপ বসে থাকে নাই।

১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্য ধরে একটি বিশেষ প্রকাশনা বের করে এই গফরগাঁও থিয়েটার। তী²বুদ্ধিসম্পন্ন এই সংকলনে একুশে ফেব্রিয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠার দাবী ছবির মতো ফুটে ওঠে। পুনর্ব্যক্ত করা এই দাবীর সংকলন ‘অর্ঘ’ অনেক পোষ্য ও মুখস্ত বুদ্ধিজীবী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মর্যাদা দাবির যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করে লেখা বিশেষ নিবন্ধ গভীর মনোযোগে পড়ে ঠোঁট টিপে হাসে। সংকলনটির আকর্ষণীয় প্রচ্ছদে ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস চাই’ এবং ‘একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই’ স্লোগানকে পরশ্রীকাতরতারভাবে দেখালেও প্রকাশ্যে গাঁইগুঁই করার সুযোগ ছিল না। অনেকে অবশ্য অতি সরল ভঙ্গিতে নরম মাতৃসুলভ কন্ঠে বলেছেন ‘ইচ্ছা দোষের কিছু নয়’। চারদিক থেকে আসতে থাকে এর দাবি- যৌক্তিকতা।

১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে মার্চ চুয়াডাঙ্গার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব- কফি আনান বরাবরে একটি চিঠি লিখেন। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা মর্যাদা প্রদানের এই দাবি চিঠি সোনা ফলানোর দিকে এগিয়ে যায়। নিজেদের আলোতে আলোকিত হয়ে ‘বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা প্রেমিক গ্রুপ’ নামে এক সংগঠন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনকে ঘোষণা করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের নিকট জোর দাবি করে।
অহংকারকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ না করে সাত জাতি ও সাত ভাষার দশজন সদস্য তরতাজা স্মৃতির এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। তনুমন জুড়িয়ে যাওয়া এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ফিলিপিনো ভাষার ‘এলবার্ট ভিনজন’ ও ‘কারমেন ক্রিস্টোবাল’, ইংরেজি ভাষার ‘জ্যাসন মেরিন’ ও ‘সুসান হডগিন্স’, ক্যান্তনিজ ভাষার ‘ড. কেলভিন চাও’, কা-চি মালয় ভাষার ‘নাজনিন ইসলাম’ জার্মান ভাষার ‘বিনাতে মার্টিনস্’, হিন্দি ভাষার ‘করুণা জোসি’ এবং সর্বশেষ বাংলা ভাষার ‘রফিকুল ইসলাম’ ও ‘আবদুস সালাম’।
এই পত্র সত্যের মতো প্রতীয়মান হওয়ায় জাতিসংঘের মহাসচিবের দপ্তর হতে পত্র লেখকদের ইউনেস্কোর সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ পত্র দেয়া হয়। এই পত্র পাওয়ার পর তাড়াহুড়া করে কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে ফোনালাপ করেন। ইউনেস্কোর সদর দপ্তরের ভাষা বিভাগের আন্না মারিয়া উৎসাহী রফিকুল ইসলামকে অসম্পূর্ণ জায়গাগুলি সম্পূর্ণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে পত্র লিখতে বলেন। এই ধারণা যে প্রয়োজনীয়, চমৎকার এবং চিত্তাকর্ষক তাও লিখেন।

মায়াবী স্নিগ্ধ মানুষ মারিয়া ৮ এপ্রিল ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে একাগ্রতার সাথে রফিকুল ইসলামকে আবারো চিঠি লেখেন। তাতে ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংগ্রামসম্পন্ন একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার ব্যাপারে সবাই সদয় এবং চূড়ান্তকরণে তা বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হবে বলে জানান। প্রচ্ছন্নভাবে সায় পাওয়া এই চিঠি যে গুজব প্রপাগাণ্ডা না তা বুঝে ফেলেন। সদর দপ্তরের আবেগী এই পত্র ফাঁকা বুলিও না ভেবে রফিকুল ইসলাম লক্ষ্যে পৌঁছানোর সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন।

মন্ত্রণালয় তা ২৩ জুন ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাপ্তিস্বীকার করে। একক সাহসের এই স্বপ্নকে ধ্যানজ্ঞান করে জুলাই মাস হতে মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করে। বিশেষ অনুমতির জন্য ফাইল পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এইদেশের সবকিছুকে এগিয়ে নিয়ে চলা ‘বেহুলা’। তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন। আমাদের দেশের অনেক সংস্কৃতিতেই যে কোনো বিষয়ে ইয়েস ইয়েস বলা স্বভাব। এইক্ষেত্রে ঘটলো উল্টা। ১২ আগস্টের পূর্বে সংশ্লিষ্ট ৮টি মন্ত্রণালয়ের মতামত প্রদানের নির্দেশ থাকলেও যথাযথভাবে পালন করে মাত্র ১টি মন্ত্রণালয়।

১০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে চূড়ান্ত মতামত ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে প্রেরণের বাধ্যবাধকতা ছিল। ততক্ষণে দম আটকানো সময় অতিক্রম করছে। মন্ত্রণালয়ের কাউকে বিব্রত করতে না দিয়ে সময়-সতর্ক প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী একক সিদ্ধান্তে সুপারিশ সহকারে যথাসময়ে প্রস্তাব পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ভাবনার স্বপ্নকে কলঙ্ক-ধুলায় পরিণত না করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও কারো মতামতের তোয়াক্কা করেনি। অতীত সাফল্যের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে এগিয়ে যায়।

ইউনেস্কোর ৩০তম সম্মেলনের ১৫৭তম অধিবেশনে এই নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। ওখানেরও ঘরে বাইরে দুষ্টচক্র কাজ করে। গুরুত্বপূর্ণ এই দিবসকে উল্টোবানে রূপান্তরের চেষ্টা করা হয়। আরো অধিকতর যাচাইবাছাই পূর্বক গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি নির্ণয় শেষে ১৬০তম অধিবেশনে উপস্থাপনের নির্দেশ আসে। বাংলাদেশের সাফল্যজনক কূটনৈতিক তৎপরতার শান্ত সাহসে সব কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্র দূর হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ভাবনা দারুণ শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে।

সকল বিরুদ্ধ ভাবনা- বিরোধীতা তাসের ঘরের মতো ধসে পড়তে শুরু করে। সফল শলাপরামর্শ শেষে ইতিহাস আশ্রিত এই একুশে ফেব্রিয়ারিকেই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা দেয়। বাংলা ভাষাকে মানসপটে ছায়াপাত রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে দিবস মর্যাদা দেওয়ার দিনটি ছিল ১৭ই নভেম্বর ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ। বাংলা ভাষার ইতিহাসে এক বিশাল আনন্দের দিন। রক্তস্নাত বাংলা একগুচ্ছ রক্তকমলের মতো উদ্ভাসিত হলো।

বাংলার ইতিহাসে অনেকগুলো গৌরবোজ্জল দিনের মধ্যে আরেকটি সংযোজিত হলো। উদ্যোক্তা, প্রস্তাবনাকারী আর বাস্তবায়নে অণুঘটকের ভূমিকা পালনকারীদের উদ্দেশ্যে কুসুমকুমারী দাশের কবিতার চরণদুইটি সফলভাবে প্রমাণিত হলো—-
“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।”
এখানে বলে রাখা ভালো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ মর্যাদা আদায়ের শেষ গন্তব্য পৌঁছানোর আগে উর্বর কিছু ঘটনা ঘটেছিল। দৈনিক বাংলা পত্রিকার জনমত বিভাগের ৬ই এপ্রিল ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ সংখ্যায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার উদ্যোগ গ্রহণের আবেদন জানিয়ে পত্র ছাপা হয়েছিল। কিছুটা শিথিল ধরনের আবেগী ভাষায় প্রকাশিত জনৈক সুনাগরিক প্রেরিত নাম প্রকাশহীন এই চিঠিখানিই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস দাবি সম্বলিত প্রকাশিত প্রথম দাবী মনে করা হয়।

পৃথিবীর দেশে-দেশে মাতৃভাষা জাগরণের পোশাকী এই নাম ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। বহুভাষাবাদ আর সংস্কৃতির প্রতি গণজাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় এই দিবস। প্রকৃতিগতভাবেই মানুষের মনের ভাব স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশের সাথে মাতৃভাষার রয়েছে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক। মানুষ তার কল্পনা, স্বপ্ন, চিন্তা, মনোভাব সাবলীল ও স্পষ্টভাবে প্রকাশ করার অপরিহার্য মাধ্যম ‘মাতৃভাষা’।

ভাষা কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে নৃবিজ্ঞানী, জিনবিজ্ঞানী, স্নায়ুজীববিজ্ঞানী, প্রাইমেটবিজ্ঞানী আর ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ থাকলেও উৎপত্তির ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ তারিখ নিয়ে একমত হতে পারেননি। তবে নৃবিজ্ঞানীদের জোরালো ধারণা ভাষার উৎপত্তির ঘটনা ইতিহাসে একবারই ঘটেছিল, একাধিকবার নয়। বিশ্বে সর্বত্র প্রচলিত মনুষ্যভাষাগুলির মধ্যে গাঠনিক সাদৃশ্য অনুমাননির্ভর হলেও প্রচলিত ধারণা ৪০ থেকে ৬০ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়াতে ঘটেছিল এই ঘটনা।

সত্য ইতিহাস লেখনীশক্তি দ্বারা মিথ্যাভাবে লেখা যায় না। কল্পকাহিনীর নির্যাসেও নয়। বাস্তবতা এখানে মরীচিকা।
মুখের ভাষার উৎপত্তির ঘটনা অনুমাননির্ভর হলেও লিখিত নিদর্শনের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগে। সেই থেকে পৃথিবীর দেশে-দেশে, সমাজে-সমাজে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভাব প্রকাশের ভাষা হয় নিজস্ব- একান্তই আপন। বর্তমান পৃথিবীতে ৭১১১ টি ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও মাত্র ২৩ টি ভাষাতেই অধিকসংখ্যক মানুষ কথা বলে। এর মধ্যে শালীন, মার্জিত, উপাদেয় ভাষা হিসাবে ‘বাংলা’ ৫ম স্থানে অবস্থান করছে। বাংলা ভাষার পূর্ণ স্বীকৃতি নিয়ে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে।

দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র আর বিশ্বের অন্যতম ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’। জারি-সারি, ভাটিয়ালি- ভাওয়াইয়ার প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতিতে নিমগ্ন এই বাংলা সর্বগুণে গুণান্বিতা। বাংলার মাধুর্য-সৌন্দর্য- আকর্ষণ-অনুভব করে বাংলাদেশের বাইরে আরো অনেক দেশ তাঁদের রাষ্ট্রীয় ভাষার সাথে বাংলাকে সম্পৃক্ত করেছে। সরকারি ভাষা হিসাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছে।

ভারতের সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ২৩ টি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম প্রধান শক্তিশালী ভাষা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা ‘বাংলা’। এছাড়া ঝাড়খণ্ড, উরিষ্যা, বিহার, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাংলা অত্যান্ত প্রভাবশালী ভাষা হিসাবে দ্বিতীয় সরকারি ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে।

বাংলার প্রতি মোহময় আকর্ষণ জেঁকে বসা অনেক দেশ, রাষ্ট্র, অঞ্চল সরকারিভাবে দ্বিতীয় বা পাশাপাশি ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে অভিমান ঝেড়ে পাকিস্তানের করাচী শহরে দ্বিতীয় সরকারি ভাষার স্বীকৃতিতে বাংলা দেবী প্রতিমার মতো উদ্ভাসিত হয়েছে। কালেভদ্রে নয়, বেশ দাপটের সাথে বাংলা তাঁর অবস্থান জানান দিচ্ছে দিল্লি, মুম্বাই, বারাণসী, বৃন্দাবন, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, কানাডা, মধ্যপ্রাচ্য, ইতালিসহ আরো অনেক দেশে। এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসের সামনে আরো অনেক আছে। তবে বাংলার প্রতি অমোঘ প্রেমের অলৌকিক আকর্ষণ দেখিয়েছে ‘সিয়েরা লিওনের’। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ই ডিসেম্বর তারিখে তাঁরা বাংলাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা প্রদান করেছে।

বাংলা ভাষা শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করলেও পৃথিবীর অনেক দাপুটে ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে, বেওয়ারিশ হয়েছে। কিংবা হারানোর ভয় চেপে বসে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে। স্মৃতিকতারতায় আক্রান্ত হয়ে বলতে পারি এই অল্প কয়দিন আগেও দাপুটে সংস্কৃতি ভাষার সমৃদ্ধ ইতিহাস এখন বিলুপ্তির প্রহর গুণছে। এরকম উদাহরণ আরো অনেক। বিলুপ্তির সঙ্গে মিতালি পেতেছে। অকাল প্রয়াতের তালিকা দীর্ঘ হয়েছে।

ভাষাবিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বর্তমানে কথিত ভাষাগুলির প্রায় ৯০% চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মাতৃভাষার প্রতি আপ্লুত সচেতনতা, সমবেদনা ও বিপুলভালোবাসা জানানোর জন্যই দিবস পালন। মাতৃভাষাকে মাঠে-ঘাটে-অনলাইনে-অফলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যাঁরা পালন করেছেন, বিভিন্নভাবে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাঁদের প্রতি আজকের ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’ নিষ্ঠাবান শ্রদ্ধা।লেখকঃ খন রঞ্জন রায়,সমাজচিন্তক, গবেষক ও সংগঠক।

খন রঞ্জন রায়: মাতৃভাষা জীবনের অস্তিত্বের অন্যতম শর্ত। প্রাণপ্রাচুর্য ও প্রাণশক্তিকে উদ্দীপ্ত করে। মনস্তাত্তি¡ক গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে মানজীবনের সৃজনশীলতার সাথে জীবনবোধের অনবদ্য অবদান ‘ভাষা’। জীবনদর্শনের আলোকিত মানুষ হওয়ার তুলনাহীন শক্তি। প্রাপ্তির লক্ষ্যে সহস্র বাধা পেরোনোর প্রেরণা। মাতৃভাষায় শত আনন্দের অধিকারী হওয়া যায়। বহু ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকে, অন্য কিছুতে তা মোটেও সম্ভব নয়। শিশু বয়স থেকে চার পাশের জগৎ সম্পর্কে অনায়াসে সামগ্রিক ধারণা লাভ করে মাতৃভাষার মাধ্যমেই।

মায়ের আবেগ অনুভূতি মুখের প্রকাশভঙ্গি দেখে শিশু বয়সেই ঠোঁটের কোণে একটা উচ্চাঙ্গের হাসি ফুটে। চেতনা সুতীক্ষ্ণ তরবারির মতো ক্ষুরধার হয়। এই নির্ভেজাল হাসি ফোটার ভাষা নিয়ে আন্তর্জাতিভাবে কোনো দিবস ছিল না। অসীম ত্যাগ ও বিপুল বীরত্বের বিনিময়ে সংগ্রামী বিজয়ী হয়েছিল ‘বাংলা’।

সংবেদনশীল মনের উজ্জ্বলতা প্রকাশ হচ্ছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারি জাতীয়ভাবে। তাও নানাভাবে নানা সময়ের অযাচিতভাবে অবহেলার অভিঘাত সহ্য করে চলছিল এই দিবস। একে স্রোতময় করে আন্তর্জাতিকীকরণে প্রথম প্রস্তাব তোলে ‘গফরগাঁও থিয়েটার’। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে একুশের এক অনুষ্ঠানে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবী উত্থাপন করে। অনেকে আবোল তাবোল মনে করলেও তারা চুপচাপ বসে থাকে নাই।

১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্য ধরে একটি বিশেষ প্রকাশনা বের করে এই গফরগাঁও থিয়েটার। তী²বুদ্ধিসম্পন্ন এই সংকলনে একুশে ফেব্রিয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠার দাবী ছবির মতো ফুটে ওঠে। পুনর্ব্যক্ত করা এই দাবীর সংকলন ‘অর্ঘ’ অনেক পোষ্য ও মুখস্ত বুদ্ধিজীবী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মর্যাদা দাবির যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করে লেখা বিশেষ নিবন্ধ গভীর মনোযোগে পড়ে ঠোঁট টিপে হাসে। সংকলনটির আকর্ষণীয় প্রচ্ছদে ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস চাই’ এবং ‘একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই’ স্লোগানকে পরশ্রীকাতরতারভাবে দেখালেও প্রকাশ্যে গাঁইগুঁই করার সুযোগ ছিল না। অনেকে অবশ্য অতি সরল ভঙ্গিতে নরম মাতৃসুলভ কন্ঠে বলেছেন ‘ইচ্ছা দোষের কিছু নয়’। চারদিক থেকে আসতে থাকে এর দাবি- যৌক্তিকতা।

১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে মার্চ চুয়াডাঙ্গার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব- কফি আনান বরাবরে একটি চিঠি লিখেন। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা মর্যাদা প্রদানের এই দাবি চিঠি সোনা ফলানোর দিকে এগিয়ে যায়। নিজেদের আলোতে আলোকিত হয়ে ‘বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা প্রেমিক গ্রুপ’ নামে এক সংগঠন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনকে ঘোষণা করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের নিকট জোর দাবি করে।
অহংকারকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ না করে সাত জাতি ও সাত ভাষার দশজন সদস্য তরতাজা স্মৃতির এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। তনুমন জুড়িয়ে যাওয়া এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ফিলিপিনো ভাষার ‘এলবার্ট ভিনজন’ ও ‘কারমেন ক্রিস্টোবাল’, ইংরেজি ভাষার ‘জ্যাসন মেরিন’ ও ‘সুসান হডগিন্স’, ক্যান্তনিজ ভাষার ‘ড. কেলভিন চাও’, কা-চি মালয় ভাষার ‘নাজনিন ইসলাম’ জার্মান ভাষার ‘বিনাতে মার্টিনস্’, হিন্দি ভাষার ‘করুণা জোসি’ এবং সর্বশেষ বাংলা ভাষার ‘রফিকুল ইসলাম’ ও ‘আবদুস সালাম’।
এই পত্র সত্যের মতো প্রতীয়মান হওয়ায় জাতিসংঘের মহাসচিবের দপ্তর হতে পত্র লেখকদের ইউনেস্কোর সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ পত্র দেয়া হয়। এই পত্র পাওয়ার পর তাড়াহুড়া করে কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে ফোনালাপ করেন। ইউনেস্কোর সদর দপ্তরের ভাষা বিভাগের আন্না মারিয়া উৎসাহী রফিকুল ইসলামকে অসম্পূর্ণ জায়গাগুলি সম্পূর্ণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে পত্র লিখতে বলেন। এই ধারণা যে প্রয়োজনীয়, চমৎকার এবং চিত্তাকর্ষক তাও লিখেন।

মায়াবী স্নিগ্ধ মানুষ মারিয়া ৮ এপ্রিল ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে একাগ্রতার সাথে রফিকুল ইসলামকে আবারো চিঠি লেখেন। তাতে ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংগ্রামসম্পন্ন একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার ব্যাপারে সবাই সদয় এবং চূড়ান্তকরণে তা বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হবে বলে জানান। প্রচ্ছন্নভাবে সায় পাওয়া এই চিঠি যে গুজব প্রপাগাণ্ডা না তা বুঝে ফেলেন। সদর দপ্তরের আবেগী এই পত্র ফাঁকা বুলিও না ভেবে রফিকুল ইসলাম লক্ষ্যে পৌঁছানোর সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন।

মন্ত্রণালয় তা ২৩ জুন ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাপ্তিস্বীকার করে। একক সাহসের এই স্বপ্নকে ধ্যানজ্ঞান করে জুলাই মাস হতে মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করে। বিশেষ অনুমতির জন্য ফাইল পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এইদেশের সবকিছুকে এগিয়ে নিয়ে চলা ‘বেহুলা’। তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন। আমাদের দেশের অনেক সংস্কৃতিতেই যে কোনো বিষয়ে ইয়েস ইয়েস বলা স্বভাব। এইক্ষেত্রে ঘটলো উল্টা। ১২ আগস্টের পূর্বে সংশ্লিষ্ট ৮টি মন্ত্রণালয়ের মতামত প্রদানের নির্দেশ থাকলেও যথাযথভাবে পালন করে মাত্র ১টি মন্ত্রণালয়।

১০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে চূড়ান্ত মতামত ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে প্রেরণের বাধ্যবাধকতা ছিল। ততক্ষণে দম আটকানো সময় অতিক্রম করছে। মন্ত্রণালয়ের কাউকে বিব্রত করতে না দিয়ে সময়-সতর্ক প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী একক সিদ্ধান্তে সুপারিশ সহকারে যথাসময়ে প্রস্তাব পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ভাবনার স্বপ্নকে কলঙ্ক-ধুলায় পরিণত না করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও কারো মতামতের তোয়াক্কা করেনি। অতীত সাফল্যের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে এগিয়ে যায়।

ইউনেস্কোর ৩০তম সম্মেলনের ১৫৭তম অধিবেশনে এই নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। ওখানেরও ঘরে বাইরে দুষ্টচক্র কাজ করে। গুরুত্বপূর্ণ এই দিবসকে উল্টোবানে রূপান্তরের চেষ্টা করা হয়। আরো অধিকতর যাচাইবাছাই পূর্বক গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি নির্ণয় শেষে ১৬০তম অধিবেশনে উপস্থাপনের নির্দেশ আসে। বাংলাদেশের সাফল্যজনক কূটনৈতিক তৎপরতার শান্ত সাহসে সব কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্র দূর হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ভাবনা দারুণ শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে।

সকল বিরুদ্ধ ভাবনা- বিরোধীতা তাসের ঘরের মতো ধসে পড়তে শুরু করে। সফল শলাপরামর্শ শেষে ইতিহাস আশ্রিত এই একুশে ফেব্রিয়ারিকেই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা দেয়। বাংলা ভাষাকে মানসপটে ছায়াপাত রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে দিবস মর্যাদা দেওয়ার দিনটি ছিল ১৭ই নভেম্বর ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ। বাংলা ভাষার ইতিহাসে এক বিশাল আনন্দের দিন। রক্তস্নাত বাংলা একগুচ্ছ রক্তকমলের মতো উদ্ভাসিত হলো।

বাংলার ইতিহাসে অনেকগুলো গৌরবোজ্জল দিনের মধ্যে আরেকটি সংযোজিত হলো। উদ্যোক্তা, প্রস্তাবনাকারী আর বাস্তবায়নে অণুঘটকের ভূমিকা পালনকারীদের উদ্দেশ্যে কুসুমকুমারী দাশের কবিতার চরণদুইটি সফলভাবে প্রমাণিত হলো—-
“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।”
এখানে বলে রাখা ভালো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ মর্যাদা আদায়ের শেষ গন্তব্য পৌঁছানোর আগে উর্বর কিছু ঘটনা ঘটেছিল। দৈনিক বাংলা পত্রিকার জনমত বিভাগের ৬ই এপ্রিল ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ সংখ্যায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার উদ্যোগ গ্রহণের আবেদন জানিয়ে পত্র ছাপা হয়েছিল। কিছুটা শিথিল ধরনের আবেগী ভাষায় প্রকাশিত জনৈক সুনাগরিক প্রেরিত নাম প্রকাশহীন এই চিঠিখানিই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস দাবি সম্বলিত প্রকাশিত প্রথম দাবী মনে করা হয়।

পৃথিবীর দেশে-দেশে মাতৃভাষা জাগরণের পোশাকী এই নাম ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। বহুভাষাবাদ আর সংস্কৃতির প্রতি গণজাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় এই দিবস। প্রকৃতিগতভাবেই মানুষের মনের ভাব স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশের সাথে মাতৃভাষার রয়েছে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক। মানুষ তার কল্পনা, স্বপ্ন, চিন্তা, মনোভাব সাবলীল ও স্পষ্টভাবে প্রকাশ করার অপরিহার্য মাধ্যম ‘মাতৃভাষা’।

ভাষা কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে নৃবিজ্ঞানী, জিনবিজ্ঞানী, স্নায়ুজীববিজ্ঞানী, প্রাইমেটবিজ্ঞানী আর ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ থাকলেও উৎপত্তির ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ তারিখ নিয়ে একমত হতে পারেননি। তবে নৃবিজ্ঞানীদের জোরালো ধারণা ভাষার উৎপত্তির ঘটনা ইতিহাসে একবারই ঘটেছিল, একাধিকবার নয়। বিশ্বে সর্বত্র প্রচলিত মনুষ্যভাষাগুলির মধ্যে গাঠনিক সাদৃশ্য অনুমাননির্ভর হলেও প্রচলিত ধারণা ৪০ থেকে ৬০ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়াতে ঘটেছিল এই ঘটনা।

সত্য ইতিহাস লেখনীশক্তি দ্বারা মিথ্যাভাবে লেখা যায় না। কল্পকাহিনীর নির্যাসেও নয়। বাস্তবতা এখানে মরীচিকা।
মুখের ভাষার উৎপত্তির ঘটনা অনুমাননির্ভর হলেও লিখিত নিদর্শনের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগে। সেই থেকে পৃথিবীর দেশে-দেশে, সমাজে-সমাজে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভাব প্রকাশের ভাষা হয় নিজস্ব- একান্তই আপন। বর্তমান পৃথিবীতে ৭১১১ টি ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও মাত্র ২৩ টি ভাষাতেই অধিকসংখ্যক মানুষ কথা বলে। এর মধ্যে শালীন, মার্জিত, উপাদেয় ভাষা হিসাবে ‘বাংলা’ ৫ম স্থানে অবস্থান করছে। বাংলা ভাষার পূর্ণ স্বীকৃতি নিয়ে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে।

দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র আর বিশ্বের অন্যতম ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’। জারি-সারি, ভাটিয়ালি- ভাওয়াইয়ার প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতিতে নিমগ্ন এই বাংলা সর্বগুণে গুণান্বিতা। বাংলার মাধুর্য-সৌন্দর্য- আকর্ষণ-অনুভব করে বাংলাদেশের বাইরে আরো অনেক দেশ তাঁদের রাষ্ট্রীয় ভাষার সাথে বাংলাকে সম্পৃক্ত করেছে। সরকারি ভাষা হিসাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছে।

ভারতের সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ২৩ টি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম প্রধান শক্তিশালী ভাষা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা ‘বাংলা’। এছাড়া ঝাড়খণ্ড, উরিষ্যা, বিহার, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাংলা অত্যান্ত প্রভাবশালী ভাষা হিসাবে দ্বিতীয় সরকারি ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে।

বাংলার প্রতি মোহময় আকর্ষণ জেঁকে বসা অনেক দেশ, রাষ্ট্র, অঞ্চল সরকারিভাবে দ্বিতীয় বা পাশাপাশি ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে অভিমান ঝেড়ে পাকিস্তানের করাচী শহরে দ্বিতীয় সরকারি ভাষার স্বীকৃতিতে বাংলা দেবী প্রতিমার মতো উদ্ভাসিত হয়েছে। কালেভদ্রে নয়, বেশ দাপটের সাথে বাংলা তাঁর অবস্থান জানান দিচ্ছে দিল্লি, মুম্বাই, বারাণসী, বৃন্দাবন, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, কানাডা, মধ্যপ্রাচ্য, ইতালিসহ আরো অনেক দেশে। এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসের সামনে আরো অনেক আছে। তবে বাংলার প্রতি অমোঘ প্রেমের অলৌকিক আকর্ষণ দেখিয়েছে ‘সিয়েরা লিওনের’। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ই ডিসেম্বর তারিখে তাঁরা বাংলাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা প্রদান করেছে।

বাংলা ভাষা শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করলেও পৃথিবীর অনেক দাপুটে ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে, বেওয়ারিশ হয়েছে। কিংবা হারানোর ভয় চেপে বসে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে। স্মৃতিকতারতায় আক্রান্ত হয়ে বলতে পারি এই অল্প কয়দিন আগেও দাপুটে সংস্কৃতি ভাষার সমৃদ্ধ ইতিহাস এখন বিলুপ্তির প্রহর গুণছে। এরকম উদাহরণ আরো অনেক। বিলুপ্তির সঙ্গে মিতালি পেতেছে। অকাল প্রয়াতের তালিকা দীর্ঘ হয়েছে।

ভাষাবিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বর্তমানে কথিত ভাষাগুলির প্রায় ৯০% চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মাতৃভাষার প্রতি আপ্লুত সচেতনতা, সমবেদনা ও বিপুলভালোবাসা জানানোর জন্যই দিবস পালন। মাতৃভাষাকে মাঠে-ঘাটে-অনলাইনে-অফলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যাঁরা পালন করেছেন, বিভিন্নভাবে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাঁদের প্রতি আজকের ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’ নিষ্ঠাবান শ্রদ্ধা।লেখকঃ খন রঞ্জন রায়,সমাজচিন্তক, গবেষক ও সংগঠক।